
বিপন্ন মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি
শ্যামল হুদাতী
বাংলা ভাষা বাঙালিদের মাতৃভাষা। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষা সরকারি ভাষা। মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে, বাংলা ভাষা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। মাতৃভাষীর সংখ্যা অনুসারে, বাংলা ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের পঞ্চম স্থানে রয়েছে। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলা ভাষার উৎপত্তি দশম শতাব্দীতে। বাংলা একটি ধ্রুপদী ইন্দো-আর্য ভাষা।
বাংলা ভাষার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ থেকে বাংলায় হিন্দু ব্রাহ্মণগণ সংস্কৃত ভাষার চর্চা করত, কিন্তু স্থানীয় বৌদ্ধরা প্রাকৃত ভাষার কোনো কোনো রূপে কথা বলত। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়, বাংলা ছিল হিন্দু যাজক বা পুরোহিতদের জন্য সংস্কৃত সাহিত্যের একটি কেন্দ্র, যা স্থানীয়দের কথ্য ভাষাকে প্রভাবিত করে। প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা যখন মগধ রাজ্যের একটি অংশ ছিল তখন মধ্য ইন্দো-আর্য উপ ভাষাগুলি বাংলায় প্রভাবশালী ছিল।
বাংলা ভাষার উৎপত্তি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে। সংস্কৃতকে বাংলা ভাষার জননী বলা হয়।
বাংলা বর্ণমালার উৎপত্তি ব্রাহ্মী লিপির পরিবর্তিত রূপ থেকে হয়েছে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হল চর্যাপদ। অষ্টাদশ শতকের শেষে বাংলা ভাষা তার বর্তমান রূপ লাভ করে। বাংলা ভাষা চলমান, সজীব এবং ক্রমাগতভাবে বদলাতে থাকে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে ছোটো ছোটো পরিবর্তন জড়ো হয়ে নতুন উপভাষার জন্ম দেয়।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০০০ সালে সারাবিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষা ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বর্তমানে কথ্য ভাষাগুলোর প্রায় ৯০ শতাংশ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। ভারত-বাংলাদেশের নাগরিক এবং অন্যান্য দেশে অভিবাসী মিলিয়ে বাংলাভাষীর সংখ্যা ৩০ কোটির বেশি। তারপরও বাংলা ভাষা যে সংকটজনক অবস্থায় রয়েছে, তা বলা বাহুল্য বিশেষত ভারতে। ভারতে ২২টি জাতীয় ভাষার মধ্যে একটি বাংলা ভাষা হলেও, পশ্চিমবঙ্গের প্রতিবেশী রাজ্যেই তার অবস্থা বিপন্ন।
অনেকেই বলে থাকেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আজ বিপন্ন। আমরা বাঙালিরা নিজেরাই কমবেশি দোষী- এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। বাঙালিরা নিজেরাই বাংলা সংস্কৃতি ও ভাষা থেকে নিজেদের দূরে ঠেলে দিচ্ছে দিনের পর দিন। কিন্তু তারা গর্বের সঙ্গে দেখাবেন পহেলা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ, দুর্গাপুজো, সরস্বতী পুজো - তারা কত ভালবাসেন। বাংলা ভাষা বিপন্ন একথা বলার জন্য সে ভোরবেলা হাঁটতে রাজি, একুশে ফেব্রুয়ারি গান গাইতে, কবিতা পড়তে রাজি। কিন্তু এই ভাষা কি কিভাবে বাঁচানো যাবে সে বিষয়ে সে একটি পদক্ষেপ খরচ করতে রাজি নয়। অথচ সেই চায়ের টেবিলে, অফিসের টেবিলে বড় বড় বুলি মারতে ওস্তাদ। সে বলবে হিন্দি আগ্রাসান এবং ইংরেজি মাধ্যম স্কুল গুলোর উপর দোষ চাপিয়ে সে পরম আনন্দ পায়। অথচ সে যখন তার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করতে যায়, প্রথমে বেছে নেয় ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোকে। এমনকি অনেক অভিভাবকরা হিন্দিকে বেছে নেয় ফাস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে। যখন প্রশ্ন করা হয় বাংলা কেন ব্রাত্য? অদ্ভুত অদ্ভুত উত্তর আসে - হিন্দিতে মার্ক্স ভালো আসে, সর্বভারতীয় পরীক্ষায় এগিয়ে যাওয়া, বাংলায় ভালো বই নেই ইত্যাদি ইত্যাদি। আপনার সন্তানকে আপনারা সবাই গর্বের সঙ্গে ইংরাজি সঙ্গে হিন্দি পড়াচ্ছেন। আবার বাবা-মারা অধিক চিন্তিত যে তাদের সন্তানরা বাংলা ভাষা পড়ছে না, ভুলে যাচ্ছে, বাংলা বানান ভুল করছে ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন হল আমরা বাংলা ভাষার জন্য কি করছি যে আমাদের সন্তানরা বাংলা পড়ার জন্য আগ্রহী হবে?
আবার অনেকে জোর গলায় বলেন বাংলা ভাষার উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো বই নেই। একথা অস্বীকার করে কিছু নেই। ইতিহাস থেকে শুরু করে বিজ্ঞান ভালো বই পড়তে গেলে ছাত্রছাত্রীকে ইংরেজি ভাষায় পড়তে হবে চাকরির পরীক্ষা দিতে গেলে ইংরেজিতে দিতে হবে। এই দেশে বাংলা একটি আঞ্চলিক ভাষা কিন্তু কেউ কি কেউ কি চেষ্টা করেছেন বাংলা ভাষায় লিখিত সাহিত্যকে ভারতের অন্যান্য ভাষায় এবং বিদেশি ভাষায় যথার্থ অনুবাদের? সব মিলিয়ে ভাবনা আর চিন্তাতে রয়েছে অমিল, দৈন্য। আমাদের কখনোই দোষ দেওয়া উচিত নয় অন্য ভাষাকে, দোষ দেওয়া উচিত নিজেকে, নিজেদের। কোন একটি দেশ যদি নিজেদের দুর্বল করে রাখে, তাহলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এসে তাকে অধিকার করবেই। এমন সংস্কৃতি তৈরি করেছি যেখানে সমস্ত জায়গায় দুর্নীতি চরম। আমরা সারাদিন রাজনৈতিক দোষারোপ করতেই ব্যস্ত। কিন্তু আমরা সমাধানে রাস্তা খুঁজতে মোটেই আগ্রহী নই। আমরা শুধু নিশ্চিত মনে পহেলা বৈশাখ নতুন জামা কাপড় বা হালখাতার পরিকল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ছি আবার ভাবছি রাজনৈতিক নেতারা আমাদের জীবন পাল্টে দেবে।
আমাদের কাছে পহেলা বৈশাখ, ২৫ শে বৈশাখ, দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজার মধ্যে রীতি আচার উৎসাহ ভরে পালন করি। নতুন পাঞ্জাবি পায়জামা পড়ে মঞ্চে বক্তৃতা মারি আর চলে উৎসব বছর পর বছর। কিন্তু এভাবে আমাদের সংস্কৃতি কতদিন টিকবে? কিন্তু আমাদের নিজস্ব বাংলা সংস্কৃতি, কৃষ্টি যদি না থাকে তাহলে ভৌগোলিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা থাকল বা না থাকল তাতে কি এসে যায়? একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে নিজেদের আবদ্ধ রেখে সমগ্র জাতির জন্য চিন্তা করবো কি করে? এইভাবে কি চলতে পারে? এখন বাংলা চ্যানেল গুলো দেখুন। যে রিয়েলিটি সো-গুলো চলে, সেখানে গান বলতে হিন্দি গান। আবাল-বৃদ্ধ- বনিতা নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবাই মজে আছেন এই রিয়েলিটি শো সংস্কৃতিতে। আরও একজন হেমন্ত মুখার্জি, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখার্জি, আরতি মুখার্জী তো নয়ই, নিদেনপক্ষে একজন কুমার শানু তৈরি হবে কিনা সন্দেহ। বাচ্চাদের গান শেখা এখন আমাদের সংস্কৃতি থেকে বিদায় নিয়েছে।
আমাদের বাংলার নগেন্দ্র প্রসাদ সর্বাধিকারী ভারতের ফুটবলের জনক। তিনি হেয়ার স্কুলে তার সহপাঠীদের সঙ্গে দল গড়ে ফুটবল খেলতে আরম্ভ করেন। উনিশ শতকে ব্রিটিশ সৈন্যরা কলকাতায় এই খেলাটির প্রচলন করেছিল। ভারতীয় দলের প্রথম পরিচিত আনুষ্ঠানিক আন্তর্জাতিক সফর হয় ১৯২৪ সালে। সেই সফরে দলটির নেতৃত্বে ছিলেন কিংবদন্তি ভারতীয় ফুটবলার গোস্ট পাল। পরবর্তী সময়ে আমরা চুনি গোস্বামী, বলরাম, পিকের মত কিংবদন্তি খেলোয়াড় পাই জাতীয় টিমে। জাতীয় টিমে বাংলার বেশিরভাগ খেলোয়াড় সুযোগ পেতে। বর্তমান জাতীয় টিমে বাংলার প্লেয়ার নেই বললেই চলে। এখনকার বাচ্চারা আর ফুটবল খেলে না। অনেকে বলে পড়ার চাপ, মাঠের অভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। আমাদের পুরনো সংস্কৃতি আজ সত্যিই বিপন্ন। আমরা কবে বুঝবো যে খেলাধুলা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের স্বাস্থ্য ও মানসিক বিকাশে সাহায্য করে?
আর যদি কোন বাচ্চা বাংলা বলতে না পারে বাংলা বুঝতে না পারে তাহলে তার এই না-পারাটা উদযাপিত হচ্ছে মৃদু রসিকতায়। কখনোই এটা তার ব্যর্থতা বলে আমরা আর মনে করছি না। বরং গর্বিত হচ্ছে আজ আমরা বাঙালি হয়ে থাকতে চাইছি না। সে ক্ষেত্রে কেন আমরা দোষ দিচ্ছি অন্যদের আমাদের জীবন থেকে ভাষা ও সংস্কৃতি লুপ্ত হওয়ার জন্য?
আমাদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আজ যে বিপন্ন একথা স্বীকার করতে বাধা নেই। আগামীতে যে সাম্প্রদায়িক একটা রাজ্য তৈরি হবে না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। আগামী দিনে যে আমাদের সিলেবাস থেকে চৈতন্যদেব, মঙ্গলকাব্য যে মুছে দেওয়া হবে না সে বিষয়েও আমরা নিশ্চিত নই। কিন্তু প্রশ্ন হল, আমরা সেই দিনটাকে আস্তে দিচ্ছি কেন? বাঙালিরাই বা কেন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তুলছে আরও? যদি এরপরেও কেউ আমাদের মুখের ভাষা, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ভাষা কেড়ে নিতে চায় হয়তো আমরা সেই দিনটাকে উদযাপন করবো। কারণ আমরা তো উদযাপন করতেই ভালোবাসি শুধু.......
--------------------------------------------
শ্যামল হুদাতী
৩৫৭/১/১৩/১, প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড
কলকাতা - ৭০০০৬৮
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন