সন্ন্যাসী
গোপেশ দে
সুকমল আর দীপা বকখালি বেড়াতে এসেছে সমুদ্র দেখবে বলে।উঠেছে একটা গেস্ট হাউসে
সুকমল রেলের রিপেয়ারিং সেকশনে চাকরি করে।মাইনে যা পায় দিব্যি সংসার।কোনো অভাব নেই।প্রেম করে বিয়ে করেছে ওরা।অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে এসেছে সুকমল।
সুকমল জামা পরাই ছিল।শুধু বারমুডাটা ছেড়ে একটা জিন্স প্যান্ট পরে নিল।দীপা ওর প্যান্টা পরা দেখে জিজ্ঞেস করল, এখন কোথায় যাবে?
সমুদ্র দেখতে যাব।
এত রাতে !
তাতে কী? বাইরে জোসনা আছে।অসুবিধা কি ?
কত বাজে দেখোতো ?
কত আর বাজবে।
সুকমল ঘড়ি দেখল ১১ টা ১০। টাইমটা বলল সে।
এত রাতে কেউ সমুদ্র দেখতে যায় ?
তাতে কি? আমরা দেখব।
সত্যি যাবে ?
আরে হ্যা রেডী তো হলাম।তোমার শাড়ি পরতে হবে না।চুরিদারেই বেশ আছো।
বেশ চল।
এখন ওরা সৈকতের কাছাকাছি।চারপাশে বেজায় নির্জনতা।কোনো জনমানুষ নেই।দীপার একটু ভয় ভয় করছে।কেমন গা ছমছমে অনুভূতি।সমুদ্রের গর্জনে সে কেঁপে কেঁপে উঠছে।সুকমলের একটা হাত ধরে ওর পাশ দিয়েই হাঁটছে দীপা।
দীপা চারপাশটা দেখে বলল, ভয় করছে।চল ফিরে যাই।
ধ্যাঁৎ।ভয়ের কী আছে।
এত রাতে এভাবে হাঁটাটা কি ঠিক হচ্ছে ?
পরিবেশটা চমৎকার কী বল।
আমি হাঁটতে পারছি না।চল।একটু বসি।
চল।
সুকমল আর দীপা একটু ঢিবির মত জায়গায় গিয়ে বসল।দীপা সুকমলের কোলে মাথা রাখল।দুজনের নীরব হয়ে সাগরের গর্জন শুনছে এখন।আকাশে বড় থালার মত চাঁদ।পুরো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে চারপাশটা।
আচমকা একটা টর্চের আলো এসে সুকমলের চোখে পড়ল।সুকমল আর দীপা ভয় পেয়ে গেল।সুকমল হাত দিয়ে আলোটা আড়াল করল।একটা লোক তাদের সামনে দাঁড়িয়ে।দুজনেই কিছুটা উদবিগ্ন।
আলোটা নিভিয়ে লোকটা ভারিক্কি গলায় জিজ্ঞেস করল, কী করছিস এখানে তোরা ?
সুকমল আর দীপা লোকটার দিকে তাকালো।চাঁদের আলোয় বেশ পরিস্কারই দেখা যাচ্ছে।
লোকটা ভালই লম্বা।ছিপছিপে শরীর।মাথার চুলে জট ধরে আছে।গায়ে নামাবলী।খালিপায়ে মুখে একরাশ দাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে আছে সে।সুকমল ভাল করে দেখল।চেহারায় পেলব মায়া যেন।
তার বয়েসীই হবে হয়ত লোকটা।
এত সুন্দর মুহুর্তে কী চায় লোকটা ? পাগল টাগল নাকি আবার ? নাকি সন্ন্যাসী গোছের লোক ?
বেশভুষা তো তাই বলে।
সুকমল অবজ্ঞার সুরে জিজ্ঞেস করে, আপনাকে তো চিনলাম না মশাই।
লোকটা বসল ওদের সামনেই, তুইও আমাকে চিনিস না আমিও চিনি না।এটা কে তোর বউ ?
দীপা খানিকটা জড়ো হয়ে বসে।সুকমল ভাবল টাকা পয়সার জন্য এসেছে কিনা কে জানে।
কিছু চান মানে টাকা পয়সা...
টাকার প্রতি আমার মোহ নেইরে।আমি সন্ন্যাসী।
ও আচ্ছা।সুকমল দীপার দিকে চাইল।
এবার বলল, কিছু বলবেন ?
এত বিরক্তি হচ্ছিস কেন ?
সুকমলের একটু আড্ডার বাতিক আছে।সে ভেবে নিল লোকটা হয়তবা ভালোই।অন্তত চোখ দুটোতো তাই বলে।স্থির কিন্তু মায়াবী দৃষ্টি।
জীবনে অনেক জায়গায় ঘুরেছি।বিবাগী হয়ে পথে পথে বেড়াই।একবার হয়েছে কি...
কন্ঠটা চেনা চেনা লাগছে দীপার।দীনেশ নয়তো ? দীনেশের সাথে ওর ভালোবাসা ছিল কলেজ লাইফে।দীনেশের গ্রাজুয়েশন তখন কমপ্লিট।
দীনেশ ছিল উড়নচন্ডী স্বভাবের যেটা ভালো লাগত না দীপার।তাছাড়া একটু ঘরকুনো স্বভাবেরও ছিল সে।আড্ডা ভালবাসত না খুব একটা।কবিদের মত একটু উদাসীন প্রকৃতিরও ছিল।ভবিষ্যতের ভাবনাটা একেবারেই কাজ করত না।সংসারের প্রতি তার মন উদাসীন।তবে দীপা তাকে বিয়ে করলেই সে শুধু সংসারী হবে।দীনেশ এই কথাটা প্রায়ই বলত দীপাকে।দীপার এইসব কথায় মন গলত না।বরং সে দীনেশকে তখন প্রায়ই বলত, তুমি একটা চাকরি জোগাড় করো।এভাবে আর কতদিন।
দীনেশ আরে করব করব করে একটা বছর কাটিয়ে দিল।
দীপা ছিল ভবিষ্যৎ সচেতন মেয়ে।সে বুঝে নিয়েছিল সেদিন এ ছেলে চাকরি করার নয়।ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ভাবনা নেই দীনেশের।শুধু শুধু বেকার সম্পর্কটা গাঢ় করা।
দীনেশের সাথে একদিন ভালোবাসার সম্পর্কটা ঘুচিয়ে দিল সে।দিনেশ ওকে সত্যিকারের ভালবাসত।কিন্তু নড়বড়ে ভবিষ্যত যে ভালবাসা টিকতে দেয় না সেটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দীপা দেখিয়ে দিল সেদিন।
দীপা যেদিন সম্পর্ক ঘুচিয়ে দেয় দীনেশের সাথে সেদিন দীনেশ বলেছিল, তুমি যখন আমাকে আর ভালোবাসই না।আমি আর সংসারী হব না।সন্ন্যাসী হয়ে যাব।
দীপা ভিতরে ভিতরে শুধু হেসেছিল পাগলের প্রলাপ ভেবে।ঘটনাগুলো প্রায় পাঁচ বছর আগের।
তবে এই কি দীনেশ? সত্যি কি সন্ন্যাসী হয়ে গেল ?
এতক্ষণ ধরে গল্প জমিয়ে নিয়েছে বেশ সুকমল আর সন্ন্যাসী লোকটা।সুকমল সিগারেটও ধরিয়েছে একটা তবে লোকটার পারমিশন নিয়ে।শত হলেও সন্ন্যাসী।
দীপা ভালো করে লক্ষ্য করল লোকটাকে।
দীনেশের অবয়বই বটে...সেই একই ভঙ্গিতে বসা, গল্পের ফাঁকে হিহি করে হাসা।গুচ্ছের দাড়ি থাকলেও চিনতে একটুও অসুবিধা হল না দীপার।দীনেশ কি তাকে চিনতে পেরেছে ? নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছে।বারে বারে যেভাবে তাকাচ্ছিল ওর দিকে না চেনার কিছুই নেই।তাছাড়া ওর চেহারারও আগের মতই আছে।একটু মোটা হয়েছে এই যা।
দীপা ভাবল।
এ আমার স্ত্রী।দীপা।
সুকমল বেশ গল্প জমিয়ে নিয়েছে।
দীনেশ হাসল, চিনি চিনি...
দীপা ভয় খেয়ে গেল।দীনেশ কি তবে বলে দেবে অতীত কাহিনি ? সুকমল যে জানে আগে কারো সাথে প্রেমই করেনি দীপা।সত্যিটা জানলে সুকমল কী ভাববে ওকে ?
সুকমলের কপালে ভাজ, চেনেন ?
দীনেশ খুব গম্ভীর গলায় বলল, আমি যে সবাইকেই দিব্যদৃষ্টিতে চিনি।
ও।তাই বলুন...
দীপা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
দীপা ভাবল, লোকটা দীনেশ তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।কিন্তু তবুও নামটা জানতে পারলে আরো নিশ্চিত হওয়া যেত।সে নিজে কি জিজ্ঞেস করবে নামটা ? ভাবল সুকমলকে আস্তে করে বলে ওর মাধ্যমে শুনবে নামটা।
দীপা সুকমলের কানের কাছে মুখ এনে বলল কথাটা।
সন্ন্যাসী আকাশের দিকে চেয়ে আছে এখন।
আচ্ছা আপনার নাম কি গুরু ? সুকমল কন্ঠস্বরে একটু ভঙ্গি এনে জিজ্ঞেস করল।
নাম দিয়ে কি হবেরে ?
না বলতে চাইলে থাক।আচ্ছা আপনি বিয়ে করেছেন ?
সন্ন্যাসী হয়েছি কি বিয়ে করার জন্যরে পাগল ! আমার সংসারই নেই।ওই ঝাউবনটা দেখছিস ?ওখানেই আমার আস্তানা।
আপনি একা ওখানে থাকেন ?
একা কেন হব ? আরও দুজন সঙ্গী আছেন বৈকি।ওঁরাও সন্ন্যাসী।আমার গুরুও থাকেন ওখানে।গুরুর সেবাযত্ন করি...
দীপা ভরসা পেল, দীনেশ তাদের পুরোনো ইতিহাস টানবে না।দীপা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে দীনেশের দিকে।সে এতটা ইম্পর্ট্যান্ট ছিল দীনেশের কাছে ! শেষমেষ ওকে না পেয়ে সন্ন্যাসী হয়েই গেল।আচ্ছা এমনও তো হতে পারে।দীনেশ সন্ন্যাসীর অভিনয় করছে। সে দীপাকে এখানে দেখতে পেয়েই হয়ত এই অভিনয়টা করছে যাতে দীপা চমকে যায়।দীপার সত্যিটা জানার কৌতুহল হল।
দীনেশ উঠে দাঁড়াল, যা অনেক রাত হল।এখানে এত রাতে খারাপ মানুষ থাকতে পারে।বিপদে পড়বি।
দীনেশ বেশ খানিকটা পথ যেতেই সুকমল পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, আপনার নামটা জানা হল না কিন্তু।
দীনু, আমি এখন সন্ন্যাসী।
দীপার বুকটা ধক করে উঠল।দীনেশ নিজের মুখেই নামটা বলেছে।তবে দীনেশ না বলে দীনু বলেছে।সেটা কি আর বুঝতে পারছে না দীপা ?
দীপা সুকমলকে জিজ্ঞেস করল, লোকটা কি সত্যি সন্ন্যাসী ?
এমন মনে হল কেন ?
এমনও তো হতে পারে।আমাদের সাথে অভিনয় করছে।
তাতে ওনার লাভ ? ভ্রু কুঁচকে বলে সুকমল।
দীপা বুঝতে পারছে নিজের কথায় নিজেই আটকে যেতে পারে।তাই একটা আলগা হাসি দিয়ে বলল, আরে চলো না ওনার ডেরাটা দেখে আসি।
যাবে ?
চুপিচুপি।ওনাকে না জানিয়ে।
কেন?
ওনার সাথে গেলে উনি ভাববেন আমরা বোধহয় ওনাকে বিশ্বাস করছি না যে উনি সন্ন্যাসী।
কথাটা মন্দ বলোনি।বেশ চল।
সুকমল আর দীপা লোকটার পেছন পেছন যেতে লাগল তবে চোরের মত খানিকটা।
ঝাউবনের কাছে দীনেশ চলে এসেছে।ঝাউবনের ভিতর দিয়ে চলছে সে।
সুকমল আর দীপা খানিকটা দূর থেকেই দেখল ছোট্ট একটা কুড়েঘর।হারিকেনের আলো জ্বলছে সামনের খোলা বারান্দায়।একজন বৃদ্ধ হারমোনিয়ামে গান গাইছে।তারও দীনেশের মতই দাড়ি।তবে খালি গায়ে এই মুহূর্তে বসে আছে।
তারপাশে বসে আছে আরেকটা লোক।দীনেশ বৃদ্ধ লোকটার পাশে বসেই গানের তালে মাথা দোলাতে লাগল।বৃদ্ধ লোকটা যে দীনেশের গুরু সেটা দেখেছি বোঝা যাচ্ছে।
মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দীপা দেখছে।তার মত এত নগন্য মেয়ের জন্য এতটা স্বার্থত্যাগ দীনেশের! দীনেশ চাইলেই কি সংসারী হতে পারত না ? অন্য একটা মেয়েকে কি বিয়ে করতে পারত না ? কিন্তু সে তা করেনি।ভিতরে ভিতরে একটু অনুশোচনা হচ্ছে দীপার এখন।পুরনো স্মৃতি যেনে ভেসে আসছে।দীপা স্মৃতি জগৎ থেকে বেরিয়ে এসে সুকমলকে ঠাট্টাসুরে বলল, লোকটার আমার মত একটা বউ থাকলে সংসারী হত।কী বল।
তোমার মত একটা বউ কেন ?
আমাকেই তো ওর দরকার ছিল।
মানে ?
দীপা হেসে ফেলল, মজা করলাম।চলো রাত হয়ে গেল।গেস্ট হাউসে ফিরে যাই।
দীপা এবার একার মত ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করল।সুকমল দীপার দিকে চাইল।একটু চিন্তিত ভঙ্গিতে সিগারেট ধরিয়ে আকাশের দিকে চাইল সে।ঝাউবনের ভিতর থেকে গানের সুর ভেসে আসছে কানে
"ওগো মন সন্ন্যাসী মন
পথের পাশে ঠিকানা আমার
গঞ্জে গায়ে গান শুনিয়ে
কোথায় দেখা পাব তোমার !"
################
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন