নভেল করোনা ভাইরাস
করোনা ভাইরাসের অনেক প্রজাতি থাকলেও মাত্র সাতটা প্রজাতি রোগ ছড়ায়। নভেল বা নতুন করোনা ভাইরাস যার নাম WHO দিয়েছে SARS COV2 বা সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম করোনা-২। এই কভ-২ মানুষের শরীরে কোভিড-19 বা করোনা ভাইরাস ডিসিজ বা রোগ ছড়ায়। ভাইরাসটার আরেক নাম 2019 এন সি ও ভি (2019-NCOV)। এর সংক্রমণের হার প্রচণ্ড বেশি। সারা পৃথিবীর 166টা দেশ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত। ২০১৯র ডিসেম্বর মাসে চীনদেশের ইউহান প্রদেশে সর্বপ্রথম এই রোগটি হয়। এই রোগে বয়স্ক ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম ব্যক্তিরাই মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। বার বার মিউটেশন অর্থাৎ জিনের সজ্জা বদল করতে পারে বলে এই ভাইরাস সহজেই পরিবর্তিত পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিয়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। COVID-19 এর কোন প্রতিষেধক টীকা এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। করোনা ভাইরাসের বৈশিষ্ট্য হল এর প্রোটিন ক্যাপসুলের একটা কাঁটাযুক্ত আবরণী থাকে দেখতে মুকুটের মত তাই নাম করোনা বা মুকুট। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশির সময় যে অতি সূক্ষ্ম জল ফোঁটা বা ড্রপলেট তৈরী হয় তার মাধ্যমে এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। ঐ রুগীর কাছাকাছি কোন ব্যক্তি যদি নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ঐ সূক্ষ্ম জল-ফোঁটা গ্রহণ করে তবে রোগী সংক্রমিত হবে। শুধু তাই নয় যে সমস্ত জায়গা ঐ আক্রান্ত ব্যক্তি ছুঁয়েছে সেই স্থানে যদি অন্য ব্যক্তি হাত দিয়ে সেই হাত চোখে, মুখে, নাকে ছোঁয় তো অপর ব্যক্তিরও রোগটি হয় আর এভাবেই দ্রুত রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে।
আমরা জানি ভাইরাস মানেই জীব ও জড়ের মধ্যবর্তী একটি বস্তু। পোষকের দেহে এটি সজীব হয় এবং বংশবৃদ্ধি করে পোষকের দেহের উপাদান নিয়েই। যেমনি করোনা ভাইরাস নতুন ব্যক্তির দেহে আসে সে বংশবৃদ্ধি শুরু করে। করোনার প্রোটিন কাঁটাতে যে রিসেপটর বা গ্রাহক থাকে সেগুলি অনুকূল গ্রাহক পেলে খাপে খাপে একদম বসে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই এর ক্যাপসুল ও প্রোটিনের আবরণীটা গলে যায় আর ভাইরাসের RNAটা সংক্রমিত ব্যক্তির শরীরে ঢুকে পড়ে ও প্রথমে DNAতে রূপান্তরিত হয়ে অসংখ্য প্রতিলিপি গঠন করে প্রচুর নতুন করোনা ভাইরাস উৎপাদন করে। সেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিকে করোনা পজিটিভ বলা হয়। নতুন ভাইরাস কোষগুলি শ্বাসনালীর মিউকাস ও সিলিয়েটেড কোষ নষ্ট করে নিউমোনিয়া রোগ সৃষ্টি করে প্রথম পর্যায়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে শরীরের অন্য রোগ প্রতিরোধ কোষগুলি ঐ নিউমোনিয়া প্রতিরোধ করতে এগিয়ে এলেও তারা বিপুল সংখ্যক ভাইরাসের জন্য দিশেহারা হয়ে শরীরের সব কোষগুলিকেই ধ্বংস করতে শুরু করে। তৃতীয় পর্যায়ে ফুসফুস নষ্ট হতে শুরু করে, বায়ুথলিগুলি পাতলা হয়ে যায়। ফুসফুসে কোষরস বা জল জমতে শুরু করে এবং শ্বাসকার্যের অভাবে রুগীর মৃত্যু হয়। কারুর ক্ষেত্রে দিন দুয়েকের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়, কারোর ক্ষেত্রে হপ্তাদুয়েক। এই সময়কে বলে ইনকিউবিশন পিরিয়ড। নভেল করোনা ভাইরাসের পিরিয়ড পাঁচদিনের মত। এইসময় সংক্রমিত কেউ না জেনেই আরও অনেককে সংক্রমিত করতে পারে। এই ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে হলে আমাদের অবশ্যই নিজেদের মধ্যে সামাজিক দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে হবে যাতে একজনের ভাইরাস আর একজনের কাছে পৌঁছতে না পারে। যতদিন না পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে ততদিন এই দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
WHO নভেল করোনা ভাইরাসের এই বিপুল সংক্রমণের পরিস্থিতিকে প্যান্ডেমিক বা অতিমারী ঘোষণা করেছে। ভারতেও বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। তাই আসুন আমরা কিছু সতর্কতা সবাই অবলম্বন করিঃ-
১। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সাবান জল দিয়ে ভালভাবে হাত ধুতে হবে।
২। ৭০% অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার ব্যবহার করে হাত পরিষ্কার করতে হবে।
৩। নাকে, মুখে, চোখে হাত দেওয়া এড়িয়ে চলতে হবে।
৪। সর্দি-কাশি, জ্বর হয়েছে এমন ব্যক্তির থেকে অন্তত একমিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
৫। রুমাল বা টিস্যু পেপার ব্যবহার করতে হবে।
৬। রুমাল না থাকলে কনুই বা কাঁধের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে হাঁচতে বা কাশতে হবে।
৭। ব্যবহৃত টিস্যু পেপার ঢাকনা দেওয়া ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।
৮। সুসিদ্ধ খাবার খেতে হবে।
৯। ভিড় থেকে দূরে থাকতে হবে, সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে।
১০। খুব অসুস্থ বোধ না করলে বাইরে যাওয়া একদম বন্ধ করতে হবে।
১১। অসুস্থ বোধ করলে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
উপরিউক্ত স্বাস্থ্যবিধিগুলি মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর জল পান ও সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণও বিশেষ প্রয়োজন। সংক্রমণের হার কমাতে জনসংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সাথে সাথে করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের যথাযথ সৎকার সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই সবাই মিলে আসুন করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করি নির্দেশমত স্বাস্থ্যবিধি মেনে। একদিন আঁধার কাটবে-সূর্য উঠবে এই আশায় পথ চেয়ে আছি সবাই।
=============
ডঃ রমলা মুখার্জী
বৈঁচি, বিবেকানন্দ পল্লী,
হুগলী, ৭১২১৩৪, পঃ বঃ
হোয়াটসঅ্যাপ- ৯৪৭৪৪৬২৫৯০
মোবাইল- ৭০০৩৫৫০৫৯৫