Featured Post
বই-আলোচনা ।। বই : তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ভিন্ন ধর্মালোচনা / লেখিকা : প্রতিমা সাহা ।। অরবিন্দ পুরকাইত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ভিন্ন ধর্মালোচনা' : দীর্ঘ এক সময়কালের উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ
অরবিন্দ পুরকাইত
প্রতিমা সাহার 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ভিন্ন ধর্মালোচনা' বইটি ব্রাহ্মধর্মমতাবলম্বীদের দ্বারা প্রকাশিত সেকালের সুবিখ্যাত এক পত্রিকায় হিন্দুধর্ম এবং সেই হিন্দুধর্মের সারাৎসার বলে একটি মতে দাবি করা হয়ে থাকে যে ব্রাহ্মধর্মকে, তার বাইরে প্রকাশিত অন্যান্য ধর্মের আলোচনা নিয়ে দীর্ঘ এক সময়কালের উপর গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। ১৮৪৩ সালে প্রকাশিত 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' সেকালের অন্যান্য পত্রপত্রিকার নিরিখে বিশেষভাবে ব্যতিক্রমী এক পত্রিকা। রচনাবৈচিত্র্য এবং সম্পাদনার মুনশিয়ানায় সেটি সমকালীন সমাজে বিশিষ্ট স্থান অর্জন করেছিল। নিছক ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা হলেও, প্রায় নয় দশকের তার যাত্রাপথে গুরুত্ব পেয়েছে নানান ধর্মের উপরে আলোকপাতকারী ভাল মানের সব লেখা। ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র হিসাবে ব্রাহ্মধর্ম বা— একটি মত হিসাবে— যে হিন্দু ধর্মের সারাৎসার বলে কথিত ব্রাহ্মধর্ম, সেই সম্বন্ধেই যে লেখা কেবল প্রাধান্য পেয়েছে তা নয়, মুক্তচিন্তার বাতায়ন সেখানে বরাবরই খোলা ছিল। তাই সাধারণত একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে পরিচিত বহু ধর্মেরই সেখানে আলোচনা স্থান পেয়েছে গুরুত্ব সহকারে। যেমন, অপ্রচলিত ধর্মাদর্শ হিসাবে মহিমা ধর্ম, বাহাই ধর্ম, বাবী ধর্ম, মহাবুবী ধর্ম, সাধু পার্কারের ধর্ম; তাছাড়া বৌদ্ধ ধর্ম, জৈন ধর্ম, মুসলমান ধর্ম/ইসলাম ধর্ম, খ্রিস্ট ধর্ম, সুফি ধর্ম, টাও ধর্ম, লিঙ্গায়ত ধর্ম, শিখ ধর্ম, জরাথুস্ত্রের ধর্ম, বৈষ্ণব ধর্ম, শিন্টোমত।
লেখক 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'র পাতা থেকে বিভিন্ন লেখক-লেখিকার বিবিধ ধর্ম সম্বন্ধীয় লেখা তুলে ধরে সেখানে তাদের যেসব দিকগুলো উঠে এসেছে সেগুলো লিপিবদ্ধ করেছেন এখানে। প্রকাশিত লেখা তথা আলোচনা থেকে উদ্ধার করে লেখক বিভিন্ন ধর্মাদর্শ বা ধর্মমতের উৎস, অভিপ্রায়, স্বরূপ বা সারকথা, ইতিহাস, অবলুপ্তি বা অবস্থান তুলে ধরেছেন যা অনুসন্ধিৎসু থেকে সাধারণ পাঠকের চাহিদা মেটাবে, কাজে লাগবে। তিনশো কুড়ি পৃষ্ঠার বইটিতে শুরুতে ড. ভক্তিপ্রকাশ ঋষিকেশ মহারাজ লিখিত "'তত্ত্ববোধিনী' অনুধ্যান" এবং তারপরে লেখকের অবতরণিকা এবং পরে প্রকাশকের নিবেদন অংশ শেষ হলে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের ছবি এবং তারপরে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার একটি পৃষ্ঠার চিত্রের পরে সূচিপত্র। সূচিপত্রে প্রথম খণ্ড কেন লেখা হল বোঝা গেল না। যাই হোক, বইয়ের নাম অনুসারে মূল বিষয় শুরু হয়েছে বলতে গেলে পঞ্চম অধ্যায় থেকে; তার আগে পরপর চারটি অধ্যায় আছে— 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা : সমাজের প্রকৃতি— সংস্কৃতির আধার', 'সম্পাদমণ্ডলী ও তাঁদের রচনাশৈলী', 'রাজা রামমোহন রায় ও তত্ত্ববোধিনীতে তাঁর প্রসঙ্গ' এবং 'সম্পাদকরূপে রবীন্দ্রনাথ ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা নিয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা'। 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত অপ্রচলিত ধর্মাদর্শ' শীর্ষক পঞ্চম অধ্যায়, ষষ্ঠ অধ্যায়ে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত প্রচলিত ধর্মমত এবং সপ্তম অধ্যায়ে ভিন্ন ধর্মাদর্শ ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তার পর্যবেক্ষণ (তত্ত্ববোধিনী রচনাপঞ্জিসহ) এবং শেষে পরিশিষ্ট। কোনও বইয়ের মূল বিষয়ই আসছে পঞ্চম অধ্যায়ে এটা ভাল দেখায় না, প্রথম চারটি অধ্যায় পুনর্লিখিত হওয়া দরকার ছিল, যা মূল আলোচ্যের মুখপাত হিসাবে আসার কথা এবং সেটি একটি অধ্যায়ে হলেই মানানসই হত।
শ্রীমতী সাহা বর্তমানে আচার্য গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলেজে গ্রন্থাগারিক। তিনি বঙ্গবাসী কলেজ ও কমার্স-এর প্রাক্তনী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রন্থাগার ও তথ্যবিজ্ঞানের স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্তা। ২০১৩-তে সেট ও ২০১৫-তে নেট পাশ করেন। ১৬ সালে একই বিষয়ে এমফিল ডিগ্রিলাভ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহু সেমিনারে যোগদান করেন তিনি। রচিত গ্রন্থ 'বিশ্বের কিছু প্রখ্যাত গ্রন্থাগারের ধ্বংসের ইতিহাস', 'ভারতীয় সাহিত্যে পরিবেশ ভাবনা', 'Contribution of Philanthropists in Library'.
দুই একটি বিষয়ে লেখকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই হচ্ছে। প্রবন্ধে জুৎসই শব্দচয়ন একটি জরুরি ব্যাপার। কোথাও কোথাও তা ব্যাহত হয়েছে। বাক্য গঠনেও শৈথিল্য কম নজরে পড়েনি, মুদ্রণপ্রমাদ ও বানানভুল রয়ে গেছে যথেষ্টই। সতর্ক হলে পুনরাবৃত্তি কম হতে পারত। এমনকি পুনর্মুদ্রণও রয়ে গেল ১৫৪-৫৫ পাতার দুটি অনুচ্ছেদ ১৫৫ পাতায়, ১৬৬-৬৭ পাতার তিনটি অনুচ্ছেদ ১৭৪-৭৫ পাতায়! কেশবচন্দ্র সেন তাঁর অনুগামীদের নিয়ে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন বলা হয়েছে (পৃ. ৩১৩), তা পরে করেছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। কেশবচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজ। লেখক বলেছেন, "দ্বিধাবিভক্ত ব্রাহ্মসমাজ এবং ধর্মীয় দুর্বলতাকে দূর করতে তিনটি পন্থা বিশেষভাবে অবলম্বন করা হয়— ব্রাহ্মধর্মের প্রচারের উদ্দেশ্যে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালা স্থাপন, পত্রিকা প্রকাশ, বেদান্ত-প্রতিপাদ্য-ব্রাহ্মধর্মের প্রচারকল্পে তরুণ পণ্ডিতের বেদাদি শাস্ত্র গ্রন্থের অধ্যয়ন ও আলোচনা। দ্বিতীয় পন্থা রূপে 'তত্ত্ববোধিনী' নামক পত্রিকা প্রকাশ করে, তৎকালীন ব্রাহ্মসমাজ সম্পর্কে সমাজকে অবগত করার কাজটি বেছে নেওয়া হয়।" কিন্তু তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা তো শুরুই হচ্ছে ১৯৪৩ সালে, আর দেবেন্দ্রনাথ ও কেশবচন্দ্র সেনের মধ্যে মতভেদ অনেক পরের যে— দু-দশকের উপর!
বইয়ের উৎসর্গে 'পাঠকদের উদ্দেশ্যে' বলা যায় কি? 'উদ্দেশে' বলাই তো সঙ্গত।
তথ্যসূচি এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত বিশেষ বিশেষ ধর্ম সম্বন্ধীয় রচনাপঞ্জি সন্নিবিষ্ট হয়েছে। প্রচ্ছদ ভাল হয়েছে।
ছোট ছোট আটটি পরিশিষ্টে এই ধর্মীয় পত্রিকার ধর্ম সম্বন্ধীয় উদার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংকীর্ণতামুক্ত, বিজ্ঞানমনস্ক, সমাজসচেতন পথচলা; একাধারে এ পত্রিকার লেখক কবি সম্পাদক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ, তাঁর ধর্মচেতনা; এ পত্রিকায় মহিলা লেখকদের রচনা এবং মহিলা লেখক; এ পত্রিকায় বিশ্লেষিত ধর্মগুলি সম্বন্ধে; কৃতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কালে এ পত্রিকা এবং শেষের দিকের সম্পাদনা এবং পত্রিকার বন্ধ হয়ে যাওয়া এসব নিয়ে প্রয়োজনীয় ছোট ছোট রচনা রয়েছে।
একেবারেই সাম্প্রতিকের এই বইয়ে বর্তমান সময়ের ধর্মোন্মাদনার প্রেক্ষিতে একটি অবলোকন তথা জোরালো ভাষ্য থাকলে বইটি আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠত বলেই বিশ্বাস।
গ্রন্থের নাম : তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ভিন্ন ধর্মালোচনা (বিষয় বিশ্লেষণ ও রচনাপঞ্জিসহ)
লেখকের নাম : প্রতিমা সাহা
প্রকাশকের নাম : শাশ্বত প্রকাশনী, বসিরহাট, উত্তর ২৪ পরগনা, ৭৪৩ ৪১১
প্রকাশকাল : জানুয়ারি ২০২৪
মূল্য : চারশো টাকা।
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন