করোনা করুনা করে না
কাজ কাজ আর কাজ। লক্ষ্মী বাউরি র দম ফেলার ফুরসত নেই। কি করেই বা থাকে। হরি সান্যালের বাড়ি বলে কথা ।
মস্ত বাড়ি, দালান , দুতলার উপর মস্ত ছাত।
লাল বড় গাড়ি চক চক করে, বাবু যখন কাজে যান তখন উর্দি পরা চালক দরজা খুলে দাঁড়ায় লক্ষী হাঁ করে দেখে।
সে তো গ্রামের গরীব ঘরের মেয়ে। বাপ মা নেই। এক মামা , গ্রামের সজন হেলার সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। মামাশশুর ও জামাই এক সাথে বসে চোলাই খায় আর বৌ পেটায়। সহ্য করতে পারেনি লক্ষী, পেটে খিদে, শরীরে কালশিটা, কাটা, ব্যাথা; একদিন গ্রামের কালিন্দির সংগে শহরে পালায়।
বরাত ফেরে বড়লোক বাবুর চোখে পড়ে যায়। বাবুর দয়ার শরীর, বাড়ি এনে গিন্নিমার হাতে তুলে দেয়।
সেই থেকে এখানে, গিন্নিমার দয়ায় পেট ভরে খেতে পায়।
পরার কাপড় পায়, শোবার মাদুর বালিস, গায়ের চাদর! আর কি চাই।
জীবন দিয়ে কাজ করে মেয়ে, মা মরা মেয়ে মায়ের মতন ভালোবাসে।
গিন্নিমার সন্তান নেই , লক্ষী মেয়ের মনে সেবা করে। চুলে তেল দেয়,জট ছাড়ায়, পা ডলে দেয়, আর সেবা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করে।
গিন্নিমার ঘরের দুটি আলমারী ঠাসা কাপড় সারিকতো সুন্দর, এমন কাপড় লক্ষী কোনো্ দিন চোখেই দেখেনি। আলমারীর দেরাজে ঠাসা সোনার গয়না, গিন্নিমা রোজ নতুন সারি নতুন গয়না পড়েন। ঠিক যেন রাজরাণী।
দুটি মানুষ তাদের কাজের লোক ছয় জনা। হবেই তো, এতো বড়ো প্রাসাদ সামলানো কি সহজ কথা।
শহরে কি যেন ছাই অজানা জ্বর হচ্ছে, করুনা নাম। অবাক কান্ড অসুখের নাম করুনা ! সে যাই হোক বাবুর বাড়ির সব কাজের লোক ছুটি নিয়েছে এক সাথে, একা লক্ষীর উপর সব দাইত্ব, দিন রাত এক করে মেয়ে মা, বাবার জন্য কাজ করে চলেছে। তাতে কি নিজের বাবা মা হলেও তো করতে হতো।
এর মাঝে গ্রামের রশিদখুড়া এসে ছিল, হাতে কাগজের উপর কালি দিয়ে লেখা।
লক্ষী বলে আমি কি নেখা পড়া জানি? তুমিপড়ে শোনাও ।
খুড়া বলে – মা রে , এ তোর মরদের লেখা , তবু পড়ছি শোন।
সে লিখেছে- লক্ষী বৌ আমার বড় জ্বর, আর বুঝি বাঁচবনি। একবার আয়,
তোকে দেখি, অনেক দোষ করেছি বৌ মরার আগে ক্ষমা চাইব রে। তুই আয়, আর রাগ করে থাকিসনি।
লক্ষীর বুক উথাল পাথাল , দু:খে , সুখে, বেদনায়, চিন্তায়। মুখে বলে খুড় আমি এই আসছি, তোমার সাথে যাব। মাঠাকরুনকে বলে আসি।
গিন্নিমা ঘরে খাটে বসে পান সাজছেন, লক্ষী এসে কেঁদে বলল
মা গো, খবর এসেছে সোয়ামীর জ্বর, আমি এখুনি যাব। কিছু টাকা দাও।
সে কি তোর স্বামী আছে নাকি , মায়ের মুখে বাঁকা হাসি!
কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা কেন মা! তুমি তো সবই জানো।
আমার মাইনা বাবদ কিছু টাকা দাও মা।
তুই এখানে থকিস, আমার অন্নে , বস্ত্রে বাঁচিস, কতো খরচ হয় জানিস।
এমন ভাবে বোলোনা মাগো, পেটের জ্বালায় ঘর বর ছেড়ে এখানে পরে আছি। এক হাতে সব কাজ সামলেছি ! কিছু টাকা ও কি আমার জমেনি মা।
অনেক বড় কথা বলিস, তোর বরের করোনা হয়েছে, মরবে নিশ্চয়, তুই কি করবি গিয়ে। এখানে কোনো লোক নেই তাই ফন্দি করে পালাতে চাস, আমি বুঝিনি ভাবিস। এখান থেকে কত টাকা গয়না দেশে পাচার করেছিস কে জানে।
ছি মাগো এমন কথা বোলোনা। টাকা ছাড়াই যাব আমি, দেখি কি আছে কপালে।
টাকা চাইনা।কিন্তু বিনা দোষে ....
চুপ কর, ছোটোলোক কোথাকার। আমি বলছি তুই চোর চোর চোর।
ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না। টাকা দিয়ে চাকর বাকর, ডাক্তার বদ্যি সব পাব! তোরা মর।
চুপ করো মা আর বোলোনা। এতো কঠিন প্রাণ? ভগবানের ভয়টাও পাও না কি!
তবেরে ছোটো মুখে এতো বড়ো কথা....
হয়তো যে হাত তুলেছিলেন লক্ষীর গালেই পড়তো যদি না বাবু এসে বাধা দিতেন।
চোখের জলে বুক ভাসিয়ে, এক কাপড়ে খুড়়োর হাত ধরে ঘরের বৌ ঘরে ফিরল।
তার পর যমে মানুষে টানাটানি, দিন রাত এক করে সেবা করে চলে লক্ষী আর মনেমনে ভগবান কে ডাকে। বর তার জ্বরে বেহঁশ, কাশি সর্দি
নানান উপসর্গ কিন্তু ঠাকুরের কৃপায় এ জ্বর সে জ্বর নয়। ডাক্তার বলে গেলেন, অতিরিক্ত মদ, তার উপর অন্ন নেই, পথ্য নেই। শুধু সেবা আর পথ্য তে হবে না, পেট ভরে খেতে দিতে হবে। লক্ষী সবার ঘরেঘরে কাজ করে যা পায় তাই খাওয়ায়, ডাক্তার বাবু ভগবান, বিনা পয়সায় ওষুধ দেন।
এক সকালে লক্ষী দেখে বরের কপাল ঠান্ডা, চোখে জল, মুখে হাসি।
লক্ষীর হাত ধরে বলে আমায় ক্ষমা করে দে। দেখিস আমি আর মদ ছোঁবোনা, তোকে কষ্ট দেবনা, কাজ করব, টাকা আনব, তুই আমায় ছেড়ে যাসনি।।
লক্ষীর অন্তর বানভাসী, সুখসমুদ্রে ঢেউ।
অদৃশ্য ভগবানের উদ্দেশে মানত করে , গিন্নিমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবে। সত্যি তো ছোটো মুখে অনেক বড় কথা বলেছে ।হাজার হলেও গুরু জন তো।
একটু বেলায় গরম ফ্যান ভাত কচু সেদ্ধ কাঁচা তেল লংকা মেখে খেতে বসেছে
নতুন বর বৌ যেন।
কালিন্দি এসে উপস্থিত । জানিস কি তোর গিন্নিমা তো আর নেই।
মানে!
করোনা জ্বরে পড়ে ছিলেন, ডাক্তার অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি।
লক্ষীর মন ভাড়ি, চোখে জল, সে তো সত্যি মা বলে ডেকেছিল।।
=================