Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

গল্প ।। জলছবির রঙ ।। সোমা চক্রবর্তী

জলছবির রঙ

সোমা চক্রবর্তী

রাণী পল্লীর তিন নম্বর গলির ঊনিশ নম্বর ঝুপড়ি থেকে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। চারমাস হলো প্রায়ই শোনা যাচ্ছে শব্দটা। ওই ঝুপড়িতে ললিতা থাকে। ললিতা একটা বাচ্চাকে চুপ করানোর চেষ্টা করছে। বাচ্চাটা মাঝে মাঝে চুপ করে যাচ্ছে, পরক্ষণেই আবার কেঁদে উঠছে।

এইসব পাড়ায়, এই ধরনের ঝুপড়িতে সাধারণত বাচ্চাদের কান্না শোনা যায় না। অথচ এখানে যারা থাকে, সবাই মহিলা। অঞ্চলটা তাই রাণী পল্লী নামে বিখ্যাত হয়ে গেছে। ওরা নিজেরাই নিজেদের বিদ্রুপ করে বলে, "এক রাতের রাণী!" বাসিন্দারা সবাই মহিলা হলেও তাদের ঘরে ঘরে শিশুর কলরব এখানে কখনো ওঠে না। তার বদলে রাত ঘন হয়ে এলে ওঠে অন্য এক ধরনের কলরব। কখনো দরদস্তুর নিয়ে, কখনো পছন্দ অপছন্দ নিয়ে। কখনো ফুলের মালা নিয়ে ফেরিওয়ালা হেঁকে যায়। কখনো আবার মুখোশের আড়ালে থাকা ভদ্রলোকদের নেশাগ্রস্ত গলার আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে এখানকার গলি। এসব ছাড়াও, রাণী পল্লীতে বাসিন্দাদের মধ্যে দিনেমানে চাঁছাছোলা গলায় খিস্তিখেউড় আর ঝগড়াও শোনা যায়। কিন্তু শিশুর কান্না বা হাসি! কিম্বা তার অবুঝ এলোমেলো কথা- একেবারেই বিরল। তবু কচিৎ কদাচিৎ এমন ঘটনাও একেবারে ঘটে না, তা নয়। রাণী পল্লীর যিনি মালিকান, এখানকার সব মেয়েদের অভিভাবক, সেই 'মাসি'র শ্যেন দৃষ্টি থেকে পিছলে, দৈত্যের বাগানেও দু-একটা ফুল ঝরে পড়ে বৈকি। চাঁদের আলোর মতো কোনো মুখ তার কচি কচি হাত-পা নেড়ে খেলা করে। সে শিশু মেয়ে হলে মাসির আহ্লাদ বেড়ে যায়। তার জন্য যত্ন করে নতুন ঝুপড়ি তোলার লালসায় তার ময়দার দলার মতো মুখটা আরো চকচক করে ওঠে। আর সে শিশু ছেলে হলে, বছর দশ-এগারো হতে না হতেই তার কপালে জোটে অর্ধচন্দ্র। তখন, হয় চায়ের দোকানে কাপডিস ধোওয়া, অথবা সিনেমার টিকিট জাল করা- এইরকম কিছু করেই তাকে নিজের পেটের সংস্থান নিজেকেই করতে হয়। কালে কালে এরাই যদি আবার হয়ে ওঠে রাণী পল্লীর নামকরা ফড়ে বা দালাল, তাতে অবাক হবার কিছু নেই।

বিষয়টা প্রায় একইরকম। এই শহরে রাণী পল্লী, ঐ শহরে বিবি পাড়া কিম্বা যা কিছুই হোক, ছবি তো ঘুরে ফিরে সেই একই। গল্প সেখানে নয়। গল্প হলো, এ হেন জায়গায়, অজস্র মহা পাতক চোখ এড়িয়ে, ললিতার ঘরে একটা শিশুর কান্না শোনা যাচ্ছে। তার কারণ, চার মাস আগে ললিতা মা হয়েছে। ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে ওর। অবশ্য বলতে যতোটা সহজ, ঘটনাটা ততটা সহজে ঘটেনি। এখানকার আর সবার মতো ললিতাও জানে না ওর সন্তানের বাবার পরিচয়। তাই, অন্য সবদিক ছেড়ে দিয়ে, এই ঝক্কির আর্থিক দিকটা সামলানোও ওর পক্ষে সহজ ছিল না। যখন বুঝতে পারলো আর ডাক্তার দিদির কাছে গেলো, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। যা কিছু পথ ছিল, সেসব তখন বন্ধ। এই অবস্থায় মাসিও ডাক্তার দিদিকে বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হলো। মাসির ব্যবসার লাভ-ক্ষতির থেকে, ললিতার জীবন আর তার সন্তানের জন্ম ডাক্তার দিদির কাছে বড়ো হয়ে উঠেছিলো সেদিন। ডাক্তার দিদির দৃঢ়তার কাছে দোর্দন্ডপ্রতাপ মাসিকেও অবশেষে হার মানতে হয়েছিলো। তবে, তারই মধ্যে, কটু ও কড়া কথা, অবহেলা ও নিষ্ঠুরতার চূড়ান্ত নাটকগুলো অভিনীত হতে লাগলো প্রতি দিনই। তারপর, সরকারী হাসপাতালে যখন ললিতাকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় আনা হলো, সে তো অন্য আর এক গল্প।

তারপরের গল্পটা ছোট্ট আরুষীর। তার পরের গল্পটা সেই রাতটার, যেই রাতে এই গল্পের যবনিকা উঠেছিলো রাণী পল্লীর ঊনিশ নম্বর ঘরটায়। যে ঘরটা থেকে ভেসে আসছিলো  শিশুর কান্না। আরুষী কাঁদছে। হ্যা৺। ললিতার মেয়ের নাম আরুষী। ডাক্তার দিদি রেখেছে নামটা। আরুষী অর্থাৎ সূর্য থেকে বেরোনো প্রথম কিরণ। কথায় কথায় ডাক্তার দিদি বলেছে, এই মেয়েই নাকি ললিতার জীবনে সূর্যের প্রথম কিরণ হবে একদিন। কিরণ মানে আলো- এই কথাটা ও জানে। তবে ডাক্তার দিদির সব কথার মানে পরিষ্কার করে বুঝতে পারে না ললিতা। তবে শুনতে ওর খুব ভালো লাগে। 

যাক সেসব কথা। রাণী পল্লীর তিন নম্বর গলির ঊনিশ নম্বর ঝুপড়িতে ললিতা এখন তার চারমাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছে। ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে মেয়েটাকে। তাই বলে রোজই যে সে তার মেয়েকে রাতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, তা কিন্তু নয়। অতো সময় কোথায় ললিতার? ওদের মতো মেয়েদের তো এই রাতের বেলাতেই যতো ব্যস্ততা। ঠুমরী মজা করে বলে, "বেলা ঠাকুর ঘুম গ্যালে আমাদের কাজ শুরু হয়।" বেলা ঠাকুর ওরা সূর্যকে বলে। বেলা ঠাকুর ঘুম গ্যালে অর্থাৎ সূর্য অস্ত গেলেই ললিতাকেও রঙচঙে কাপড় পরে, রাংতার গয়না গায়ে দিয়ে সেজে, রাতের অতিথিদের জন্য তৈরী হতে হয়। আজও তাই হয়েছিলো ললিতা। কিন্তু যে বুড়ি রোজ রাতটুকু আরুষীর দেখাশোনা করে, তার আজ জ্বর হয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে এসেছিলো ললিতা। কিন্তু হঠাৎ কি হলো ওর? মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে মাতৃস্নেহের অমৃতধারা কি উপচে উঠলো? ঠিক তা তো নয়। এ মেয়েকে মোটেই স্নেহের চোখে দেখে না ললিতা। কার ঔরসে জন্ম এর, তাই তো জানেনা। বরঞ্চ, জ্ঞান হবার পর, মেয়ে হয়েছে দেখে খুবই ভেঙে পড়েছিলো ও। ওদের কোলে মেয়ে আসা মানে তো আর একজন ললিতার সৃষ্টি। ঠিক যেমন করে নিজের মায়ের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই তিন নম্বর গলির ঊনিশ নম্বর ঝুপড়ি ললিতার নামে হয়েছে। ঠিক তেমনি একদিন হয়তো এই ঊনিশ নম্বরে ওর মেয়ের কাছেও আনাগোনা শুরু হবে রাতের অতিথিদের। কেঁদে ফেলেছিলো ললিতা। "কি হবে ডাক্তার দিদি?" ডাক্তার দিদি কিন্তু ওকে বুঝিয়েছিলেন সম্পূর্ণ অন্য কথা। বলেছিলেন বর্তমান পৃথিবীর পরিস্থিতি। বলেছিলেন, "এখনকার দিনে যৌনকর্মীদের ছেলেমেয়েদের সবকিছু করবার অধিকার আছে। তারা চাইলে, তাদের মায়ের পরিচয়েই স্কুল-কলেজে পড়তে পারে। সমাজের অন্য কেউ তাদের একঘরে করে রাখতে পারবে না।" ডাক্তার দিদি নিজেও এরকম কি সব যেন কাজ করে। তবে, কথাটা ললিতা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে নি। আবার অবিশ্বাস করার সাহসও হয়নি। কত লেখাপড়া করেছে ডাক্তার দিদি। কতো বড়ো বড়ো লোকজন যাতায়াত করে তার কাছে। কি সুন্দর সব জামাকাপড় পরে। লুকিয়ে একবার ডাক্তার দিদির শাড়িটা মুঠোয় ধরে দেখেছে ললিতা। কি নরম! এরকম সুন্দর কিছু ললিতার জগতে তো নেই। কি সুন্দর গন্ধ ডাক্তার দিদির গায়। মনটা যেন ভরে ওঠে। সেই ডাক্তার দিদি কি মিথ্যে কথা বলবে ওকে? তবে বিশ্বাস করাও যে শক্ত। অন্তত ললিতার মতো মেয়ের পক্ষে। জন্মাবধি যে কেবল দেখে এসেছে তার কদর শুধু মাত্র তার দেহটার জন্য। তার কাছে রাতের বেলা যারা আসে, তাদের কিছু এসে যায় না, তার নাম ললিতা না সবিতা না গঙ্গা সেইসব কিছুতে। অনেকে কথায় কথায় নাম জানতে চায় আর তখনই ভোলে। অনেকে তো জানতেই চায় না। এ হেন ললিতার সন্তানের পরিচয় হবে কিনা তার পরিচয়ে? কি পরিচয় তার? ললিতা দেবী, যৌনকর্মী। এই ধরনের একটা কিছুই না ভোটার লিস্টে উঠেছে গতবার ভোটের সময়? বিরু দালালের সঙ্গে ওরা দল বেঁধে ভোট দিতে গিয়েছিলো। সঙ্গে না ছাই। আসলে তো পাহারা। সে যাই হোক, গিয়ে কিন্তু খুব মজা হয়েছিলো ওদের সকলের! হেসে বাঁচে না ওরা লেখাপড়া জানা বাবুদের খেয়াল দেখে। সেই আলো জ্বলা মিশিং নাকি, তাতে নানা রঙের অনেক ছবি। সেইখানে নাকি বোতাম টিপে দিলেই ভোট হয়ে গেলো। ওদের সবাইকে তো বিরু বলে দিয়েছিলো, "সবাই মনে রেখো, দুই নম্বর বোতাম হলো আমাদের ক্যান্ডিডেট"। সেটা কি জানতো না ওরা। কিন্তু সার বেঁধে সবাই দুই নম্বর বোতাম টিপে ভোট দিয়ে মহানন্দে ফিরে এসেছে। পরে ডাক্তার দিদি বুঝিয়ে বলেছে, ওই ভাবে না জেনে কাউকে ভোট দিতে নেই। কিন্তু জানার উপায়? সেসব উপায়ের কথাও বলেছে ডাক্তার দিদি। বলে সময় সুযোগ পেলেই। ওদের এখানে এসে, মাসির অনেক আপত্তি থাকা সত্ত্বেও, মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে ডাক্তার দিদি। আরো কেউ কেউ আসে। অনেক কিছু বোঝায় ওদের। অনেক বিষয়ে সচেতন করে তোলে। আর তার ফলেই না এখন ওরা খানিকটা হলেও স্বাধীন ভাবে, মাথা উঁচু করে বাঁচার কথা ভাবে! কিন্তু সেসবও তো অন্য একটা গল্প। আর ললিতাদের জীবনে তো রোজই এক একটা গল্প। গল্পের অভাব কি ওদের!

কিন্তু ডাক্তার দিদি ওকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, ওর মেয়ে ওর মতো হতে কখনো বাধ্য নয়। সমাজটা শুধু ওপর তলার কিছু মানুষের, যাদের টাকা আছে, বংশ পরিচয় আছে, আরো অনেক কিছুই আছে, শুধু তাদেরই নয়। সমাজটা ললিতার মতো আরো অনেক মানুষেদেরও। ইচ্ছে করলে, লেখাপড়া শিখে ললিতার মেয়েও জজ হতে পারে! কিম্বা ডাক্তার! ঠিক ডাক্তার দিদির মতো। কিম্বা অন্য যা খুশী। ললিতা গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছিলো, ওমা, কথা শোনো! ওই অতো বড়ো কোর্টে কালো কোট পরে জবাব নেবে ললিতার মেয়ে? টিভিতে সিনেমা দেখার সময় ঠিক যেমনটা দেখেছে ললিতা? আরুষী দেবী, ললিতা দেবী নামের যৌনকর্মীর মেয়ে! হেসে বাঁচে না ললিতা। বেশ হয় কিন্তু তাহলে! কে জানে! ঠিক বিশ্বাস হয় না ললিতার।

এমনিতে মেয়েটা বেশী কান্নাকাটি করে না। ললিতা তো একদমই ধারেকাছে ঘেঁসে না মেয়ের। কি একটা বিজাতীয় রাগ যেন ঠেলে ঠেলে ওঠে ওর মধ্যে। তবু খুব একটা কান্নাকাটি শোনেনি এ পর্যন্ত। মেয়েটা হয়তো বুঝতে পেরেছে, কান্নাকাটি বেশী চলবে না এখানে। এই চারমাস শুধু একটু দুধ খাওয়ানোর সময় ছাড়া খুব বেশী দেখেওনি ললিতা তার মেয়েকে। দিনের বেলাই বা সময় কোথায় ললিতার? সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ঘুম দিয়ে তারপর রান্না, খাওয়া, ধোওয়া, স্নান পর্ব মেটাতে মেটাতে বেলা ঠাকুরের নিদ্ যাবার সময় হয়ে যায়। তখন চলে রাতের প্রস্তুতি পর্ব। এখানকার বাচ্চারা বড়ো হয় আই বুড়িদের কাছেই। আই বুড়িরা সব এখানকারই বাসিন্দা। বয়েস হয়ে তারা আইয়ের কাজ করে আর এখানেই থেকে যায়। ললিতাদের ঘরে বাচ্চা হলে এই আই বুড়িরাই দেখাশোনা করে থাকে। এই নিয়মই চলে আসছে এখানে বছরের পর বছর।

আজই শুধু কিছুই ঠিকমতো হয়নি। তাই ললিতা রাতের জন্য করা সাজ পোশাক পরেই, বলা যায়, কিছুটা বাধ্য হয়েই, বসেছে মেয়েকে ঘুম পাড়াতে। তাড়াতাড়ি ওকে ঘুম পাড়ানো চাই। সময় তার বড়ো অল্প। লম্বা ঝুপড়িটাকে আড়াআড়ি ভাবে কোনমতে ভাগ করেছে একটা নড়বড়ে বেড়া। সামনের দিকে, যেদিক দিয়ে বাইরে বেরোনোর দরজা, সেইদিকে একটা তক্তপোষ পাতা। পাশে একটা টেবিল। টেবিলের ওপর একটা ছোট টিভি। তার পাশে রাখা একটা সস্তার ফুলদানি। এখনো সেখানে সাজানো রয়েছে আগের দিনের একগোছা আধ শুকনো গোলাপ। দেয়ালে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে। তাতে একটা সুন্দরী মেয়ের মুখ। দেয়ালের আর এক দিকে একটা পুরনো ঘড়ি টানানো। ঘড়িটা ললিতার মায়ের সময় থেকেই ওখানে আছে। নড়বড়ে বেড়ার গায়ে একটা দরজা। দরজার গায়ে আধ ময়লা পর্দা ঝুলছে। তারই পেছনে রয়েছে ললিতার রান্নার সরঞ্জাম। একটা টানা দড়িতে ওর যাবতীয় জামাকাপড়। এদিকের দেয়ালে একটা বড়ো আয়না। আয়নার ঠিক নীচে দড়ি দিয়ে বেঁধে তক্তার তৈরী তাকে ললিতার সাজগোজ করার যাবতীয় জিনিস। ফিতে, চিরুনী, নানা রঙের টিপের পাতা, কাজল, ঠোঁটে, গালে মাখার জন্য রঙ, এইসব আর কি। এই দিকটাতে একটা কোণায় একটা জায়গা ইট দিয়ে খানিকটা উঁচু করে একটা বেদীর মতো করে, তার ওপর পুরনো কাপড়ের পুরু আস্তরণ বানিয়ে তৈরী হয়েছে ললিতার মেয়ের বিছানা। অবশ্য বেশীরভাগ সময় রাতের বেলা মেয়েটা থাকে আই বুড়ির ঝুপড়িতে। শুধু দিনের বেলাগুলোর জন্যই এই বিছানার ব্যবস্থা। 

আজ সব কিছুই উল্টোপাল্টা হয়েছে। তাই ললিতা এখন সাজগোজ করা অবস্হায় এইখানেই মেঝেতে বসে মেয়েটাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। উল্টোদিকের দেয়ালে এক হাত বাই দেড় হাত মাপের একটা জানলা। এই জানলা দিয়েই সকালের এক চিলতে রোদ রোজ বাঁকা হয়ে ঢুকে আরুষীর ছোট্ট বিছানাটার ওপর পড়ে। ললিতার মেয়ের গাল টিপে দিয়েই নিমেষের মধ্যে পালিয়ে যায়। আধ ময়লা কাপড়ের স্তূপের ওপর বসে ললিতা এখন তার মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে। চকমকে কাপড় পরনে। ওর হাতের কাঁচের চুড়ির রিন্ ঠিন্ শব্দ শুনে ছোট্ট মেয়েটা বড়ো বড়ো চোখ মেলে কান খাড়া করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আই বুড়ির হাতে চুড়ি বাজে না। ললিতা অবাক হয়ে দেখছে, জন্মের পর দেখা সেই লিলিপুটের মতো চেহারায় মাংস লেগেছে একটু। পুতুলের মতো গোলাটে মুখের গড়নটায় যেন ললিতার মুখের আদল কোথায় লেগে আছে। কথাটা মনে হতেই শিউরে ওঠে ললিতা। "আমার মেয়ে", এই কথাটা যেন আজ প্রথমবার ওর মনের দরজায় কড়া নেড়ে গেলো। ললিতা ভালোভাবে তাকালো কোলের শিশুটির দিকে। উজ্জ্বল দুটো চোখ তুলে সে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে। কখনো ললিতার কপালের চকচকে টিপ, কখনো কাপড়ের জড়ির পাড় দেখছে বারবার। হাত মুঠো করে মায়ের কাপড় ওর ছোট্ট মুঠিতে চেপে ধরেছে। দেখতে পেয়ে সামান্য ঈর্ষা বোধ হলো ললিতার।  নিশ্চয়ই আই বুড়ির কাপড় এভাবেই রোজ মুঠোয় ধরে ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। আই বুড়িকেই বেশী চেনে ললিতার থেকে। তাই আজ এতো কান্না, চোখে ঘুম নেই! মনে মনে ভাবলো ললিতা।

জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আধফালি চাঁদটাকে। ক্রমাগত সে রূপো ঝরিয়ে চলেছে কালো রাতে ঢাকা পৃথিবীর ওপর। ললিতার মাথার ওপর কম পাওয়ারের হলুদ বাল্ব জ্বলছে। মেঝের ওপর পুরনো কাপড়ের বিছানায়, কোলে মেয়ে নিয়ে বসে রয়েছে ললিতা। সকলেই বলে, মেয়েটা বড়ো লক্ষ্মী। কিন্তু কি কারণে যেন আজ আর ঘুমাচ্ছে না মেয়েটা। কোল থেকে নামাতে গেলেই কেঁদে উঠছে। আবার কখনো ললিতার কাপড়টা মুঠোয় করে ধরছে। সেটা মুখে পুরে দিয়ে হাসছে। যেন কোনো অজ্ঞাত নির্দেশে বুঝতে পেরেছে যে, ঘুমিয়ে পড়লেই মা চলে যাবে। তাই ঘুমাবার কোনো তাড়াই নেই আজ তার। ওদিকে মাসির লোক দু-দুবার তাড়া দিয়ে গেছে। এরপর হয়তো মাসি নিজেই এসে হাজির হবে। কিন্তু ললিতার যেন কোনো খেয়াল নেই সেদিকে। নেশায় পাওয়া হয়ে সে দেখছে তার মেয়ের কান্ড কারখানা। এতটুকু শিশু, তবু তার সবকিছু বোঝানোরই ভাষা আছে- আবিষ্কার করে ললিতা। আওয়াজ করে হাসছে মেয়েটা। কখনো গলা থেকে খুশীর শব্দ বার করছে। ওর চোখ দুটোর সঙ্গে যেন কিসের মিল খুঁজে পায় ললিতা। রাতের আকাশের তারা নাকি ভোরবেলার শিউলি- ঠিক করতে পারলো না ও। এতো উপমা দিয়ে ভাবতে শেখেনি বেচারী। এইরকম করে মেয়ের সাথে নিজেকে একাত্ম করে ভাবেওনি কখনো এই চারমাসে। "আমি মা", "একটা আস্ত মানুষের মা আমি"- এই ভাবনা যে এতো সুখের হয়, বেচারী ললিতা জানতো না কখনো। ওদের জীবনে মা হওয়া মানেই শুধু যন্ত্রণা আর সমস্যা। কিন্তু কি যেন আছে ললিতার মেয়ের মধ্যে, অথবা সব শিশুর মধ্যেই থাকে, কিম্বা সব মা-ই দেখতে পায় তার নিজের সন্তানের মধ্যে- দুনিয়ার সর্বত্র এই একই নিয়ম, একই জাদু। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে বিভোর হয়ে গিয়েছিলো ললিতা। কখন যে পর্দা সরিয়ে মাসি এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে, লক্ষ্য করেনি। গলা খাকারি দিয়ে জানান দেওয়াতে, চমকে ফিরে তাকালো ললিতা। ইশারা করে মাসি বোঝানোর চেষ্টা করলো, বেড়ার ওপাশে ললিতার আজকে রাতের অতিথি এসে বসে আছে।‌ বিতৃষ্ণায় জিভ, গলা সব তেতো হয়ে গেলো ললিতার। মাসির চোখ থেকে চোখ সরিয়ে ফিরে তাকালো মেয়ের মুখের দিকে। মেয়েটা কি বুঝলো কে জানে, একবার নতুন আগন্তুক মাসির দিকে, আর একবার মায়ের মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো। অবোধ্য ভাষায় কতো কি বলে যাচ্ছে আপন মনে। ও কি মায়ের ভাবান্তর টের পেয়েছে? ললিতা কি ওর মুখে কোনো বিপন্নতা টের পেলো? যাই হোক, মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিলো ললিতা। আর সেটাই দৃঢ় ভাবে মাসির দিকে ফিরে জানিয়েও দিলো। আজ রাতটা ছুটি চাই ললিতার। 

প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলো মাসি। এতো স্পর্ধা? আই বুড়ি আসেনি বলে মেয়েকে রাখার জন্য ছুটি? একটা গোটা রাত? এই ধরনের বিপ্লব সহসা এখানকার কেউ দেখায় না। দেখাতে দেওয়া হয় না। সবাই এরকম সন্তানস্নেহ নিয়ে আদিখ্যেতা করতে শুরু করলে মাসির ব্যবসা টি৺কবে কিভাবে? আর সকলের বেলায় যেরকম করে, সেই ভাবেই, প্রথমে নরমে, তারপর ধীরে ধীরে গরমে রূপান্তরিত হয় মাসি। সে শুধু জানে অর্থলোভ, লালসা আর স্বার্থের ভাষা। এই জীবনে অনেক দেখেছে সে। কিভাবে ললিতার সাময়িক দুর্বলতাকে দলে পিশে নির্মূল করে ফেলতে হবে, সেই শিক্ষা খুব রয়েছে তার। তাই চাপা অথচ তীব্র গলায় ললিতার ওপর তর্জন গর্জন চালাতে থাকে।  "ললিতার জানা উচিত, কাজ না করলে এখানে চলে না। মেয়ে কোলে করে বসে থাকলে পেট চলবে কি করে দুজনের? সময় থাকতে আখের গুছিয়ে না নিলে বুড়ো বয়েসে কে খাওয়াবে ওকে? এভাবে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা মানে বোকামি। ডাক্তার দিদিই মাথাটা খাচ্ছে ললিতার। এখানে থেকে বেরোলে সমাজে কি জায়গা হবে ওর? ও কি গৃহস্থ বাড়ির বউ যে বাচ্চা কোলে করে রাত কাটাবে?" এইসব আরও অনেক.. অনেক কথা এক নাগাড়ে বলে চলে মাসি। মুখে বলে বলে ললিতাকে যতখানি হেনস্থা করা সম্ভব, ততখানিই করে। নেহাত বাইরের একজন আগাম টাকাপয়সা দিয়ে ঘরের মধ্যে বসে রয়েছে, তাই গায়ে হাত তুলতে শুধু বাকি রাখে।

আরুষীকে কোলে নিয়ে স্থির হয়ে বসে রইল ললিতা। মাসির বলা সব কথাই ঠিক, জানে সে। আজকের মতো প্রতি রাতে আবেগের আতিশয্যে গা ভাসিয়ে দিলে তার মতো মেয়ের চলবে না। কাজ তো তাকে করতেই হবে। আর, কাজ সে করবেও। কাল থেকেই করবে। কিন্তু শুধু আজ নয়। শুধু আজ, এই মায়াময় জাদু রাতে, যে রাতটায় ও সত্যিকারের 'মা' হয়ে উঠলো মনে প্রাণে, শুধু সেই রাতটুকু সে তার সন্তানের সঙ্গে কাটাতে চায়। হয়তো মেয়েটা তার শিশুকালে আর কোনদিনই রাতের বেলা মা'কে কাছে পাবে না। পাবে না মায়ের আঁচলের গন্ধ, পাবে না রূপকথার গল্পের ঠিকানা। তাই শুধু আজকের রাতটুকু এ জীবনের মতো মা আর মেয়ের হোক।

অবশ্য এতো কথা যে ললিতা ঠিক এভাবেই বলতে পারলো তা নয়। বললো সে তার নিজের ভাষায়, নিজের মতো করে। মাসি কি বুঝলো কে জানে! ললিতাকে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে, ভারী কোমর দুলিয়ে, ক্ষুব্ধ বাবুটিকে নিয়ে চলে গেলো। হয়তো কোনো নতুন ঠিকানায় পৌঁছে দিতে। মাসির দরাজ গলায় কাঁদতে শুরু করে দিয়েছিলো মেয়েটা। ললিতা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে, বহুদিন আগে শোনা, প্রায় ভুলে যাওয়া একটা ঘুম পাড়ানি গান স্মৃতির অলিন্দ থেকে পেড়ে এনে, গাইতে শুরু করলো পরম সুখে। রাক্ষসরা রাজকন্যাকে না নিতে পেরে, শেষ পর্যন্ত ফিরে গেছে- এই কথাটা বুঝতে পেরেই বোধহয়, এতক্ষণে মায়ের বুকের মধ্যে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো মেয়েটা। মুঠোর মধ্যে ধরে রাখলো মায়ের কাপড়খানা। যেন ওর ওই মুঠি খুলে ফেলে, কেউ আর ওর মা'কে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে না কোনদিন।

পরম সন্তর্পণে ললিতা ঘুমন্ত মেয়ের নরম চুলগুলোর ভেতর হাত বুলিয়ে দেয়। মুখ নামিয়ে মেয়ের গায়ের গন্ধ শোঁকে। দুধের গন্ধ, শিশুর গায়ের মিষ্টি মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে আসে। সেই গন্ধের মধ্যে ললিতা ডাক্তার দিদির গায়ের গন্ধ পায়। আবেশে ওর চোখ দুটো বুজে আসে। তার আরুষী একদিন বড়ো হবে। ইস্কুলে যাবে। তারপর কলেজ। তারপর... তারপর.... ঠিক জানেনা ললিতা। ডাক্তারীর পড়া পড়বে ললিতার মেয়ে। ললিতা ঠিক পারবে মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে। তাকে পারতেই হবে। খুব খাটবে সে। আর কোনো দ্বিধা, কোনো দ্বন্দ্ব রাখবে না মনে। নিজের ভাগ্যকে আর দুষবে না। সে যৌনকর্মী। এটাই সত্যি। এটাই তার পরিচয়। এই পরিচয়েই তার মেয়ে বড়ো হবে। ডাক্তারীর পড়া পড়বে। তারপর, একদিন, যখন ললিতা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা দুটো পাকা চুল দেখতে পাবে তার মাথায়, ঝড়ের মতো ঘরে এসে ঢুকবে তার মেয়ে- আরুষী। বলবে, "চলো, তোমাকে সমুদ্র দেখিয়ে নিয়ে আসি, মা। কিম্বা পাহাড়। এ জীবনে তো কিছুই দেখা হয়নি তোমার। দেখবে চলো, কতো বড়ো এই দেশ। এখানকার পাহাড়, সমুদ্র, জঙ্গল। দেখবে চলো, কতো বিশাল এই পৃথিবী। তোমার এই ঘরের কোণার থেকে কতো বিশাল।" মেয়ে এসে জড়িয়ে ধরবে ললিতাকে। সূর্যের প্রথম কিরণ এসে সেইদিন পড়বে ললিতার জীবনে। ভাসিয়ে দেবে, উড়িয়ে দেবে, পুড়িয়ে দেবে ওর পুতিগন্ধময় যা কিছু আছে, যা কিছু ছিল, সব।

মেয়ের গায়ে ঠিক ডাক্তার দিদির গায়ের মতো গন্ধ। গায়ে ওইরকম নরম, ফুরফুরে পোশাক। কিসের মতো নরম? মেঘের মতো নাকি কুয়াশার মতো? জলের মতো না হাওয়ায় মতো? ঠিক এভাবেই ভাবতে পারে না ললিতা। ভাবে, তার নিজের মতো করে। বসে থাকে মেয়েকে বুকে করে। জানলা থেকে সরে গেছে রূপো ঝরানো ফালি চাঁদ। হয়তো এখন শেষ রাত। রাণী পল্লীর তিন নম্বর গলিতে কুকুর ডেকে উঠলো। আর কোনো শব্দ নেই কোত্থাও। চাঁদের সব রূপো আজ যেন ঝরে পড়েছে ললিতার স্বপ্নে। বিভোর হয়ে তাই রূপোলী ভবিষ্যতের জাল বুনতে থাকে ললিতা!
 

-------------------------


সোমা চক্রবর্তী
Kalikapur, Taki Toad 
PO. Barasat, Dist: 24 Pgs (N), WB.
Pin: 700124.


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক