" না বদলানো দৃষ্টিভঙ্গি"
সমতার বুলি আওড়ানো এই বিপুল গণতান্ত্রিক দেশে নারী,পুরুষ নিয়ে ভেদাভেদ করা ঠিক নয়। সকলকেই যোগ্য সম্মান,সুযোগ দেওয়া উচিত এই কথার যে কোনো সারবত্তা নেই তা মোটেও নয়। সমতার প্রশ্নে সত্যিই নারী-পুরুষ উভয়েই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কায়িক পরিশ্রম বা বুদ্ধিদৃপ্ততায় অস্তিত্বের লড়াইয়ে শামিল,সেটা নিজেদের বেঁচে থাকার তাগিদেই হোক আর সমাজ,সংসারের উন্নয়নের স্বার্থে । মাঠে-ঘাটে চাষের কাজ কিংবা স্কুল-কলেজ,অফিস-আদালত সর্বত্র সব রকম অনুকূল,প্রতিকূল পরিস্থতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে এমনকি জল,স্থল,অন্তরীক্ষ সব জায়গায় নিজেদের পারদর্শিতার বলিষ্ঠ ছাপ রেখে চলেছে আজকের নারী পুরুষ ।
আপাত দৃষ্টিতে এ এক দারুণ সাফল্য বলে যতই গলা ফাটাই না কেন ,পুরুষতান্ত্রিকতার ফাঁস এখনো সমাজের মনন চিন্তনে,রন্ধ্রে,মজ্জায় শাখা প্রশাখা মেলেই চলেছে। জীবনে নারীর প্রতি সম্মান রাখতে হবে ,রাখা উচিত ,নারী হলো মা, জননীর সমার্থক এসব ভাবনা বজায় রেখেও,
একটু বেগতিক কিছু ঘটনা ঘটলেই,নিজের ভেতর থেকে আবর্জনার দূষিত ভাবনাগুলো বমি করে দিতে পুরুষের বাধে না । ঘটনার আড়ালে হারিয়ে যায় সত্যিকারের দেশ, রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ খবর সমূহ ।আধুনিকতার জোরালো প্রভাবে এই সমাজ ব্যবস্থায় উন্নতি এতটাই হয়েছে যে হাতে হাতে রাষ্ট্র ধরিয়ে দিতে পেরেছে যতখুশি ফ্রি নেট ।অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের নিশ্চয়তা না থাক, ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহারের স্বাধীনতার জোয়ারে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের ভেদাভেদ ভুলে পোশাক-পরিচ্ছদে এসেছে আমূল পরিবর্তন ।আর এসব ঝাঁ চকচকে জীবন যাপন দেখে সত্যিই বোঝা মুশকিল যে,কে শহুরে আর কে অজ পাড়া গ্রামের অষ্টাদশী ।তার ভালো থাকা,না থাকা,স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া,সবটাই নির্ভর করছে তার বাড়ির পরিবেশ,বন্ধু বান্ধবীদের সাহচার্য ও অবশ্যই তার শিক্ষা দীক্ষা রুচিবোধে।
ফেসবুকে যেভাবে বিভিন্ন পোস্টে উগ্র রুচিবোধের ঝলক, মাঝেমধ্যে স্ক্রিনে ফুটে ওঠে ,চমকে যাই আমরা ।এর মাঝে রয়েছে আবার পছন্দের মেয়ের কাছ থেকে নিজেকে হিরো হিসাবে দেখা পুরুষের, প্রেমের প্রস্তাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে,মেয়েটির বদনাম ঘটানোর নানা পন্থা,ফন্দি ফিকির। 'ভালোবাসা' শব্দটি কি পরিমান যে সস্তা হয়ে গেছে আজকাল,অবাক হয়ে যেতে হয়! তা যে ছেলেটি ভালবাসি, ভালবাসি করে ,দিনের পর দিন মেয়েটিকে ফলো করে গেল ,সেই প্রত্যখ্যাত হয়ে যত রকম ভাবে নোংরামির আশ্রয় নিয়ে বিরোধ করা যায় সেই রাস্তায় পথ হাঁটে। অনুসরণ করে, এমন বেশ কিছু ভায়োলেন্সের নোংরা পথ। আমরা প্রত্যহ দেখি এমন নজির,স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগে, তবে কি এটা ভালোবাসা ছিল না? এ ছিল মোহ ,শরীরের পূজা আকর্ষণ ।বলা হয় , প্রকৃত যে নাকি ভালোবাসে, তার দ্বারা, যাকে ভালোবাসে তার কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দুদিনে দেখেই প্রেম,আদতে মোহ, সব চাইতেই পেয়ে যাওয়া এ যেন এক বড়লোকের খামখেয়ালিপনা।অতীতে দেখি ভালোবাসার মানুষকে না পেয়ে ,নিজেকে বঞ্চিত তকমায় আজীবন চুপ করে কাটিয়ে দেবার ব্রত নেওয়া পুরুষ ,নারীকে।কিন্তু আজকের আধুনিক প্রেম,নারীদের প্রতি আশ্চর্য্য দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ,পুরুষ তান্ত্রিকতার শেকল।
যে মহিলাটি ,দিনরাত কায়িক পরিশ্রমে সংসার নামক বোঝাকে দায়িত্বের সঙ্গে প্রতিপালন করে চলেছেন,পান থেকে চুন খসলে কিন্তু ,তার পাশে কেউ নেই।পুরুষ কিন্তু রেডি, সমাজ দোষ দিতে প্রস্তুত।কেউই ছেড়ে কথা বলবে না অথচ সে কি কষ্টের মধ্য দিয়ে , স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে সমানে চেষ্টা করে চলেছে সংসারের ভারসাম্য বজায় রাখতে । সে তো আসলে সাক্ষাৎ গৃহলক্ষী, কিন্তু মাটির লক্ষ্মী প্রতিমাকে মহাসমারোহে, আড়ম্বর নিয়ে পূজা করলে স্ট্যাটাস বাড়ে বীর পুঙ্গবদের,অথচ দুবেলা পেট পুরে খেয়ে, উদরপূর্তি যাদের কল্যাণে সেই বাড়ির মহিলারা খেয়েছে কিনা সেই প্রশ্নটা করার মত কেউ থাকে না নারীদের পাশে। আসলে নারীদের প্রতি চিরাচরিত কাল থেকে চলে আসা নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি,
বঞ্চনা,নিয়ন্ত্রণ, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে,মজ্জায়।
সমাজ, সৃষ্টি হয় ব্যক্তিদের সমষ্টিতে।সমাজ কোনো ব্যক্তিবিশেষ নয়, তার নিজস্ব কোন ধর্ম,বিচার বুদ্ধি নেই ।সমষ্টিগত মানুষের যূথবদ্ধ রূপ হলো সমাজ ।তাঁদের আচরণ,ভাবনার দৃষ্টিকোণই সমাজের বলে গণ্য হয় ।এই সমাজ যদি আশি শতাংশ এমন পিছিয়ে পড়া মানসিকতার মানুষ দ্বারা চালিত হয় সেই সমাজে নারীদের প্রতি উচ্চ ভাবনা পোষিত হওয়া সত্যিই মুশকিল ।আজ পুরুষের অন্তর্বাস হোক, চাষের সার বা ইলেক্ট্রনিকস আইটেম ,সবেতেই নারীদের উত্তেজক ছবির ব্যবহার ।আসলে ওই সকল পণ্যে নারীর ভূমিকা না থাকলেও বাজারে আকর্ষণীয় প্যাকেট করে মার্কেটিং করাটা নারীদের জড়িয়ে আসলে পুরুষ তান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির এক পিছিয়ে পড়া মানসিক প্রতিবিম্ব ।
সারাদিন সংসারের জন্য খেটে ক্লান্তি,নিদ্রা,ভূক নিয়ে অপেক্ষারত নব বধূটি স্বামী না আসায় পথ চেয়ে বসে আর অন্যদিকে গুনধর পতিদেবটি, ক্লাবে,কি পাড়ার ঠেকে, বন্ধুদের সাথে ফ্রি ইউ টিউবের উত্তেজক ভিডিও ও সুরাপানে অবগাহন করে চলেছেন !আবার, নিজের বাড়ির নারীদের প্রতি দায়িত্ব পালনে সক্ষম কর্তব্য পরায়ণ পুরুষটি যখন বাইরে সম্পূর্ণ পাল্টে যায়, ছোট বাচ্ছাটি,অষ্টাদশী তন্বীটিকে, কুৎসিত ইঙ্গিতে আঘাত করা থেকে বিরত হয় না কেন, এর কোনো সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়।এই রকম নিন্দনীয় বহু ঘটনা ঘটে চলে আড়ালে,কিন্তু নারী প্রগতির এমন উন্নত সমাজে তাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে কে,আদৌ কি পাল্টাবে এ প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের গর্ভেই নিহিত থেকে যায় দশকের পর দশক।
===========================================
রাণা চ্যাটার্জী
বর্ধমান