কৃষক-বন্ধু রবীন্দ্রনাথ
প্রকৃতি আমাদের মা। পরম প্রকৃতির দানেই জীব-জগতের আবির্ভাব,লালন-পালন। কিন্তু বুদ্ধিমান নাকি বুদ্ধুমান মানুষেরা সেই প্রকৃতিই করছে দূষিত। সবুজ জঙ্গল কেটে বানাচ্ছে কংক্রিটের জঙ্গল। সবুজ গাছ উধাও হলে যে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্কট হবে তা রবীন্দ্রনাথ সে যুগেই মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন, তাই প্রবর্তন করেছিলেন বৃক্ষরোপণ উৎসবের। সেকথা আমরা সবাই জানি, কিন্তু যা অনেকেই জানি না তা হল যে পল্লী বাংলার দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে এতটাই ভাবিয়ে তুলেছিল যে তিনি সক্রিয়ভাবে পল্লীবাংলার উন্নতিতে মনোনিবেশ করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন যে দেশে কোন কৃষি-বিদ্যালয় নেই, নেই কোন সরকারি কৃষিনীতি। তাই রবীন্দ্রনাথ কবি ও কৃষিবিদ্ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সহযোগিতায় শিলাইদহে আলুর চাষ শুরু করেছিলেন। প্রথমবার এই কৃষিকাজে সাফল্য তাঁর আসেনি। প্রচুর ব্যাঙ্গ-কৌতুকের বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি পুনরায় ঐ কাজে ব্রতী হলেন। এবার আলুচাষে এল সাফল্য। আজকে বাংলার যে ফসলটির ওপর আমরা অনেকটাই নির্ভর করি সেই আলুর বিজ্ঞানসম্মতভাবে চাষের প্রথম প্রবর্তনের জন্যও আমরা রবীন্দ্রনাথকে একজন দরদী, আধুনিকমনস্ক কৃষকবন্ধু হিসেবে মনের খাতায় অবশ্যই লিখে রাখতে পারি। সত্যি তিনি তাঁর বিশাল, বিস্ময়কর সাহিত্যচর্চার সাথে সাথে এত সক্রিয়ভাবে বিপুল কর্মকাণ্ড করার সময় কখন, কিভাবে পেলেন! ১৮৯৯ এর ২৪শে জুন তাঁর এক চিঠিতে তিনি লিখেছেন,''আমার চাষবাসের কাজ মন্দ চলিতেছে না, আমেরিকান ভুট্টার বীজ আনাইয়াছিলাম, তাহার গাছগুলো দ্রুতবেগে বাড়িয়া উঠিতেছে। মাঝারি সরু ধান রোপণ করাইয়াছি, তাহাতে কোন অংশে নিরাশ হইবার কারণ দেখিতেছি না।''
ক্রমে নানা জিনিস চাষাবাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ রেশম চাষেও উদ্যোগী হয়েছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি রাজশাহী জেলার কালিগ্রামে রেশম চাষের সূচনা করেছিলেন। শুধু এতেই ক্ষান্ত হননি। গ্রামের ছেলেরা যাতে এবিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে তাই তিনি রাজশাহী ডায়মণ্ড জুবিলি স্কুলে ছাত্রদের বৃত্তির ব্যবস্থা করলেন।
নিজের চাষবাস নিয়ে চিন্তাভাবনাকে আরও আধুনিক আরও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে পরবর্তী প্রজন্মগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়াসে তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রথীন্দ্রনাথকে পাঠালেন আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যা পড়তে। কিছুদিন পরে তাঁর ছোট জামাতা নগেন্দ্রনাথও তাঁরই অনুপ্রেরণায় গিয়েছিলেন কৃষিবিদ্যা শিখতে। ফিরে এসে রথীন্দ্রনাথ পিতার ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণায় পতিসরে তাঁদের জমিদারীতে চাষবাসের উন্নতি পুরদমে শুরু করলেন। তিনি আমেরিকান ভুট্টা, আলু, টম্যাটোর চাষ করলেন। এমনকি আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সহযোগিতায় জমি চাষ করার জন্য ট্রাক্টর পর্যন্ত কেনা হয়েছিল এবং সেই ট্রাক্টরটি নিজের হাতে চালিয়েছিলেন কবিপুত্র রথীন ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের মহান ব্যক্তিত্বের স্নেহধন্য শিলাইদহ, শাহাজাদপুর, পতিসরের মাটি। নিজে জমিদার হয়েও নিপীড়ক জোতদার ভূস্বামীর বিরুদ্ধে কবি লড়াই চালিয়েছিলেন। কালীনাথ পরগণায় চাষীদের তখনকার দিনের তিনলক্ষ টাকা 'ওজরীকর' বা আপত্তিকর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মুকুব করে দিয়েছিলেন। ঐ এস্টেটের ম্যানেজার প্রমথ চৌধুরী (বীরবল) এই মহানচেতা জমিদার রবিকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,'বাংলার জমিদার মাত্রেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নন। রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে যেমন,জমিদার হিসেবে তেমনই 'ইউনিক',আমি সেইসব জমিদারের কথা বলছি যারা শতকরা নিরানব্বই।' বীরবলের সেই 'ইউনিক' জমিদার মহান রবি মহাজনের শোষণ থেকে প্রজাদের বাঁচানোর জন্যে পতিসারে কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করে নোবেল পুরষ্কারের জন্য প্রাপ্ত একলক্ষ আট হাজার টাকা অর্পণ করলেন সেই কৃষিব্যাঙ্কে, কম সুদে চাষীদের ঋণ দেবেন বলে। সত্যি, এমন প্রজাবৎসল চাষী-বন্ধু পাওয়া বিরল দৃষ্টান্ত যখন আমরা দেখলাম সে যুগে যে যুগে শতকরা নিরানব্বই ভাগ জমিদারই ছিলেন প্রজাশোষণকারী।
পতিসারে জমিচাষের সময় রবীন্দ্রনাথ কৃষিকার্যের উন্নতির পথে অন্তরায়গুলি যে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তা তাঁর এই লেখাটি পড়লেই আমরা জানতে পারব। ''....এক জেলা এক ফসলের দেশ। সেখানে ধান উৎপাদন করতে চাষিরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে। তারপর তাদের ভিটের জমিতে তারা অবসরকালে সবজি উৎপাদন করতে আরও উৎসাহ দিয়েছিলুম, ফল পাইনি।"
হেমন্তবালা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,'সাহিত্যের বইয়ের চেয়ে বিজ্ঞানের বই আমি বেশি পড়ে থাকি। আমার রচনায় যদি এ অনুরাগ রূপ ধারণ করে, তোমরা তার সম্ভোগ থেকে বঞ্চিত হবে না।" বিজ্ঞানের আলোয় আলোকিত রবীন্দ্রনাথ কৃষিকার্যে বিজ্ঞানের প্রসার ঘটিয়ে ফসল বেশী উৎপাদনে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছিলেন। তাঁর মতে,'আমাদের দেশের চাষের ক্ষেত্রের উপর সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞানের আলো ফেলিবার দিন আসিয়াছে। আজ শুধু একলা চাষির চাষ করিবার দিন নাই,আজ তাহার সঙ্গে বিজ্ঞানকে,বৈজ্ঞানিককে যোগ দিতে হবে।' তিনি কৃষিকার্যে আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয়তা সেই যুগেই উপলব্ধি করেছিলেন। বিজ্ঞানমনস্ক রবীন্দ্রনাথের লেখায় তার সুস্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়।– 'মানুষ যেমন একদিন হাল-লাঙলকে, চরকা-তাঁতকে, তির-ধনুককে, চক্রবান যানবাহনকে গ্রহণ করে তাকে নিজের জীবনযাত্রায় অনুগত করেছিলেন, আধুনিক যন্ত্রকেও আমাদের সেইরকম করতে হবে। যন্ত্রে যারা পিছিয়ে আছে, অগ্রবর্তীদের সঙ্গে তারা কোনমতেই পেরে উঠবে না।' সেই যুগেই তিনি কৃষি নিয়ে যা চিন্তা ভাবনা করে গেছেন তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক।তাঁর সেই বিজ্ঞানসম্মত কৃষিভাবনা তিনি সক্রিয়ভাবে প্রয়োগ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর একটি পত্র থেকে আমরা তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন পাই।''...Please encourage them to grow in their homestead land. On the bounderies of the fields and where ever possible pine-apples, bananas, date palm, other fruit trees. Good and strong fibres can be obtained from leaves of pine-apple. The fruit is also easily marketable. Tapioca can be grown as hedger and tenants should be taught how to extract food materials from its roots. It would be profitable if they could be inducted to cultivate potatoes. Try again to sow the seeds of the American Maize which I have kept in the office." পর্যায়ক্রমিক শস্য চাষের গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ তাঁর কৃষিবিজ্ঞানভিত্তিক গভীর জ্ঞান থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। বাজার চাহিদা অনুযায়ীও পরিবর্তিত শস্য চাষে মনোযোগী হয়েছিলেন।
শ্রীনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষিবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণের বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন ও কৃষিব্যাঙ্কও চালু করেছিলেন। সার, বীজ, সেচ প্রক্রিয়ার বিজ্ঞানসম্মত প্রশিক্ষণের সাথে চলল ধান, আলু, আখ, বিট, গাজর, ভুট্টা, আনারস, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, টম্যাটো, কলাই, ফুলকপি, সয়াবিন প্রভৃতি ফসলের চাষবাস জোরকদমে। এখানেই শেষ নয় শ্রীনিকেতনের কৃষিবিদ্যায় প্রশিক্ষন-প্রাপ্তরা রবীন্দ্রনাথের প্রচেষ্টায় আরও আশেপাশের গ্রামে গিয়ে চাষীদের হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে চাষেবাদে আমূল পরিবর্তন এনে পশ্চিমবঙ্গে সবুজ বিপ্লবের সূচনা সেই যুগেই করতে ব্রতী হয়েছিলেন। কৃষকদের মধ্যে উতসাহ-উদ্দীপনা সঞ্চারের জন্য তিনি মাঘ মেলায় চাষীদের উৎপাদিত ফসলের প্রতিযোগিতা, প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের এক সুন্দর ও অভিনব পন্থা গ্রহণ করেছিলেন।
ঘরে ঘরে যেমন রবীন্দ্র সংগীত, কবিতা, নাটক, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ পৌঁছে গেছে, তেমনই সব চাষীর ঘরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চাষবাস সম্মন্ধে নতুন বার্তা পৌঁছে দেবার চেষ্টা শুরু হল। বিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত, প্রজাদের দুঃখে দুঃখিত, জমিতে নতুন বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ এ যেন আর এক নতুন রবি- তাঁর হিরে-পান্না খচিত মুকুটে যেন আর এক রত্ন। আমরা ধন্য, বাংলা ধন্য, ভারত ধন্য, সমগ্র বিশ্ব ধন্য এমন এক বিরল জিনসজ্জায় সজ্জিত অতিমানবের জন্মের পরমলগ্নের জন্য।
আবার কবে কিরণ দেবে তোমার মত রবি
লেখার কাটাকুটি থেকে আঁকলে নানান ছবি।
কৃষিবিদ্যা, পশুপালন তাতেও সজাগ দৃষ্টি-
বহুমুখী রবীন্দ্রনাথ এক অসাধারণ সৃষ্টি।
================================
ডঃ রমলা মুখার্জী
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী
হুগলী, ৭১২১৩৪