কবি গীতা চট্টোপাধ্যায় : এক কবিপ্রত্নবিদ্
সুমন ব্যানার্জি
১.
কবি দেবারতি মিত্র ব্যবহার করেছিলেন 'কবিপ্রত্নবিদ্' শীর্ষক অসামান্য শব্দবন্ধটি কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়'র কবিতা প্রসঙ্গে। বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যাশ্রয়ী জীবন স্রোতের অভিঘাতকে তিনি তুলে এনেছেন বাংলা কবিতায়। বিচিত্র কিংবদন্তি,মিথ,পুরাণ,লোককথা, ইতিহাস নানা মাত্রায় নানা বর্ণে আভাসিত হয়েছে তাঁর কবিতায়।এক আশ্চর্য সুন্দর গোধূলি বিষণ্ণ সৌরভ রয়েছে তাঁর লেখায়।সেই নিয়েই সংক্ষেপে আলোচনা করাই এই প্রবন্ধের অন্বিষ্ট।
ধরা যাক্ 'যে দেশে কোকিল ডাকত' কবিতাটির কথা ; তাঁর দুরবগাহ কল্পনাশক্তির পরিচয় পাব -
"স্বপ্ন নেমে এলে মাঠে,রাঢ়ের তমালে দিনশেষ / কৃষ্ণকীর্তনের মাঠে সাক্ষাৎ এলেন রাজেশ্বরী, / শারদীয় একাদশী, শুক্লা জ্যোৎস্নামাখা একরাশ / আকাশগঙ্গার জলে উবুছুবু মুছে নেন কেশ।''
কবি কি ভুলতে পারেন তাঁর ঐতিহ্যের শিকড়কে ? নিজের সংস্কারকে ? গীতা চট্টোপাধ্যায় নিজেকে স্বেচ্ছায় অন্তরালবর্তিনী রেখেছেন।বাইরে পৃথিবীর সাময়িক উত্তেজনা, রাজনৈতিক আবর্ত থেকে তিনি স্বতন্ত্র ও সম্ভ্রান্ত দূরত্বে নিজের সৃজনের ভূমিকে তৈরি করেছেন। তিনি রসদ সংগ্রহ করেছেন সেই শিকড় থেকেই -
"কলাগাছ উলুটানা ছায়াপথে লগ্ন-শেষাবধি / বিজন কোকিল-ডাকা রমণীর পাড়ে এসেছো যে, / তারি তো তরঙ্গধ্বনি অখিল গুন্ঠনবতী চোখ ! / সমস্ত হলুদ নিয়ে পৃথিবীর গায়ে-হলুদের বনে আলো / তোমার দৃষ্টির আগে পরপার গোধূলি কাঁপালো।'' ('বাংলার বর')
তথাকথিত নারীবাদ নয় বরং সনাতন বাঙালি জীবনের মেয়েদের জীবন ও সংস্কারের মধ্যে যে কতখানি প্রাণ ও মাধুর্য ছিল তা কী সুচারুভাবে ভাবে অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর 'কর্তার ঘোড়া দেখে রাসসুন্দরী' কবিতায় -
"উঠোনে ধানের রাশি খেয়ে যায় মহিমায় ঘোড়া / কর্তার ঘোড়ার সামনে কী করে বা যেতে পারে নারী / যদি দেখে ফেলে সেই ঘোড়ার ভিতরে অধিকারী / অবাধ আলোয় দেহে এক-উঠোন ধানের সন্তোষে ? / আমি যে দেখিনি তাঁকে কখনো রৌদ্রের দুঃসাহসে !''
২.
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বিরচিত "কপালকুণ্ডলা" উপন্যাসটি কল্পনায় অনুরঞ্জিত হয়ে উঠেছে কী অনন্য সুন্দরভাবে -
" 'মৃন্ময়ী, চ' ঘরে যাই' হাত ধরে শ্মশানভূমিতে। / এদিকে গঙ্গার আড়ে মুখ থুবড়ে বেলাশেষ ভয় / সূর্যাস্তের লাল মেঘ ঘোরতর অমঙ্গলময় / অল্প অল্প ফাট ধরছে পায়ের তলায় শক্ত ভিতে।''
এমন কবিতা তো বাংলা কবিতার ইতিহাসে একটি স্বর্ণফলকের মতন।
প্রাচীন গ্রাম বাংলার সুদাসী বৈষ্ণবী হরিচন্দনের নির্মল প্রেমের আকুতির অন্তরালে ধ্বনিত হয় কবির নিজেরই অন্তর্লীন অনুরাগ -
"সুদাসী বৈষ্ণবী তার সারা গায়ে মেখেছিল হরিচন্দনের মতো প্রেম / শরীর ছিল না তার কতক্ষণ , কতক্ষণ গন্ধই শরীর, / মৃগনাভি হরিণের বিভোরতা উপত্যকা-দেশের বাগানে / নীল গন্ধরেখা ধরে পদে পদে ফিরে আসা নাভিতে নির্জন / সে-ও এক অসম্ভব অভিসার জ্যোৎস্না পথে রাসস্থ মন্ডলে।''
নিজের নারী সত্তাকে তিনি একাত্ম করতে চেয়েছেন সনাতন বাঙালি নারীর সঙ্গে।কবিতায় অধিবাসিত হয়েছে তাঁর ব্যক্তিক স্মৃতি।সেই অষ্টাদশ শতকের নারীর গার্হস্থ্য জীবনের সর্বোপরি সাংস্কৃতিক চালচিত্র ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় -
"কান বিঁধিয়ে প্রথম পরা নিমকাঠিটি দিয়ে যাবো .../ বিষ্ণু পটচিত্র ঘিরে সারা সকাল চন্দনে ওঁ / পুণ্যিপুকুর গোকাল গোরুর শিঙয়ে সিঁদুর হলুদফোঁটা / ন্যাওটা বোনের হাত ধরে ঝিম দুপুর জুড়ে বারান্দারই / অলীক বাড়ি ঘুরে ঘুরে নেমন্তন্ন পুতুলভোজে।'' ('উত্তরাধিকার')
৩.
মৃত্যু শোক বহু কবির সৃষ্টিতেই স্থায়ীভাব হিসাবে এসেছে। ব্যক্তিগত জীবনের বিয়োগ ব্যথা , অশ্রুজল,স্মৃতি বেদনার কত ছবি উঠে আসে কবিতায়। -
"আষাঢ়ের ভিজে মাটি তবু দাগ চাকার পড়ে না / টেবিলে হাতের ছাপ হাতে করে নেয়নি,যখন / চলে গেছে এমনি গেছে, দুটি হাত শুধু খালি করে, / মা ডেকেছে , বহুদূর থেকে যেন আবছা কানে শোনা।'' (শ্রীচরণেষু , দিদি)
কিন্তু গীতা চট্টোপাধ্যায় শুধু সেখানেই সীমায়িত থাকেননি। তাঁর অনন্যতা এখানেই যে মৃত্যু নিয়ে বিশেষত পরলোকগত আত্মা নিয়ে সনাতন হিন্দু পরম্পরার প্রতি তাঁর বিশ্বাস,শ্রদ্ধা ফুটে উঠেছে।এখানেই তিনি অনন্য হয়ে ওঠেন।কবি কল্পনায় কী সুন্দরভাবে প্রমূর্ত হয়েছে সেই সুদূর অতীতের স্মৃতি।
"করধৃত এই বারি একবার পান করবে ও কি ? / কুরুক্ষেত্র কৌশিকী ও চন্দ্রভাগা সরযূ গন্ডকী .../ হে বন্ধু , হে অবান্ধব , অদেখা দেশের বন্ধু যত, / হে নিষ্ফল, ফলবতী, দুরন্ত বেপথু আশাহত, / সপ্তদ্বীপনিবাসীরা, যতদূর পথ চলে যায় / মানুষের কাছে এই মানুষের করধৃত দায়।'' ('তর্পণ')
বৈদিক,ঔপনিষদিক, পৌরাণিক ঐতিহ্যের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত করছেন নিজেকে। কতখানি বৈদগ্ধ্য থাকলে এমন কবিতা লেখা যায়।এখানেই তো তাঁর অনন্যতা।
৪.
পুরাণের বিনির্মাণ কীভাবে ঘটেছে তাঁর কবিতায় তাঁর দু'টি দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করব।
"সৃষ্টির তৃতীয় দলে বসে আছি শেষ পদ্মযোনি / অন্ধকার রয়ে গেছে, আর আত্ম অবিশ্বাস, শীত, / শহরের দূরশান্ত নৈর্ঝত কোণের এই ঘর - / এখানে কাঁপবে নেই কোনো হাওয়া, জল নিস্তরণী।'' ('ব্রহ্মা')
"দিন বয়ে যায়, সেনাধ্যক্ষ, স্থির গোধূলি / রণক্ষেত্র শেষ ভূপালির অস্তরাগে / কতক্ষণ ই থাকবে বলো, সন্ধ্যা অপার। / নামবে জেনেই সন্ধি করো, যুগলবন্দী।'' ('সন্ধি')
বস্তুত নিজের সঙ্গে সন্ধি বাসুদেব কৃষ্ণও করেছিলেন। গীতা চট্টোপাধ্যায়'র গবেষণা ছিল "ভাগবত ও বাঙলা সাহিত্য''।সেখানে বৃষ্ণি-যাদব-সাত্বত গোষ্ঠীর মহানায়ক স্বয়ং শ্রী কৃষ্ণের আলেখ্য অবলম্বন করেই এই কবিতা লিখেছেন।
আরো অনেক কবিতার নাম উল্লেখ করা যায় এই প্রসঙ্গে যেমন - 'ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব' ,'ষষ্ঠী' ,'পুণ্যিপুকুর', 'সাবিত্রী' ইত্যাদি। সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি, প্যাশান, বিস্তৃত অধ্যয়ন,মহাপয়ারের প্রতি ঝোঁক তাঁর কবিতাকে ক্লাসিকে উন্নীত করেছে। বিশিষ্ট লেখক অদ্রীশ বিশ্বাস যথার্থই বলেছিলেন যে - বাংলা কবিতার একমাত্র ক্ল্যাসিক আধুনিক কবি।ক্ল্যাসিক সাহিত্যের বিরাট সমুদ্রে অবগাহন করে মণিমুক্তা তুলে আনা এবং সেই সমস্ত কিছুকে আধুনিক সাহিত্যের মধ্যে প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা একজন কবিপ্রত্নবিদ্-র পক্ষেই সম্ভব।
------------------------
সুমন ব্যানার্জি (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর বাংলা প্রাক্তনী)
দূরভাষ - 9123650977,9073803347
মেল -
suman.uddalack93@gmail.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন