দুখু মিয়া কবি
————————
দুখু মিয়া কবি l আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম l আদ্যন্ত দুখী এক পরিবারে জন্মেছিলেন l সম্বল ছিল একটা বাঁশের বাঁশি l খিদে ভুলতে তাতেই সুর তুলতেন l মধ্যদুপুর অতিক্রান্ত বিকেলের বাতাস সে সুর বয়ে যেত বহু দূর l ঘাট থেকে ঘাটে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে l
একদিন সেই বাঁশিকে সম্বল করে ঢুকে পড়লেন লেটোর যাত্রাদলে l শুরু হল ভ্রাম্যমান জীবন l জনপদ মুখরিত হল তাঁর বাঁশির সুরে l পালার কাহিনী থেকে জীবনের পাঠ শিখে নিলেন l শুরু হল স্ব-শিক্ষার ভিত্তিস্থাপন l পরে নিজের চেষ্টায় আরবি, আর ফারসি শিখেছিলেন করাচি সেনানিবাসে এক পাঞ্জাবী মেজরের কাছে l নিজেই ব্যঙ্গ করে লিখেছেন একসময়—
'বিলেত ফেরনি?' প্রবাসী-বন্ধু ক'ন্, 'এই তব বিদ্যে ছি !'
ছি! ছিল তাঁর সারাটা জীবন l হিন্দুরা বলেছেন 'নেড়ে', মুসলমানরা বলেছেন 'কাফের' l অথচ তাঁর মত উদার সর্ব-মানবিক সংস্কারমুক্ত সত্যিকার সাম্যবাদী মানুষ বিশ শতকে কমই জন্মেছেন l
"গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান !"
নারী-পুরুষে সমানাধিকার চেয়েছিলেন l "আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই !"
কুলি-মজুর, শ্রমিক, চাষী সবাইকে শোষিত মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন l তাদের শোষণের অবসান চেয়েছিলেন l
"প্রার্থনা করো—যারা কেড়ে খায় তেত্রিশকোটী মুখের গ্রাস / যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ !"
সর্বহারা মানুষের দুঃখে প্রাণ কাঁদত l কেননা নিজেও তো ছিলেন এক দুঃখী বঞ্চিত আর ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষ l সখেদে বলেছিলেন, "আমি কবি হতে আসিনি, শিল্পী হতে আসিনি ; আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, প্রেম পেতে এসেছিলাম l পেলাম না বলে নীরব অভিমানে এই প্রেমহীন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিলাম l"
অদ্ভুত সমাপতন l এর পরই কবি চিরমূক পৃথিবীতে চলে গেলেন l
আমার কাছে তাই নজরুলের বিদ্রোহী কবি-সত্তা, তাঁর স্বাধীনতা সংগ্রামী সত্তা, সুরকার সত্তার চেয়ে প্রেমিক সত্তা বেশি আদরের l ধূমকেতুর কবির অগ্নি-বীণার ঝংকারের চেয়ে ব্যক্তি-কবির নীরব অশ্রুমোচন বেশি দামি বলে মনে হয় l আজীবন দুঃখের সঙ্গে লড়েছেন l আত্মভোলা সংগীত-পাগল কবিকে এক বোতল সুরা আর এক ডিব্বা পান দিয়ে সারাদিন ধরে গান লেখানো, সুর দেওয়া, আবার সারারাত ধরে সেই গান শিল্পীর গলায় তুলে দেওয়ার মত শ্রমসাধ্য মহড়াও দিতে হয়েছে গ্রামোফোন কোম্পানীর কর্তাদের কথায় l
অসুস্থ পক্ষাঘাতগ্রস্ত স্ত্রী প্রমীলাদেবীর চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতে কবি যখন দিশেহারা, তখন খুব কম টাকায় সমস্ত বই ও গানের কপি রাইট কিনে নিয়ে ছিলেন ডি এম লাইব্রেরির মালিক l স্ত্রীর সুস্থতা তখন তাঁর কাছে একমাত্র কাম্য ছিল l আমরা দেখলাম এক চিরকালীন প্রেমিক নজরুলকে l
সুন্দরের পূজারি ছিলেন তিনি l সত্য আর ন্যায়ের সাধক l আকাশের মত উদার আর নির্মল l ঠিক যেন আর এক লালন l জাতিভেদ, বর্ণভেদ, উঁচুনীচু—এসব তিনি মানতেন না l নারী-পুরুষ ভেদ করতেন না। খোদা ভগবান সব তাঁর কাছে একাকার। লিখেছেন—
"শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও সখা সত্য সিন্ধু জলে !"
সারাটা জীবন দুঃখের সাথে লড়াই করে শেষে বাক্যহারা নীরব হল বাঁশি l সুর কিন্তু হারালো না l হাজার হাজার কবিতা আর গানে সে সুর অক্ষয় করে গেলেন l
বড় ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ এই দামাল কবিকে l বুকে আগলে রাখতে চেয়েছিলেন l কিন্তু বড়ই চঞ্চল আর সুদূরের পিয়সী ছিলেন নজরুল l আজন্ম বোহেমিয়ান, তাকে বাঁধবে কে? তাঁর কবিতার ছন্দে পাই কবির সেই উন্মত্ত দামাল প্রকৃতির ছোঁয়া l এমন মানবিক, এমন সংস্কারমুক্ত সুরেলা কবি রবীন্দ্রনাথের পরেই তিনি l
তাই তিনি যেমন বিদ্রোহের, প্রতিবাদের, ঔদ্ধত্য আর প্রবল ভাঙনের কবি l তেমনই প্রেমের কবি, কাঙাল কবি, সুন্দর আর সত্যের কবি, ফুল আর গুলবাগিচার কবি l আমাদের নজরুল দুখু মিয়া কবি !
—————
রবীন বসু
Rabindra nath Basu
189/9, Kasba Road, 2nd Floor, Flat no. 5
Kolkata-700042, Ph- 9433552421