অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
রবিবারের বিকেলটা ব্যস্ততার শেষ নেই গোধূলির। হাজার কাজ ! অসুস্থ বাবা। মায়ের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। সপ্তাহের বাজার করেও দু'দণ্ড বসার সুযোগ নেই। সারা সপ্তাহের বাদ যাওয়া টিউশনগুলো মেকআপ করার এই সুবর্ণ সুযোগ। জোর পা চালায়। এই টিউশন শেষ করে আরও একটা ঘরে পড়াতে হবে । হঠাৎ মোবাইলটা বেজে ওঠে। মা হয়তো ফোন করেছে। তাড়াতাড়ি বাড়ি আসতে বলবে। জানেনা কত ধানে কত চাল। নতুন টিউশনের ফোনও হতে পারে। মন্দ হয় না। কষ্টমস্ট করে আরো একটা পড়াতে পারবে। মাস গেলে কিছু পয়সা তো পাবে। ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে। অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন।
-"হ্যা.. হ্যা.. হ্যালো গোধূলি.."
-"হ্যাঁ আমি গোধূলি বলছি। কে আপনি ?" ওপার থেকে অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে।
-"আমি ... আমি শুভ..মানে শুভময় বলছি। মনে পড়েছে ? গত পরশু আমরা......."
গোধূলি ভুলো মনের মেয়ে নয়। পড়াশোনায় কোনদিনই মন্দ ছিল না। অংক আর বিজ্ঞানে একটু কাঁচা । তাই বাবার ইচ্ছা থাকলেও বিজ্ঞান নিয়ে পড়েনি। ইংরেজিতে অনার্স। মাস্টার্স কমপ্লিট করে বিএড করেছে। চাকরির জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। কয়েকটা পরীক্ষাও দিয়েছে । ফলাফল হাইকোর্টের হাই ভোল্টেজ তারে লটকে আছে।মোক্ষম বুঝেছে সেটা দুর্গাপূজা নয়, যে বছরেই হবে। উনত্রিশে ফেব্রুয়ারিও নয়। তার বাবা বিনোদবাবু মাঝে মাঝেই সুর করে বলেন "ছাড়ো যদি জীবনের আশা, বাঁধো তবে মরণের বাসা।"
না, পরশুর ঘটনা গোধূলি ভোলেনি। ভুলতে চেয়েও পারেনি। সন্ধ্যার সময় একান্তে ছাদে গিয়ে বুকের ওড়না দিয়ে চোখের জল মুছেছে। একহাতের শক্ত মুঠোটা অন্য হাতের তালুতে বারবার মেরেছে। চিবুক শক্ত করে প্রতিজ্ঞা করেছে ''কিছু একটা করতেই হবে।"
গোধূলির ইচ্ছে স্থায়ী একটা কিছু করতে হবে। তার আগে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। বাবা মাও সায় দিয়েছিল প্রথমে। তবে দিন দুনিয়াই খারাপ। বিনোদ বাবুর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। কখন কি ঘটে যায় বলা যায় না। তাছাড়া বিয়ের বাজারে ভাল পাত্র পাওয়া মুশকিল। সহজে মেলে না। আর হুট করে বললেও হয় না। দেখাশোনা পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার আছে। দিনক্ষণ কেনাকাটা আরো কত কি। গোধূলিকে বোঝানো হয়েছে দেখা শোনাটা অন্তত শুরু হোক। প্রথমে 'না না' করলেও মেনে নিয়েছে । ইচ্ছে তো তারও করে- যৌবনের বনে মন হারাতে।
তিন জায়গা থেকে পাত্রপক্ষ এসেছিল। পছন্দ হয়নি । ঠাকুরমা কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছে-"চন্দ্রমুখিকেও পছন্দ হয়না। বলিহারি তোদের পছন্দ! প্রতিমা গড়ে দিতে হবে নাকি ?"
হতাশ হয়ে দেখাশোনা বন্ধ করে দিতে বলেছিল গোধূলি। বিনোদ বাবু হেসে হেসে বলেছিলেন "ওরে হতাশ হলে কি বাতাস লাগে গায়ে ?" গত পরশু এসেছিল শুভময় ঘোষ। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। মাথায় চুল নেই। কম্পিউটারের সামনে বসে বসে ভুঁড়ি বাড়িয়েছে। গায়ের রংটা দাবা। তবে সোনার আংটি বাঁকা হলেই কি ? বাবার কাছে শুনেছে দিল্লিতে পোস্টিং। ফ্ল্যাটও নিয়েছে। বেশ অভিজাত পরিবার। সঙ্গে এসেছিল মা বাবা দিদি জামাইবাবু।
শুভময়ের বাবা অতুলকৃষ্ণ ঘোষ কথায় কথায় বলেছিলেন ''রয়ে বসে পাত্রী দেখার মত সময় নেই ভায়া। হাতে সময় বড় অল্প।" যদিও গাঁট্টা হয়ে বসেছিল তার স্ত্রী। ওঠার নামটাও করেনি।প্রণাম করার পর গোধূলিকে আশীর্বাদ করতে গিয়ে দেখে নিয়েছিল মাথার চুলটা আসল কি না ।
মিষ্টি জল খাওয়ার পর চা বিস্কুট নিয়ে এসেছিল গোধূলি। অতুল বাবু ব্যস্ত হয়ে বলেছিলেন
-"বসো মা বসো। আচ্ছা মা গান জানো তুমি ?" গোধূলি মাথা নেড়ে সংক্ষেপে বলেছিল 'জানি'।
-"তা বেশ তো ! একটা শোনাও তো মা ।" বারকয়েক খুক খুক কেশে বিনোদ বাবু বলেছিলেন "হুম, খুব সুন্দর করে একটা গান শুনিয়ে দে তো মা।"
গোধূলি বিনোদবাবুর আদুরে মেয়ে। বড় অভিমানী। মা-বাবার দুঃখ হবে ভেবে কোনদিন হোস্টেলে থাকেনি। পড়াশোনার সঙ্গে বাড়ির কাজ করেছে। গানের গলাও মন্দ নয়। ভরাট গলায় সুরেলা কণ্ঠে শুরু করলো -"কে আবার বাজায় বাঁশি এ ভাঙা কুঞ্জবনে।" কয়েকবার চায়ে চুমুক নিয়ে শুভর দিকে তাকিয়েছিল তার মা। শুভ তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল গোধূলির দিকে। কাজের সময় যেমন তাকিয়ে থাকে কম্পিটার স্ক্রিনে। বারবার দেখে নিচ্ছিল গোধূলির চোখ মুখ বুক।
গান শেষ হওয়ার আগেই শুভর মা বলেছিল "থাক থাক। একটু দাঁড়াও দেখি।" অমনি দাঁড়িয়ে যায় গোধূলি। কয়েকবার পাত্রপক্ষের মুখোমুখি হয়েছে। বেশ বুঝেছে অগ্নি পরীক্ষা দিতেই হবে। বাবা মায়ের মুখ চেয়ে প্রতিবাদ করতে পারেনি। অসহ্য মনে হয়েছে তবু চেপে গেছে।
ভাবি শাশুড়ি মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়েছিল গোধূলিকে। দক্ষ হাটুরে যেমন বেছে বেছে সবজি কিনে। কয়েকবার রুমাল দিয়ে নিজের মুখটা মুছে নিয়ে বলেছিল 'শর্ট হাইট'। তারপর বিবাহিতা মেয়ে পিউর দিকে তাকিয়ে বলেছিল "কি বলিস রে মা পিউ ?"
-"রংটাও দুধে আলতা নয়। ফ্যাকাসে সাদা। শুভর সঙ্গে ঠিক মানাবে তো ?" মাথা নেড়ে নেড়ে বলেছিল পিউ। গোধূলি লাজুক চোখে তাকিয়ে দেখেছিল পিউর দাঁতগুলো বড় বড়। পুরুষালী মুখ। ছিরিছারা নেই। টকটকে লাল লিপস্টিকটা বড় বেমানান লাগছে। হঠাৎ তাকালে মা কালীর মূর্তি মনে হবে।শুভ'র জামাইবাবুর কি জানি কি দেখে পছন্দ হয়েছে।শুভ অবশ্য কিছুই বলেনি। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। লাজুক মুখে কয়েকবার গোধূলিও তাকিয়েছে। ভালোলাগা মন্দলাগা আঁচ করতে পারেনি।
-"পড়াশোনা তো বাছা ভালোই করেছো। সেটা ধুয়ে ধুয়ে তো জল খাব না। রান্নাবান্না জানো কিনা ? কৃষ্ণনগরের পুতুলের মত তো সাজিয়ে রাখতে পারব না। তাহলে আমার শুভ না খেয়ে মরবে।" গড়গড় করে বলে গিয়েছিল শুভর মা। গোধূলিকে অবশ্য উত্তর দিতে হয়নি। তার আগেই সবাই উঠে গিয়েছিলো।
গোধূলি বেশ বুঝেছে বিয়ের বাজারে গুণ বিকায় সিকি পয়সায়। রূপের দাম সাড়ে ষোল আনা।পেটে বিদ্যে না থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রী হতে বাধা নেই। রূপের বিচার করতে রূপবতী হওয়ার দরকার হয়না।
গোধূলি চলে যাওয়ার সময়ও সেদিকেই তাকিয়ে ছিল শুভ। অনেকটা যাওয়ার পর পিছন ফিরে তাকিয়ে বুঝেছিল গোধূলি।তখন মুচকি হেসে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল শুভ।আর শুভর মা খুব চিন্তিত হয়ে বলেছিল "মনে হচ্ছে শুভর সঙ্গে ঠিক মানাবে না। হাইটটা..." পিউও কিছু একটা বলতে গিয়েছিল। ড্রাইভার স্টার্ট দেওয়ায় তা বলা হয়নি। গাড়িতে চাপার আগে দোতালার জানালার দিকে তাকায় শুভ। আরো একবার দেখে নেয় গোধূলির গোল মায়াবি মুখটা। যেমন করে সন্ধ্যা নামার আগে সূর্যকে দেখে নেয় সবাই।
শুভময় ফোন করেছে। কি জানি আর কত অপমান করলে সুখী হবে। অন্য সময় হলে দুটো কথা শুনিয়ে দিতে পারতো গোধূলি। কিন্তু রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে তা সম্ভব নয়। তাছাড়া আরো দুটো ঘরে পড়াতে হবে। সময় নষ্ট করে কি লাভ ? কথা শেষ করে ফোন রাখতে পারলেই বাঁচে।
-"গোধূলি... গোধূলি... জানো তো তোমাকে আমার পছন্দ হয়েছে।"
বড্ড বিরক্ত লাগে গোধূলির। মনে মনে ভাবে বাহ বেশ ঢং জানে তো ! বাজে একটা কথা মুখ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। সামলে নেয় নিজেকে।
-"কিন্তু আপনার মা, দিদির তো পছন্দ হয়নি । আপনার পছন্দ হয়েই কি লাভ ?"
সেদিনের পর থেকে গোধূলির মিষ্টি কথাগুলো শুভর কানে বেজে চলেছে। গানটা সবার অজান্তে রেকর্ডিং করে নিয়েছে। নিজে শুনেছে। বন্ধুদেরও শুনিয়েছে । মন ভরে নি। কিন্তু আজকে গোধূলির মিষ্টি কথায় অভিমান মিশে আছে। বুঝতে পারে শুভ।
-"বিশ্বাস করো গোধূলি, দিদি আর মায়ের ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছি আমি । ওদের জন্য ক্ষমা চাইছি। তবে... জানো... তো গোধূলি...?
-"হ্যাঁ বলুন ।"
-"আমি প্রতিবাদ করতে পারিনা । মুখ বুজে সহ্য করে নিই। তোমাকে দেখে মনে হল তুমিও প্রতিবাদ করতে শেখো নি। অন্যায় অবিচার ঘটছে অবিরত। সংসারে টিকে থাকার জন্য প্রতিবাদ করতে জানাটা দরকার।"
ধীরে ধীরে শান্ত হয় গোধূলি। সত্যিই তো ! বাসে ট্রেনে ট্রামে কতবার বিরক্ত হয়েছে। বুক ফেটেছে, তবু মুখ ফোটে নি। হাটে বাজারে কত চালাকি দেখেছে। চুলকে ঘা করতে পারেনি। লোকলজ্জায়। শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। ঠাকুরমা বলতো "বিটি ছেল্যার আরও দেমাক ! সইবি ত বইবি।" ভাবতে থাকে। ভাবতেই থাকে।
পরের দিন তোড়জোড় দেখে গোধূলি বুঝেছিল কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তার বাবা হেসে হেসে বললেন -"জানো তো মা 'বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী'।" আজ যে পাত্র আসছে তার বয়সটা একটু বেশি হলেও মস্ত ব্যবসা। পাত্রের বাবা গোধূলিকে দেখেই বলেন "বাঃ ভারী মিষ্টি মুখ।" পাত্রীর মা কয়েক বার দেখে নেয় গোধূলিকে। উপর থেকে নিচ। নিচ থেকে উপর। শকুনের মতই।
-"হুম চোখগুলো টানা টানা নয়। হাইট টাও....." চিন্তিত হয়ে বলে পাত্রের মা। কয়েকবার ঢোক গিলে গোধূলি।
-"হ্যাঁ হাইটটা আমার আপনার মতো একটু কমই আছে। তাতে আমার হাত নেই। বরং মার্কশিট গুলো দেখতে পারেন।"
চমকে যায় পাত্রের মা। কয়েকবার গলাখাঁকারি দেয়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-
-"মুখে তো খই ফুটছে। ক এ কলম, খ এ খুন্তি।কলম তো অনেক দিন চালালে।এবার খুন্তি চালাতে হবে। কাজবাজ জানো কিনা ? আমার ঘরে বাবা কাজের শেষ নেই। নাকি শোকেসে সাজিয়ে রাখতে হবে ?"
গোধূলির চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঠাকুমার মুখটা। ভেসে ওঠে শুভর মুখটাও। নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারছে না। হঠাৎ করেই মিষ্টি গলায় বলে ওঠে -
-"তাহলে ছেলের বিয়ে না দিয়ে কাজের লোক রাখলেই পারতেন।"
তড়াক করে উঠে পাত্রের মা। চেঁচিয়ে বলেন- "ঠাকুর এ যাত্রা বাঁচালে তুমি। অলক্ষুণে মেয়ে। যত বড় মুখ নয় তত বড় কতা।" চিৎকার করে উঠে গোধূলির বাবাও। এমন চিৎকার করতে কোনদিন দেখেনি সে। খুন্তি নিয়ে তেড়ে আসে তার মা। ঠাকুমাও কিছু একটা বলতেই আসছিল। পাশ দিয়ে সটান চলে যায় গোধূলি। হাতে তুলে নেয় মোবাইল। কললিস্ট ঘেঁটে বার করে শুভর নাম্বারটা।
-"হ্যালো... হ্যালো... আমি... আমি... গোধূলি বলছি । আপনি ঠিকই বলেছেন প্রতিবাদ করাটা ভীষণ দরকার। ভীষনই। আমি শিখে নিয়েছি সেটা।"
অমনি একটা দুষ্টু প্রজাপতি এসে বসে তার বুকে। দূরে কোথাও বেজে ওঠে সানাইয়ের সুর।
------------
অরূপ কুমার গোপ মন্ডল
নতুন বাঘমুন্ডি রোড
ঝালদা, পুরুলিয়া
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন