রম্য রচনা : !! এবং লোকডাউন কথা !!
************************************
লেখক :এম. রুহুল আমিন
****************************************
অনেকদিন পর একটা দীর্ঘ অবসাদ যাপনই বলা যেতে পারে |কুড়ি বিশের প্রথম কোয়াটারে সারা বিশ্বকে বিষ ভাইরাস এভাবে বিপর্যস্ত করে দেবে আমার মতো অতি সাবধানীরাও বোধহয় এ কল্পনা করতে পারেনি |এই সেবার ভারত -পাকিস্তান যুদ্ধ হবো হবো, ফেইসবুক আর হোয়াটস্যাপ এর পেজে ফিস ফিস শব্দ শুনে একগাদা চাল, ডাল, আলু, তেল, নুন কিনে ভাঁড়ার ঘর ভরতে লাগলাম |তো গিন্নির মেজাজ গেলো বিগড়ে !তারপর যত দিন যায় চাল , ডাল, আলুতে পোকা বাহিনীর আক্রমণ যত বেড়ে চলে, আমার কর্ণকুহরে গিন্নির ক্ষেপণাস্ত্র হানা ততই বেড়েই চলে |কিছু চাল, ডাল, আলু একে ওকে দিয়ে দিলে সে যাত্রায় গৃহযুদ্ধটা থেমে যায় |
মাঝের দিনগুলি বেশ কাটছিলো |কিন্তু গত বছরের শেষ নাগাদ চীনের উহানে কি একটা ভাইরাস ছড়িয়েছে শোনা যাচ্ছিলো |মাস গড়াতে না গড়াতেই সস্তা চায়না মালের মতো রোগটা চারদিকে এভাবে বাজার দখল করবে কেউ বোধহয় ভেবে উঠতে পারেনি |যদিও ' হু ' এই রোগটা চারদিকে হু হু করে ছড়াতে পারে তার একটা সাবধান বাণী শুনিয়ে ছিলো |এদিকে গৃহযুদ্ধের ভয়ে এবারে আর চাল, ডাল, আলু, তেল স্টক করার রিস্ক নিলাম না |রোগটা দিন দিন ভারতে থাবা বসাতে শুরু করছে, ব্যাপক হারে সংক্রমন ছড়ানোর ভয়ে সরকার মার্চ মাসের মাঝামাঝি নাগাদ বিদ্যালয়গুলি বন্ধ করে দিলেন আর সেই সাথে শিক্ষকগণকে অর্ধদিবসের পরিবর্তে পূর্ণ দিবস গৃহযুদ্ধে পাঠানো হলো |আমার ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হলোনা |বাইরে করোনা বাহিনীর হামলা যে হারে বেড়ে চলেছে সেই সাক্ষাৎ যমদূতের হাত থেকে বাঁচতে আপাততঃ গৃহের কোণকেই বেছে নিলাম |
ওদিকে পাশের বাড়ির ছেলেটা অকাল বোধনের ন্যায় বাড়তি ছুটি পেয়ে সারাদিন এর ওর সাথে টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে |ভাইরাস-টাইরাসের ভয় দেখিয়েও ধরে রাখা যাচ্ছে না |একান্ত নিরুপায় হয়ে ওর মা একদিন রাতের বেলা চুপি চুপি কাঁচি দিয়ে খাবলা খাবলা করে একগাদা চুল কেটে দিলেন |অগত্যা ছেলেটাকে নেড়া হতেই হলো |সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া ছেলেটা সেই থেকে আর বাড়ির বাহিরে পা দেয়না পাছে কেউ নেড়া নেড়া বলে রাগায় |ওষুধে কাজ হয়েছে দেখে অন্য সব মায়েরা এই পন্থার আশ্রয় নিলো |কিন্ত ফল হলো উল্টো !এখন সারা পাড়ায় নেড়াতে ভরে গেলো |কে কাকে আর নেড়া বলে ফলে, নেড়াদের জটলা বেড়ে গেলো | ওদিকে অনেকদিনের শখ পুষে রাখা কয়েকটা জোয়ান মরদ এই সুযোগে নেড়া হওয়ার শখ মিটিয়ে নিলো |এ যেন -"আমরা সবাই নেড়া, আমাদেরই নেড়ার রাজত্বে....|"
এই লোকডাউন পর্বে ভারত সরকারের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রক কেবল টিভিতে রামায়ণ, মহাভারত ও নব্বই দশকে ছোটোদের অতি জনপ্রিয় ধারাবাহিক 'শক্তিমান 'সম্প্রচার করার ছাড়পত্র দিলেন |এই সুযোগে পুরোনো দিনের নষ্টালজিয়াতে আবার একটু মেতে ওঠা গেলো |সেদিন কিছু অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়ের উদ্দেশ্যে বাজারে চলেছি |পথিমধ্যে কোনোএক বাড়ির কেবল টিভিতে রামায়ণ পর্ব চলছে কানে এল |ঐক্ষণে তাদের বাড়ির ছোট্টো কন্যাটি কিছুটা উৎসাহী হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো -সুর্পণখা রাবণের কে? উত্তরে মা বলে -রাবণের পিসি |পাশ থেকে তার বাবা বলে- না না, রাবণের মাসি |তারপর রামায়ণ গেলো থেমে, গৃহে মহাভারত শুরু হলো |আওয়াজ তীব্রতর হচ্ছে দেখে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়লাম |বাজারে গিয়ে দেখলাম লোকে লোকারণ্য, এতটুকুও মনে হলোনা দেশে মহামারী চলছে !যাইহোক নাকে গেঞ্জিকাপড়ের মাস্কটা লাগিয়ে খুবই সন্তর্পণে বাজার সেরে বাড়ির দিকে পা চালালাম |
এখন দিন কাটে বই পড়ে, কিছু লেখালিখি, বিবি-বাচ্চাকে সময় দেওয়া আর নেট মারা স্মার্ট ফোনের দেওয়ালে চোখ রেখে দেশ বিদেশের খবর রাখা |এই সেদিন গিন্নি আমারে ডেকে ডেকে কয়, দেখো দেখো, একটু দেখে শেখার চেষ্টা করো !একজন এম. পি হয়ে কিনা বৌয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছে !আর তোমার বিয়ের পাঁচ বছরে সব রোমান্টিকতা যেন কর্পূরের মতো উবে গেছে !পাছে মহাভারত শুরু হয়ে যায় এই ভয়ে আর কথা বাড়ালাম না |
এদিকে ভারত সরকার স্বাস্থ্য কর্মীদেরকে উৎসাহ দিতে বিকেল পাঁচটায় তালি ও থালি বাজানোর কথা বলতেই দেশ জুড়ে কি উৎসাহ উদ্দীপনা !অনেক জায়গাতে দেখলাম ঢোল, করতাল, কাঁসর, ঘন্টা, থালা, বাটি, চামচ যা যেখানে পেয়েছে তাই নিয়ে মিছিল সহকারে করোনার পিন্ডিদান করে ছাড়লো |
আর একদিন ফেসবুকের পাতায় চোখ রেখেছি, হঠাৎ দেখি সোনারপুর রেলস্টেশনের মাথায় কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছে |ক্ষণিক ছবিটার দিকে আবিষ্ট হয়ে যাই,পরে দেখলাম এটা নিছক রঙ্গতামাশা |তবে এই সময় বিশ্বজুড়ে পরিবেশের কিছুটা যে উন্নতি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা |লোকালয়ে বন্য জীবজন্তুদের আনাগোনা আর সকাল সাঁঝে বহু দূর থেকে ভেসে আসা আজানের সুর ও শঙ্খধ্বনি তারই ইঙ্গিত দেয় |
আরো কতশত ঘটনার ঘনঘটা উল্লেখ করা হলোনা |তবে লোকডাউনের বিষয়টি মোটেও তামাশার নয়, যেভাবে আমরা নিয়েছি |সেই সাথে আমাদের মতো জনবহুল গরিব দেশে লোকডাউন সত্যিই চাপের |ভিন রাজ্যে আটকে পড়া লাখো লাখো শ্রমিক ও দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার গুলোর আকুতির ছবি মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে |অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন |কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গুলো নিরলস ভাবে কাজ করে চলেছে |আশা রাখি -
"এই সব অন্ধকার কেটে যাবে,
পথঘাট আবার কোলাহলে ভরে যাবে |"
(সমাপ্ত )
******************************************
নিবেদনে :এম. রুহুল আমিন, গ্রাম &পোষ্ট -চন্দনেশ্বর, থানা -ভাঙ্গড়, জেলা -দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পিন কোড -743330, contact no -993309151, email -
alordishariacademy@gmail.com
******************************************