Featured Post
ছোটগল্প ।। সঞ্চারিত ।। বিশ্বনাথ প্রামাণিক
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
সঞ্চারিত
বিশ্বনাথ প্রামাণিক
১
তখন পশ্চিমে বড় বড় সবুজ গাছগুলোর মাথার উপর বিকালের ক্লান্ত সূর্য, তার সহস্র হাতে সাদা- নীল ক্যানভাসের উপর মন খারাপের ছবি আঁকতে শুরু করেছে। আর একটু পরেই সব ছবি মুছে এক কালো রঙের চাদরে ঢেকে দেবে কেউ।
তবু কচি কচি
তারাদের ছোট ছোট মুখে হাসি ফুটে উঠবে।
গোটা স্টেশান জুড়ে ঘর মুখো মানুষজনের ব্যস্ততা। টিকিট কাউন্টারের পিছনে মরা শিরিস গাছটার উপর একটানা কাকেদের কলতান শোনা যাচ্ছে। টিনের চাল আর দরমার বেড়ায় ঘেরা, পঞ্চাদার এক চিলতে চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে স্নেহ মিশানো মৃদু ধমকের সুরে স্কুল ফেরতা মাস্টার হেসে হেসে বলে উঠে – কি রে আজ আবার তোরা এসেছিস? আচ্ছা রোজ এত পয়সা কোথায় পাই বল দেখি, যে বিনিপয়সায় তোদের রোজ রোজ ভোজ খাওয়াবো?
দাঁত বের করে করে হাসে অবোধ, ময়লা ছেঁড়া জামাপ্যান্ট পরিহিত, জট পাকানো চুলের পাঁচ সাতটি নাম গোত্রহীন ছেলে মেয়ে। যেন ভারী মজার কথা! যেন এত বড় মিথ্যে কথা তারা জীবনে কোনদিন শোনেনি।
-তোদের এই নিষ্পাপ হাসিটাই যত নষ্টের গোড়া বুঝলি? বারবার আমাকে ফতুর করে দিচ্ছে এই হাসি। পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে পঞ্চাদার দোকানে চা, বিস্কু্ট, কেকের অর্ডার দিতে দিতে একটানা কথাগুলো বলে চলে সুশোভন।
-মাসের
শেষে
ফক্কা পকেটে বাড়ি
গেলে
আমারও
যে
তোদের
মত
দশা
হবে বাপ সকল। আপন
মনে
কথাগুলো বলে
নিজের
মনেই
খানিক হেসে নেয়
সে। তারপর বলে- নে
নে,
ধর
ধর। আবার ঠেলাঠেলি! আহা,
আগে
কেকটা
খেয়ে
নে,
তারপর তো
চা খাবি!
ছেলে মেয়ে গুলো কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছে এই বাবুটির বড় দয়ার শরীর। আর তাই সূর্য যখন পশ্চিমে একটু হেলে যায়, আর তার লাল লাল আভা আকাশময় ছড়িয়ে পড়ে, ঠিক তখনই তারা স্টেশনে পঞ্চাদার চায়ের দোকানের সামনে এসে হাজির হয়ে যায়।
চা তৈরি করতে করতে বাহাত্তুরে পঞ্চাদা বলে, এমনি করে রোজ রোজ ওদের খাইয়ে খাইয়ে লোভ আপনিই বাড়িয়ে তুলছেন মাস্টার।
সুশোভন হাসে- কী আর খায়! একটা কেক, কি দুটো বিস্কুট আর একটু গরম জল বৈই তো নয়।
পঞ্চা মাথা নাড়ে- সে অবশ্য ঠিক কথা।
তার দোকানে এত লোক আসে। বসে, চা খায়,গল্প করে, আড্ডা মারে। সেই ভোর থেকে রাত্রি পর্যন্ত সারাদিনই তো চলতে থাকে চিৎকার-চেঁচামেচি হৈ-হুল্লোড়। কিন্তু বিকেলের এই সময়টা যেন তার সব থেকে বেশি ভালো লাগে। এমন তৃপ্তি সে আর কখনো পায় না। আজ-কাল ইচ্ছা করেই সে কেটলিতে একটু বেশি করে জল নিয়ে ফেলে। সে ছোট ছোট গ্লাস গুলো ভর্তি করেই চা দেয় তাদের। মনে মনে ভাবে তারও যদি সাধ্য থাকতো, সে ও মাস্টারের মত এমনি করেই ওদের বিনিপয়সায় খাওয়াতে পারত- চা, বিস্কুট, কেক- যখন যেমন জোগাড় করতে পারতো।
মাস্টারকে তার ভারী ভালো লাগে।
গ্লাসে ধীরে ধীরে গরম চা ঢালতে ঢালতে আড় নয়নে চেয়ে চেয়ে দেখতে থাকে সে- নে, এবার ধর দেখি সব একে একে। আ-হা হা, দেখিস বাবারা, গ্লাস গুলো আবার ভেঙে ফেলিস না।
পঞ্চার এক চিলতে দোকানের সামনে পেতে রাখা বেঞ্চিতে বসে সুশোভন সবাইকে নিয়ে তৃপ্তি করে চা খায়।
পঞ্চা প্রথম প্রথম এই ছেলে মেয়ে গুলোকে খুব একটা পাত্তা দিত না। বলতো- ওদের এভাবে মাথায় তুলবেন না মাস্টারবাবু। এতে ওদের নোভ বেড়ে যাবে। ঠিক পাঁচটার গাড়ি গেলে ওরা এসে হাজির হবে।
কথাগুলো যে পঞ্চা ঠিকই বলেছিল আজ মাস্টার টের পায়। মাস্টারের সঙ্গে সঙ্গে এখন তারও কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে এই আগাছা গুলোর উপর।
পাঁচ থেকে দশ বছরের পাঁচ সাতটা ছেলে মেয়ে। কেউবা ছেঁড়া গেঞ্জি গায়ে আলগা ঢিলেঢালা ময়লা প্যান্টটা বাঁ হাতে ধরে আছে কিংবা কোমরের ঘুনসিতে আটকে নিয়েছে সজোরে, আবার কেউবা আদুল গায়ে। তাদের মাথায় সব লাল লাল চুল- দীর্ঘদিন তেল জল পড়েনি দেখলেই বোঝা যায়। কারো কারো নাকে সর্দি গড়াচ্ছে। ডান হাতের তালুর পিছন দিয়ে ঘসে ঘসে মুছে নিয়ে এখন চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে বিস্কুট খায়। এরা সব নাকি উদ্বাস্তু, যাযাবরের দল। আজ এ স্টেশন তো কাল অন্য স্টেশন। এদের মা-বাবারা ওই দু'নম্বর স্টেশনের অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জায়গাটায় গোল হয়ে বসে তিনটে ইট দিয়ে বানিয়ে নেওয়া উনানে কালো কুচকুচে ছোট্ট হাঁড়ি কড়াইতে রান্না করে। আর এদের ছেলেমেয়েগুলো সারাদিন স্টেশনে স্টেশনে ভিক্ষা করে বেড়ায়। পথ চলতি লোকজনদের কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, বাবু একটা টাকা দেবে? সারাদিন কিছু খাইনি।
এভাবে সারাদিন ধরে যা কিছু তারা পায় তার সবটাই প্রায় কেড়ে নেয় তার মা বাবারা।
২
বেলপাহাড়ী সুশোভনের আপনার দেশ। গাছগাছালিতে ঘেরা সবুজ গ্রাম। মাঠের কোল বেয়ে রোদ চুইয়ে পড়ে। অনাবিল প্রকৃতির কার্পণ্য নেই তাতে। রুক্ষ পাহাড়ি মাটিতে মনের আনন্দে বেড়ে উঠছে শাল- সেগুনের জঙ্গল। বছর পাঁচেক আগে সে নিজের জন্মভুমি ছেড়ে, মা বাবা ভাইবোনকে ছেড়ে ক্যানিংয়ের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রাইমারি স্কুলে মাস্টারের চাকরি নিয়ে এসেছে। কালো রঙের ছোটখাটো রোগা চেহারার সুশোভন এর মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে। বাড়ি থেকে অনেক দূর বলে যাওয়া আসা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই গড়িয়ার একটি মেসে আরও দু’দশজন বর্ডারের সঙ্গে সেও থাকে। বড় কোন ছুটি পড়লে সে বাড়ি যায় তার আপন গ্রামে।
দীর্ঘদিন বাড়ি না যেতে পারলে সে কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে। মনে হয় কোন দূর দেশে সে নির্বাসিত হয়েছে। মায়ের জন্য, বাড়ির জন্য তার মন কেমন করে। তাও তালদি স্টেশনের ঐ ছেলে-মেয়ে গুলোকে পড়িয়ে সে এক রকম তৃপ্তি পায়। স্কুল থেকে অন্যদের ফেলে দেওয়া বই খাতা এনে দিয়েছে, নিজের পয়সায় কলম খাতা কিনে ওদের প্রথম শিক্ষার স্বাদ দেখিয়েছে সে। পঞ্চাদার চায়ের দোকানে বসে ওদের প্রথম পাঠ দিয়েছে। ওরা এখন দিব্যি পড়তে শিখেছে। প্রথম প্রথম পথ চলতি মানুষ গুলো ওকে ব্যঙ্গ করেছে, মুখ টিপে হেসে চলেও গেছে। তাতে সে গায়ে মাখে নি।
কিন্তু সমস্যা হয়, যখন সে শোনে, ছেলে মেয়ে গুলো নিয়ে তার বাবা মায়েরা আবার কোথাও ভেগে গেছে। আবার নতুন কোনও দল এলে সে একিই ভাবে তাদের নিয়ে বসে।
এবারের ছেলে- মেয়ে গুলো বড় ভালো। কথা শোনে তার। আর আছেও অনেক দিন। সে মনে মনে কত বার ভেবেছে, মাস দুয়েক সময় হাতে পেলে অন্তত পড়তে লিখতে পারার মতো অক্ষর জ্ঞান করিয়ে দিতে পারে সে।
কিন্তু এ ভাবে আর কত দিন ! দূরের চাকরি বলে সে ট্রান্সফারের অর্ডারের জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে দেয় এস. আই অফিসে। অনেক দিন পর এবার ভগবান মুখ তুলে চেয়েছে। বাড়ির কাছে ট্রান্সফারের অর্ডারও সে পেয়ে গেছে।
স্কুলের ফেয়ার ওয়েল শেষে সেদিন ফেরার
পথে
পঞ্চাদার চায়ের
দোকানে
দাঁড়িয়ে তার
মন
খারাপ
হয়ে
যায়।
ছেলেগুলোকে কাছে
ডেকে
পাশে
বসিয়ে
চা
বিস্কুট কেক
খাওয়াতে খাওয়াতে কেমন
যেন
মায়া
পড়ে
গেছে তার- চলিরে, সব ভালো থাকিস……
চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতে খেতে ছেলে মেয়ে গুলো হাঁ করে চেয়ে থাকে ,যেন এত বড় অবিশ্বাসের কথা তারা জীবনে শোনে নি। আবেগমথিত সুশোভন আবারো বলে, এখানে আমার ছুটি হয়ে গেছে। আমার যে এবার যেতে হবে।
-আবার তুমি কবে আসবে?
যেন শুনতে পায় নি সে, আপন মনে বলে চলে- যে বই গুলো দিয়েছিলাম সেগুলো মন দিয়ে পড়িস। আর শোন, রাত দিন এভাবে,পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়াস না।
সবথেকে ছোট্ট ছেলেটি এবার বলে, ভিক্ষা না করলে যে মা মারবে ছু দাদা। সুশোভন তাদের দাদা বলতে শিখিয়ে ছিল।
উত্তর খুঁজে পায় না সুশোভন। কি বলবে সে? দারিদ্র্য যে কি ভয়ংকর তার থেকে বেশি আর কেউ জানে না। অভাব মানুষকে বড় ছোট করে দেয়। দ্রুত আগাপাস তলা কি যেন ভেবে নেয় সে।
তার পর মৃদু হেসে বলে- তবে এক কাজ কর, এই দোকানে যেমন তোরা চা, কেক, বিস্কুট খাচ্ছিস, খাবি। আমি সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা পাঠিয়ে দেব। পঞ্চাদাকে ডেকে সে সব বুঝিয়ে দেয়, কিভাবে পে টি এম থেকে তার আকাউন্টে টাকা পাঠানো যায়, সব।
সব কিছু বন্দোবস্ত করে সেদিন ফিরতে ফিরতে তার বেশ রাত হয়ে যায়। মেসে ফিরে দেখে দেশ থেকে কাকা এসে বসে আছে।
৩
তারপর একদিন সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে সুশোভনকে ফিরতে হয় তার আপন গ্রামে। যেখানে ফেরার জন্য সে সারা মাস অপেক্ষা করে থাকে। নীল মেঘের নিচে সবুজ গাছের দেশে, এ যে তার আপন দেশ। মা-বাবা ভাই-বোন পাড়া-প্রতিবেশী নিয়ে তার আবালের স্মৃতি বিজড়িত জন্মভূমি।
কিন্তু কেমন যেন তার কষ্ট হয় স্কুলের বাচ্চাদের জন্য আর স্টেশনের সেই ছেলে মেয়ে গুলোর জন্য। তার চোখে জল এসে যায়।
প্রথম প্রথম কয়েক মাস পঞ্চাকে সপ্তাহে সপ্তাহে টাকা পাঠিয়ে ছিল সে। তারপর একদিন সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে যায় স্মৃতি। সব ভুলে যায় সে। আবেগ শেষ হয়ে যায় দূরত্বের সঙ্গে সঙ্গে। সন্দেহ দানা বাঁধে মনে। একদিন তার মনে হয়, কি জানি আদৌ ছেলে মেয়েগুলো কিছু পাচ্ছে কিনা! তারা ওখানে আর আছে কিনা তাই বা কে জানে!
তারপর একদিন সেও টাকা পাঠানো বন্ধ করে দেয়।
দিন আসে, দিন যায়। মানুষের বিচিত্র স্বভাবের হদিশ আর কে রাখে! সামান্য চায়ের দোকানের মালিক পঞ্চা কেমন করে যেন ভালো বেশে ফেলে ছিল আগাছা এই ছেলে-মেয়ে গুলোকে।
পঞ্চাদা চা খাওয়াতে ভুলে না ছেলেগুলোকে। পাঁচটার গাড়ি এলে সেও পথের দিকে চেয়ে থাকে। মাস্টারের ভালোবাসা কেমন যেন তার মধ্যেও নেশা ধরিয়ে দিয়েছে।
পরকে খাইয়ে এত আনন্দ সে জীবনে কোনদিন পায়নি।
-----------------------------
Better Some Tabs. For You
1.
Samsung Galaxy Tab A 10.1 (10.1 inch, RAM 2GB, ROM 32GB, Wi-Fi-Only), Black
Deal Price: Rs. 12,499.00
Extra 10% direct off on SBI Card (20-23 Jan, 2021)
For Details CLICK HERE
Lenovo Tab M10 HD Tablet (10.1 inch, 2GB, 32GB, Wi-Fi Only) Slate Black
Samsung Galaxy Tab A7 (10.4 inch, RAM 3 GB, ROM 32 GB, Wi-Fi-only), Grey
Deal Price: Rs. 16,999.00
Extra 10% direct off on SBI Card (20-23 Jan, 2021)
For Details CLICK HERE
=======================
========================
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন