অমেধাবী ছাত্র
--------------------
শিক্ষক এই শব্দের সাথে নানা রকম মানুষ ও পেশা জড়িত। নবপ্রভাত একটি
সাহিত্য সাইট। ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস উপলক্ষে একটি সাহিত্য সাইট প্রিয়
শিক্ষক সম্পর্কে ভাল মন্দ যেমন হোক লিখতে বলেছেন। আমরা যারা লিখিয়ে তাদের
কাছে শিক্ষক সম্পর্কে লেখা চাওয়া হয়েছে। ব্যাপারটা খুব একাডেমিক মনে হলেও
ব্যক্তি জীবনের সাথে সম্পর্কযুক্ত। মানুষের অমঙ্গল -মঙ্গলের সব বিষয়
ব্যক্তি সম্পর্কিত তো বটেই। কোনো না কোনো ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক অবশ্যই
থাকে। নব প্রভাত মেইল পাঠানোর পর প্রথম ভাবলাম একটা সাহিত্য সাইট আবার
সেই মাধ্যমিক স্কুলের বিশদ রচনা লেখার মত একজন আদর্শ শিক্ষকের রচনা লেখার
আয়োজন করছে কি কারণে। পরে অনেক চিন্তা করলাম না বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। নব
প্রভাত না বললে হয়ত এভাবে চিন্তাই মাথায় কাজ করতো না। একটা তাগিদ অনুভব
করলাম লেখার।
শিক্ষক শব্দের অর্থ কি। অত্যন্ত ব্যাপক সন্দেহাতীত ভাবেই। ছাত্রদের
ভেতরের শক্তিকে অনুধাবন করে সেই শক্তিকে এমনভাবে বিকশিত করার চেষ্টা করেন
যা তার সমস্ত জড়তাকে ভেঙ্গে স্বপ্নযাত্রার সূচনা ঘটায়। যিনি গন্তব্য নয়
বরং পথে হাঁটতে শেখান। যিনি সিদ্ধান্ত না দিয়ে শিখিয়ে দেন কত ভিন্ন
উপায়ে কত ভাবে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। যিনি সীমাবদ্ধতাকে দেরে ঠেলে
সম্ভাবনাকে প্রাধান্য দেন। বই বিহীন যিনি বাস্তবতার মুখোমুখি করেন। এখন
কথা হলো শিক্ষকের কাজ শিক্ষা দেয়া। তাহলে শিক্ষা কি ? শিক্ষা
প্রক্রিয়ায় কোন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য
উৎসাহ দেয়া হয় এবং সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের
জন্য যে সকল দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলো অর্জনে সহায়তা করা। সাধারণ অর্থে
জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগতভাবে জ্ঞানলাভের
প্রক্রিয়াকেই শিক্ষা বলে। তবে শিক্ষা হল সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ
সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে 'শাস' ধাতু থেকে।
যার অর্থ শাসন করা বা উপদেশ দান করা। অন্যদিকে শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ
এডুকেশন এসেছে ল্যাটিন শব্দ এডুকেয়ার বা এডুকাতুম থেকে। যার অর্থ বের
করে আনা অর্থাৎ ভেতরের সম্ভাবনাকে বাইরে বের করে নিয়ে আসা বা বিকশিত
করা। সক্রেটিসের ভাষায় "শিক্ষা হল মিথ্যার অপনোদন ও সত্যের বিকাশ।"
এরিস্টটল বলেন "সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা"। রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের ভাষায় "শিক্ষা হল তাই যা আমাদের কেবল তথ্য পরিবেশনই করে না
বিশ্বসত্তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমাদের জীবনকে গড়ে তোলে।"
মা হচ্ছে সব মানুষের জীবনে শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। জীবনের শুরুতেই যার কাছে
আমরা শিখি সেই শিক্ষকতো মা। মায়ের উপর আরো কোনো শিক্ষক নেই। মা ন্যায়
অন্যায় সব কিছুর মধ্যেই যেমন ভালোবাসেন, তেমনি শাসন করেন। তেমনি শিখিয়ে
দেন জীবনের প্রথম ধাপ।
হয়ত অনেকেই অনেক গভীর আর সমৃদ্ধ সব লেখা পাঠাবেন। আমার তো আসলে একাডেমিক
শিক্ষালয়ে খুব প্রিয় কোনো শিক্ষক নেই। কারণ হচ্ছে আমি ছাত্র হিসাবে কোনো
কালেই খুব মেধাবী ছিলাম না। আবার খুব দুষ্ট প্রকৃতিরও ছিলাম না। একাডেমিক
শিক্ষকরা এই দুই ক্যাটাগরীর ছাত্রদের বেশী মনে রাখেন। ভালদের মনে রাখে
তাদের মেধার জন্য; আর দুষ্টুদের তাদের দুষ্টুমির জন্য। আর এভারেজ মেধার
যারা তারা কারোর কাছেই তেমন জনপ্রিয় বা মনে রাখার মানুষ হয়ে ওঠে না।
প্রতিদিন কত কাজই মানুষ করে। মানুষ প্রতিনিয়ত শিখে। কাজেই শিক্ষক বললে
নানা ক্যাটগরীর মানুষ এসে যায়। আমার কাছে বিষয়টা সার্বজনীন অর্থে মনে
হচ্ছে ব্যক্তি মানুষের অনেক রকম শিক্ষক থাকে। ঘরে বাইরে মানুষ প্রতিনিয়তই
শেখার মধ্য দিয়েই বড় হচ্ছে এবং জীবন যাপন করছে আর জীবনকাল শেষ করছে।
অনেকেই হয়ত লিখবে তাদের প্রিয় শিক্ষককে নিয়ে। আমার তেমন প্রিয় কেউ নেই।
তবুও যাদের কাছ থেকে জীবন চলার জন্য একজন সাধারণ মানুষের জীবন ধারণের যে
সব মৌলিক উপকরণ দরকার তা নিয়েছি। তাদের কাছে জীবনভর ঋণী। আমার প্রাথমিক
বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে তাহের স্যার খুব নরম মনের ছিলেন। বাংলা
পড়াতেন। তিনি সব ছাত্রদেরই খুব স্নেহ আদর দিয়ে পড়াতেন। কোনো ভয় পেতাম না
এই স্যারকে। আর আমাদের সঙ্গে পড়তো স্কুলের সাথেই বাড়ী টিটুর আব্বা
ওয়াজিউল্যা স্যার। অংকের শিক্ষক ছিলেন। আমরা সবাই খুব ভয় পেতাম স্যারকে।
কিন্তু কোনদিন মারতেন না। তবুও ভয়। তিনি ছিলেন খুব লম্বা, লুঙ্গির সাথে
পাঞ্চাবী পরতেন। তখন আমি সম্ভবত ক্লাস থ্রি বা ফোর -এ পড়ি। টিফিন আওয়ার
যাদের বাড়ী কাছে তারা বাড়ী গেছে দুপুরের খাবার খেতে। যাদের দূরে তারা
স্কুলেই আছে। আমিও স্কুলেই আছি ক্লাসে। একদিন দুপুর বেলা কাছে বাড়ী
দুপুরের খাবার খেয়ে বোধ হয় স্যার ও টিটু আগে বাগে চলে এসেছে। ক্লাসে এসে
স্যার নির্দিষ্ট চেয়ার টেবিলে আর আমি আমার বেঞ্চিতে বসা। টিটু এসে ওর
বেঞ্চে বসলো। হঠাৎ টিটু যেন স্যারের কাছে গিয়ে স্যারকে কি বললো। স্যার
টেবিলের কাছে আমাকেও ডাকলেন। তখন স্যার একটা এক টাকার নোট বের করে উল্টো
করে ধরে আমাকে আর টিটুকে একক দশক শেখালেন। তখন আমরা ঠিক মত গুণতে পারতাম
না বা মনে থাকত না। উল্টো পাল্টা গুণে ফেলতাম। তো এটি আমার সব সময়ই মনে
হয়। স্যারকে সারাজীবন শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। ইংরেজীর শিক্ষক দুলাল স্যার।
সেই রকম কড়া আর রাগী স্যার। ওনার রাগের কারণে বউ বিষপানে আত্মহত্যা
করলেন। একবার ওনার মাইর খেয়ে অনেকেরই জ্বর এসে গেলো। আমিও জ্বরে পড়লাম।
এটা দেখে আমার নানা রেগে মেগে বললেন স্কুল খুললে আমি যাব হেড মাস্টারকে
বিচার দিবো। নানার শ্বশুর বাড়ীর লোক তিনি। নানার শ্যালকের ঘরে সাথে ঘর।
যাহোক পরে আমি না করলাম। নানা ক্ষান্ত হলেন।
মাধ্যমিক স্কুলের খুব প্রিয় কেউ নেই। মাধ্যমিকের শুরুর দিকে ক্লাসের
গার্হস্থ বিজ্ঞানের এক শিক্ষক ছিলেন। রুমার আম্মা, ওনার মেয়ের নাম রুমা।
ইংরেজীর শিক্ষক আয়েশা আপা আর এই আপার বাড়ী পাশাপাশি ছিলো। আয়েশা আপা আমার
ক্লাস বন্ধু মানন -এর কেমন ভাবী হতো। আমি আর মানন প্রায়ই স্কুল থেকে
ফিরতি পথে ও পথ দিয়ে যেতাম আয়েশা আপার বাড়ী বেড়াতাম কিছু সময় খেয়ে দেয়ে
বাড়ী ফিরতাম। রুমার আম্মা তিনি অন্য আরো কি কি বিষয় পড়াতেন মনে নেই। সেই
আপা এত স্মার্ট ছিলেন সবাই পছন্দ করতাম। এখন নামটা আর মনে করতে পারিনা।
ওনি ক্লাসে আসলে আমি শুধু বাচন ভঙ্গি দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। এতই ভাল লাগতো।
ক্লাস সিক্স সেভেন এই দুটি বছর আমি একই স্কুলে পড়ে স্কুল বদল করলাম।
স্বপন কুমার স্যারের কাছে অংক প্রাইভেট পড়তাম। তিনি মেয়ের মত মা মা করে
আমাদের অংক শেখাতেন। ক্লাসে তিনি অংক করাতেন না। তিনি বাংলা পড়াতেন। বড়
ক্লাসে একবার কারবার পদ্ধতি পড়ালেন। তিনি প্রায়ই আমার ছোট ভাইবোনদের কাছে
খোঁজ নিতেন আমার। কোথায় আছি। কেমন আছি ইত্যাদি। তিনি জানতেন আমি কবিতা
লিখি। আমি নতুন বই প্রকাশ হলে স্কুলের জন্য পাঠাতাম। তখন তিনি প্রধান
শিক্ষক ছিলেন। অংকের আর একজন দক্ষ শিক্ষক ছিলেন রাউত স্যার। বাবু ননী
গোপাল রাউত সেই রকম কড়া। স্কুলে তিনি কখনো বেত ব্যবহার করতেন না। তিনি
ডাষ্টারকেই শাস্তির উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করতেন। তার সেই ডাষ্টারের
ব্যবহার যার উপর হয়েছে। তার চরম শিক্ষা জীবনে। হাতের কনুই আর মাথার
একপাশে বিশেষ করে কপালের পাশে। একবার আমার ভাগ্যে জুটেছিল। সেই কপালে।
স্যার ভাল ভাবে উচ্চারণ করতে পারতেন না। ওনার মুখের অংশ পোড়া ছিলো।
হাসলেই মুখের থেকে লালা পড়তো। অংক না পারলে রেগে বলতো তোরা আজ থেকে সবাই
সালি (ছাঁই আঞ্চলিক উচ্চারণ সালি/ ছালি) খাবি, ভাত খাবি না, ভাত খাবি না।
আর বাড়ীতে তোদেরকে লাউয়ার (লাল পোকা মত আঞ্চলিক উচ্চারণ লাইয়্যা) বাসা
দিয়ে বেঁধে রাখতে বলবি। কিন্তু গণিতে এত ভাল দখল ছিলো। ভয়ে স্যারের কাছে
কখনো প্রাইভেট পড়িনি। স্যার শিক্ষকতার পাশাপাশি জুতার ব্যবসা করতেন ছুটির
পরে। ব্যাকরণ পড়াতেন বাবু রাধারমণ দাস। খুবই অমায়িক ব্যবহার ছিলো। একবার
ক্লাসে প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় বেশীর ভাগ ফেল করলো। ২/৩ জনের মধ্যে আমি
একজন যে পাশ করলাম। তারপর থেকে স্যার খুব স্নেহ করতেন। নতুন বিষয় হিসাব
বিজ্ঞান শুরু হলে তিনি এই বিষয়ও পড়াতেন। আমি একমাস প্রাইভেট পড়লাম
স্যারের কাছে। আরো অনেক স্যার ছিল এখনো অনেকেই আছেন। সবার কথাই মাঝে মাঝে
ভাইদের জিজ্ঞেস করি। অন্যদের মুখে শুনি।
কলেজ জীবনে সেই হৈমন্তী গল্প পড়াতেন খুব মজা করে ওবায়েদ স্যার। আমাদের
পাশের গ্রামে ওনার পৈতৃক বাড়ী। তারপর বদরুন্নেছা কলেজ। এখানে অনেক স্মৃতি
অনেকেরই সাথে। ইতিহাস বিভাগের সেলিনা হাবীব। সেলিনা আপা এতই স্নেহ করেন
যেনো তিনি বন্ধু। আপা এখনো রাস্তা ঘাটে কোথাও দেখা হলে বিশেষ করে আপাই
আমাকে দেখেন। কেন জানি আমি কখনো দেখি না ওনাকে। ওনি পিছন দিক থেকে আমার
ঘাড়ে ছোট একটা আদুরী ছাপ্পর মেরে হাসি মুখে সামনে এসে দাঁড়ান। মনে পড়ে
ইতিহাস বিভাগের সাবিহা আপা বিএনসিসি -তে আমাদের কলেজ ইউনিটের দায়িত্বে
ছিলেন। এসকার্সনে গেলাম সেই রকম মজা করলেন। এসকার্সনে গেলাম একই সাথে
ভূগোলের নাজমা আপা ছিলেন আরো অন্য রকম। শুধু ঘোরাঘুরি, হৈ হুল্লোড়।
ইতিহাস বিভাগের আনিস আপা এখনো রাস্তায় দূর থেকে দেখলে দাঁড়িয়ে যান ডাকতে
থাকেন। আর খেলার শিক্ষক আপা যেনো বন্ধু। এখনো দেখা হলে অনেক কথা বলেন।
ইফফাত আপা স্মার্ট আর কোমল মনের মানুষ। ছিলেন বাংলার খুরশীদ জাহান আপা
(পরে উপাধ্যক্ষ হয়েছেন), সমাজ বিজ্ঞানের সুলতানা আপা খুব স্নেহ করতেন
আমাদের। রাষ্ট্র বিজ্ঞানের রওশন আপা (প্রয়াত) শুধুই শৈশব কৈশোরের গল্প
বলতেন পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু রাগীও ছিলেন খুব। বদরুন্নেছা কলেজে
আমাদের গ্রুপটা ছিল খুব দুষ্টু প্রকৃতির। গাছের আম, কাঁঠাল, ফেয়ারা, আর
কলা কোনোটাই বাদ থাকত না। রাতে নতুন বিন্ডিংয়ের ছাদের আড্ডা। দিনে আমরা
খুবই সহজ সরল ছিলাম। ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকারের বান্ধবী // অধ্যক্ষ
// ছিলেন। আমাদের গ্রুপটাকে মোটেও দেখতে পারতেন না। একবার ওনাকে অফিস
কক্ষে আটকে রাখলাম। ওনি মেয়েদের খুব বাজে একটা গালি দিয়েছেন। সেই জন্য
আটকে রাখলাম ২ ঘন্টা, টেলিফোনের তার বিদু্্যতের তার পানির লাইন সব কেটে
দিলাম। অফিস রুমের সব কাঁচ ভেঙ্গে চুরে একাকার। তারপর তিন মাসের মধ্যে
বদলী। টেলিফোনের লাইনটা কাটলো সিরাজগঞ্জের ছোট জয়া কাঁঠালি চাঁপার চিকন
একটা গাছ ছিলো অফিস বিল্ডিং লাগোয়া ওটার উপর দিয়ে ওঠে। আমাদের তপ্ত আগুন
উস্কে দিলেন ইংরেজী বিভাগের প্রধান প্রফেসর শাহেদা ওবায়েদ আপা। অনেক
সুন্দর আর স্মার্ট ছিলেন শাহেদা আপা। মাঠের পাশে কত গুলো ভাঙ্গ ইটের আদলা
ছিলো। বললো এগুলো আছে কিসের জন্য। তারপর আর কি রক্ষে আছে অধ্যক্ষ বের
হবার সময় তার গাড়ীতে রাস্তা পর্যন্ত সেই ইটের আদলা মেরে মেয়েরা রাস্তায়
ইট সুড়কিতে ভরিয়ে ফেললো। আর অধ্যক্ষ নিলুফার হুদা আপা এবং ফাহিমা খাতুন
আপা আমরা ছাত্রলীগ করতাম যারা আমাদের কেন জানি খুব একটা পছন্দ করতেন না।
এরা আমাদের একটা বিরুদ্ধ গ্রুপ ছিলো আর বিএনপি করতো যারা তাদের আবার খুব
পছন্দ করতো।
কলেজে প্রথম ১৯৯৭ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার এই প্রিয়
বিদ্যাপীঠে আসবেন। তখন এই ফাহিমা আপা সবকিছুর হর্তাকর্তা। তিনি হঠাৎ
আমাদের ঢুকতে দিবেন না বলে দিলেন। তখন আমি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি।
আমাদের কোনো পাত্তাই দিলেন না। দলীয় এবং সাধারণ মেয়েরা সবাই আমাকে গিয়ে
ধরলো। এটা কেমন কথা, আমাদের কলেজ আমাদের ঢুকতে দিবে না। তখন বাহাউদ্দিন
নাসিম ভাইকে ফোন দিলাম এবং বললাম এই ঘটনা। তো তিনি সেদিন কিছু বললেন না।
আর একদিন মাত্র সময়। মেজাজটা খুব খারাপ। হোস্টেলের মেয়েরা পিছন দিকে হল
সুপারের গেট দিয়ে যাতায়াত করবে। কলেজের ভেতরের এই গেট বন্ধ করে দিলো।
আগের দিন সন্ধ্যায় নাসিম ভাই ফোন দিলেন আমাদের লালবাগের কার কাছে যেনো
ফোন ছিলো তার ফোনের মাধ্যমে। ফোন তখন কেবল আসছে খুব দামী। আমাদের কারো
কাছেই মোবাইল নেই। আমি রাগে গজ গজ করতে থাকলাম। এমন সময়ে আমার হাতে ফোন
দিলো নাসিম ভাই ফোনের ওপারে। আমিতো উত্তেজিৎ। নাসিম ভাই আমাকে ক্ষেপিয়ে
দিয়ে বললেন আপনি কে ? আমি আরো রেগে বললাম আমি এই কলেজের প্রেসিডেন্ট,
আপনি কে ? কালকে ঢুকতে না দিলে সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিবো। দেখি কে কি
করেন। তারপর যা হোক নাসিম ভাই পরে আমাকে শান্ত করলেন। বললেন কলেজ মাঠ
ছোট, জায়গা হবে না বেশী লোকের। তো যারা ঢুকবে সবার নাম লিষ্ট করো। নামের
লিস্ট দিয়ে দাও। লিস্ট অনুযায়ী ঢুকবে। যাহোক আমরা ঢুকলাম। কিন্তু আমাদের
মুল মাঠে ঢুকতে দিলো না; ফাহিমা আপার নির্দেশ । একটা ব্যারিকেড ছিলো সেটা
কিছুতেই পার হতে দিলো না। আমরা ছাত্রলীগ কলেজ মাঠে কোনো অনুষ্ঠান করতে
চাইলে অনুমতি দিতো না অধ্যক্ষ। তখন অডিটোরিয়ামের জায়গাটা পাওয়া যায়নি। সব
অনুষ্ঠান এই কলেজ মাঠই সম্বল। তো আমি পনের আগষ্টের জাতীয় শোক দিবস
অনুষ্ঠান করবো। প্যান্ডেল হলো কোনে শিক্ষককে বলিনি। মাঠে অনুষ্ঠান যার
খুশি আসবেন। কারণ তখন আমাদের এই ধরণের কোনো অনুষ্ঠানই করতে দেয়া হতো না।
পরে অনুষ্ঠানে মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ভাই এবং ওবায়দুল কাদের ভাই আসলেন।
দেখে অনেক শিক্ষকই স্বেচ্ছায় এসে প্যান্ডেলে বসলেন। ফাহিমা আপা অনুষ্ঠান
শেষে কিছুটা রাগত স্বরে বললেন কেন আগে বললাম না। আমি কোনো কথার উত্তর
দেইনি। মনে মনে বললাম বললে কি হতো। শুধু দাঁড়িয়ে ওনার সাথে কয়েকজন মিলে
ছবি তুললাম।
জীবনে অনেক শিক্ষক পেলাম সবার কাছেই ঋণী। এখন কবিতাকর্মী। এখন সংসারী।
সংসারে একজন কর্তা সবার থাকে। কোথাও কোথাও কর্তারা বেশী কর্তিত্ব করে
থাকেন। কিন্তু কোথাও কোথাও গিন্নীরা বেশী কর্তিত্ব করে থাকেন। আবার কোথাও
সমঝোতা দুজনেই সময়ে সময়ে বিষয়ানুযায়ী এই কর্তিত্ব করে থাকেন। সংসারে সবাই
সবাইকে মানতে হয়, বুঝতে হয়, সমঝোতা থাকতে হয়। তবেই তো সুখে থাকা, নয়তো
সারাক্ষণই অসুখ ও অস্থির থাকতে হয়। জীবন জড়িয়ে গেলে কারো সাথে মেনে নিতে
হয় অনেক কিছু। তাই সমঝোতাই কিছুটা সমাধান। তবে মানুষের জীবন যাত্রা ও
প্রাগ্রসর বিজ্ঞানের নতুন আবিস্কার মানুষকে এখন অনেক সচেতন করে তুলেছে।
এই জন্য মানুষের চিন্তা চেতনায় প্রভূত পরিবর্তন এসেছে। তাই কর্তা আর একক
ভাবে যাই খুশি তা ছাপিয়ে দিতে পারেন না। এই জন্য নারী পুরুষ উভয়েরই মনে
মুল্য আছে, কথার মূল্য আছে, কাজের মূল্য আছে উভয়ের কাছে, পরিবারের কাছে,
সর্বোপরি সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। আর তাই জীবন যার সাথে জড়িযে গেছে তার
কথার মূল্য দিতে হয় ক্ষেত্র বিশেষে। কখনো কখনো মনে আমাকে অনেক বিষয়ে
মূল্যায়ণ করে। তাই তাকে মানতে হয়। আবার অনেক সংকট মূর্হুতে তার দিক্
নির্দেশনা একটা আশার জায়গা তৈরী করে। তখন তাকে শিক্ষকই মনে হয়। এই
শিক্ষকের মূল্যও কম নয় জীবনে। ধন্যবাদ আজাদ। আর কবিতার বেলায় অনেকেই বলেন
কবিতার আবার শিক্ষক কি ? না এটা আমি মানতে পারি না। এটা যারা নাম ধাম করে
ওস্তাদ হয়েছেন তারা মানেন না। তারা আবার পন্ডিতে পন্ডিতে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি
আছে। কথায় আছে না পান্ডিত্যের অহংকারে দুই পন্ডিত এক জায়গা থাকতে পারে
না। কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রেও শিক্ষক আছেন। বড়রা ছোটদের নানা বিষয়ে দিক্
নির্দেশনা দেন। বড়দের জীবনের অভিজ্ঞতা গুলো ছোট জানিয়ে তাদের সচেতন করে
তোলেন। যখন কবিতাকর্মী অনুপ্রাসের সাথে যুক্ত হয়ে একজন শিক্ষক পেয়েছি।
কবি ও সাংবাদিক শেখ সামসুল হক। ওনার অসংখ্য কবিতার ছাত্র আছে। তার মধ্যে
আমিও একজন। বিজ্ঞান কবিতা লেখার ব্যপারে ওনার নির্দেশনা ছিল অসাধারণ। ওনি
নতুন লিখিয়েদের কবিতা স্বয়ং কবির চেয়ে বেশী যত্ন করে শোনেন এবং পড়েন আর
মতামত দিয়ে সেটাকে কবিতা হবার যোগ্য করে তোলেন। তিনি কোনো বড় হবার
স্বীকৃতি কখনো চাননি, প্রচার চাননি, কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য
কোনো দিনও চেষ্টা করেননি। নিলোর্ভ মানুষ। তাই তিনি কবিতার জায়গায় আমার
কাছে শিক্ষকের মর্যাদা পেয়েছেন। কবিতার কাছে তারাও আমার শিক্ষক যারা আমার
কবিতার বুঝদার কঠোর সমালোচক। আমার অগ্রজ যারা আমার লেখার প্রেরণা হয়ে
থাকেন কবিতার প্রতি লাইনে তারা সকলেই আমার শিক্ষক।
মাইকেল-বিহারীলাল-লালন- রবীন্দ্র-জীবনানন্দ-বিষ্ণুদে-নজরুল-সুকান্ত সবাই
শিক্ষক। আর রাজনৈতিক ভাবে একজনই শিক্ষক বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান। জীবনের সর্বস্তরে যারা নীতি, নৈতিকতা ও মানবিকতা
শিখিয়েছেন তাদের সবার কাছেই আমার ঋণ সব সময়। সব শিক্ষককেই শ্রদ্ধা জানাই।
আর তাই সেই শিক্ষকের কথাই বলবো : সুনির্মল বসু'র ''সবার আমি ছাত্র"
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল
উদার হতে ভাই রে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি
বায়ুর কাছে পাই রে।
পাহাড় শিখায় তাহার সমান-
হই যেন ভাই মৌন-মহান,
খোলা মাঠের উপদেশে-
দিল-খোলা হই তাই রে।
সূর্য আমায় মন্ত্রণা দেয়
আপন তেজে জ্বলতে,
চাঁদ শিখাল হাসতে মোরে,
মধুর কথা বলতে।
ইঙ্গিতে তার শিখায় সাগর-
অন্তর হোক রত্ন-আকর;
নদীর কাছে শিক্ষা পেলাম
আপন বেগে চলতে।
মাটির কাছে সহিষ্ণুতা
পেলাম আমি শিক্ষা,
আপন কাজে কঠোর হতে
পাষান দিল দীক্ষা।
ঝরনা তাহার সহজ গানে,
গান জাগাল আমার প্রাণে;
শ্যাম বনানী সরসতা
আমায় দিল ভিক্ষা।
বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর,
সবার আমি ছাত্র,
নানান ভাবে নতুন জিনিস
শিখছি দিবারাত্র।
এই পৃথিবীর বিরাট খাতায়,
পাঠ্য যেসব পাতায় পাতায়
শিখছি সে সব কৌতূহলে,
নেই দ্বিধা লেশমাত্র।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথা- "শুধু নিয়ো না- দিও, কারণ যে
শুধু নেয় সে খায় ভাল; কিন্তু যে দেয় সে ঘুমায় ভালো। " শান্তিতে ঘুমাবার
শিক্ষাটাই যেনো ধরে রাখতে পারি সেটাই চেষ্টা করে যাই। আমার সব শিক্ষকগণ
ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন সেই প্রত্যাশা।
সংক্ষিপ্ত পরিচিত :
-----------------------------
রীনা তালুকদার নব্বই দশকের কবি , প্রাবন্ধিক। মহাসচিব- অনুপ্রাস জাতীয়
কবি সংগঠন। বিভাগীয় সম্পাদক-অনুপ্রাস সাহিত্য পাতা দৈনিক নব অভিযান,
দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা ও সাপ্তাহিক কালধারা। সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান
কবিতা পরিষদ।
সাবেক সভাপতি, বদরুন্নেসা কলেজ ও সাবেক সহ-সভাপতি, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ)
ছাত্রলীগ। বাবা -মো: আবদুল করিম। মাতা- আনোয়ারা বেগম। পড়াশুনা- এম.এ।
জন্ম -২১ আগস্ট, ১৯৭৩, জেলা- লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ১৩টি, গবেষণা প্রবন্ধ-২টি (বিজ্ঞান কবিতার ভাবনা
ও কাব্য কথায় ইলিশ), সম্পাদনা কাব্যগ্রন্থ-১টি, সহযোগী সম্পাদনা
(বিষয়ভিত্তিক)- ১১টি।জাগ্রত ছোট কাগজের সম্পাদক। উল্লেখযোগ্য
কাব্যগ্রন্থ- সাত মার্চ শব্দের ডিনামাইট (বঙ্গবন্ধু সিরিজ), বিজ্ঞান
কবিতা, প্রেমের বিজ্ঞান কবিতা, স্বাধীনতা মঙ্গলে, বিজ্ঞান সনেট। বর্তমান
সময়ে তিনি বিজ্ঞান সমন্বয়ে কবিতাকে নতুনত্ব দিয়েছেন। প্রথম কাব্যগ্রন্থ
প্রকাশ হয় নব্বই দশকে।
লেখালেখির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা কামাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন-এর
মহান বিজয় দিবস-২০১১ সম্মাননা ও সাপ্তাহিক শারদীয়া কাব্যলোক বিশেষ
সম্মাননা-২০১৩ পেয়েছেন।
ঠিকানা: এ-২, বাণিজ্যবিতান সুপারমার্কেট, ইস্টকর্ণার, ২য়তলা, নীলক্ষেত,
ঢাকা-১২০৫, বাংলাদেশ। ইমেইল-
rinakobi@yahoo.com ফোন:- 01716676350 ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন