
কবিগানের সাহিত্যক ও সমাজতাত্ত্বিক মূল্য
বারিদ বরন গুপ্ত
বাংলার লোকসংস্কৃতির এক অভিনব ধারা হলো কবিগান! আর এই কবিগানই এক সময় গ্রাম বাংলার মুখ্যু সুখ্যু জনগণের শিক্ষার আলো ছড়িয়েছিল! অষ্টাদশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে উনবিংশ শতকে মধ্যভাগ পর্যন্ত কবিগান বাংলার সমাজ জীবনে শুধুমাত্র বিনোদনের নয়, বাংলার মাটি মাখা মানুষগুলো এ থেকে লোক শিক্ষার অনেক উপাদান সংগ্রহ করেছিল যা তাদের জীবন বিকাশে অনেকখানি ভূমিকা পালন করেছিল, বলতে গেলে কবি গান গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে লোক শিক্ষার বাহকের ভূমিকা পালন করেছিল, প্রায় সমাজের সর্বস্তরে কম বেশি এর প্রভাব পড়েছিল। সেই হিসেবে আমরা বলতে পারি কবি গানের সাহিত্যিক বা সমাজতাত্ত্বিক ভূমিকা কিন্তু যথেষ্টই ছিল!
অষ্টাদশ' শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উনবিংশ শতকে মাঝামাঝি সময় পর্ব পর্যন্ত ছিল কবিয়ালদের যুগ, গোঁজলা গুঁই, লালু, কেষ্টা মুচি, হরু ঠাকুর, রাম বসু, নিধু বাবু, রাম ময়রা, নবাই ময়রা, ভোলা ময়রা থেকে শুরু করে হাজার হাজার কবিয়াল গ্রাম বাংলার মাটি মাখা জীবনের প্রতিচ্ছবি, এরা তাৎক্ষণিক পদের সাহায্যে বিভিন্ন আসরে সমাজের বিভিন্ন বিষয় শ্রোতাদের কাছে তুলে ধরেছেন! গ্রাম বাংলার মুখ্য সুখ্য খেটে খাওয়া মানুষজনরা বিনোদনের পাশাপাশি তাদের জীবন বোধের উপাদানগুলো এইসব আসর থেকে কুড়িয়েছেন, ফলে স্বাভাবিক ভাবে তাদের মনোজগতের যেমন বিকাশ ঘটেছে, জীবন সম্পর্কে তাদের অবস্থানটা তারা ধরতে পেরেছে।তাই অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার একটা পর্ব হিসেবে এই কবিগানকে ধরা যেতে পারে!
কবিয়ালরা আসলে স্বভাব কবি! তাৎক্ষণিক পদ রচনায় তারা সিদ্ধ হস্ত! এই তাৎক্ষণিক পদের সাহায্যে তারা শ্রোতাদের কাছে বিনোদনের পাশাপাশি বিষয়বস্তুকেও তুলে ধরার চেষ্টা করেন! কবিয়ালদের সাথে আলাপচারিতায় ও বিভিন্ন কবিগানের আসরে দেখেছি তারা সাধারণত দুটো উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কবি গান পরিবেশন করেন, এক শ্রোতাদের মনোরঞ্জন, অর্থাৎ আসরে শ্রোতাদের ধরে রাখা, অপরটি বিষয়বস্তুকে শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া, যাতে করে শ্রোতারা বিষয়বস্তু সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করতে পারে! সাধারণত দুটি দলে ভাগ হয়ে কবি গান গাওয়া হয়, প্রত্যেক দলে একজন মূল গায়ক এবং দু তিনজন দোহারি বর্গ থাকে, তাছাড়া চার পাঁচ জন বাদক বর্গ থাকে। কবিগান শুরুর আগে একটা বিষয় নির্বাচন করা হয়! সেই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে কবিগান শুরু হয়।কবিগান সাধারণত দুটি পর্বে বিভক্ত চাপান এবং উতোর, চাপান পর্বে সাধারণত কিছু প্রশ্ন রাখা হয়, উতোর পর্বে বিপক্ষ গায়ক সেই প্রশ্নের উত্তর গীতি বা কবিতার মাধ্যমে প্রদান করেন! সাধারণত এই চাপান উতোর পর্ব শেষ হলে, দুই কবিয়ালের মুখোমুখি সাক্ষাৎ ঘটে যাকে তর্কাতর্কি পর্ব বলে, এখানে কোন একটা বিষয়ে কে নিয়ে উভয় কবিয়াল তর্কযুদ্ধে অবতীর্ণ হন, শেষে একটা মিলন পর্বে এসে তার পরিসমাপ্তি ঘটে ।
অনেকের মতে কবি গানের সূত্রপাত খেউর, আখড়া বা হাফ-আখড়া ঘরানা থেকে! এই অভিযোগ পুরোপুরি না হলেও আংশিক সত্য! কবিগানের শুরুর দিকে অর্থাৎ প্রথম দিকে কবিগান ছিল প্রায় পুরোপুরি বিনোদনমূলক! চটুলতা মিশিয়ে ক্ষণিকের আনন্দদানই ছিল কবিয়ালদের প্রধান উদ্দেশ্য! তা জানার জন্য আমাদের তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতির দিকে একটু নজর দিতে হয়! একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না কবিগানের সূত্রপাত কিন্তু গ্রাম বাংলার সমাজ সংস্কৃতির প্রেক্ষাপট থেকেই! অষ্টাদশ শতকে একেবারে শেষ ভাগে লর্ড কর্নওয়ালিসের আমলে ঘটলো আমূল ভূমি সংস্কার, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে গ্রাম বাংলার প্রেক্ষাপটে বাবু শ্রেনীর(জমিদার) উদ্ভব খটলো, তাদের এবং তাদের সংগোপাঙ্গদের মনোরঞ্জনের জন্য ডাক পড়লো কবিয়ালদের, এই বাবুশ্রেনীর মনোরঞ্জনের দিকে নজর দিতেই কবিয়ালদের মধ্যে খেউর আখড়াই ধারণার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়! তখন গ্রামীন প্রেক্ষাপটে সাধারণত জমিদারদের সেরেস্তা বা দরদালানে কবি গানের আসর বসতো। সেই সময় কবি গানের মধ্যে ভাববাদ বা আধ্যাত্মবোধের প্রভাব খুবই কম ছিল, স্বাভাবিকভাবেই লোক শিক্ষার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল, এই সময় পর্বে কবিগান অনেকের কাছে রঙ্গ রস বা তামাশার বিষয়বস্তু বলে মনে হয়েছিল। যার জন্য সাহিত্যের উপাদান তেমন ছিল না বললেই চলে!
এরপরই ঘটেছে সমাজ সংস্কৃতির পরিবর্তনের হাওয়া, প্রসারিত হয়েছে সমাজ সংস্কার মূলক চিন্তাধারা! উনবিংশ শতকের প্রায় প্রথম আর্ধ থেকে কবি গানও বাবু সমাজ থেকে ধীরে ধীরে সাধারণ সমাজ ব্যবস্থায় প্রবেশ করতে থাকে, পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্কৃতির প্রভাবে সমাজের মানুষের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়গুলো একটু একটু করে ভিন্ন হতে থাকে, সমাজে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই কবি গানের ধারার পরিবর্তন ঘটতে থাকে! কবিগান শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক বিনোদন নয় তার পাশাপাশি সমাজ সচেতনতার বিষয়টিও যুক্ত হয়ে পড়ে! কবি গানের মধ্যে সমাজের সাধারণ মানুষের কথা- তাদের দুঃখ দুর্দশার কথা, চাওয়া- পাওয়া,জীবন সংগ্রামের কথা, দেশপ্রেম, মানবতাবাদ, ভাববাদ ও আধ্যাত্মবোধের বিষয়গুলো যুক্ত হতে থাকে! উল্লেখ করা যেতে পারে কবি গানের এই ধারার পরিবর্তন অবশ্যই লোকসাহিত্য এবং লোক শিক্ষার একটা উপাদান হিসেবে উঠে আসে!
গবেষক ডঃ সুশীল কুমার দে মনে করেন, কবিগানের মধ্যে সামাজিক উপাদান যথেষ্টই ছিল! সমসাময়িক সমাজের চালচিত্র এর মধ্যে ফুটে উঠেছে! তিনি আরো মনে করেন কবিয়ালরা যেহেতু সমাজের তথাকথিত খেটে খাওয়া সম্প্রদায় থেকে উঠে এসেছে, তাই তাদের পদে সাধারণ মানুষের কথা উঠে আসবে না এটা হতে পারে না। গোঁজলা গুঁই, লালু, কেষ্টা মুচি বা নবাই ময়রা এরা প্রায় সকলেই ছিল সমাজের নিম্ন শ্রেণীর প্রতিনিধি! স্বাভাবিকভাবে এদের পদে সমাজের খেটা খাওয়া জীবনের ছবি ফুটে ওঠে! তাই বর্ধমানের পূর্বতন সাহেবগঞ্জ থানার খেরুর গ্ৰামের সেই বিখ্যাত কবিয়াল যিনি একসময় মন্তেশ্বর থানার মালডাঙ্গা হাটে গঙ্গা ময়রার দোকানে কাজ করতেন, অল্প লেখাপড়া জানা এই কবিয়াল ভিয়েন করতে করতে দুঃখের বারোমাসার কথা তাৎক্ষণিক পদে প্রকাশ করতেন--
"খেরার গ্রামে বসত বাটি
গুড় চিনিরে ময়রা বাটি!"
বা
"গুরু দত্ত গুড় লয়ে
ভিয়েন কর মন ময়রা হয়ে,
সন্দেশ তৈরি হলে
ভেট দিবি শমনে গিয়ে!"
আবার তারই কন্ঠেই ধ্বনিত হয়েছে শাক্ত বৈষ্ণবের সমন্বয়কারী এক আধ্যাত্ম্যবাদ-
"হৃদয় রাস মন্দিরে দাঁড়াও মা ত্রিভঙ্গ হয়ে
একবার হয়ে বাঁকা দেমা দেখা শ্রীরাধারে বামে লয়ে
হৃদ মাঝারে কালশশী দেখতে বড় ভালোবাসি
অসি ছেড়ে ধরমা বাঁশী চরণে চরণে থুয়ে!!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিগান সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়েছিলেন! তিনি একে লোকশিক্ষার বাহক হিসেবে না ভেবে 'নতুন সামগ্ৰী' বা 'নষ্ট পরমায়ু' বলে অভিহিত করেছেন! কিন্তু এই অভিযোগ পুরোপুরি সত্য বলে মনে হয় না। একটা কথা ভুললে চলবে না যে বঙ্গে কবি গান কিন্তু সবসময় একই ধারায় বয় নাই! আগেই বলেছি কবি গানের সূচনা পর্বে চটুলতা বা নিম্ন রুচির উপাদান যথেষ্ট ছিল, প্রাথমিক পর্বে কবি গানের আসবে বেশিরভাগ কবিয়াল ও শ্রোতা ছিল স্বল্পশিক্ষিত তথাকথিত নিম্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি, সেই হিসেবে কবি গানের মধ্যে যে চটুলতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই চটুলতার মধ্যেও যে লোক শিক্ষার বিষয়গুলি ছিলো না, তা কিন্তু নয়, তবে সমাজ সংস্কৃতির পরিবর্তন, সমাজে তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর অংশগ্রহণ, সমাজবদ্ধ মানুষের সাধারণ চাওয়া পাওয়ার বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্তি ধীরে ধীরে কবি গানের ধারার কিন্তু পরিবর্তন ঘটিয়েছে! অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্ব থেকে গোঁজলা গুঁই, নবাই ময়রা, এন্টনি ফিরিঙ্গি বা ভোলা ময়রাদের সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত হাজার হাজার কবিয়াল এসেছে, তারা অধিকাংশ ছিল সমাজের খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত পরিবারের প্রতিনিধি, তাই সমকালীন সমাজ জীবনের প্রতিচ্ছবি, খেটে খাওয়া জীবনের বারোমাস্যা, লোক শিক্ষার উপাদান, কবি গানের মধ্যে যথেষ্টই এসেছিল, যা পরবর্তীকাল বাংলা সাহিত্যকে পরিপুষ্টতা দান করেছে এবং সমাজকেও একটা নির্দিষ্ট ধারায় পরিবর্তন করেছে, তাই এর সাহিত্যিক এবং সমাজতাত্বিক মূল্য যথেষ্ট আছে।
স্বাধীনতার পরবর্তীকালে, বিশেষ করে অটের দশকের প্রথমার্ধ থেকে, বিজ্ঞান প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার, বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপক অনুপ্রবেশ দেশীয় সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে, এর ফলে দেশীয় সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে পিছু হটচ্ছে, ফলে কবিগান যাত্রা বাউল কীর্তন প্রভৃতি দেশীয় শিল্প সংস্কৃতি ব্যাপক অবনমনের ধাক্কায় বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাচ্ছে, বর্তমান প্রজন্ম এই শিল্পচর্চায় আর আসছেনা, সামান্য কয়েকজন ঐতিহ্যবাহী পেশাদারী পরিবার থেকে এসে এখনো কোনরকমে এই পেশাকে ধরে রেখেছে, বিভিন্ন কবিয়ালের সাথে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে, তবে আজও বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ,বর্ধমানের উত্তর পূর্বাংশ এবং নদীয়া জেলায় কবিগান আজও তার জনপ্রিয়তা কে মোটামুটি ধরে রেখেছে, বলতে গেলে অজয় এবং গঙ্গার উভয় তীরবর্তী অংশে বীরভূম কাটোয়া মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়া জেলায় কবিগানের মতো প্রাচীন সংস্কৃতি ধিকিধিকি করে আজও বইছে!
=====================
লেখক পরিচিতি :: বারিদ বরন গুপ্ত, মন্তেশ্বর, পূর্ব বর্ধমান, লেখক দীর্ঘ দিন সমাজ সংস্কৃতির গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখালেখিতে যুক্ত আছেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন