ভয় কাটিয়ে আবার নতুন সকাল
রাঢ়বঙ্গে তো এবারো পলাশ ফুটেছিলো অনেক, দেখতে গিয়েছিলো কি কেউ তাদের আর পলাশ উতসব?না জানতে পারিনি সেসব কিছু।ডুয়ার্সের শাল সেগুনের জঙ্গলে ঝরা পাতার মধ্যে দিয়ে আওয়াজ তুলে হাত ধরাধরি করে গিয়েছিলো কি কোন প্রেমিকযুগল-যখন দূরে হয়তো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছিলো ভূটান পাহাড়ে আর বহুদূর থেকে,চা বাগানের নালা থেকে, তাদের ওপর নজর রেখেছিলো কি ডোরাকাটা বাঘ?সবই চলে গেলো এবছর এমনি এমনিই-চৈত্র মাস-বসন্তকাল-ঝরাপাতা-হু হু হাওয়া।খুব মনে পড়ে ছোটবেলায় এসময় আমাদের পরীক্ষা হয়ে যেতো।রেজাল্টের আগে কোন বছর হয়তো আমরা কোন আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যেতাম-কোন বছর কেউ আমাদের বাড়ি আসতো।ভাইবোনেরা মিলে তখন সারাদিন বাড়ি গমগম করতো,খুব খেলা আর হুটোপুটি হত সারাদিন ধরে।এরকম তখন প্রায় পাড়ার সব বাড়িতেই আত্মীয়েরা ঘুরতে আসতো,ফলে অনেকের ভাইবোনই আমাদের চেনা হয়ে গিয়েছিলো।আমরা সারা দুপুর ধরে দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতাম কোথায় কোথায়-তার ঠিকানা নেই।বাড়ি ঢুকতে অনেক বেলা হয়ে যেতো।তারপর মা-মাসীরা সব বকতে থাকতো আমাদের আর আমরা সকলে স্নান করতাম একসাথে।
তারপর তো খাওয়া।খাওয়াদাওয়া যে নিম্নবিত্ত পরিবারে খুব উন্নতমানের আসতো তা তো নয়,তাবে হাতের গুণে তার উতকৃষ্টতা এমন জায়গায় পৌছতো,যে আজ পঁচিশ তিরিশ বছর পরেও সেসবের স্বাদ মনে পড়ে যায়।সে সময়ের খাওয়া দাওয়ার মধ্যে খুব মনে পরে কাঁচাকলার খোসা বাটা বা ডিমের বড়ার ডালনা।ওতদিন আগে আমাদের মফস্বলে তো পনীর পাওয়া যেতো না,নিরামিষ রান্না হোতো ছানার ডালনা।এরমধ্যেই চলে আসতো চৈত্র সংক্রান্তি –পয়লা বৈশাখ।চৈত্র সংক্রান্তির আগে আমরা পেছন ধরতাম গাজনের দলের-কোথায় কোথায় যে চলে যেতাম তাদের সাথে।লাল কাপড়-মাথায় লাল সিঁদুরের টিপ-হাতে ত্রিশূল-কাঁধে চড়কের কাঠ-ঝিম ধরানো দুপুরে হঠাত আওয়াজ উঠতো-শিবো হে, বাবা মহাদেবের চরণে সেবা লাগে।চড়কের মেলা আসতো একদিন এভাবেই।অবাক হয়ে দেখতাম কিভাবে লোক ঘোরে পিঠে বঁড়শি ঢুকিয়ে।অবাক হয়ে যেতাম তাতে তাদের এক ফোঁটা যন্ত্রনা হয় না বা মুখের বিকৃতি হয় না,তাহলে কি তারা সত্যিই শিব ঠাকুরের আশীর্বাদ পায়।দুপুর থেকে কি কি খায় যেন তারা,আমাদের দেয় না।
মনে আছে একবার চড়কের মেলায় আগুন পেরুচ্ছি সকলের সাথে আর তখনই সম্মিলিত জনতার থেকে হঠাত চিতকার হয়েছে কোন কারণে,ব্যস দাঁড়িয়ে গিয়েছি,এবারে বুঝতে পারছি পায়ের তলায় গরম লাগছে,সবাই আগুন পেরিয়ে গেছে আর আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছি।মুহূর্তের ব্যবধানে কে যেন এসে আমাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিলো সেদিন।তাই বহুদিন অব্দি আমি বিশ্বাস করতাম এরা বিশেষ শক্তিপ্রাপ্ত।এক অদ্ভূত আকর্ষনে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে পেরিয়ে যেতো।তারপর উত্তম মধ্যম,সে তো জুটবেই।ও নিয়ে আমাদের কোন চাপ ছিলো,আসল তো পেয়েই গেছি,আর তাই ফাউ তো মিলবেই।আর চৈত্র সংত্রান্তির দিন এঁচোড়-নিমপাতা-কাঁচা আম এসব খুঁজে আনতে হয়,মফস্বলে তখন এসব বাজারে মেলে না।সেদিন বাড়িতে নিমপাতা-টকডাল আর এঁচোড়ের ডালনা রান্না হয়।
আজ যখন ঘরে বসে বসে লকডাউনের দিন গুনছি-হিসেব কষছি যে কদিন বাকি আছে বা কদিন পেরুলো-হাজার ফেসবুক হোয়াটস এপ করেও ঘড়ির কাঁটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না-ওদিকে টিভি দেখতে গেলেই শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাচ্ছে হিমস্রোত-শুধু ভাবছি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে দেশের পরিস্থিতি।বাজারে বেরুলেই দেখতে পাচ্ছি লোকে মহানন্দে বাজার করে যাচ্ছে-কোন দূরত্ব নেই-কোন বাঁধা নেই-কেউ মুখে একটা রুমাল বেঁধেছে –কেউ আবার তাও আটকায়নি-এইসব সুখস্মৃতি রোমন্থনে একটু সময় কাটে।মেয়েকে গল্প করি কিভাবে আমাদের ছোটোবেলায় বাড়ির সামনের মাঠে জ্বলতো নিভতো হাজার হাজার জোনাকি বা লোডশেডিং কাকে বলে –তা কিরকম হয়-আমরা কিরকম টেবিলল্যাম্প বা হ্যারিকেনে আলোয় পড়তাম।ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে বসে দেখি ধূ ধূ দুপুরে রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে যায় একা একা-কে যায়-এইভাবে যদি একটু সময় কাটে।এবারে হয়তো গাজনের মেলা হবে না-নিঝুম দুপুরে কেউ আওয়াজ দেবে না-শিবো হে।কিন্তু ঘরবন্দি হয়ে বেঁচে থাকলে আবার হয়তো দেখা হবে বন্ধুরা,একদিন পাখি ডাকা ভোরে হয়তো শুনবো করোনার ভয় আর নেই।সকাল সকাল বাচ্চারা সব স্কুলে যাবে হৈ হৈ করতে করতে।আপাতত না হয় শুধু সেই সকালটার অপেক্ষায়,আসুন ধৈর্য্য ধরে থাকি সকলে।
======================
সত্যম ভট্টাচার্য, রায়কতপাড়া,জলপাইগুড়ি।
ফোন-৯৪৭৫৮৯৩৪৩৩।