ডাউন করোনা লেন
আগামীকাল রবিবার। প্রতি রবিবারের মতোই কাল আবার একটা কফি আড্ডা হবে, সে কথা মাথায় রেখে বিজানুজ স্কুল সেরে ফেরার পথে সুপার স্টোর থেকে কিছু ড্রাই ফুড্ নিয়ে বাড়ি ফিরল। এই শহরে একা থাকা বিজানুজের কাছে উইকেন্ডের এই আড্ডাটা প্রাচীন রিভাইটালের মতো। নুর আর অন্তরাও অপেক্ষা করে থাকে- তিনজন কফি হাতে মুখোমুখি রবিবারের জন্য। নুর একটা নামি বাংলা অনলাইন নিউজ পোর্টালের এডিটর এবং অন্তরা জেনেটিক্ ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পি এইচ ডি কম্লিট করেছে এখন একটা ইউনিভার্সিটির অ্যাসিসট্যান্ট প্রফেসর। কাজের জায়গাগুলো এতটাই আলাদারকম তবু বন্ধুত্বের ক্রসব্রিজ ভীষণ দৃঢ়। যদিও আড্ডার স্থানের পরিবর্তন ঘটে তিনজনের কারও না কারও আস্তানায়, কিন্তু কালের বদল ঘটেনি এখনও।
রবিবার।
অন্তরা আর নুর হাজির বিজানুজের বাড়ির দরজায়। দরজায় এসে দাঁড়াতেই অটোডিটেকটারে ফেস স্ক্যান, দরজা খুলে যায় (সঙ্গে ওয়েলকাম নোট)। বাইরে থেকে আসার পর নিজের নিজের মাস্ক-গ্লাভস খুলে রেখে অটোমেটেড্ স্টেরিলাইজার রুম পেরিয়ে বিজানুজের ঘরে প্রবেশ করল দুজনে। বিজানুজ তখন ইন্টিগ্রেটেড ট্রান্সপারান্ট পি সি -তে কাজে ব্যাস্ত। স্কুলের বাচ্চাদের স্যানিটাইজেসন্ সার্টিফিকেট আর মেডিকেটেড্ ফুড্ সাপ্লিমেন্ট ডিস্ট্রিবিসন্-এর ক্রাইটেরিয়া রেকটিফিকেসনের দায়িত্ব তার উপর। বিজানুজের সাবজেক্ট ফুড এন্ড নিউট্রিশন, তাই পড়ানোর ফাঁকে এই দায়িত্ব সামলাতে হয়। অন্তরা আর নুরকে দেখেই-
বিজানুজ || এসেছিস তোরা? বস সোফায়। আজ একটু দেরী করলি তোরা তাই কাজে বসেছিলাম (বিজানুজ রিভলভিং চেয়ার বিপরীতে ঘুড়িয়ে বসতেই পি সি সাট্ ডাউন হয়ে যায়)।
নুরের নজরে আসে ঘরের দেওয়ালে একটা নতুন ডিজিটাল ক্লক, চারিদিকে সবুজ রঙের আলোর আভা। নুর আগে এটা কোথাও দেখেনি। নুর বিজানুজকে বলে 'তোর ইলেক্ট্রনিং গ্যাজেটস্ কালেকশন সত্যিই অসাধারণ। ঘড়িটা কবে নিলি? কোনো স্পেশালিটি আছে?'
বিজানুজ কিছু বলার আগেই-
অন্তরা || এটা একটা অটোমেটেড লাইট অ্যাকটিভেটেড্ ক্লক। আর তার সাথে এটা রুমের মধ্যে আসা ইনফেকসাস্ পার্টিকল লোড্ অ্যানালাইজ করতে পারে। এখন গ্রিন লাইট এমিট্ করছে মানে রুম ইজ্ আউট্ অফ্ ডেঞ্জার। ইনফেকসাস্ পার্টিকল লোড্ বেড়ে যাওয়ার সাথে এটা ক্রমান্বয়ে হলুদ, লাল এবং গাঢ় লালে পরিবর্তন হয়।
নুর || ওয়াও! কিন্তু রাতে লাইট অফ্ থাকলে এটা কি বন্ধ হয়ে যায়?
বিজানুজ || আরে না না। এটাতে সোলার সেলের মতো ফোটন্ স্টোরেজ সেল আছে। ব্যাক আপ নিয়ে রাখে কম করে হলেও এক মাস চলতে পারে ব্যাক আপে রাখা ফোটনে।
নুরের এতটাই ভাল লেগেছে যে গল্পটা চলতে চলতেই নুর অনলাইনে অর্ডার করে ফেলে নিজের হাতের ডিজিটাল ওয়াচ্ থেকে। গল্প জমে ওঠার আগেই বিজানুজ গতকালের এনে রাখা ড্রাই ফুডস্ আর কফি বানিয়ে নিয়ে আসে।
অন্তরা || বিজানুজ,আজ তোর ওয়াল ডিজিটাল ফ্রেমে দেখছি বেশিরভাগ ছবি
২০১৯ - ২০২০ সালের। খুব মনে পড়ছে নাকি সেসব দিনের কথা?
বিজানুজ || হ্যাঁ। মাঝে মাঝে মনে পড়ে। আজকের পৃথিবীর ইউ-টার্ন'টা সেই সময়টার কথাই মনে করায়।
নুর || ডাউন মেমোরি লেন?
অন্তরা || আমার মনে হয় 'ডাউন করোনা লেন'।
বিজানুজ || হমমম। আসলেই তাই। ২০ টা বছর কেটে গেছে তারপর। মানুষ সবচেয়ে উন্নত জীব। উন্নতির চরম বিড়ম্বনায় পৌঁছে যখন দেশের পর দেশে সরকারি ঘোষণা মেনে মানুষকে ঘর বন্দি হতে হয়েছিল, সেসব দিন মনে পড়ারই কথা...।
নুর || আমার মনে হয় করোনা আমাদের থেকে শুধু কেড়ে নেয়নি, শিখিয়েছে নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা...
অন্তরা || যতই বিজ্ঞান এগিয়ে যাক না কেন...প্রকৃতি নির্বাচন করে অ্যাডভান্সমেন্ট লিমিট্। একের পর এক খারাপ কাজ করেছে মানুষ, কখনও নিবিড় অরন্য জ্বালিয়ে দিয়েছে, কখনও পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তায় বধ করেছে মনুষ্যত্বকে। অর্থনৈতিক প্ররোচনায় মানুষ ধ্বংস করে গেছে প্রকৃতিকে।
নুর || ঠিক বলেছিস, ক্ষয়-ক্ষতির পরিমান এতটাই বেশি হয়ে পড়েছিল যে- বুমেরাং হওয়াটা ছিল সময়ের অপেক্ষা।
অন্তরা || সেই সময়টার কথা মনে করিয়ে দিস না তোরা...চুপ কর...চুপ কর...
(চোখে জল আসে অন্তরার)
বিজানুজ || কাঁদিস না রে। শুধু তুই না, আমরাও আমাদের পরিজনদের হারিয়েছি কোভিড-19'এ।
নুর || কাঁদিস না, প্লিজ কাঁদিস না।
বিজানুজ || মানুষ যখন নিজেকে সর্বেসর্বা ভেবে ফেলে...মনে করে সব কিছুই তার ইচ্ছে মতো হবে, ঠিক তেমন সময় প্রকৃতি তার অস্তিত্বের প্রমান দেয়।
অন্তরা || (চোখ মুছতে মুছতে বলে) তোরা একটা কথা ভেবে দেখেছিস- সেই সময়টায় মানুষ ধর্ম নিয়ে কতটা উত্তেজিত হয়ে পড়ত। 'আমার ধর্মের এটা ভাল, ওর ধর্মের ওটা খারাপ...'
নুর || একদম...একদম। অথচ যখন করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিল বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশের মানুষ, সাইন্টিস্টরা মেডিসিন কিংবা ভ্যাকসিনের কিনারা করতে পারছিল না হাজার চেষ্টার পরেও তখন কোথায় ছিল সেই ধর্মধারীরা...
আব্বা-আম্মা আক্রান্ত হওয়ার পর কোয়ারান্টাইনে নিয়ে গিয়েছিল সরকারি দায়িত্বে থাকা কর্মীরা। তারপর আর কোনোদিন দেখতে পেলামনা...সব শেষ হয়ে গিয়েছিল।
বিজানুজ || আমি তো তখন অন্য রাজ্যে, দাদুর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতাম। মা-বাবা দুজনেই আক্রান্ত হয়ে যখন মৃত্যু শয্যায় তখন কথা হত বোনের সাথে মোবাইলে, বেচারী বাড়িতে একা হয়ে গিয়েছিল আমিও তো আর মা-বাবাকে ফিরে পেলামনা...।
(বলতে বলতে দৃষ্টি ভিজে যায় বিজানুজের। অন্তরা, বিজানুজের কাঁধে হাত রেখে সান্তনা দেয়)
অন্তরা || আমার মা-বাবাকে তো আমি জন্মের পর দেখিনি। অনাথ একটা মেয়ে, চার্চের সিস্টার দায়িত্ব নিয়ে আমাকে বড় করেছিলেন। অথচ কোভিড-19 সেই মানুষটাকেও আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিল।
নুর || সত্যিই, মানুষ যেভাবে চলছিল সেটা সম্পূর্ণ ভুল পথ ছিল। কোভিড-19 ছিল প্রকৃতির বার্তা।
বিজানুজ || এখন দেখ, প্রত্যেক মানুষকে বাধ্যতামূলক দায়িত্বগুলো পালন করতেই হয়। যেমন মানুষ-প্রতি নির্দিষ্ট সংখ্যক গাছ লাগানো, পরিবেশ দূষণ যাতে না হয় তার ব্যাবস্থা করা, এমনকি যে কোনো কল-কারখানার মালিককে বিধি-সম্মত ওয়েস্ট প্রোডাক্ট ম্যানেজমেন্টের দায় নেওয়া...
অন্তরা || এমনকি কোনো শিল্পপতি বহুতল বিল্ডিং বানালেও সেই বিল্ডিং-এ থাকা মোট ঘরের সমসংখ্যক গাছ লাগাতে হবে সেই বিনিয়োগকারীকে এবং পরবর্তী বেশ কয়েক বছর সেসব গাছের দেখাশোনার ব্যবস্থাও করতে হবে ।
নুর || আসলেই মানুষ শক্তের ভক্ত। আমরা যখন ছোট ছিলাম, এরকম অনেক নিয়মই তো ছিল...কিন্তু মানুষ মেনে চলত না কিছুই।
বিজানুজ || এতকিছু বাদ দিয়ে এটা বল মানুষ এখন কেন সব মানছে? কেন সব আইন অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে? কারণ মানুষ বুঝেছে- ভগবান, আল্লাহ, জেসাস্...এগুলো জাস্ট প্রতীকী, সুপার অথরিটি হল প্রকৃতি।
অন্তরা || আর এই ভয়টাই মানুষকে মানুষ হতে বাধ্য করেছে।
বিজানুজ || এক্স্যাক্টলি। এখন একটাও কম্পানি পাওয়া যাবেনা যারা জীববৈচিত্র নষ্ট করে বিল্ডিং-কারখানা করছে অথবা বর্জ্য পদার্থ দিয়ে নদীগর্ভ কিংবা আকাশ ঢেকে দিচ্ছে। এই সবকিছুই হয়েছে মৃত্যুভয় থেকে। মানুষ মরনশীল হলেও মৃত্যুপ্রবণ নয়।
সেদিনের আড্ডা শেষ হয়। যে যার বাড়িতে ফিরে যায়। ওদের রেখে যাওয়া কাপ-ডিস্ অটোমেটোড্ ওয়াসিং স্টেরিলাইজারে পাঠায় বিজানুজ। পরদিন থেকে আবার স্কুল...অবশ্যই প্রাকৃতিক নিয়ম-কানুন মেনে...। প্রকৃতিকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে মানুষ যেভাবে পরাধীন বাঁচতে শুরু করেছে,- আসলে এই ইউ-টার্ন'টাও স্ট্রাগল ফর্ এক্সিসটেন্স্'র প্রমান দেয়। যদিও মানুষের ইচ্ছেতে হয়তো নয়...কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী আছে, চাপে পড়ে মানুষকে 'ব্যক্ টু দ্য নেচার' হতেই হয়েছে। সমস্ত রাজনীতিকে পেছনে ফেলে প্রকৃতি'নীতির এই জয় মাঝে-মাঝেই মানুষকে স্মৃতি বিজড়িত করে। না না...ওটা ডাউন মেমোরি লেন নয়, স্পষ্টতই 'ডাউন করোনা লেন'।
..................................
বিজয়ন্ত সরকার