দেবাংশু সরকার
বারো বছর পর দেশে ফিরে আসছে শোভন। সবকিছু ছেড়ে। লোভনীয় চাকরি ছেড়ে, আমেরিকা থেকে দেশে ফিরছে সে। কিন্তু কেন? কেন ফিরে আসছে সে? কেন সে ছেড়ে দিচ্ছে এই রকম লোভনীয় চাকরি? চাকরিতো নয়, যেন টাকার গাছ! মাত্র বারো বছরে, আমেরিকায় বসবাস করে, প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠিয়েও তার ব্যাঙ্কে জমেছে কয়েক কোটি টাকা। তাহলে কেন সে ছেড়ে দিচ্ছে এই রকম এক চাকরি? সে যে ভারতে সমমানের কোনও চাকরি পেয়েছে তাও নয়। এমন কি ঐ চাকরির কাছাকাছি মানের কোনও চাকরি পেয়েছে, সে রকম কোনও খবর কারও কাছে নেই। পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন সকলের মনে এক প্রশ্ন। কেন, কেন, কেন? কেন সে চাকরি ছাড়ছে? কেন সে আমেরিকা ছাড়ছে? এর পেছনে কি কোনও গূঢ় রহস্য আছে? সেকি তার অফিসে আর্থিক বা অন্য কোনও কেলেঙ্কারিতে ফেঁসে গেছে? তাহলে তার অফিস তাকে ছাড়বে কেন? কোনও অন্যায় করলে, কেলেঙ্কারিতে জড়ালে সেতো শাস্তি পাবে। এসব ব্যাপারে আমেরিকার আইন খুব কড়া। তাহলে সে কি করে দেশে ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছে? তবে কি সে অফিসের বাইরের কোনও কেলেঙ্কারিতে ফেঁসেছে? তাহলেওতো ঐ দেশের পুলিশ প্রশাসন তাকে আমেরিকা ছাড়তে দেবে না। আবার কারও মনে প্রশ্ন জাগে, দক্ষিণ আফ্রিকার মত ঐ দেশেও বর্ণবিদ্বেষী সমস্যা রয়েছে। তুলনায় কম হলেও রয়েছে। সাদা চামড়ার মানুষরা কালো চামড়ার মানুষদের সহ্য করতে পারে না। চোরাগোপ্তা মারামারি, হানাহানি চলতেই থাকে। কখনও কখনও বিশেষ কোনও কালো চামড়ার মানুষ টার্গেট হয়ে যায়। শোভনও কি এরকম কোনও সমস্যায় পড়ে আমেরিকা থেকে পালিয়ে আসছে? শোভনের দেশে ফিরে আসা নিয়ে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন জেগে ওঠে শোভনের চেনা পরিচিতদের মনে।
বারো বছর আগে ভাগ্যের অন্বেষণে, মাকে দাদা বৌদির কাছে রেখে শোভন পাড়ি দিয়েছিল আমেরিকায়। সম্বল বলতে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রী আর বছর দুয়েকের কাজের অভিজ্ঞতা। দুর সম্পর্কের এক আমেরিকাবাসী আত্মীয়ের ভরসায় সে দেশ ছাড়ে। সেই আত্মীয় আন্তরিক ভাবে সহায়তা করে শোভনকে, ফলে বিদেশে গিয়ে খুব বেশি সমস্যায় পড়তে হয়নি তাকে।
আমেরিকায় পৌঁছানোর পনেরো দিনের মধ্যেই সে চাকরিটা পেয়ে যায়। দেশে থাকাকালীন সে দু বছর চাকরি করেছে। সেই চাকরির মাইনে আর আমেরিকায় পাওয়া নতুন চাকরির মাইনের মধ্যে যে এত বেশি তফাৎ সে কল্পনা করতে পারেনি। তার সঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন রকমের সুযোগ সুবিধা।
মা, দাদা, বৌদিকে ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে প্রথম প্রথম নিঃসঙ্গ লাগলেও, ক্রমশ সেই মানসিক অস্থিরতা কেটে যায় শোভনের। সে দেখেছে কাজ পাগল দেশটার প্রতিটা মানুষই কাজ পাগল। কাজ ছাড়া আর কিছুই তারা বোঝে না। কিছু প্রবাসী ভারতীয়র সঙ্গে তার আলাপ পরিচয় হয়। তারাও যথেষ্ট সহানুভূতিশীল শোভনের প্রতি। সব সময়েই তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় শোভনের দিকে। কয়েক মাসের মধ্যেই সে মানিয়ে নেয় আমেরিকার জীবনযাত্রার সঙ্গে।
আমেরিকার জীবনযাত্রার সঙ্গে শোভন মানিয়ে নেওয়াতে খুশি হয় তার দাদা বৌদি। তাছাড়া বাড়ির জন্য সে প্রতি মাসে যে মোটা অঙ্কের টাকা পাঠায়, সেই টাকা হাতে পেয়ে তার বৌদির খুশির মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যায়। নিয়মিত শোভন তার মায়ের সঙ্গে, দাদা বৌদির সঙ্গে ফোনে কথা বলে। তার মা বারে বারে জানতে চান কবে সে বাড়ি ফিরবে। ছেলের জন্য ফোনে কান্নাকাটিও করেন। মাকে পরিস্কারভাবে কিছু না বললেও, সে তার দাদা বৌদিকে জানায় যে অদুর ভবিষ্যতে পাকাপাকিভাবে দেশে ফেরার কোনও ইচ্ছা তার নেই। হয়ত কয়েক বছর অন্তর, কয়েকদিনের জন্য সে মায়ের সাথে দেখা করার জন্য দেশে ফিরবে। তবে সেটা কয়েকদিনের জন্য, চিরদিনের জন্য নয়। তার দাদা বৌদিও তাকে সমর্থন করে। শোভন কোনও দিন দেশে না ফিরলে তার দাদা বৌদির দুদিক দিয়ে লাভ। প্রথমত বাড়ি ঘর, জমি জায়গার কোনও ভাগিদার থাকবে না। পুরোটাই শোভনের দাদা বৌদি ভোগ করতে পারবে। দ্বিতীয়ত প্রতি মাসে শোভন যে টাকা পাঠায়, সেই টাকায় ভালোভাবে তাদের সংসার চালিয়েও, বেশ কিছু টাকা তাদের হাতে থেকে যায়। ফলে শোভনের দাদা যে মাইনে পায় তার পুরোটাই জমতে থাকে।
ফিরে আসছে শোভন। খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার দাদা বৌদি। তার বৌদি ভাবছে প্রতি মাসে এতগুলো টাকা সে হাতে পেত। গত বারো বছর ধরে পেয়ে এসেছে। সেই টাকায় হেসে খেলে সংসার চলেছে। বেশ কিছু টাকা সঞ্চয় হয়েছে। কিন্তু এবার থেকে আর তারা টাকা পাবে না। শোভনের দাদার মাইনের টাকাতে সংসার চালাতে হবে। টাকা জমানোর পরিমাণ অনেক কমে যাবে। রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছা করছে শোভনের বৌদির।
শোভনের দাদার দুশ্চিন্তা টাকা নিয়ে নয়। সে জানে তার সংসার চালানোর দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। এতদিন শোভনের পাঠানো টাকায় সংসার চলেছে, কিছু সঞ্চয়ও হয়েছে। এবার সে চালাবে। সেওতো ভালো চাকরি করে, উপার্জনশীল। তাই টাকা পয়সা নিয়ে তার কোনও দুশ্চিন্তা নেই। বরং সহোদর ভাইয়ের সাথে অনেক বছর পর দেখা হবে বলে একটা আনন্দ তার মনে রয়েছে। তার দুশ্চিন্তা অন্য ব্যাপারে। যে ছেলেটা কয়েকমাস আগেও বলেছে যে আমেরিকা ছাড়ার কোনও ইচ্ছা তার নেই, সে কেন হঠাৎ সবকিছু ছেড়ে চলে আসছে? চলে আসছে নাকি পালিয়ে আসছে? সঙ্গে করে কোনও বিপদ নিয়ে আসছে নাতো?
শোভনের মায়ের মনে অবশ্য কোনও দুশ্চিন্তা নেই। তাঁর ছোট ছেলে ফিরে আসছে শুনে তিনি খুশির জোয়ারে ভাসছেন। শোভন যা কিছু খেতে ভালোবাসে সেই সব পদ তিনি প্রথম দিনেই রান্না করবেন বলে স্থির করেছেন। কবে কোন মন্দিরে শোভনকে নিয়ে পুজো দিতে যাবেন। কবে কোন আত্মীয়ের বাড়ি শোভনের সঙ্গে যাবেন তারও পরিকল্পনা করে চলেছেন। এক কথায় তার মনে আনন্দের বান ডেকেছে।
বাড়ি ফিরেছে শোভন। বাড়ি ফিরেই সে তার বন্ধুদের সঙ্গে গল্পে আড্ডায় মেতে উঠেছে। কখনও সে আমেরিকার গল্প শোনায়। নিজের বিভিন্ন বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলে। কখনও আবার পাড়ায় গত বারো বছরে কোথায় কি ঘটনা ঘটেছে সেকথা শুনতে চায়। সে মেতে উঠেছে পাড়ার দুর্গা পুজো নিয়ে। বন্ধুদের সঙ্গে সে দুবেলা চাঁদার বিল হাতে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুজোর চাঁদা তোলে। যে বাড়িতেই সে যায় সকলের এক প্রশ্ন, আমেরিকা ছেড়ে ফিরে এল কেন? হাসি মুখে সে এড়িয়ে যায় সেই সব প্রশ্ন। পরিস্কার করে কোনও উত্তর দেয় না। পাড়ার এক বৌদি মজা করে বলে, "ফিরেই যখন এলে, সঙ্গে করে এক গাছা মেম সাহেব আনতে পারতে। আমি কোনও দিন জ্যান্ত মেম সাহেব দেখিনি।"
কেবল চাঁদা তোলাই নয়। নিয়মিত পোটো পাড়ায় যাওয়া, প্যান্ডেলের জন্য ডেকরেটর, ইলেকট্রিসিয়ানের সঙ্গে কথা বলা, পুরুত ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলা। আনুষঙ্গিক আরও অনেক কাজ করতে হচ্ছে শোভনকে। পুজোর যে আর এক মাসও বাকি নেই।
ভাদ্র মাস শেষ হতে চলেছে। একটু একটু করে কালো মেঘ সরে যাচ্ছে আকাশ থেকে। নীল আকাশে ভেসে চলেছে সাদা মেঘের ভেলা। তার সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে ঘুড়ি। পেটকাটি, চাঁদিয়াল, চৌরঙ্গীদের সঙ্গে শোভনের পুরানো সখ্যতা থাকলেও বহু বছর সে ঘুড়ি লাটাইতে হাত দেওয়ার সুযোগ পায়নি। আকাশে ঘুড়ি দেখেই তার পুরানো নেশাটা জেগে উঠেছে।
সকাল থেকেই শোভন সুতোয় মাঞ্জা দিতে শুরু করে। সুর্য মাথার উপরে আসার অনেক আগেই তার ঘুড়ি আকাশে উঠে আসেপাশের ঘুড়ির সঙ্গে লড়াই শুরু করে দেয়। চলতে থাকে কাটাকাটি খেলা। দেখতে দেখতে বেলা বাড়তে থাকে।
ঘর থেকে মা ডাকেন, "শোভন খাবি আয়।" সাড়া দেয় না শোভন। তার নজর ঘুড়ি সুতোয়। বারে বারে ডাকতে থাকেন তার মা।
বিরক্ত হয়ে শোভনের বৌদি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলে, "কি হল ঠাকুরপো? এবারে ঘরে এস। কেন বুড়ো মানুষটাকে অপেক্ষা করাচ্ছ?"
- "আরও কয়েকবার ডাকতে দাওনা বৌদি। মায়ের মুখে, মায়ের ভাষায় এই 'ডাক' শোনার জন্যইতো সব ছেড়ে, সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে ফিরে এলাম।" উত্তর দেয় শোভন।
।। সমাপ্ত ।।
দেবাংশু সরকার।
M.G.ROAD
BUDGE BUDGE
KOLKATA - 700137.
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন