নিরাকার
সকাল থেকেই হইচই শুরু করেছেন প্রভাত বাবু।পুরো নাম প্রভাত কুমার নস্কর,ছোটদাদু
দিয়েছিলেন।প্রতিদিন ভোরবেলা উঠে পার্কে প্রায় এক ঘন্টা শরীরচর্চা করেন। বাড়ি
ফিরে, বাড়ির সামনের কাঠা দুয়েক জমিতে নিজের সবজি বাগানে কিছুক্ষণ সময় দেন
তারপর চা- মুড়ি টিফিন করে বাজারে।প্রতিদিনের একই রুটিন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে
চাকরী করতেন প্রভাত বাবু।আগের বছর বসন্তে দখিনা হাওয়া গায়ে মেখে অশ্রু সজল
চোখে বিদায় নিয়েছিলেন।সকলের প্রিয় আর মজার মানুষ।সাড়ে সাতাশ বছরের কর্মজীবনে
কামাই কদিন গুনে বলা যাবে।সংসারের থেকেও বেশি স্কুলকে ভালোবাসতেন।স্কুল ছেড়ে
চলে যাবার ভয়ে কর্ম জীবনের একমাত্র ইনক্রিমেন্ট, হেড মাস্টারের পদ পর্যন্ত
অবলীলায় ত্যাগ করেছিলেন। প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী'রাও স্যর বলতে অজ্ঞান। রাস্তায়
দেখা হলে দাঁড়িয়ে কথা বলে,বাজারের ব্যাগ ভারি হলে কেউ এগিয়ে দেয়,ইলেকট্রিক বিল
জমা দিতে গেলেও তাই-লাইন দিতে হয় না।এক্ষেত্রে প্রভাত বাবুর আপত্তি থাকলেও,কে
শোনে।কিছু কিছু ছাত্র বাইরে থাকে। বাড়িতে ফিরেই আগে স্যরের বাড়ি।বিয়ে হয়ে
যাওয়া ছাত্রী'রাও বাপেরবাড়ি এলেই দেখা করতে আসে।কেমন যেন অদৃশ্য টান।প্রভাত
বাবু মানুষটাই এইরকম,কিছু না করেই অনেক কিছু করে ফেলেন।সংসারে আগে অশান্তি
লেগেই থাকত।পাড়ায় কারও কিছু বিপদ হয়েছে,কার মেয়ের বিয়েতে টাকা
চাই,প্রভাতবাবু।কোনো কোনো মাসে অর্ধেক মাইনেই দিয়ে দিত।গিন্নি বলত 'তোমারও তো
একটা মেয়ে আছে তারও তো বিয়ে দিতে হবে।আমাদের পুঁজি তো কিছু নেই।শেষে কি, না
খেয়ে মরবে? না,তোমার ছাত্রছাত্রীরা তোমায় দেখবে?'প্রভাত বাবুর একটাই উত্তর 'ও
ঠিক হবে খোনো'।
যাক, অমায়িক স্যরের সব ছাত্র তো আর সমান হয়নি।বিভিন্ন জন বিভিন্ন পেশায়।মহীম
ডাক্তার হয়েছে,শান্তনু ইঞ্জিনিয়ার, রঞ্জন মাস্টার,নওসিন রাজনীতিতে।শাসক দল,
অশাসক দল এসব নিয়ে প্রভাত বাবু অতশত মাথা ঘামায়নি কোনোদিন। খেলাধুলো
ভালোবাসেন,পাড়ার খেলার মাঠে বিকালে গিয়ে বসে থাকার অভ্যাস এখনো ছাড়তে পারেননি
এই বয়সেও প্রভাত বাবুর বয়স চল্লিশেই আটকে।চেহারাও বড়সড় নয়।হাসি মুখ
সর্বদা।পৃথিবীর কোনো বিষাদ গ্রাস করতে পারেনি ওনাকে।
নওসিন প্রভাত বাবুকে ধরেছে, 'আপনাকে এবারে পঞ্চায়েত ভোটে দাঁড়াতেই হবে'।মেয়ের
খুব আপত্তি।প্রভাত বাবু বলে 'আমি এসব তো কোনোদিন বুঝিনি রে,ভোটে দাঁড়িয়ে কি
করব তাও জানিনে'।নওসিন'ও নাছোড়বান্দা।অনেক পিড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত রাজি
হলেন।নওসিন যথেষ্ট বুদ্ধিমান, সে বলল,'আপনকে কিচ্ছু করতে হবে না।আপনার নমিনেশন
জমা করছি, যা কিছু করার আমরাই করব'।
'কি বলি বলতো- তোরা আমার ছাত্র,তোদের কথা ফেলতেও পারিনে,বলছিস এত করে...
,কিন্তু আমার মন সায় দিচ্ছেনে.....'
'কিচ্ছু চিন্তা নেই স্যর , আমার ফোন নম্বর লিখে রেখে দিন,যে কোনো দরকারে ফোন
করবেন।'
নির্লিপ্ত ভাবেই প্রভাত বাবু বলেন,'আচ্ছা'।
কয়েকদিন হলো অভ্যাসেও পরিবর্তন হয়েছে।মরনিং ওয়াক হলেও,সবজি বাগানে আগাছা
হয়েছে,গাছ গুলোও কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে,প্রভাত বাবু সোহাগ ভরে তাকায়।অন্য
দায়িত্ব নিয়ে ফেলেছে যে। সারাজীবন স্কুল জীবনে কোনদিন সময়ে পৌঁছায়নি এরকম
হয়নি।এখন সকাল সকাল বেরোতে হচ্ছে, যা গরম পড়েছে তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি ফিরে
আসাই ভালো।জিততে পারলে অঞ্চল প্রধান করা হবে তাই অন্যান্য গ্রামেও প্রার্থী
দের সাথে ঘুরতে হচ্ছে।তাছাড়া শাসক দল যখন পাশে আছে,তার উপর রিটায়ার্ড মানুষ,
সময়ও আছে।এরই মাঝে দু-এক বার পার্টি অফিসেও আড্ডা দিয়ে এসেছেন প্রভাত
বাবু।সেখানেও সকলে সম্মান দেয়।সময় ভালোই কাটছে।গিন্নি,অন্নপূর্ণা তড়িঘড়ি করতে
পারে না,ধীরেসুস্থে কাজ করে।এত ব্যস্ততা তার একেবারেই পছন্দ নয়।তাদের একটাই
মেয়ে যাদবপুরে হস্টেলে থাকে, ইঞ্জিনিয়ারিং করছে,দ্বিতীয় বর্ষ।মাসে দু-এক দিনের
জন্য আসে, খুব চাপ পড়াশোনায়।অন্নপূর্ণার বিশেষ কাজ নেই তবুও অনেক কাজ। প্রভাত
বাবু'রই বরং সময় কাটে না।এখন তবে খুব ব্যস্ত। অন্নপূর্ণা'র অবার পায়ের ব্যামো।
সকালের পাঠঝাট ধীরেসুস্থে করে,স্নান করে তারপর রান্না করে।রুটিন পরিবর্তন এখনো
অভ্যাস করে উঠতে পারেনি।
দলের কর্মীরা প্রায়শই বাড়িতে আসে,নানা রকম আলোচনা-'কত পুল হতে পারে, কিভাবে
জিতবে,কোথায় ছাপ্পা দিতে হবে,বুথ প্রতি খরচ,ক-জনকে কিনতে হবে,কোথায় ত্রিপল
দিতে হবে,কয়েকটা ইয়ং দল আছে তাদের ফষ্টিনষ্টি'।এর মধ্যে প্রভাত বাবু ঠিকঠাক
অংশ নিতে পারেননা। চা, পাঁপড় এইসব সাপ্লাই করে যান।লোকজন চিরকালই পছন্দ করেন,
অন্নপূর্ণার আপত্তি থাকলেও..........।
প্রভাত বাবুর খেলার মাঠে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে।এদিক ওদিক পাড়া ঘুরে
ঘুরেই ক্লান্ত।রাতে চাঁদের দিকে দেখতেও আর ইচ্ছে হয় না।ঘুমিয়ে পড়েন তাড়াতাড়ি।
বিরোধী দলের রৌনকও তার প্রাক্তন ছাত্র,একদিন রাস্তায় ধরেছিল, 'স্যর আপনি
রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লেন? এটা কেমন যেন বেমানান।'
'কি করি বল? নওসিনের কথা একদম ফেলতে পারলুম নি রে।'
এই ক-দিনেই প্রভাত বাবুর ভালো টাকা খরচা হয়ে গেছে।সামনের মাসে প্রথম দিকেই
ভোট তাই মাইনে পেলে বাকিটা দেবে বলেছে।দায়িত্বটা সত্যি কঠিন মনে হচ্ছে
এখন।দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় নেই।মাঝ পথে হাল ছেড়ে দেবার মানুষ প্রভাত বাবু
নন।তবুও মনে আশা জিতলে অবশ্যই মানুষের জন্য কিছু করবেন।নওসিন সেইরকমই
বলেছে।দেখতে দেখতে প্রচারের দিন শেষ।ঘাড়ের কাছে ভোট শ্বাস ফেলছে।কাউন্টডাউন
শুরু।অন্নপূর্ণার মনে ভয়, মাস্টার যদি হেরে যায়।প্রভাত বাবুর মনেও এখন এই একই
ভয়, কি হবে?যদি হেরে যায় মুখ দেখাবে কি করে?এ যে ঘোর অপমান। রৌনকের কথাও মনে
আসে,ওরাও তো ছাত্র,আজ অন্য রঙে নিজেকে রাঙিয়ে অনেকেই পর হয়ে... ।আগে সবাই কাছে
ছিল এখন কেউ কেউ.......
ভোট মোটামুটি মিটল,লুটপাট, মারধর, বোমাবাজি সবই হয়েছে পরিকল্পনা মাফিক।এই রকম
পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হবে প্রভাত বাবু ভাবেননি।নিজেদের শান্তিপূর্ণ গ্রাম,
ভেতরে ভেতরে এতোটা বিদ্বেষ এত আগুন আন্দাজ করা যায়নি।চারিদিকে অশান্তির
বারুদ।আগে কিছু কিছু জায়গা সেনসিটিভ ছিল,এখন বাছার কিছু নেই।মনটাও ভালো নেই
প্রভাতবাবুর, ভিতরে ভিতরে কি যেন একটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।খুব অস্বস্তি, গোমড়া
মুখ। এই কদিনে বয়সটাও যেন বেড়ে গেছে।
মেয়ে প্রতিভা বাড়িতে এসে থেকে বাবাকে বলে যাচ্ছে, 'তুমি কেন এসবের মধ্যে যেতে
গেলে?দেশের পরিস্থিতি খুব ভয়ংকর, তুমি জিতলেও নিজে কিছু করতে পারবে এটা ভেবো
না,এই ধারনা ভুল।সব ওদের হাতে তুমি জিতলেও কিছু নিজের মতে করতে পারবে না।এখন
সাম্প্রদায়িকতার মায়াজালে সমাজের সব আদর্শ ডুবেছে।তুমি এখনকার সমাজব্যবস্থার
খোঁজ কতটুকু রাখো,তোমায় বলেছিলাম তো প্রথমেই'।অন্নপূর্ণাও তাল মেলালো।প্রভাত
বাবু চিরকালের মতই শান্ত,কি উত্তর দেবেন বুঝতে পারলেন না।প্রতিভা বলতেই থাকল,
'এত কিছু থাকতে তুমি রাজনীতি, উফ,পরশু আবার রেজাল্ট। এসবে আমার একদম মত
নেই।কি অবস্থা জানো মা? জীবন নিয়ে টানাটানি। এর পর আরও খারাপ কিছু হবে।আমার তো
ভয় পাচ্ছে,তোমরা একা থাকো,বাইরের কোনো খবর রাখো না।কালকে তরুন'দার সাথে দেখা
হতেই বলল -'কাকু আমাদের কিছু জানায় নি,নিজেই মনস্থির করেছে'। তোমরা বুঝতে
পারছোনা, তোমাদের চারদিকে শত্রু। অসহিষ্ণুতার শৈবালে আটকে আছো।'
প্রভাত বাবু আর চুপ থাকতে পারলেন না, বললেন, 'এতো কিছু বুঝে আমি যোগ
দিইনি,সারাজীবন তোদের কথা ভেবে সব দায়িত্বই পালন করেছি,যদিও কিছু ভুল করি তাতে
কিন্তু তোদের কোনো ক্ষতি হয়নি।আজও হতে দেবো না....'
প্রতিভা পরের দিনই চলে গেল,ভোট দিতেই এসেছিল।আগামীকাল ভোটের রেজাল্ট।ভোটের পর
থেকে দলের লোকেদের আনাগোনা বন্ধ,সব থমথমে। সদা হাস্য প্রভাত বাবুও
থমথমে.....।এবারে রিটায়ার্ড বয়স্ক মানুষ বলেই মনে হচ্ছে।ভোটে দাঁড়াবার পর থেকে
অনেকেই আর আগের মতো কথা বলেনা। চিন্তায় ভালো ভাবে খাওয়া দাওয়াও করেননা প্রভাত
বাবু।অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।
আজ সকালে ঝিমিয়ে যাওয়া গাছগুলোতে জল দিয়েছেন।স্নেহের হাত বুলিয়েছেন বিরুৎ
গুলির গায়ে।দুপুরবেলা ভোটের রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। বিপুল ভোটের ব্যবধানে প্রভাত
বাবু জিতেছেন।এদিকে প্রভাত বাবু সেই যে বেলায় টিফিন করে, ঘরে ঢুকে দরজা
দিয়েছেন অনেক ডাকাডাকিতেও খোলেননি।ব্যপারটা কি হয়েছে অন্নপূর্ণাও বুঝতে
পারেনি।দলের লোকেরা সময় মতো ফুল মালা নিয়ে হাজির, গাড়িও নিয়ে এসেছে। পাড়া
ঘোরানো হবে,সাজিয়ে।আবির খেলা হবে, বাজনাও রেডি।প্রভাত বাবু'র কোনো সাড়া নেই।
অনেক চেষ্টায় দরজা ভেঙে প্রভাত বাবুকে বের করে আনা হল।দুটো খোলা চোখে শান্তির
প্রলেপ।মহা সমারোহে বিজয়ী প্রার্থীকে পাড়া ঘুড়িয়ে পাড়ার শেষ প্রান্তের
চিরাচরিত শ্মশানে দাহ করা হল।এসব করতে বেশ রাত হল।অনেক মানুষ,অনেক ছাত্রছাত্রী
এসেছিল।মানুষটি জেতার খবর পর্যন্ত পেল না।কুণ্ডলীকৃত ধোঁয়ার উপর চাঁদের আলো
পড়তেই, প্রতিভা দেখল- একটা হাসি মুখ ফুটে উঠেছে।তার বাবা।হাত দুটো ছড়ানো, যেন
বলতে চাইছে 'আমি সবার কারও একার নয়,কোনো দলে নয়,নিরাকার .......'।
গ্রাম- ভূরসীট ব্রাহ্মণপাড়া
ডাক- মুন্সিরহাট
থানা- জগৎবল্লভপুর
জেলা- হাওড়া
৭১১৪১০
পেশা- শিক্ষিকতা
দূরাভাষ- ৭৯৮০৯২২৬৯২
ইমেইল -
sourav.ghosh1883@gmail.com
IMG-20180326-WA0054.jpg
<
https://drive.google.com/file/d/0B13G3CzHQE2Ncld3U1RvbF9CYUltaWpKRFFWcGs4bUwybU53/view?usp=drivesdk>
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন