মানস কুমার সেনগুপ্ত
১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সারা ভারতবর্ষ জানাল নৈতিক সমর্থন। কেন্দ্রীয় সরকার এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সামরিক এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় সমর্থন করলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে। আর পশ্চিম বঙ্গের আপামর জনসাধারণ আবেগে, ভালবাসায়, সুরে, স্বরে মানবিক এবং আত্মিক বন্ধনে সামিল হ'ল মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বরচিত সুরে নতুন করে রেকর্ড করলেন দুটি গান ।একটি ' মাগো ভাবনা কেন, আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্তছেলে' আর একটি 'এদেশের মাটির পড়ে অনেক জাতির অনেক দিনের লোভ আছে'। দুটি গানই দুই বাংলার প্রাণের গান হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে প্রথম উল্লেখ করা গানটি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে এই গানটি নিয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের শতবর্ষে আপামর বাঙালি আজও স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় অংশুমান রায় নিজের সুরে গেয়েছিলেন ' শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠে আকাশে-বাতাসে ওঠে রনি, বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।' বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের শতবর্ষ উদযাপনে যে গান আজও প্রাসঙ্গিক দুই বাংলায়। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের বেতার তরঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পরিবেশনে পদ্মশ্রী দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়ের আবেগময় কন্ঠটি আজও বেঁচে আছে আমাদের হৃদয়ে। আর দুই বাংলাকে মেলালেন যিনি মেলালেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি ' গানটি বাংলা ভাষা, বাঙালি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবেগময় অনুভূতিকে মিলিয়ে দিল এপার বাংলা , ওপার বাংলায়।বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা শুধু নয় । এ ভাষা আমাদের গৌরব , আমাদের অহংকার । বাংলা সাহিত্য, বাংলা সঙ্গীত , চলচ্চিত্র , নাট্যকলা চর্চায় আমরা এক সমৃদ্ধ এবং নিয়ত বহমান ধারার উত্তরাধিকারী। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের বাণীতে যখন বলেন ' আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি , তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী '। বঙ্গ জননীর রূপের মতো, মধুর বাংলা ভাষা দুই বাংলার অগনিত মানুষের প্রাণের ভাষা। শুধুমাত্র ভাষার জন্য ওপার বাংলার অগনিত মানুষের আত্মবলিদানে, ২১ শে ফেব্রুয়ারি দিনটি স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। দুই বাংলার প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল ইসলামের কাব্য, সঙ্গীত, সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহনকারী অগনিত বাঙালি আত্মগরিমায় জারিত হয়েছে বাংলা ভাষা চর্চায়। কান্তকবি রজনীকান্ত, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্য সঙ্গীত সমৃদ্ধ করেছে বাঙালির প্রাণের ভাষা চর্চার ইতিহাসকে। পঞ্চ কবির অফুরান সৃষ্টি বিশ্বের দরবারে বাংলা ভাষাকে গৌরবান্বিত করেছে।বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় বাংলা ভাষার প্রাথমিক শিক্ষার সোপান। রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ এক ছন্দবদ্ধ স্মৃতিমেদুরতার জন্ম দেয়। বাঙালির সাহিত্য চর্চা সমৃদ্ধ হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ অগনিত সাহিত্য স্রষ্টার হাত ধরে। বাঙালি কাব্য চর্চায় জীবনানন্দ, সুকান্ত, সুভাষ, শক্তি - সুনীল প্রমুখের লেখনীর সার্থক উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও কবি শঙ্খ ঘোষের লেখনী ছিল সজীব। বাংলা দেশের কবি জসীমউদ্দীন, শামসুর রহমান আজও বেঁচে আছেন দুই বাংলার অগনিত মানুষের হৃদয়ে। লালনগীতি মিশে থাকে আমাদের জীবনবোধের অনুভবে। বটবৃক্ষসম রবীন্দ্রনাথ এবং বিদ্রোহী কবি নজরুলের সৃষ্টি দুই বাংলা আজও লালন করে চলেছে তাদের চেতনায় অনুভবে। আমাদের মাতৃভাষা চর্চার ইতিহাস সমৃদ্ধ হয়ে থাকবে দুই বাংলার মানুষের সম্মিলিত নিরন্তর প্রয়াসে।কিন্তু এত কিছুর পরেও দুই বাংলার মাতৃভাষা চর্চায় আবেগ এবং ভালোবাসার উজ্জীবনে এক সীমারেখা থেকেই যায়।'মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা '। মাতৃভাষায় কথা বলতে এপার বাংলার মানুষ আর তেমন করে শ্লাঘা বোধ করেন না। ভারতবর্ষের অন্য কোনও প্রাদেশিক ভাষায় কথা বলা মানুষ নিজের ভাষাটিকে মাথায় করে রাখেন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে হিন্দির অগ্রাধিকার এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ভাষার গুরুত্বকে অস্বীকার না করেও একথা বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর এক গানের বাণীতে কতদিন আগেই বলেছিলেন ' কাহারও ভাষা হায় ভুলিতে সবে চায়,সে যে আমার জননী '। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণের উত্তরাধিকার বহন করা বাঙালি আজ বাংলা পড়তে গৌরব বোধ করে না। বিশেষ করে নবীন প্রজন্ম। তাদের দোষী সাব্যস্ত করে লাভ নেই। ভবানী প্রসাদ মজুমদারের কবিতায় এক বঙ্গজ অভিভাবক বলে ওঠেন - ' জানেন দাদা আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা।' বাংলায় কথা বলতে চাওয়া কোনও ভিনদেশী মানুষের সঙ্গে আমরা ভুল হিন্দি ভাষায় কথা বলতে চাই। বাংলা, হিন্দি মেশানো এক মিশ্র ভাষার জন্ম দিয়েছি আমরাই। পেশাগত বা শিক্ষার প্রয়োজনে এবং আন্তর্জাতিক কথ্য ভাষা মাধ্যমে ইংরেজির গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু নিজের ভাষা ভুলতে চাইলে সংস্কৃতির শিকড়ও যে আলগা হয়ে পড়ে। তাই আশা রাখি,বাংলা ভাষা আবার ফিরে পাবে তার আত্মগরিমা এই বাংলাতেই।
======================
মানস কুমার সেনগুপ্ত, ১৭/৮, আনন্দ মোহন বসু রোড, দমদম, কলকাতা ৭০০০৭৪.মোবাইল-৮৯০২২১৭৭৮০
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন