Featured Post
প্রবন্ধ ।। করোনা ভাইরাসের বিশ্বভ্রমণ ।। সবিতা বিশ্বাস
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
করোনা ভাইরাসের বিশ্বভ্রমণ
সবিতা বিশ্বাস
ছটফটে, স্মার্ট করোনাকে কেউ আটকে রাখতে পারলনা | ১৯৩০ সাল থেকেই সে চেষ্টা করছিল বেরিয়ে পড়ার, কিন্তু ডাক্তাররা, বিজ্ঞানীরা আটকে দিয়েছে বারবার | তখন অবশ্য অন্য নাম ছিল, ব্রঙ্কাইটিস ভাইরাস | সেবার বেশিদূর যেতেও পারেনি | ওই মুরগীর খোঁয়াড় পর্যন্ত | একেবারেই যে মানুষদের বাড়ি যায়নি তা নয়, তাদের বাড়ি গিয়ে তাদের দেহের কুঠুরিতেও হানা দিয়েছিল | তবে ওই যে ডাক্তার! তারা টেনে বের করে নিয়ে গেল গবেষনাগারে |
এবার অবশ্য একটা নয়, দু'দুটো নাম দিয়ে দিল | 'মনুষ্য করোনাভাইরাস ২২৯ই' এবং 'মনুষ্য করোনাভাইরাস ওসি৪৩' | বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন একে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, কিন্তু করোনা ভাইরাস একা নয়, আরো জ্ঞাতিদের ডেকে নিয়ে এল | তাদের নামকরণ ও হল | ২০০৩ সালে 'এসএআরএস-সিওভি',২০০৪ সালে 'এইচসিওভি এন এল ৬৩, ২০০৫ সালে 'এইচকেইউ১', ২০১২ সালে 'এমইআরএস-সিওভি' এইরকম সব কঠিন কঠিন নাম | তবে নামে কি আসে যায়! কাজটাই আসল |
এই করোনা নামটা কিন্তু দারুন! করোনাভাইরাস শব্দটি ল্যাটিন ভাষার করোনা থেকে নেওয়া হয়েছে যার অর্থ 'মুকুট' | এই নামকরণের যথার্থ কারণ ও আছে | দ্বিমাত্রিক সঞ্চালন ইলেকট্রন অনুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা গেছে এই ভাইরাসের গায়ে যে গদা আকৃতির প্রোটিনের কাঁটা আছে সেগুলোকে অনেকটা মুকুটের মত দেখায় | ভাইরাসের উপরিভাগ প্রোটিন সমৃদ্ধ থাকে যা ভাইরাল স্পাইক পেপ্লমার দ্বারা এর অঙ্গসংস্থান গঠন করে | এ প্রোটিন সংক্রমিত হওয়া টিস্যু বিনষ্ট করে |
২০১৯ সালে চীনে 'এসএআরএস-সিওভি-২' নামের যে প্রজাতিটি পাওয়া যায় সেই হল নোভেল করোনাভাইরাস | ঐসব সাংকেতিক নাম একেবারেই পছন্দ ছিল না করোনার | এই নামটা দারুণ!
পছন্দসই নাম পাবার পরই করোনা বেরিয়ে পড়ল অভিযানে, বিশ্বভ্রমণে | কিন্তু করোনা তো একা একা ট্রেনে, বাসে, প্লেনে চেপে বিশ্বভ্রমণ করতে পারবে না, তাই প্রথমে করোনা বাদুড়কে টার্গেট করলো, ওদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে | কিন্তু নাঃ! এভাবে হবেনা | অন্য প্রাণী দিয়ে কোনো কাজ হবেনা, একমাত্র মানুষই করোনার মনোবাঞ্ছা পূরণ করতে পারবে | কেননা মানুষ সবসময় সব জায়গায় ঘুরছে | পাহাড়, পর্বত, নদী, সাগর, ঝড়, ঝঞ্ঝা, বন্যা, তুফান যাই হোক না কেন মানুষ থেমে নেই | তাই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মাসে চীনের উহান প্রদেশ থেকে করোনা ভাইরাস যাত্রা শুরু করে | করোনার যাত্রাপথ একেবারে নিষ্কন্টক | এক এক করে বিশ্বের প্রায় সব দেশ জয় করে ফেলছে | মানুষকে ঘরবন্দী করে জনজীবন অচল করে রাজপথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনা ভাইরাস |
করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশুদের শ্বসনতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায় | ক্ষতির সম্ভাবনার দিক থেকে এই ভাইরাস বৈচিত্র্যময় | ঠান্ডার পাশাপাশি বড় ধরণের কিছু উপসর্গ সৃষ্টি করে, যেমন জ্বর, ফুলে যাওয়া অ্যাডিনয়েডের ফলে গলা ব্যথা | ভাইরাসটি একইসাথে সিভিয়ার এ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) এবং উর্দ্ধ ও নিম্ন শ্বাসনালীর সংক্রমণ ঘটায় | শ্বাসের সাথে যে জলকণা বেরোয় তার মাধ্যমে চোখ, মুখ, বা নাকের মধ্য দিয়ে একজন সুস্থ মানুষের শরীরে ভাইরাস কণা অর্থাত ভিরিয়ন ঢুকে শ্বাসনালীর মধ্যে দিয়ে ফুসফুসে পৌঁছয় | ফুসফুসে পৌঁছে শ্বাসনালী ব্রঙ্কি (bronchi) বলে দুটো ভাগে ভেঙ্গে যায় | এই ভাইরাস ব্রঙ্কির এক বিশেষ ধরণের কোষকে আক্রমণ করে | এর ক্লিনিকাল লক্ষণ হল জ্বর, কাশি, ক্লান্তি, থুতু ওঠা, শ্বাসকষ্ট, গলা ব্যথা, মাথা ব্যথা আর কিছু ক্ষেত্রে পাতলা পায়খানা এবং বমি | এইসব লক্ষণ দেখে ডাক্তার ঠিক করেন রোগী কোভিড-১৯ এ ভুগছেন কি না |
সাধারণত সুস্থ লোকের রোগ প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় ছয় থেকে আট দিনের মধ্যে সংক্রমণ সেরে যাওয়া উচিত | কিন্তু যাদের সুগার, প্রেশার, এইচ আই ভি, ক্যান্সার, হার্টের অসুখ বা অটোইমিউন ডিসঅর্ডার আছে তাদের ক্ষেত্রে লক্ষণগুলো গুরুতর হয়ে ওঠে | অঙ্গ প্রতিস্থাপন (ট্রান্সপ্লান্ট) হওয়ার ফলে যারা প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্তিমিত করার ( ইমিউনোপ্রেসিভ) ওষুধ খান তাদেরও একই সমস্যা দেখা দেয় | এইসব রোগীদের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ ব্যবস্থা সহজেই নাজেহাল হয়ে পড়ে আর সংক্রমণের বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে | শরীরের এই অত্যধিক রোগ প্রতিরোধের প্রচেষ্টার ফলে প্রচুর সক্রিয় শ্বেতরক্তকণিকা ফুসফুসে জড়ো হয় আর ফুসফুসের ক্ষতি করে, যার পোশাকি নাম ইমিউন-ইনডিউসড লাং প্যাথলজি | এরপর ফুসফুসের ছিদ্রে (অ্যালভিওলিতে) জল জমে নিউমোনিয়া সৃষ্টি করে এবং রোগীকে শ্বাস নিতে ভেন্টিলেটরের মতো জীবনদায়ী ব্যবস্থার সাহায্য নিতে হয় | এর সাথে অতিসক্রিয় রোগ প্রতিরোধক কোষ (ইমিউন সেল) থেকে অতিরিক্ত সাইটোকাইন ঝড়ের মতো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে | কিডনি, লিভার, এবং হার্টের মতো শরীরের অনেক অঙ্গে একসাথে পড়ে এর প্রভাব | এইসময় রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়ার পর্যায়ে চলে যায় | এর সুযোগ নিয়ে শরীরে অন্যান্য ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে এবং পরিস্থিতি আরো জটিল করে তোলে | এইসব ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ সাধারণ সময়ে প্রাণঘাতী নয় | কিন্তু এখন এরাই সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেপটিক শক সৃষ্টি করে | এর শেষ হতে পারে একাধিক অঙ্গের একসাথে ব্যর্থতার (মাল্টিপল অর্গান ফেইলিওর) ফলে রোগীর মৃত্যুতে |
প্রথম থেকেই করোনাকে আটকাবার জন্য মাস্ক দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখার কথা বলেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা | কারণ শ্বাসের সাথে যে জলকণা বেরোয় তার মাধ্যমে চোখ, মুখ বা নাকের মধ্য দিয়ে একজন সুস্থ মানুষের শরীরে ভিরিয়ন সরাসরি ঢুকে পড়তে পারে | এছাড়া দূষিত পৃষ্ঠতল থেকেও মানুষের শরীরে ভিরিয়ন ঢুকতে পারে | এই ভাইরাস প্রথমে নির্দিষ্ট কোষকে চিহ্নিত করে, সেই কোষের ওপর গিয়ে আটকায়, তারপর কোষের ভিতরে ঢোকে এবং কোষের ভিতরে নিজের আরএনএ (RNA) ছেড়ে দেয় | এরপর ভাইরাস কোষের যন্ত্রপাতি ছিনতাই করে নিজের জিনোম আর প্রোটিন বানাতে শুরু করে | সবশেষে অনেক নতুন ভাইরাস কণা বা ভিরিয়ন তৈরী হয় | তারপর এরা কোষ থেকে বেরিয়ে চারপাশের সুস্থ কোষকে আক্রান্ত করে |
করোনাভাইরাস এইভাবে মানুষ থেকে মানুষে চেনের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে | একে আটকাবার জন্য জোর কদমে চলছে গবেষণা | খুব তাড়াতাড়ি একে থামিয়ে দেবে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা |
করোনা ভাইরাসের বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ভেঙ্গে ফেলার দায় শুধুমাত্র ডাক্তার বা বিজ্ঞানীর নয়, আমাদেরও দায় দায়িত্ব নিতে হবে | বার বার হাত ধোওয়া, জীবাণুনাশক ব্যবহার, ছয় ফুট দূরত্ব মেনে চলা, জনসমাগম এড়িয়ে চলার পাশাপাশি ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ও ১০ বছরের কমবয়সীদের বেশি যত্ন নিতে হবে | এভাবেই করোনার বিশ্বজয়কে প্রতিহত করতে হবে, যদিও ইতিমধ্যেই বিশ্বে ৬৯,২৪০,১৯৬ জন মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন করোনায় (১০/১২/২০২০) | মারা গেছেন ১,৫৭৫,৮১৯ জন | এবং করোনাকে বাধা দিয়ে লড়াই করে জয়ী হয়েছেন ৪৭,৯৯৫,২৬৯ জন |
করোনা যতই স্মার্ট, ছটফটে, সুযোগসন্ধানী হোক না কেন ওকে থামতেই হবে | অনেক ক্ষতি করেছে, এবার করোনাকে ধ্বংস হতেই হবে | করোনাভাইরাসের পরিবারের চারটি ক্যাটাগরি | আলফা, বিটা, গামা ও ডেল্টা | সার্স কোভ-২ হল বিটা করোনাভাইরাস | চারটি ক্যটাগরিতে মোট ৬০ টি প্রজাতির করোনাভাইরাস রয়েছে বলে গবেষকরা জানিয়েছেন | এই বিশাল পরিবারের জিনোম পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে বাইরে থেকে আরএনএ ঢুকিয়ে ভাইরাসের আরএনএ কে খতম করা সম্ভব | আর বেশি দেরী নেই, করোনার বিশ্বভ্রমণের সমাপ্তি ঘটতে |
---------
তথ্যসুত্র—১) আন্তর্জাল
সবিতা বিশ্বাস ২ ) আ ব প পত্রিকা
প্রযত্নে – লন্কেশ্বর বিশ্বাস
গ্রাম + পোস্ট – মাজদিয়া (বিশ্বাসপাড়া)
(শুভক্ষণ লজের পাশে )
জেলা-নদীয়া পিন-৭৪১৫০৭
ফোন-৮৯০০৭৩৯৭৮৮
ভারত
ই মেইল- sraybiswas@gmail.com
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন