Featured Post
একুশের গল্প ।। সুস্মিতা পাল
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
একুশের গল্প
সুস্মিতা পাল
বছরের এই সময়ে এসে দিনের আলো চলে যাওয়ার আগে আরো কিছুটা বেশীক্ষণ বারান্দায় দাঁড়ায়। শুভ্রা চায়ের কাপ দুটো হাতে দরজার সামনে এসে দেখে মাসিমা ঝুঁকে নীচের রাস্তায় কি যেন দেখছে। আশি বছর পুরল দুমাস আগে। মেয়ে জামাই এসেছিল মুম্বই থেকে, কেক কাটল। হৈচৈ হলো, শুভ্রার খুব খাটনি গেল কটাদিন। তবে ভালোও লাগে, বাড়িটা কেমন হাসিখুশী মনে হয়। মাসিমার মতো বয়সে জীবনটাও ঐ বিকেলটার মতোই, আলো নেভার অপেক্ষায় । শুভ্রা পাঁচ বছর হলো এ বাড়িতে সারাদিনের জন্য থাকে । মাসিমার দেখভালের কাজ।
এসব পরিবারে শুভ্রার মতো মহিলাদের কেয়ারগিভার বলুক আর যাই বলুক, শুভ্রা জানে সমাজে ওর অবস্থান। কখনো তাই সেই সীমা পার হবার চেষ্টা করে না। আসলে ওর মতো মেয়েদের খুব সমস্যা। না ঘরকা না ঘাটকা। ওকে দেখে যে কেউ ভাববে সম্ভ্রান্ত ঘরের বৌ। তাছাড়া, কিছুক্ষণ কথা বললেই বোঝা যায়, পেটে কিছু বিদ্যে আছে। না, মাধ্যমিকের পরে আর স্কুলমুখো হওয়া হয়নি। মা অসুখে বিছানা নিল, সব ভার ওর ঘাড়ে এসে পড়ল। সেই সময় থেকেই টুকটাক কাজ করতে করতে বিয়ে। তবে তপন সবিতাকে কথা দিয়েছিল, কোনদিন শুভ্রার অসম্মান করবে না। কথা সে রেখেছে সাধ্যমতো। সুখেই রেখেছিল, যতটা পেরেছে। দশ বছর আগে অ্যাক্সিডেন্টে জখম হয়ে কাজটা গেল। ছেলেটা তখনো চাকরি পায়নি, বাধ্য হয়ে এ পথে আসা। তারপর ছেলে মোটামুটি দাঁড়িয়েছে, বিয়ে করল । নাতনীটা ফুটফুটে , তিন বছর বয়স।
এ বাড়িতে প্রচুর বই। মাসিমার বর কলেজে বাংলা পড়াতেন। অবসর পেলেই মন ভরে বই পড়ে শুভ্রা। স্কুলে বাংলাটা বড়ো ভালো লাগত। সবিতা যত্ন করে ভাষাটা শিখিয়েছিলেন ওকে। বাংলায় এম,.এ. পড়ছিল সবিতা, য়খন দেশে মুক্তিযুদ্ধের আগুন জ্বলল। একাত্তরের নতুন সূর্যের ভোরে খানসেনারা হার মেনে পালাল। ক্যাম্পে ফেলে গেল সবিতার মতো হাজার হাজার গর্ভবতী মেয়েদের। এদের জীবনে আর কোনোদিন স্বাধীনতা আসেনি। ঢাকার বনেদী ধনী তিনতলা বসুবাড়ির মেয়ের ঠাঁই হলো ভারতের একটা হোমে। সদ্যোজাত মেয়ের ধবধবে গায়ের রং দেখে হোমের দিদি নাম রেখেছিলেন 'শুভ্রা'। মাকে দেখলে শুভ্রার মনে হতো দুঃখিনী রাজকন্যা। এখন বোঝে, যে মাকে ও কাছে পেয়েছে, সে ওকে জন্ম দেবার আগেই মরে যাওয়া একটা মানুষ। মায়েরা মরে গিয়েও বোধহয় কোথাও একটু স্নেহ বাঁচিয়ে রাখে। সেটুকু উজাড় করে শুভ্রাকে দিয়ে গেছে সবিতা। আর দিয়ে গেছে নিজের শিক্ষাটুকু, যতটা পেরেছে। কান পাতলেই শুনতে পায় শুভ্রা --
"পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল।
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল।।
শীতল বাতাস বয় জুড়ায় শরীর।
পাতায়-পাতায় পড়ে নিশির শিশির।।
ফুটিল মালতী ফুল সৌরভ ছুটিল।
পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল।"
মাসিমার রাতের খাবার গুছিয়ে রেখে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুভ্রার সাতটা বেজে যায়। রাস্তার মোড়ে পার্টিঅফিসে জোরালো সাউন্ডসিষ্টেম গমগম -- "আমার মায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। " সত্যি, ভুলতে পারে না শুভ্রা। এই তারিখটা না এলে তো সবিতাকে শুভ্রার মা হয়ে মরতে হতো না। সবিতা আজ সুন্দর সেজে বলিরেখা ভরা হাসিমুখে ফেসবুকে নিজের ছবি দিত। সবিতা যেমন ছিল তাতে সব স্বাভাবিক থাকলে, স্বাধীন দেশের সাংস্কৃতিক জগতে গণ্যমান্য কেউ একজন, নিশ্চয়ই হতো। পাশ কাটিয়ে এগোয় শুভ্রা। হাত পা ধুয়ে নাতনীটাকে নিয়ে বসে রোজ। আজ ওকে গল্প শোনাবে, একুশের গল্প। আর শুভ্রার মায়ের গলার সুর মনে করানো ছড়া--
গগনে উঠিল রবি সোনার বরণ।
আলোক পাইয়া লোক পুলকিত মন ॥
রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে।
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে ॥
উঠ শিশু মুখ ধোও পর নিজ বেশ।
আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ ॥
---------*--------
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন