google-site-verification=aFCzFTmuVjPqPlrdWXeJSj2r_EMig_cypLnlmiUQpw0 re গল্প -- অনির্বাণ মন্ডল - নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

Breaking

নবপ্রভাত মাসিক ব্লগ-সাহিত্যপত্র

NABAPRAVAT : A Monthly Bengali Literary Blogzine.

মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

গল্প -- অনির্বাণ মন্ডল






ফিরে পাওয়া



প্রথম যখন লকডাউন ঘোষণা হয় তখন একটু কিংকর্তব্যবিমূঢ় ই হয়ে পড়েছিলেন অধ্যাপক শুভজিৎ বাবু। আসলে ব্যাস্ত একটা জীবন; প্রতিদিন ছাত্র ছাত্রীদের নতুন নতুন প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য পড়াশোনা, সকাল ৯ টায় বাড়ি থেকে বের হওয়া, মাঝেমধ্যে কলেজের মিটিং শেষ করে বাড়ি ফেরার জন্য তাড়া এসব হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কি করে সময় কাটাবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। প্রথম প্রথম একটু বিশ্রাম পেয়ে অবশ্য ভালোই লাগছিল। কিন্তু কিছুদিন যাবার পর ব্যাপারটা বেশ একঘেয়ে হয়ে ওঠে। টিভি খুললেই মৃত্যুর খবর, সোশ্যাল মিডিয়ায় ও সেই একই ব্যাপার। তখনই তার হঠাৎ মনে হল অনেক দিন হয়ে গেল নিজেকে সময় দেওয়া হয়নি। কোনো দেরী না করে তিনি পুরানো দিনের গান শোনা শুরু করলেন; সেইসব গান যেগুলো তার মনে উন্মাদনা জাগাত কৈশোরে কিংবা প্রথম যৌবনে। এদিকে টিভি তে রামায়ণ, ব্যোমকেশ বক্সী দেখতে দেখতে স্ত্রীর কাছে একটু মুখরোচক খাবারের আবদার আর  মাঝেমধ্যে মেয়ে কে তার নিজের কেরিয়ার সম্পর্কে সচেতন করা এভাবেই সময় কেটে যেতে লাগলো বেশ। মাথায় কোনো চাপ আর হাতে কোনো কাজ না থাকায় শুভজিৎ বাবুর পুরানো দিনের কথা গুলো বারবার উঁকি দিতে লাগল মনের মধ্যে। স্ত্রী রীনার সাথে লুকিয়ে প্রেম করার দিন গুলো, স্কুল জীবনের স্যারেদের কথা, প্রথম নিষিদ্ধ বই পড়ার কথা, প্রথম সিগারেট খেয়ে বাবা জানতে পারার ভয়ে কলাপাতা চিবানোর কথা,একাহাতে মায়ের সংসারের সব কাজ সামলানোর কথা, বাবার হাত ধরে সারা কলকাতা ঘুরে বেড়ানোর কথা আরও কত কি! এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মনে পড়ে গেল ছোটবেলার বন্ধু প্রকাশের কথা। প্রতিদিন বিকেলে ঝিলের ধারে ওর সাথে আড্ডা না মারলে ভাত ই হজম হতো না যেন।ওর বাবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করত আর অন্যদিকে শুভজিৎ বাবুর বাবা ছিলেন কৃষিদপ্তরের অফিসার। তবে এরজন্য কিশোর শুভজিৎ আর প্রকাশ এর বন্ধুত্বের মধ্যে কোনো সমস্যা হয় নি কোনো দিন। প্রকাশ শুভজিৎ দের বাড়িতে এসে শুভজিৎ এর রেফারেন্স বই গুলো থেকে দরকারি লাইন গুলো লিখে নিয়ে যেত। টাকা খরচ করে টিউশন পড়ানোর সামর্থ্য প্রকাশের বাবার ছিল না।তবু শুভজিৎ অবাক হয়ে যেত যখন পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হত। শুভজিৎ ক্লাসে প্রথম হত বরাবর। কিন্তু কোনো সুযোগ সুবিধা না পেয়ে, বাবা মা র কাছ থেকে কোনো পরামর্শ না পেয়ে, নিজের পড়ার জন্য আলাদা কোনো ঘর না পেয়ে, কোনো টিউশন না পেয়ে কিভাবে প্রকাশ তৃতীয় বা চতুর্থ স্থান দখল করত এটা শুভজিৎ এর বাল্যবুদ্ধিতে কিছুতেই বোধগম্য হত না।পরে অবশ্য সাংসারিক অভাবের কারণে প্রকাশের পড়াশোনা আর বেশীদূর হয়নি। আর এদিকে শুভজিৎ এর বাবা চলে আসেন কলকাতায় নিজের পরিবার নিয়ে। তারপর পড়াশোনার চাপ, চাকরী আর সংসার জীবনের ব্যাস্ততায় শুভজিৎ এর জীবন থেকে হারিয়ে যায় ছোটবেলার বন্ধু প্রকাশ।
মাঝে একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয়েছিল প্রকাশের সাথে। তখনই শুভজিৎ বাবু জানতে পারেন প্রকাশ স্থানীয় এক পেন কারখানায় কাজ করে। তবে খুব সংযমী মানুষ তো তাই অল্প উপার্জনের মধ্যেই ধীরে ধীরে উন্নতি করেছে; মাটির বাড়িটা পাকা করেছে, ছেলেকে ভালভাবে পড়াশোনা শেখাচ্ছে।ও নিজের থেকেই বলে উঠেছিল' আমার তো স্বপ্ন গুলো পূরণ হয়নি! কিন্তু ছেলেকে আমি প্রতিষ্ঠিত করবই। ওকে আমি অভাব বুঝতে দেব না।সে আমাকে ওভার টাইম কাজ করতে হয় হোক ।' কথা গুলো ভাবতে ভাবতে শুভজিৎ বাবুর চোখ অজান্তেই ছলছল করে উঠল; আর ঠিক তখনই মনে পড়লো প্রকাশের সাথে শেষ যেবার দেখা হয়েছিল তখন ওর ফোন নম্বর টা নিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে পুরানো বন্ধুর খোঁজ নিতে মনটা উসখুস করে উঠল।সময় নষ্ট না করে তিনি কল করলেন। কিছুক্ষণ রিং হবার পর ওপার থেকে প্রকাশের গলা শোনা গেল। অনেক দিন পর বন্ধুর গলার স্বর শুনে তিনি ভাবুক হয়ে পড়লেন। প্রকাশ ও কিছুতেই নিজের আবেগ চাপতে পারছিলনা। শুভজিৎ বাবু বললেন' কেমন আছিস রে এই লকডাউনে? ' কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রকাশ বললো ' কেমন আর থাকব! এই চলছে কোনো মতে ' । জানিস আজ আমার ছোট বেলার কথা খুব মনে পড়ছে ' বলে উঠলেন শুভজিৎ বাবু। ' হ্যাঁ রে আমার ও এই কদিন ছোট বেলার কথা খুব মনে পড়ছে; সেই অভাবের দিন গুলোর কথা, পড়াশোনা না করে আমার কাজে চলে যাবার কথা, তোর কলকাতা চলে যাবার কথা আর আমার একা হয়ে পড়ার কথা ' ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো প্রকাশ; ওর গলায় আজ একরাশ অভিমান। ' একটু একটু করে সংসার টা গুছিয়ে নিচ্ছিলাম রে; একটু একটু করে এগোচ্ছিলাম, আজ একঝটকায় অনেক টা পিছিয়ে পড়লাম! সঞ্চয় বলতে আমার তেমন কিছু নেই রে; অল্প যেটুকু ছিল তাও এই লকডাউনে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে! পেট তো আর লকডাউন মানছেনা! কি আর করব! ' একনাগাড়ে বলে চলে প্রকাশ।  আমি ও জানি রে লকডাউন ছাড়া কোনো উপায় নেই; কারণ আগে বেঁচে থাকা। আমি ও বাড়ি থেকে বের হচ্ছি না। কিন্তু কি করব? আমাকে তো আর মুদির দোকানে বাকি দিচ্ছেনা!' আজ প্রকাশ থামছে না কিছুতেই। এদিকে হাজার খানেক বই পড়া শুভজিৎবাবু কিছুতেই কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না প্রকাশকে বলার মত।

===============