আত্মরক্ষা
অলোক দাস
বৈশাখ মাস, গ্রীষ্মকাল; রৌদ্রের তীব্র অহংকার চারিদিক নিস্তব্ধ করে রেখেছে। জীবন যেন বিতৃষ্ণ, থমকে গেছে; সামনের দিকে কিছুতেই এগিয়ে যেতে চাইছে না। সেই বিতৃষ্ণা থেকে মুক্তি পেতে, তৃপ্তি পেতে আমরা বেশ কয়েকজন অমৃতের খোঁজে বেড়িয়েছি। আমাদের কাছে সেই অমৃত হলো কাঁচা তাল। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে এই কাঁচা তালের আস্বাদ অমৃতের চেয়ে কম কিছু নয়। যারা এই জিনিস খেয়েছেন, তারা নিশ্চয় এখান থেকে আনন্দ পেয়ে থাকবেন। তবে যারা গ্রামে বাস করে তারা খুব সহজেই এর রস তৃপ্তি পেতে পারে। শহরের মানুষের কাছে এই জিনিস একপ্রকার বিরল বললেই চলে।
কোথায় তাল খুব সহজেই পাওয়া যাবে, সেই নিয়ে ক্লাবের সামনে আমরা আলোচনা করছি। সকালবেলা; ঠিক এমন সময় কোথা থেকে কাবেল দাদু এসে হাজির। প্রফুল্ল বদনে বলল, "দলবল বেঁধে কোথাও যাওয়া হবে মনে হচ্ছে?"
আমি বললাম, "হ্যাঁ, তাল খেতে যাব।"
কাবেল দাদু জিজ্ঞাসা করল, "কোথায় তাল খেতে যাবি?"
আমি বললাম, "সেটাই ভাবছি, কোথায় পাওয়া যায়।"
দাদু জিজ্ঞাসা করল, "তাল কি করে পারবি?"
আমি বললাম, "বিকাশদা গাছে উঠবে বলেছে।"
কথাটা শুনে কাবেল দাদুর মুখ বিষন্ন হয়ে গেল। দেখে মনে হলো কি যেন ভাবছে। বিকাশদা কাবেল দাদুর মুখের দিকেই তাকিয়ে ছিল, সে বলল, "আমার নাম শুনে তোমার মুখটা ওরকম পাংশু হয়ে গেল কেন? তোমার কি মনে হয়, আমি গাছে উঠতে পারবো না!"
বিকাশদার এই রকম উত্তেজনা মূলক কথাবার্তা কাবেল দাদু একদম সহ্য করে না; প্রতিবাদ সে করবেই। কিন্তু আজ সে টু শব্দটি করল না, বরং বিকাশদাকে সে সাবাশি দিল। সে বলল, "না রে আমি তোকে নিয়ে ভাবছি না। আমি জানি তুই অনেক বড়ো বড়ো কাজ একা হাতে সামলাতে পারিস। আমি ভাবছি এক অন্য ঘটনা, ঘটনাটা মনে পড়তেই মনটা খারাপ হয়ে গেল।"
বিকাশদা জিজ্ঞাসা করল, "কি ঘটনা শুনি?"
দাদু বলল, "বহু বছর আগের ঘটনা, আমি তখন তোদের মতোনই হবো। আমিও বন্ধুদের সাথে তাল খেতে গিয়েছিলাম ওই তালপুকুরে। তোরা এখন যে তালপুকুরকে দেখছিস, আমাদের সময়ে তালপুকুর ওই রকম ছিল না। তালপুকুরের চারিপাড়ে প্রচুর সারি সারি তালগাছ ছিল।"
তালপুকুর হচ্ছে একটা বড়ো পুকুর, আমাদের গ্রামের পাশেই। পুকুরটি মাঠের মাঝখানে, উঁচু পাড়যুক্ত, চারিপাড়ই বেশ চওড়া। অনেকের মুখে শুনেছি তালপুকুরের নামকরণ সম্ভবত পুকুরের চারপাড়ে প্রচুর তালগাছের জন্যই। এখন সেখানে একটি তালগাছও নেই, তার পরিবর্তে আছে সোনাঝুড়ি গাছের বাগান। আমি বললাম, "সে জানি তালপুকুর কিরকম ছিল। কিন্তু তাল খেতে গিয়ে কি এমন ঘটেছিল, যে তোমার মুখটা এরকম হয়ে গেল?"
দাদু বলল, "সে এক মর্মান্তিক ঘটনা, মনে পড়লে আমার শরীর এখনও কেঁপে ওঠে। শুধু আমি কেন যারা সেদিন গিয়েছিল সবার। অবশ্য আমার হাতেই ঘটনাটা ঘটে।"
বিকাশদা বিরক্ত হয়ে বলল, "কি হয়েছিল সেটা তো বলো?"
সেদিন আমরা পাঁচ-সাতজন তাল খেতে গিয়েছিলাম। যে কজন ছিলাম তার মধ্যে আমি আর পচা দুজনে গাছে উঠতে পারতাম। আমরা তার আগে অনেকবার তাল খেতে গেছি; প্রায় প্রতিদিন পচাই গাছে উঠতো, আমাকে উঠতে হতো না। সেদিন পচার একটু শরীর খারাপ লাগছিল, তাই আমাকেই উঠতে বলল। আমি খুব বেশি বড়ো তালগাছে উঠতে পারতাম না, যেগুলো মাঝারি কি ছোট, সেগুলোই উঠতাম। সেদিনে জলের ধারে হেলা একটা গাছে উঠেছিলাম। ওই গাছটার তালগুলো বেশ বড়োবড়ো ছিল, সবাই ওটাতেই বলল। তাছাড়া গাছটা বেঁকে থাকার জন্য আমার উঠতে সুবিধা হবে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু উঠার সময় সুবিধা হলো না, এর থেকে খাঁড়া হয়ে থাকা গাছে উঠতে অনেক সুবিধা হতো। কিছুটা উঠে দেখলাম গাছটা খুব অমসৃণ; পিঁপড়া আরও অনেক রকম পোকামাকড়ের আস্থানা। তখন প্রায় অর্ধেকটার বেশি উঠে গেছি, সেজন্য নেমে আসতে আর ইচ্ছা করল না। আস্তে আস্তে গাছের ডগে পৌঁছে গেলাম। তালপাতার গোড়াই করাতের মতো প্রচুর দাড়া থাকে তোরা জানিস, লাগলেই কেটে যাই। ধীরে ধীরে কয়েকটা পাতার দাড়া দা দিয়ে পরিস্কার করে গাছের একেবারে উপরে উঠলাম। বসার জায়গাটা বেশ যুত করে এককাঁদি তাল নিচে ফেললাম। এবার দ্বিতীয় কাঁদি কাটতে যাব, এমন সময় হঠাৎ একটা পাতার গোড়ার দিক থেকে ভীষণ গর্জন করে একটা কেউটে সাপ মাথা তুলে দাঁড়ালো। ভয়ে আমার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। ছুটে পালিয়ে যাওয়ার কোন রাস্তা নেই। একবার ভাবলাম গাছ থেকে পুকুরের জলে লাফ দিয়। দেখলাম তাও সম্ভব নয়, গাছের পাতাগুলো এতো বড়ো ছিল যে লাফ দেওয়া যাবে না। একটাই উপায় আমার কাছে খোলা ছিল, ধীরে ধীরে গাছ থেকে নেমে আসা। কিন্তু নির্ভয়ে নেমে আসা তখন সম্ভব ছিল না। কারণ সাপের থেকে আমার দূরত্ব মাত্র আড়াই-তিন হাত। একটু এদিক-সেদিক হলেই আমাকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে।
শেষ উপায় অবলম্বন করে আমি ধীরে ধীরে নামার চেষ্টা করলাম। তখন আমার হাত-পা ভয়ে এতোটাই কাঁপছে যে, মনে হচ্ছিল আমি এক্ষুনি গাছ থেকে নিচে পড়ে যাব। তখন আমার একটা বড়ো ভুল হয়েছিল। নামার সময় আমার সম্পূর্ণ দৃষ্টি ছিল সাপের উপর, সেজন্য কিছুটা সময় পেলেও আমি নেমে আসতে পারিনি। আমি যখন গাছের শেষ পাতাটা থেকে কান্ডে পা দিয়েছি, সেই সময় সে অন্য একটা পাতা বেয়ে ঠিক আমার মুখের উপর রণমূর্তি নিয়ে হাজির হলো। কোন উপায় না পেয়ে আমি এক তীব্র চিৎকারে আমার ডানহাতে থাকা ধারালো দা দিয়ে সজোরে প্রহার করলাম। সাপটা দুটুকরো হয়ে মস্তক ভাগটা নিচে গিয়ে পড়লো। বাকি অংশটা ঠিক আমার মুখের উপর ঝুলছে। আমিও বাঁ হাত দিয়ে একটা তালপাতার গোড়া ধরে ঝুলছি। তখন আমি যেন এক রক্ত খেকো পিশাচ, একফোঁটা একফোঁটা করে রক্ত ঠিক আমার চোখেমুখে পড়তে লাগল, এর থেকে বিরত হওয়ার আমার কোন উপায় ছিল না। আস্তে আস্তে আমার সারা শরীর রক্তে ভিজে গেল। এক অব্যক্ত যন্ত্রনায়, অভক্তিতে আমার মন বিচলিত হয়ে উঠলো।
আমি যখন গাছ থেকে নামলাম, দেখলাম আমি যেন রক্তের সাগরে স্নান করে এসেছি। আমার বন্ধুরা হুল্লোড় করে আমার কাছে ছুটে এলো, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বেড়লো না। আমি বোবার মতো পুকুরের ঘাটে গেলাম। রক্ত মাখা জামাটা খুলে পুকুরের মাঝখান দিয়ে ছুঁড়ে দিলাম। তারপর স্নান করে বাড়ি ফিরলাম।
আমরা সবাই নির্জীবের মতো কাবেল দাদুর কথা শুনছিলাম। বিকাশদা হঠাৎ বলে উঠল, "কি ভয়ানক ব্যাপার।"
কাবেল দাদু বলল, "হ্যাঁ, তবে সেদিন রাতেও একটা ভয়ানক ব্যাপার ঘটেছিল।"
আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম, "কি?"
দাদু আবার বলতে লাগল, সাপটাকে ওই ভাবে মারার জন্য সারাদিন কিছু ভালো লাগছিল না। শুধু ওই ঘটনাটাই মনে পড়ছিল, আর কেমন যেন ভয় লাগছিল। সারাদিন একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে কাটালাম। দুপুরে খেতেও ইচ্ছা গেল না। আমি খাবার সময় ছাড়া সারাদিন বাড়ির বাইরে ঘুরে বেড়াতাম; কিন্তু সেদিন বাড়ির বাইরে বেড়োতে কোন ইচ্ছা গেল না। সারাদিন শুয়ে থেকে কাটিয়ে দিলাম, ঘুম পর্যন্ত এলো না।
রাতে মা খেতে ডাকলো, খেতে গেলাম; কিন্তু খাওয়া আর হলো না। অল্প খাবার মুখে তুলতেই মনে পড়ে গেল, কাটা সাপের অংশ থেকে আমার মুখে পড়া সেই ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। সঙ্গে সঙ্গেই শরীরটা কেমন উথালপাথাল করে উঠল, যা খেয়েছিলাম তার এক কোনাও আর থাকল না; বমি পেট থেকে সব নিকড়ে বের করে আনল।
চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরলাম। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। রাতে বাড়ি যখন নিস্তব্ধ হলো, সব আলো নিভে গেল, তখন আমার ভয় যেন আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। আমি ঘরের যেই দিকেই তাকাচ্ছি যেন সেই সাপটাকে দেখতে পাচ্ছি। ভয় থেকে কিছুটা বিরত থাকার জন্য আমি ঘরের আলোটা জ্বালালাম।
ভয়ে ভয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। মাঝরাতে এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখলাম, প্রচন্ড চিৎকারে 'না! আ!আ!'--বলে জেগে উঠে বসলাম। স্বপ্নে দেখলাম, একদল সাপ তাদের সঙ্গীর প্রতিশোধ নেবার জন্য রাতের অন্ধকারে আমার উপর আক্রমণ করেছে। তারা আমার ঘুমন্ত শরীরের উপর দিয়ে আমার চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ক্রোধের প্রচন্ড গর্জনে কান পাতা দায়। সারা বিছানা জুড়ে শত শত সাপ, আমি যেন তাদের উপর শুয়ে আছি। আমার সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। শরীরের সমস্ত লোম কাঁটা হয়ে দাঁড়ালো। আমি তখন কাঁপতে লাগলাম। হঠাৎ একটা সাপ আমার বুকে উঠে হিংস্র দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পরে সে তার বিষদাঁত সজোরে আমার মুখের উপর বসাতেই আমার তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো।
সেদিন রাতে আর ঘুম এলো না; সারারাত জেগে কাটিয়ে দিলাম।
________________________________
অলোক দাস
গ্রাম- খাটগ্রাম
ডাকঘর- সন্তোষপুর
থানা- গোঘাট
হুগলি, ৭১২৬০২
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
মোঃ- ৮৩৪৮৯২৯৬৩০
No comments:
Post a Comment