
বিপন্ন মাতৃভাষা ও তার মুক্তির পথ
মিঠুন মুখার্জী
মনের ভাব প্রকাশ করার অন্যতম মাধ্যম হল ভাষা। ভাষা ছাড়া মানুষ অচল। প্রত্যেক দেশে রয়েছে বিভিন্ন ভাষার প্রচলন। প্রত্যেক দেশের মানুষের আছে মাতৃভাষা। যে ভাষায় সে একেবারে সাবলীল এবং জন্মের পর থেকে যে ভাষায় সে কথা বলে আসছে সেই ভাষাই তার মাতৃভাষা। মাতৃভাষার মতো অন্যভাষায় মানুষ খুব একটা সাবলীল নন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও আছে। সৃষ্টির আদিতে মানুষ বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে মনের ভাব প্রকাশ করলেও বর্তমানে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সভ্যসমাজের সবথেকে শক্তিশালী ভাববিনিময় করার মাধ্যম হয়েছে ভাষা। তাই ভাষাকে বাদ দিয়ে মানুষের অস্তিত্বের কথা ভাবাই যায় না।
এই পৃথিবীতে রয়েছে বিভিন্ন জাতি। তার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ অন্যতম। এছাড়াও আমরা যে ভাষায় কথা বলি সেই ভাষাকে কেন্দ্র করেও জাতিগত ভেদ তৈরি হয়েছে। যেমন বাংলা ভাষায় যারা কথা বলেন তারা বাঙালি, মারাঠি ভাষায় যারা কথা বলেন তারা মারাঠি, তামিল ভাষায় যারা কথা বলেন তারা তামিল,। অর্থাৎ মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করেই এই ভাষাগত জাতি গড়ে উঠেছে।
নিজেদের মাতৃভাষাকে বাঁচাতে সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক আন্দোলন হয়েছে, জীবনহানি ঘটেছে। রক্তপাতের বিনিময়ে প্রিয়জনদের বলিদানের মাধ্যমে মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষ। এর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ভারতের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভেঙে যখন দুটি দেশ হয়েছিল তখন পূর্ববঙ্গ (বর্তমান বাংলাদেশ) হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনে আসে এই জায়গাটি। বাংলার পরিবর্তে জোর করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিরা সেটা মেনে নিতে পারে নি। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন নারী থেকে পুরুষ সকলকেই সহ্য করতে হয়েছিল। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে বরকত-সালাম-রফিকদের আত্মবলিদানের মধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানিরা জয়লাভ করেন এবং তাদের মাতৃভাষা বাংলা থেকে যায়।
পূর্বপুরুষদের আত্মবলিদানের মধ্যমে যে মাতৃভাষা একদিন জয় লাভ করেছিল সেই মাতৃভাষা বর্তমানে নবপ্রজন্মের কাছে লাঞ্ছিত। আজকের যুবসমাজ মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জা পায়। আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজির গুরুত্বকে গুরু করে মাতৃভাষাকে লঘু করে দিয়েছে। মাতৃভাষা আজ খুবই দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছে। এই ভাষাকে অবজ্ঞা করে বিদেশীদের ভাষাকে আপন করে নিয়েছে বর্তমানের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুব সমাজ। বাঙালিদের মাতৃভাষা বাংলা। এরা বাংলা ঠিক মতো বলে না, অন্য ভাষার মিশ্রন ঘটিয়ে বলে। বাংরেজি (বাংলা+ইংরেজি),হিংলা(হিন্দি+বাংলা)ভাষায় বর্তমানে সকলে কথা বলেন। শুদ্ধ বাংলা লিখতে ও বলতে ভুলে গেছেন তারা। এটা আমাদের কাছে চরম লজ্জার। সুতরাং বাংলা ভাষায় সমগ্ৰ বাঙালি জাতির একটা বড় অংশ বর্তমানে কথা বলছে না। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভাষা অবলুপ্তির পথে যাচ্ছে। বাংলা ভাষা বিপন্নতার পথে। সমগ্ৰ বিশ্বে প্রায় সাত হাজারের মতো ভাষা আছে। তার মধ্যে প্রায় চার হাজার ভাষা আজ বিপন্ন অর্থাৎ অবলুপ্তির পথে । কোন জাতির অল্প লোক সংখ্যা হলেও তারা সকলেই যে ভাষায় কথা বলবে সেই ভাষা সজীব ভাষা। কিংন্তু অনেক লোকসংখ্যা হলেও যদি স্থানীয় ভাষায় সেই জাতির বেশিরভাগ মানুষ কথা না বলেন তবে সেই ভাষা বিপন্ন। যত দিন যাচ্ছে বাংলা ভাষাও বিপন্ন ভাষা হয়ে পড়ছে। এর জন্য দায়ী আমরা বাঙালিরাই।
বতর্মানে বাংলা বলার প্রতি শিশুদেরও অনীহা দেখা যায়। তার জন্য দায়ী বর্তমান সমাজব্যবস্থা ও অভিভাবক-অভিভাবিকারা। তারা মাতৃভাষার থেকে হিন্দি ও ইংরাজি ভাষাকে বেশি গুরুত্ব দেন। প্রায় সব দেশের মাতৃভাষা আজ ইংরেজি ভাষার কারনে অবহেলিত। সরকারি অফিস - আদালতে যেহেতু ইংরেজির চল, সেহেতু মাতৃভাষা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে কিছু দেশ আছে যাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা মাতৃভাষা। এই কারনে তাদের দেশের সমস্ত সরকারি কাজকর্মে মাতৃভাষাকেই সবথেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেমন গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
মাতৃভাষা আজ বিপন্ন। এরও অনেকগুলো কারণ আছে। সারা পৃথিবীর অনেক মাতৃভাষা আছে যে ভাষা আত্মনির্ভরশীল নয়। অর্থাৎ কোনো নতুন ভাব প্রকাশ করার জন্য সেই ভাষায় শব্দ পাওয়া যায় না। অন্য ভাষার থেকে শব্দ ধার করে সেই ভাব প্রকাশ করতে হয়। আগেও এরকম হয়েছে, এখনো চলছে, ভবিষ্যতেও চলবে। আবার কোনো কোনো প্রাচীন ভাষা আছে যাদের নতুন কোনো ভাব প্রকাশ করতে অন্য কোনো ভাষার শব্দভান্ডার থেকে শব্দ ধার করতে হয় না। নিজের শব্দভান্ডার থেকে শব্দ নিয়ে একটু এদিক- ওদিক করে নিলেই হয়। এই সমস্ত ভাষা আত্মনির্ভরশীল। এই ভাষার মধ্যে আছে সংস্কৃত, আবেস্তা ইত্যাদি। অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহারের ফলে এবং মাতৃভাষার যথাযথ শব্দ না থাকায় মাতৃভাষা বিপদগ্ৰস্ত হয়ে পড়ছে। বাংলা ছাড়াও যে সকল ভাষা আজ বিপন্নের পথে তার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল---চেরকি ভাষা (আমেরিকান - ইন্ডিয়ান আদিবাসী চেরোকিদের মাতৃভাষা), ইয়িডিশ ভাষা (ইয়িডিশ ভাষা জার্মানির আশখেনাজি ইহুদিদের মুখের ভাষা),মাপুচে ভাষা (দক্ষিণ আমেরিকার চিলি ও আর্জেন্তিনার মাপুচেদের ভাষা মাপুচে।),ককবরক ভাষা (ভারতের উত্তর পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের জনজাতির প্রাচীন ভাষা ককবরক।), সামি ভাষা (বিস্তীর্ণ স্ক্যান্ডিনিভিয়া জুড়ে একসময় সামি ছিল একটা প্রধান ভাষা।),নুরিস্তানি ভাষা (নুরিস্তানি ভাষা আফগানিস্তানের পূর্ব সীমান্তে, পাকিস্তানের চিত্রল জেলার কাফিরি জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা)। ইউনেস্কো থেকে এই সমস্ত ভাষাকে বিপন্ন ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অন্যান্য বিপন্ন ভাষার মতো বাংলা ভাষার বিপন্নতার পিছনে অনেক কারন আছে। যেমন বিপন্ন ভাষা অবলুপ্তির নানা কারণ থাকে। শিল্প ক্ষেত্রেও বর্তমানে বাংলা ভাষার ব্যবহারে একটি অনীহা তৈরি হয়েছে। দোকানের নাম থেকে শুরু করে হিসাবনিকাশ সবকিছুই চলে ইংরাজিতে। ফলে সেখানেও বাংলার চল উঠে যাচ্ছে। কয়েক বছর আগে এমনটি ছিল না। শিল্প ও ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলার যথেষ্ট ব্যবহার ছিল । কিন্তু চাহিদার সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী ভাষা ইংরেজির কাছে বাংলা ভাষা ও বাংলার মতো ভাষারা বিপন্ন হয়ে উঠছে।
ভাষার অবলুপ্তি হয়ে যাওয়া একটি জাতির পক্ষে ভয়ংকর ব্যাপার। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে মাতৃভাষা বলে কিছু থাকবে না। পরের ভাষাকে মাতৃভাষা হিসেবে গ্ৰহন করা ছাড়া উপায় থাকবে না। তাই সমগ্ৰ জাতির পক্ষে এখনো সাবধান হওয়ার সময় আছে। বাংলা ভাষা এবং বাংলা ভাষার মতো বিপন্ন ভাষাগুলোকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে সেই জাতির বেশিরভাগ মানুষদের ওই ভাষায় কথা বলতে হবে,অন্য ভাষার পরিবর্তে নিজের মাতৃভাষাকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে, অফিস-আদালত ব্যবসা-বানিজ্য সবক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে ব্যবহার করতে হবে, শিক্ষাক্ষেত্রেও নিজের মাতৃভাষার ব্যবহার করতে হবে। তবেই বিপন্ন ভাষাকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
===================
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
পিন-- 743252
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন