অ্যালবাম
সেই ছেলেবেলা থেকেই দেখে এসেছি, অ্যালবাম বা আলেখ্য কুঁচিকা নামক জিনিসটির খুব কদর। প্রায় প্রতি বাড়িতেই এই বিশেষ বস্তুটি খুব যত্নের সঙ্গে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে থাকে।
অবসর সময়ে আমরা প্রত্যেকেই সেই অ্যালবাম নিয়ে নাড়াচাড়া করি, পাতা ওল্টাই। কত ঘটনা, কত স্মৃতি মনের পর্দায় বুদ্বুদের মত ভেসে ওঠে, আঁকিবুঁকি কাটে, তরঙ্গায়িত করে যায় আমাদের...
আসলে, অনেকগুলি অ্যালবামের মাঝে, আমার অতি প্রিয় অ্যালবামটি খুলে বসতেই, জ্বলজ্বল করে উঠলেন সেই মানুষটি, যাকে নিয়ে আমার আগ্রহের শেষ নেই। যাকে নিয়ে পত্রপত্রিকায় কোন লেখা পেলে আমি গোগ্রাসে পড়ে ফেলি।
১৯৫১ সনে শান্তিনিকেতন পৌষমেলায় গিয়েছেন, সদ্য কলকাতা আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়া ছাত্র পূর্ণেন্দু পত্রী। এক বন্ধু তাঁকে নিয়ে গেলেন রতনপল্লির একটি মাটির বাড়িতে। যে মাটির বাড়িতে থাকেন দুটি চোখে বুঁদ হয়ে থাকা স্বপ্ন নিয়ে বলিষ্ঠ, ঋজু, টানটান সেই মানুষটি। যাঁর দুর্ধর্ষ সব ভাস্কর্যে ভরে উঠেছে শান্তিনিকেতনের খালি প্রাঙ্গণ। যাকে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ডেকে বলেছেন- "তুই তোর মূর্তি আর ভাস্কর্য দিয়ে আমাদের সবখানে ভরে দে। একটা শেষ করবি আর সামনে এগিয়ে যাবি।" যার জীবন নিয়ে পরবর্তীকালে সাহিত্যিক সমরেশ বসু সপ্তাহের পর সপ্তাহ, কিস্তির পর কিস্তি "দেশ" পত্রিকায় লিখে গেছেন "দেখি নাই ফিরে" উপন্যাস।
এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন আপনারা, আমি বলছি- বাঁকুড়ার যুগীপাড়ার ছেলে, নন্দলাল বসুর ছাত্র কিঙ্কর, রামকিঙ্কর বেইজ এর কথা।
সেদিন রতনপল্লির মাটির বাড়িতে রামকিঙ্কর পূর্ণেন্দু পত্রীর ছবির অ্যালবাম যেমন দেখেছিলেন তেমনি পূর্ণেন্দুকে দেখিয়েছিলেন তাঁর পাহাড়ি শহর শিলং সিরিজের ছবি। ওয়াশে আঁকা সে সব অরণ্যগন্ধী ছবি দেখে পূর্ণেন্দু'র মনে হয়েছিল---
''শিলং যেন নড়ছে, চড়ছে, দুলছে গাছ, হাঁটছে মেঘ, রঙ বদলাচ্ছে রোদ, গাছ শিকড় নামাচ্ছে মাটিতে, খসে পড়ছে কিছু, কেউ যেন ছড়িয়ে যাচ্ছে কারও সঙ্গে আলিঙ্গনে-মন্থনে।'
আমার অতি প্রিয় সেই ছবির অ্যালবামের পাতায় পাতায় স্বপ্নশীল সেই শিল্পী মানুষটির সঙ্গে প্রাতঃস্মরণীয় আরও অনেক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি... যাঁদের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে, যাঁদের আত্মস্থ করে, আজ আমাদের এগিয়ে চলা... ঐতিহ্য আর পরম্পরাকে আঁকড়ে ধরা…
তাঁর শিলং সিরিজের সেই ছবিগুলির মত আমার অ্যালবামের ছবিগুলিও ঠিক একইভাবে জীবন্ত হয়ে নড়াচড়া করে ওঠে। খুলে দিয়ে যায় মনের বন্ধ ঘরের বাতায়ন। আন্দোলিত করে গভীর থেকে গভীরতর ভাবনায়। অনুপ্রাণিত করে যায় এক গভীর জীবনবোধে। আমি দেখি, অন্ধকার থেকে চুইয়ে পড়ছে এক আলোকরশ্মি। নতজানু হই আমি সেই আলোর সামনে।
======================
Sumitra Pal
Flat no- 2b3, Tower- 2
Silver Oak Estate
Kalipark
Rajarhat Road
Kolkata- 700136