ভাবনার সেতু বন্ধন
পর্ব-১
আজ বেলায় পায়ে পায়ে বাজার বেরিয়ে ন্যূনতম কয়েকটা জিনিস কিনতে পারলো না অয়ন। পকেটে একটু বেশি টাকা নিয়েই বেরিয়েছিল, যদিও চাহিদা বেশি ছিল না। দুটো দুধের প্যাকেট,দই ,খান দশেক ডিম আর বড়জোড় এক কিলো ময়দা। ধ্যাৎ এটুকু যদি বাড়ির চাহিদা মেটাতে না পারি কিসের জন্য তবে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়েছি ভাবতে ভাবতে অয়ন ফাঁকা চার মাথার মোড় টায় ইতস্তত ঘুরপাক খেলো একটা আতঙ্ক থম মেরে রেখেছে ভিড়ে ঠাসা এই রাস্তাটাকে যেন চব্বিশটা ঘন্টা ঝিমিয়ে আছে তার প্রাণবন্ত বনেদি শহর বর্ধমান।অন্যান্য দিন শুধু গন্ডা গন্ডা বাস,টাউন সার্ভিস তার প্যাসেঞ্জার ,শয়ে শয়ে ছাত্র ছাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা জেরক্স সেন্টার জমজমাট মিষ্টির দোকান লাইন দিয়ে আসা টো টো কোথায় কি সব ধূ ধূ করছে শ্মশানের যেন নিস্তব্ধতা। এমন শূন্যতা আজ নিয়ে তিন দিন হলো যেন বিদ্রুপ করছে মনমরা শহরকে।ফিস ফিস করে বলে গেল বাতাস,জলদি বাড়ি ফের নৈলে এভাবেই সব শেষ হয়ে যাবে নাগরিক জীবন যাপন,চোখের সামনে শুকিয়ে যাওয়া দেখতে হবে নিরুপায় কাঠপুতুল হয়ে।
ওই দূরে এক কোণে শতছিন্ন শাড়ি পড়ে দু চাররকম সবজি এক ঠাকুমা বিক্রি করছিলেন।ওনাকে দেখেই এগিয়ে গেল অয়ন। কি গো কেউ কোথাও নেই,তুমি এখনো বসছো? একটু যেন বাইরের মানুষটার সাথে কথা বলতে পেরে স্বস্তিতে সে। দাও তবে ওই ফালি কুমড়োটাই বলে চোখ খুঁজতে লাগলো যদি নিম পাতা পাওয়া যায়।ও ঠাকুমা কাল কি বসবে তাহলে একটু নিম পাতা এনে দিও তো বলে আবার পা বাড়ালো অন্য প্রান্তে যদি ওই প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পাওয়া যায়।মুদি ও ঔষধের দোকান গুলো অল্প হলেও সাটার খুলে রেখেছে কিন্তু এত লম্বা লাইন ! কখন যে পাওয়া যাবে যাই সামনের গুমটিটা খোলা রেখেছে নিশ্চয়ই, দুধ নিতেই হবে বলে লাইন ছেড়ে এগিয়ে গেল ।
না দুধ কি আর এই বেলায় পাওয়া যায়,দোকানও বন্ধ,তবে কাল ভোরে আসবো ভেবে খানিক দাঁড়াতেই মনে পড়লো , "আচ্ছা ওদের কি খবর, ফুটপাথে চট আড়ালে যে ভিখারি পরিবারটা থাকে "! ভাবনাটা আসতেই উদ্বিগ্ন অয়ন থলি হাতে রাস্তা টপকে ওপারে চলে গেলো।ওই তো ওদের বাচ্চা মেয়েটা ফুটপাথ জুড়ে টুকরো ইঁট নিয়ে লাল লাইন কেটে একা একাই কিৎ কিৎ খেলছে।ভিখারি বাবাটা অদূরে শুকনো গাছের ডাল কিছু পাতা সংগ্রহ করছে। হয়তো অন্য দিনের মতো তোবড়ানো টিনের হাঁড়িটায় দু মুঠো ভাত ফুটিয়ে নেবার তোড়জোড় করবে এবার।শুনশান রাস্তায় পথচারী লোক জনও নেই একটা দুটো এম্বুলেন্স গাড়ি চলে যাচ্ছে ভিক্ষা দেবেটাই বা কে! ওদের কিভাবে চলছে তবে-ভাবনার মাঝে সামনের ফ্লাটের কাজের কোনো দিদি হয়তো সবজির খোসা ফেলতে যেই ডাস্টবিনে এসেছে খেলা ছেড়ে সেটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলো ভিখারি কন্যা! কত আর বয়স ওই আমার মেয়ের থেকে এক দু বছর কমই হবে-ইস কিভাবে এরাও দু মুঠো খাবারের জন্য হন্যে হয়ে কাটাচ্ছে জনশূন্য শহরের পাহারাদার হয়ে এটা ভেবেই অয়নের মনটা হু হু করে উঠলো।
পর্ব-২
ফেরার পথে আর এক মুদির দোকানে দাঁড়াতেই দোকানি ইশারা করে লাইন দিতে বললেন-কিন্তু বাপরে এত বড় লাইন,সবার হাতে তো বিরাট বড় ফর্দ! আজ তো মাসের শেষ সপ্তাহ তবে মাস কাবারী বাজার এখন থেকে কিনে মজুত রাখার উদ্বিগ্নতা দেখে অবাকই হলো।এমন ভয় কেন পাচ্ছে মানুষ, সরকার তো মুদি দোকান খোলা রাখবে বলেছে।একজন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জানালো ডিম হয়ে গেল সাড়ে চার থেকে আট টাকা-গাড়ি ঢুকছে না জানিনা খাবো কি! একটা লোক লাইন না দিয়ে ঠায় চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।দেখছিলাম দোকানির চোখে কিছু একটা ইশারা করা যায় কিনা এই মনোবাসনায় মাস্ক পড়ে দাঁড়িয়ে এককোণে তিনি। অন্যদের হিসেব করার ফাঁকে গলা খাঁখাঁরি দিয়ে দোকানি কি চাই আপনার বলতেই তিনি সুরুৎ করে কাছে গিয়ে কানে মুখ রেখে পাঁচ প্যাকেট গোল্ড ফ্লেক সিগারেট চাইতেই দোকানদার ইতস্তত। স্যানিটারি ন্যাপকিন দেওয়ার ভঙ্গিতে কাগজের ঠোঙায় মুড়ে ২৭৫ টাকা দাম নিলেন। আমি তখনো ভাবছি আমার তো একটা মাত্র জিনিস এক কিলো ময়দা লাগবে নিশ্চয়ই দেবেন কিন্তু বিধি বাম! ময়দা নেই কাল আসুন যদি সাপ্লাই আসে বলে আমার কপালে চিন্তার ঘাম বাড়ালো।পেছনে দাঁড়ানো এক মাসিমা সিগারেট দিতে দেখে ততক্ষণে আবদার ছুঁড়ে দিয়েছেন যে আমায় দিন না চার প্যাকেট। "না না আমরা এভাবে সিগারেট বিক্রি করতে পারি না "দোকানি বলতেই মুখ ফস্কে আমিও বলে ফেললাম" সেই তো মানুষ প্রয়োজনীয় চাল আটা পাচ্ছে না আর নেশার জিনিস কিনতে অস্থির এনারা। হয়তো উনি লজ্জা পেলেন ,আমার সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো ঠিক যেন ওনার বাড়ির খন্ড চিত্র। অসুস্থ চেন স্মোকার কত্তা বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া না দিতে পেরে হাঁফিয়ে উঠেছেন নির্ঘাৎ তাই বুদ্ধিমতী শ্রীমতী ললিপপ কিনতে বেড়িয়েছেন।
ফিরছিলাম জুতোর শোলটা পাথরে আচমকা ঠোকা খেয়ে খুলে বেরিয়ে এলো! আশেপাশে কোথাও তো এখন এই কদিনে মুচি বসবে না!খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির সদর দরজা খুলতেই টিভি নিউজের শব্দ এলো।নিচের ঘরে বাবা টিভিতে খবর শুনছিলো। সরকার কত চটজলদি রাজনীতির উর্দ্ধে ওঠে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে দেখছি কদিন ধরে। ভাবনা এলো হাওয়াই চপ্পল নিয়ে কতো সমালোচনা হতে দেখে বড় হওয়া আমার সেই কলেজ জীবন থেকে। এবার দোকান বাজার স্বাভাবিক ভাবে খুললে একটা বরং ভরসার হাওয়াই চপ্পল কিনবো।
পর্ব-৩
করোনায় যত ঘরে কাটাচ্ছে মানুষ পেট ফেঁপে মরছে। শুধু খাই খাই কাজ আর কত কাঁহাতক ঘুম দেওয়া যায়। পুরুষ দের সে অর্থে বাইরের কাজ নেই বললেই চলে তবে কাজের মেয়েদের ছুটি দিয়ে গৃহস্থ বাড়ির হেঁসেল সামলাতে অস্থির গিন্নি , মায়েরা । আজও বাড়িতে মজুত থাকা সবজি থেকে বেশ ভালোই আয়োজন মন্দ হয় নি।মেরে কেটে চার রকম পদ কে খুব যে সামান্য আয়োজন বলে না সে মিথ্যাটা বলবো না।সে যতই ভারিক্কি আইটেম না হোক পাট শাক,কুমড়ো শাকের চচ্চড়ি,মাছের কালিয়া সঙ্গে আমের চাটনি ডাল তো ছিলই। এক একবার মনে হচ্ছে জুটে তো যাচ্ছে ঠাকুর করে যতদিন বাজারে অল্প স্বল্প জিনিস পাবো। কানে আসছে আড়তদাররা স্টক আটকে রাখছে,মুদির দোকানে অনেক কিছুই নেই শুনতে অভ্যস্ত হচ্ছে কান।মানুষেরও বলিহারি যাই! প্রয়োজন টুকু কেবল না কিনে কিনা এত এত কাঁড়ি কাঁড়ি দ্রব্য সংগ্রহে নেমেছে আর এটাই চাহিদা যোগানের মধ্যে ঘটাচ্ছে কৃত্রিম ক্রাইসিস ভারসাম্যহীনতা।ঘরে কাজকর্মহীন কাঁহাতক বসে থাকা আর যায়-কদিনেই সব বাড়ি থেকে ভাল্লাগে না এই শব্দে ফোন মারফৎ এসেই চলেছে।
ছোটবেলায় অনেকের অভিজ্ঞতা আছে মা যখন রান্নাঘরে বা বাড়িতে এক মনে সংসারের কাজে মন দিতেন ,সন্তান সন্ততি এক নাগাড়ে বিরক্ত করলে উনি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে লক করে দিতেন! কতবার এমন অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়েছে অয়ন এটা ভাবতে ভাবতে ঘরে খানিকক্ষন বসলো।মা কে তার খুব মনে পড়ছে ,আজই মায়ের বাৎসরিক কাজ হবার ছিল কিন্তু কি আর করা যায়। একটা আশ্চর্য্য মিল আছে আজ ২৭শে মার্চ ,এই আজকের দিনে মায়ের এক বছর মৃত্যুর তিথি পড়লো আর আজকের দিনেই মা শেষ বারের মতো নার্সিংহোমে গেছিলো আর ফেরেনি!এই এখন যে গৃহবন্দি হচ্ছে মানুষ এ বিষয়ে মনে পড়লো ছোটবেলায় যখন মা কে খুব জ্বালাতো, কাজ করতে দিতো না অয়ন মা ঘর আটকে বা নিচে খেলতে পাঠিয়ে এক মনে কাজ করতে যেত।
আজ করোনার চোখ রাঙানিতে নেহাৎ ভয় পেয়েছে মানুষ ।তবুও ভয় পেয়ে শুধরেছে আর বলি কি করে! সরকারের কড়া পদক্ষেপে বলা যায় বাধ্য হয়েছে সেই সঙ্গে নিজের পরিবারের সুস্থ থাকার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বলেই না কিছুটা নিরুপায় অবস্থান।এটা তো সত্যিই যে যারা ঘরে থেকে অভ্যস্ত তাদের জীবন যাত্রায় খুব একটা বিরাট ফারাক না এলেও যারা প্রতিনিয়ত ট্রেনে বাসে দৌড় ঝাঁপ জীবন কাটায় এ এক বিরাট ছেদ।যে ছেলে-ছোকড়া,কাকু-দাদাটি বাইরের ঠেকে আড্ডা দেয়,চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে বোল তোলে গসিপের,সেই কাকুমনি ,জ্যেঠু দাদুর দল কত আর টিভির খবরে করোনা করোনা শুনে আর ভালো থাকতে পারে এ এক ঝঞ্ঝাট,মানব সভ্যতার অস্তিত্বের সংকট বলা যেতে পারে।
পর্ব-৪
ডায়াবেটিস এর সমস্যায় থাকা প্রায় আটাত্তর বছর বয়স্ক বাবাকে নিয়ে অয়ন বেশ চাপে ছিল কিন্তু এখন বরং একটু নিশ্চিন্ত।রাঁধুনি দিদি পাঁচ ঘরের রান্নার দাপটে যা বিতিকিচ্ছিরি রান্না করে পালাতো এখন গৃহ বন্দি থাকায় পৃথা পুরোপুরি সে দায়িত্ব নিয়ে ফেলায় রান্নার পদ যেমন বেড়েছে রান্নার স্বাদও।খুব বয়স্কা কোথাও যাবার উপায় না থাকা কাজের মাসিকে মোটেও এ দুর্দিনে ছাড়ে নি তারা ।না কাজ করানোর জন্য নয় বরং এই মাসি কোথাও গিয়ে রাত কাটাতে পারে না কারণ এখানে বেশ বহাল তবিয়তে থাকে আর এটা সুনিশ্চিত করা অয়ন-পৃথারা অন্যতম কর্তব্য হিসেবেই ধরে।অবশ্য শ্বশুর মশাই বহুবার গজ গজ করেন,কটু কথা বলেও দেন। যতদিন পৃথা চাকরির সূত্রে ভিন জেলায় থাকতো ও মাঝে মধ্যে ছুটিতে অসুস্থ শাশুড়ি মাকে দেখতে এসে বিভিন্ন ভালো লাগা পদ বানাত ততবার দেখতো পুরুষমানুষ দের খবরদারি তে এ বাড়িতে দুমাস ছাড়া ছাড়া কাজের লোক ছেড়ে যাওয়া,পাল্টানো একটা রেওয়াজ হয়ে উঠেছিল।অয়ন বহুবার বাবাকে বুঝিয়েছে দেখো এদের যদি না দেখো,সুযোগ সুবিধা না দাও থাকবে কেন এরা,টাকার গরম দেখালে এমনই দুর্গতি হবে কিন্তু কে শোনে কার কথা!শুধু কামাই আর কামাই অগত্যা অয়ন কত দিন সকালে রান্না করে অফিস গিয়ে আবার ফিরে সময়ের মধ্যে রান্না করে অসুস্থ মা বাবাকে দিয়েছে।আজ সব কিছু ইতিহাস লাগছে,মা ও নেই তার ওপর এমন ঘরে বসে করোনার জন্য গৃহবন্দি।কিন্তু বাবা কম বেরুলেও হাঁফিয়ে উঠছে একবার বারান্দায় একবার খাট এই করেই কাটছে।
মায়ের বাৎসরিক এর কাজ সেই জন্য বাজার হাট মোটামুটি সব করা হয়েছিল অয়নদের।রাঁধুনি, ডেকোরেটর মোটামুটি সব বুক করে এডভান্স করা হয়েও গেছিলো কিন্তু তারপর এমন করোনা ঝড়ে সব উথাল পাথাল একপ্রকার তছনছ।দাদা-বৌদিরাও শেষ মুহূর্তে বাইরে থেকে আসা ক্যানসেল করতে বাধ্য হলো।এই অচলাবস্থা আশাকরি কাটবে তখন আবার এই বাজার হাট কাজে লাগবে এটা ভেবে স্নানঘরে ঢুকেই অয়নের কি যেন একটা মনে পড়ে গেল! আনন্দে চক চক করে উঠলো এই ভেবে যে আরে বাহ এখনই তো মায়ের কাজ হচ্ছে না,ওখান থেকে যদি কিছু চাল,ডাল একটু আগে দেখে আসা ফুটপাথের পরিবারটা কে দিয়ে আসি তবে তো বেশ হয়! মুহূর্তেই বাবার কথা মনে পড়লো,যেহেতু বিশেষ জন,জীবন সঙ্গিনী অয়নের মায়ের কাজ তাই বিষয়টি বেশ সেনসিটিভ ।তবু তার মন জোর পেল এটা ভেবে যে ওই চাল, ডাল গরীব পরিবারটিকে এই দুর্দিনে দিলে বরং মায়ের আত্মা শান্তি পাবে।এই সব সাতপাঁচ ভেবে স্নান সেরে খেতে বসলো অয়ন। ততক্ষণে বাবা ও মেয়ের খাওয়া হয়ে গেছে,মাসিও পৃথা নিজের খাবার বাড়ছে।"এই তুমি এত কি সব ভাবছো বলো তো"- তখন থেকে দেখছি বলে পৃথা প্রশ্ন করেই উত্তর পাওয়ার আগেই বলল একটা কাজ করে দেবে আমার,একবার টি কষ্ট করে বেরুতে হবে তোমায়।কৌতূহলী অয়ন তাকাতেই পৃথা আঙুল দিয়ে একটা প্যাকেট দেখিয়ে বলল,ওই আমাদের মেন রোডের পাশে ফুটপাথে যে ভিখারি পরিবারটা আছে না,বেচারারা কি খাচ্ছে এই দুর্দিনে কে জানে আমি ওদের জন্য কিলো পাঁচেক চাল আলু ডাল টুক টাক ব্যবস্থা করে রেখেছি একটু দিয়ে এসো প্লিজ কষ্ট করে।
এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে অয়ন তার মায়ের মালা পড়া পিকচারটা দেখলো আর মনে মনে পৃথার জন্য ভীষণ গর্বিত হলো।
==========