google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re নিবন্ধ ।। একুশে ফেব্রুয়ারি : বাঙালির শ্রেষ্ঠ অশ্রুবিন্দু ।। জীবনকুমার সরকার - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

নিবন্ধ ।। একুশে ফেব্রুয়ারি : বাঙালির শ্রেষ্ঠ অশ্রুবিন্দু ।। জীবনকুমার সরকার

একুশে ফেব্রুয়ারি: বাঙালির শ্রেষ্ঠ অশ্রুবিন্দু

জীবনকুমার সরকার


বাঙালির সবচেয়ে গৌরবের মাস ফেব্রুয়ারি। বাংলায় ফাল্গুন। ভাষার জন্য আত্মবলিদানের এমন নজির পৃথিবীতে বিরল। ১৯৫২ সালের একুশ তারিখে ঢাকার রাজপথে রফিক-শফিক-সালাম-বরকত-জব্বারের বুকের তাজা রক্তের স্রোতধারায় ১৯৭১ সালে এসে অর্জিত হয়েছে বাংলাভাষার নামে একটি দেশ। বিশ্ব মানচিত্রে দেশটির নাম বাংলাদেশ। কিন্তু বর্ষগণনার অমোঘ নিয়মে ফেব্রুয়ারি আসে আর যায়। বাঙালির কোনো পরিবর্তন দেখি না। একুশ ফেব্রুয়ারির দিন বাঙালি বড়ো বড়ো করে ব্যানার, ফেস্টুন আর ফ্লেক্স জুড়ে লিখবে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন'। 

          উদযাপনই বটে। তার থেকে বিশেষ কিছু কিছু আলাদাভাবে হৃদয়ে দাগ কাটে না। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বাঙালি শতরবে মাতৃভাষায় মুখরিত করবে অনুষ্ঠান কেন্দ্রগুলো। একই মুখ আর একই মানুষদের ভিড়ে শহিদবেদিতে নেতা ধ'রে ধ'রে এনে তাদের হাত দিয়ে ফুল ছেটানো হবে। অনুষ্ঠান স্থানে চমক দিতে আসা খিচুড়ি ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক–বাহক শহুরে নেতারা একদিনের জন্যে একুশের আবেগ ছড়িয়ে দিয়ে চলে যাবে। বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, একুশের পরের দিন থেকে ওইসব নেতা–মন্ত্রী–আমলারা বাংলা ভাষার ভয়ানক ক্ষতি করতে থাকবে নিজেদের অজান্তে। রাস্তাঘাটে আরও কত রকমের মেকি ভাষাপ্রেম কত জন ছড়ায়, তার কোনো হিসেব থাকে না।

          বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত একুশ সাত দশকের মধ্যে সারা বিশ্বে ভাষাপ্রেমের সমীহ আদায় করেছে। বাঙালির এই অনন্য ভাষাপ্রেমের মহা সংগ্রামকে সূচক হিসেবে চিহ্নিত করে সারা বিশ্বের মানুষ নিজ নিজ মাতৃভাষার বন্দনা করে। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে বছরে একদিন একুশে ফেব্রুয়ারি ইতিহাস স্মরণ করা বাঙালিরা একুশের চেতনাকে আড়াল করছে নিজেদের অজান্তে। একুশের চেতনাকে লালন করা সাধনার বিষয়, ফ্যাশানের বিষয় নয়। বাংলার বাঙালিরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করে; লালন করে না। তাই সর্বত্র একুশের নামে যা দেখি, তা আসলে ফ্যাশান। বাঙালির জাতিসত্তাকে প্রসারিত করার কোনো আয়োজন দেখি না। মাতৃভাষার ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে কোনো ঝোঁক নেই। অর্থাৎ, একুশে ফেব্রুয়ারির দিন বাঙালি, আবার বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে অবাঙালি সত্তায় উত্তরণ। 

           ভারতে যেভাবে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ প্রবল গতিতে এগোচ্ছে তাতে অন্যান্য ভাষাসমূহের বিপদ আসন্ন। ইতিমধ্যে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজশক্তি 'হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানে'র নামে অনেক আঞ্চলিক ভাষাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। অনেকে লক্ষ করছেন না, হিন্দুত্বের চেয়ে হিন্দিত্ব আরও কত মারাত্মক এই মুহূর্তে। হিন্দি বলয়ের ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রনেতারা মানুষের মগজে এই বিষ ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, হিন্দিভাষা আর দেশপ্রেম একই। এই উৎপাদিত শক্তির বিরূদ্ধে দক্ষিণ ভারত বিশেষ করে তামিলনাড়ু জ্বলে উঠতে পারলেও বাঙালি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকাকেই শ্রেয় বলে মনে করে।

           বাংলার বাইরে বাঙালিদের অবস্থা চরম সংকটে। বিহার-ঝাড়খণ্ড-মেঘালয়–উড়িষ্যা–উত্তর    প্রদেশ-আসাম-আন্দামান সহ বাংলার বাইরে অন্যান্য রাজ্যে বাঙালির মৃত্যুশয্যা তরান্বিত। বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ, বাংলা বইয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে চুপিসারে হিন্দি শব্দ, বাধ্য করা করা  হচ্ছে হিন্দি ভাষা নিয়ে পড়াশুনা করতে। বাঙালি এক অদ্ভুত প্রজাতি। বর্বিবঙ্গে বাঙালি সহোদরের মৃত্যুশয্যা তরান্বিত দেখেও টু শব্দ করছে না। বাঙালিকে পর্যদুস্ত করতে হিন্দিবলয়ে তৈরি হয়েছে একটা নতুন ফাঁদ। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি শ্রমিকদের দেখলেই বাংলাদেশি তকমা দিয়ে হেনস্থা করা হচ্ছে রীতিমত। প্রায়ই গণমাধ্যমে দেখছি এই বাজে ঘটনা। তবু আমরা প্রতিবাদহীন। নির্বিকার। অথচ, আমাদেরই আছে মাতৃভাষার জন্য আত্মবলিদানের মতো মহান ঐতিহ্য। আর একুশের মতো প্রেরণা। 

         অজস্র বেদনার মধ্যে এই বেদনা আমাদের আরও কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে — একুশের পাশে থাকা কলকাতা আজ মাতৃভাষার ক্ষমতায়নে পিছিয়ে। এমনই তার দুর্দশা যে, হিন্দি না জানলে কলকাতায় একটি পান-বিড়ি সিগারেটের ঘুমটি পর্যন্ত চলে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। অতি সাম্প্রতিক দুটি বেদানার কথা উল্লেখ করতে চাই। এক. সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেছে একজন অবাঙালি মহিলা কলকাতায় দাঁড়িয়ে একজন বাঙালি মহিলাকে হুমকি দিয়েছে এইভাবে, এটা বাংলাদেশ না, এটা ভারত। আপনি হিন্দি বলুন। ভারতে থাকতে গেলে হিন্দি বলতে হবে। দুই. একটি কর্পোরেট হাউসের ডাকে বাংলার বিখ্যাত গায়িকা ইমন চক্রবর্তী মঞ্চে গান গাইতে শুরু করলে একজন প্রতিবাদ করে বলে ওঠেন, আপনি হিন্দিতে গান করুন। 

           এই দুটি ঘটনাকে খুব গভীরভাবে লক্ষ করলে বোঝা যায় কলকাতায় হিন্দিভাষীদের প্রভাব বাড়ছে। নাহলে কলকাতার মাটিতে দাঁড়িয়ে এইসব যারা বলে, তাদের এত দুঃসাহস কোথা থেকে আসে? এই রাজ্যে অবাঙালিদের এ ধরনের দুঃসাহস আমরাই দিয়ে চলেছি। সরকারও উদাসীন। সামান্য কিছু অবাঙালিদের ভোট করায়ত্ত করতে গিয়ে রাজ্য সরকার তাদের আগ্রাসনের বিষয়টি গুরুত্বের বাইরে রেখেছে। যার মাশুল হিসেবে দিতে হচ্ছে কলকাতায় অবাঙালিদের দাপট। দিনের পর দিন বাড়ছে এটা।

            বাঙালি আজ আর মাতৃভাষা ও মাতৃসংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধ নয় বলে বাংলার মাটিতে হাড়ে হাড়ে সুযোগ নিচ্ছে  হিন্দি ভাষার সম্প্রসারক কেন্দ্রীয় সরকার। বাংলা ভাগ করেও বাঙালিকে নিঃশেষ করতে না পেরে এখন এনআরসি ক'রে অসাম্প্রদায়িক চেতনার ঐতিহ্য বহনকারী বাঙালিকে আইনের প্যাঁচে ফেলে নিঃশেষ করতে উদ্যত হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা। একুশ উদযাপনের মুহূর্তে এসব ভাবা জরুরী। মনে রাখতে হবে, ভাষা-সংস্কৃতি একটি প্রতিরোধের জায়গা। প্রতিবাদের জায়গা। একুশ ফেব্রুয়ারি সেই চেতনা আমাদের দিয়েছে। সুতরাং, একুশ মানে ভাষাশহিদের স্মৃতসৌধে মাল্যদান করা আর সকলের হাততালি কুড়োবার জন্য ব্যক্তব্য দেওয়া নয়। শত সহস্র একুশ উদযাপন করার থেকে আমরা যদি রাজ্যের সব কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার নির্দেশ আদায় করতে পারি সরকারের থেকে, তাহলে এপারে বাংলা ভাষা অন্তত এই রাজ্যে বেঁচে থাকবে। নাহলে একুশ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের বিরুদ্ধেও একদিন ফতোয়া দেবে অবাঙালিরা। 

          

         


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন