অতনু টিকাইৎ-এর 'কিছু কথা ছিল' গ্রন্থটি গল্পগ্রন্থ।এই গ্রন্থের প্রত্যেকটি গল্প ভিন্ন স্বাদের। কোনো গল্পটি অণুগল্প কোনোটিকে বা ছোটোগল্পও বলা যেতে পারে।সতেরোটি গল্প নিয়ে সেজে উঠেছে 'কিছু কথা ছিল' গল্পগ্রন্থটি।গ্রন্থটির মুখবন্ধে লেখক বলেছেন-"এ গ্রন্থের সতেরোটো গল্প ভিন্ন ভাবনার।মনুষ্যত্বের অবক্ষয়,পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েন,বিভিন্ন আর্থ সামাজিক দ্বন্দ্বের কথা বলে।"হ্যা লেখকের এই মুখবন্ধে মিথ্যের কোনো আভাসমাত্র নেই তা গ্রন্থটি নিবিড়ভাবে পাঠ করলেই বোঝা যাবে।
গ্রন্থের প্রথম গল্পটি হল ধর্মের থাবা।তবে এই ধর্ম বলতে কোনো সাম্প্রদায়িক বিভেদ নয়।ক্যানসার রোগে মৃত এক বৃদ্ধার দাহ করার দৃশ্যে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে শ্রুতি ও সন্দীপ নামের যুগলমূর্তি।কেননা গল্পে দেখানো হয়েছে দাহ করার সময় শরীরের সমস্ত বসন খুলে নেওয়া হচ্ছে।এরকম দৃশ্য দেখে অস্থিরতা কাজ করে শ্রুতির মধ্যে।শ্রুতি সন্দীপকে কথা দিতে বলে যে তার মৃতের পর যেন অন্তত দেহের বসনটি রেখে দাহ করা হয়।লেখক এই গল্পে নিজ ধর্মেরই এক অমানবিক দৃশ্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
আরেকটি গল্পে পলাশবাবু নামের এক নামমাত্র ভদ্রলোক এক বয়স্ক সবজিওয়ালাকে গালিগালাজ করতে থাকে সবজির দাম পলাশবাবুর মাত্রার মধ্যে না হওয়ার দরুণ।এমনকি জাত নিয়েও গালিগালাজ করতে বাদ দেয়নি পলাশবাবু।অন্যদিকে তার বন্ধু অম্বিকেশবাবু তাকে উদাহরণ সহকারে তার ভুল ধরিয়ে দেয়।আসলে আমরা নিম্মবৃত্ত মানুষকেই গালিগালাজ করতে পারি এবং উচ্চবৃত্ত মানুষদের ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিবাদ চাঁপা পড়ে যায় তারই একটি দৃষ্টান্ত লেখক খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন।
'সুদীপ্তকে যেভাবে দেখেছি' গল্পে মানবতাপরায়ণ সুদীপ্তকে লেখক তুলে ধরেছেন পাঠকমহলে।'ফিরে দেখা' গল্পে বাবান এক কুলিকে একপ্রকার অপমান করার পর বাড়ি এসে তার মার কাছ থেকে তার বাবার প্রকৃত অবস্থার কথা জানতে পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকে।'জীবনযাত্রা' গল্পে রমানাথের মতো আড্ডাবাজ ছেলে বাবা মারা যাবার পর যে কোনো ধরনের কাজ করার জন্য রাজি হয়ে কাজ খুঁজতে থাকে।
'নীরব প্রতিবাদ' গল্পে পেটের দায়ে একটি ছেলে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়।তাকে গল্পের নায়ক অম্বিকেশবাবু ছাড়া সকলেই পেটাতে থাকে।অম্বিকেশবাবুর কিছু করার না থাকলেও বিজয় মালিয়ার টাকা লুট করার প্রসঙ্গ তুলে নীরব প্রতিবাদ গড়ে তোলে।'ভোট' গল্পে রাজনৈতিক নেতারা নির্বাচনে জয়লাভ করার জন্য কতটা অমানবিক হতে পারে তারই বাস্তব রূপে তুলে ধরেছেন গল্পকার।
'জবাবদিহি' গল্পে একরখা,জেদী মানুষের জেদের কি পরণতি হয় তারই বাস্তব রূপ গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।'রাজনীতি' গল্পে মানুষ সাম্প্রদায়িক বিভেদ বা নিজ ধর্মের প্রচারের জন্য রাতারাতি কিভাবে দেবতার সৃষ্টি করে ভন্ডামি করে থাকে তা তুলে ধরা হয়েছে।এই গল্পটি পড়ে শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা 'দেবতার জন্ম' গল্পের কথা মনে পড়ে যায়।
'সোহেল এবং ভারতবর্ষ' গল্পে সোহেল মুসলিম হয়েও সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সাহায্য করে থাকে।সে বিভেদ মানে না।আসলে আমাদের ভারতবর্ষও ঠিক এরকমই।এখানে বহু ধর্মের মানুষ থাকলেও ভেদাভেদ থাকবে না।একে অপরের পারস্পরিক মেলবন্ধন নিয়েই আমাদের ভারতবর্ষ।কিন্তু আমাদের চেনা ভারতবর্ষ কোথাও যেন হারিয়ে গেছে যদিও এই ভারতবর্ষ বেঁচে আছে সোহেলের মতো মানুষদের জন্য।
'শরীর সংলাপ' গল্পে মহুয়ার স্বামী বিভাসের অ্যাক্সিডেন্টের পর তার এক পা ও হাত কাটা পড়ে যায়।ঠিক তখন থেকেই মহুয়ার প্রেম জমে গেছে অরিন্দম নামক এক ছেলের সঙ্গে।যদিও তা ভালোবাসা নাকি সাময়িক আকর্ষণ তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।'অহঙ্কার' গল্পে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা কতটা সরল ও উদার প্রকৃতির হয় তার একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হয়েছে।
'ধর্ম' গল্পে কবির সরকার নামক এক গায়ক ও কবি সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কিভাবে তাদের আসন সরিয়ে দিতে পারে এবং এই সমস্ত গায়ক ও কবিদের কোনোভাবেই যে দমিয়ে রাখা যায়না তা স্পষ্টভাবে বোঝানো হয়েছে।'শিল্পী' গল্পে একজন শিল্পী পরিস্থিতির স্বিকার হয়ে, আর্থিক টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ে অন্যায়কারীর সঙ্গে গলা মিল করতে বাধ্য হয় এরকমই একটি দৃষ্টান্ত ধরা পড়েছে গল্পকারের কলমে।
'টান' গল্পে পুরনো জিনিসের মধ্যে যে স্মৃতি রচনা হয় তা শত পুরানো হলেও যে তার প্রতি একটা টান থেকেই যায় তা বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।'সময়' গল্পে সময়ের যে শক্তি,সময় মানুষকে কোন জায়গায় নিয়ে আসতে পারে,কীভাবে মানুষকে পরিবর্তন করে দিতে পারে তা গল্পের নায়ক সুবলের মাধ্যমে উঠে এসেছে।
পরিশেষে বলা যায় অতনু টিকাইৎ-এর 'কিছু কথা ছিল' গল্পগ্রন্থটি পাঠক রুচিসম্মত একটি গল্পগ্রন্থ।গ্রন্থটির প্রচ্ছদ করেছেন ঋতুপর্ণা দাস। প্রচ্ছদ যেন অনেক কথা বলে দেয় সেই ধরনেরই একটি সুন্দর ও রুচিসম্মত প্রচ্ছদ পাঠকমহলে তুলে ধরা হয়েছে। আলোচ্য গল্পপ্রন্থটি পড়ে আমার মনে হয়েছে এ যেন লেখকের নিজের জীবনেরই টুকরো টুকরো গল্প। আসলে আমাদের প্রত্যকের জীবনই এরকমই টুকরো টুকরো গল্প নিয়ে সজ্জিত।
গ্রন্থ-- কিছু কথা ছিল
লেখক-- অতনু টিকাইৎ
প্রকাশনা-- সোনাঝুরি
মূল্য-- ৪৫টাকা
আলোচক্-- ফিরোজ হক্