ডুমুরের ফুল
---------------------------------------------------------
ডুমুরগাছের আগাটা মুচড়ে ভাঙতে গিয়ে মুখ- চোখ বিকৃত হয়ে গেল শিপ্রার। কী শক্ত রে বাবা! তেমনই খসখসে আর ধারালো। হাতের পাতাটা লাল হয়ে জ্বালা করছে। হাল ছেড়ে দিল। জানালা থেকে সরে যথাস্থানে গিয়ে অল্প অল্প দুলতে লাগল গাছটা। মাথাটা দুমড়ে আছে এখনও। দোলার ভঙ্গিটি কেমন যেন বিদ্রূপাত্মক। মনে হল শিপ্রার।
' কী ডাগর- ডোগর ডুমুরগুলো গো। খাও না কেন তোমরা?'
রীনাদির কথায় ওইদিন মুখ বেঁকিয়েছিল সে। দু-চক্ষে দেখতে পারে না গাছটাকে। সত্যি একটা উৎপাত! দেওয়ালের হাঁ- মুখের ভেতর গজিয়ে উঠে রাতারাতি ঝাঁকড়া হয়ে ঢুকে আসতে চায় ঘরের ভেতরে। যেমন মশা হয়, তেমন অন্ধকার! এমন বেয়াড়া জায়গায় হয়েছে, কাটবে যে তারও উপায় নেই। পাশের বাড়ির ছাদে উঠতে হবে তাহলে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। শিপ্রারা এই এলাকার কারো সঙ্গে মেশে না। কলোনি পাড়ার লোকজন সব, তাদের স্ট্যাটাসের সঙ্গে মেলে না।
বাদল এলে তাও কায়দা করে জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কিছুটা ছেঁটে দিয়ে যায়। এখন তো তারও উপায় নেই। লকডাউন শুরু হয়ে গেছে গোটা দেশ জুড়ে। কী এক মারণ ভাইরাস যে এল! সারা পৃথিবীতে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে। সব বন্ধ চারদিকে। বাড়ির বাইরে বের হলেই পুলিশ আটকাচ্ছে। বলছে তো একুশ দিন পরেই উঠে যাবে লকডাউন। যদি না ওঠে? মায়ের জন্য কফি বানাতে বানাতে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় স্টোররুমের ভেতর। কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করে। মোটামুটি সব মজুত আছে। স্যালারি ঢুকলে আরও কিছু কেনাকাটা সেরে রাখতে হবে। এখন তো ওয়র্ক ফ্রম হোম। আড়চোখে ঘড়ি দেখে। সাতটা বাজতে যায়। কনফারেন্স মিটিং- এর সময় হয়ে এল।
(২)
ল্যাপটপটা বন্ধ করে শিপ্রা। দু-হাতে মুখ ঢেকে ধপ করে বসে পড়ে খাটের ওপর। জার্মানির প্রোজেক্টটা বন্ধ হয়ে গেল আজ থেকে। আসলে কোম্পানিটাই উঠে গেল। অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে সেই দেশের। শিপ্রার কোম্পানিও ধুঁকছে। বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক সংস্থা দু- মাসের স্যালারি দিতে পারেনি কর্মচারিদের। চাকরি গেছে অনেকের। নতুন প্রোজেক্ট না পেলে হয়তো ছাঁটাই হয়ে যাবে শিপ্রাও। ভারতে লকডাউন একুশ দিনের মেয়াদ পেরিয়ে এখন তিনমাস। মৃত্যুর হিসেব নেই কোনো। বাড়ির বাইরে পা রাখলেই জেল।
ঘরে সামান্য চাল পড়ে আছে। দু- প্যাকেট বিস্কুট। বেরিয়ে কিনবে যে সে উপায় নেই। সাহসও নেই। আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। সারাক্ষণ হাত ধুতে ধুতে, দরজা- জানালা মুছতে মুছতে নিজেকে কেমন যেন উন্মাদ, বাতিকগ্রস্ত মনে হয়। দুশ্চিন্তা গাঢ় হয় কপালের ভাঁজে। আজ থেকে কী খাবে তারা? অনলাইন শপে অর্ডার করতে গিয়ে বার বার ক্যানসেল হয়ে যায়। সমস্ত স্লট বুকড। ভেবে কূল পায় না শিপ্রা। গরীবদের জন্য ফ্রি কমিউনিটি কিচেন চালু হয়েছে বেশ কিছু। টোল ফ্রি নম্বরে যোগাযোগ করলে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেবে। নম্বরটা খুঁজে বের করে। কল করতে গিয়েও থমকে যায়। কোথায় যে বাধে...
বিছানা থেকে উঠে জানালার পাশে সরে আসে সে। গাছটা আরো বড়ো হয়েছে। থোকা থোকা ডুমুরে ভর্তি। জানালা দিয়ে গলে আসা পাতারা শিপ্রার মাথায় হাত বোলায়। দু-চোখ বেয়ে জল গড়ায় তার। একটা একটা করে ডুমুর তুলে দু- হাতের মুঠোয় জড়ো করে। কৃতজ্ঞতায় চুমু খায় বন্ধ মুঠোয়।
কলিং বেল বেজে ওঠে এমন সময়।নিজের কানেই অচেনা ঠেকে কেমন। ঠিক কতদিন পরে শুনল! মনে করতে পারে না। ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখতে চেষ্টা করে কৌতুহলে। দুটো ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস। হাতে বেশ বড়ো কয়েকটা প্যাকেটও রয়েছে।
' দিদি, আমরা এই পাড়াতেই থাকি। বাড়ি থেকে একদম বের হতে না পারায় নিশ্চয়ই খুব অসুবিধায় পড়েছেন, তাই না? সেই ভেবেই পুলিশের অনুমতি নিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। আপনাদের জন্যও এনেছি। গেটের বাইরে নামিয়ে রেখে গেলাম। আমাদের ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। কোনোরকম অসুবিধায় পড়লে জানাবেন দিদি। আর হ্যাঁ, এভাবে নিতে অস্বস্তি হলে আপনি না হয় জিনিসের দাম দিয়ে দেবেন। কেমন? '
শিপ্রা প্রত্যুত্তরে কিছু বলার আগেই বাইকে স্টার্ট দেয় একজন। মিলিয়ে যায় চোখের নিমেষে। দূরে। ওই মাঠের দিকে। কলোনিপাড়ার মাঠ। সেখানে অজস্র ডুমুর গাছ। মনে মনে দেখতে পায় শিপ্রা। ফুলে ফুলে ভরা। সাদামাটা। আন্তরিক। বন্ধুবৎসল।
------------------------------------------------------------
পিয়ালী মজুমদার
১৯ নং, বান্ধবনগর, বেলঘরিয়া
কলকাতা- ৭০০০৫৬
চলভাষঃ ৯০৫১৯০৯৭২০