Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

গল্প ।। আগুনের পরশমণি ।। সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী


আগুনের পরশমণি

সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী


ভ্রু কুঁচকে আকাশের দিকে তাকাল রঘু। ভোররাত থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামার লক্ষনই নেই। আকাশ ঢেকে আছে ভুট কম্বলের মতো ঘন কালো মেঘে। ছায়া ছায়া অন্ধকার হয়ে আছে শহরটা, সময় বোঝা যাচ্ছে না। চার্চের ঘড়িতে ঢং-ঢং করে আটটা ঘন্টা না বাজলে বোঝার উপায় ছিল না যে বেলা আটটা বেজেছে।

রঘু অধৈর্য্য হয়ে আকাশের দিকে তাকায়, "ঢেলে একটা ভারি বৃষ্টি হয়ে মেঘটা কেটে যেতে পারে, তা না... সেই ঝিপঝিপ ঝিপঝিপ করে ঝরেই চলেছে!" রঘু জানে এই বৃষ্টিটাকে ইলশেগুঁড়ি বলে। গঙ্গায় ইলিশ আসে, জালে আটকায়, আদুল গায়ের জেলেরা খাবি খাওয়া ইলিশসমেত জাল টেনে ডাঙায় তুলতে না তুলতেই ইলিশগুলো চোখ চেয়ে মরে যায়। গঙ্গার পাড়ে ঘাটের ধারে ব্যাগ হাতে বাবুরা দাঁড়িয়ে থাকে। জেলেরা ভিজে জাল কাঁধে পাড়ে উঠতে না উঠতেই হামলে পড়ে বাবুরা। কে কার আগ ইলিশ ব্যাগস্থ করবে কড়কড়ে অনেকগুলো নোট গুনে দিয়ে, তারজন্য একেবারে হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দেয়। তবে এবারে কম। ভিড় হতে দিচ্ছে না সিভিক পুলিশেরা। ঘুরছে সবসময়। রঘু হাতকয়েক দূরে তার ফুটপাতের দোকানে বসে-বসে সব দেখে। ভাবে, "ইলিশ খেতে কি খুব ভালো? অত দাম কেন?" রঘু জানে না। জানার সম্ভাবনাও নেই।

রঘুরা খুব গরীব। গঙ্গার ধারের ফুটপাতে রঘু প্লাস্টিক বিছিয়ে বসে দোকানদারি করে। বাচ্চাদের সস্তার খেলনা। ওর বাবাও ওখানটাতেই বসত দোকান সাজিয়ে। তারপর কী একটা করোনা নামের রোগ এল... পুলিশ আর প্লাস্টিকের পোশাকে সর্বাঙ্গ ঢাকা ক'জন হাসপাতালের লোক এসে রঘুর বাবাকে খাঁচা গাড়ি করে তুলে নিয়ে গেল। বাবার নাকি রোগটা হয়েছিল। ওদের ভাড়াবাড়ির মালিক কয়েকটা ষণ্ডাগুণ্ডা লোক লাগিয়ে ওদের জিনিসপত্র বাইরে ফেলে দিল। রঘুর মা রঘু আর ওর ছোট্ট বোন রেশমিকে নিয়ে কত জায়গায় ঘুরল... কেউ ভাড়া দিল না। শেষকালে কর্পোরেশন থেকে একটা বড় হলঘরের মতো লম্বা ঘরের অস্থায়ী শিবিরে আরো অনেকের সঙ্গে রঘুদেরও থাকার জায়গা করে দিল। রঘুদের জিনিসপত্র বলতে ক'টা বাসনকোসন, দুটো টিনের বাক্সে কিছু কাপড়চোপড়, দুটো মাদুর আর একটা পায়া নড়বড়ে চৌকি। ওসব নিয়ে থাকা যায় না কর্পোরেশনের শিবিরে। তাই দুশো টাকায় চৌকিটা বেচে দিল মা। কিনে নিল রহিম চাচা। টিনের বাক্স দুটো আর বাসনকোসনের পুঁটলিটা রঘুর মা অনেক বলেকয়ে নিজের কাছে রাখল, নীল সাদা ড্রেসের কর্পোরেশনের ওষুধ দেওয়া দিদিমণির হাতেপায়ে ধরে-টরে।

রঘুর বাবা আর ফেরেনি হাসপাতাল থেকে। কর্পোরেশনের লোকেরাই একদিন সকালে খবর দিল যে রঘুর বাবা মরে গেছে। মা খুব খানিক কাঁদল বুক চাপড়ে চাপড়ে। তারপর দেখতে যেতে চাইল বাবার বডি। কিন্তু তার নাকি উপায় নেই। সরকারি নিয়ম যে বডি প্লাস্টিকে মুড়ে হাসপাতালের ডোমেরাই পুড়িয়ে দেবে। প্লাস্টিক খুলে দেখাতে গেলে নাকি ঐ রোগটা ছড়িয়ে যাবে। তাতে রঘুর মাও ছেলেপুলে নিয়ে মরে যেতে পারে। রঘুর মায়ের সাহসে কুলোল না। দিনদুয়েক কেঁদেকেটে কাজের ধান্দায় বেরোল। নাহ্, কোথাও কোনো কাজ নেই। দোকানপাট বেশিরভাগই বন্ধ। ফ্ল্যাট বাড়িগুলোতেও বাইরের লোক ঢুকতে দিচ্ছে না। ঘোরাঘুরিতে রঘুর মায়ের হতাশাই শুধু বাড়ল, কাজের কাজ কিছুই হল না।

তবে আপাতত কর্পোরেশনের শিবিরেই খাওয়াদাওয়া মিলছে। এরপর কী হবে? পনেরো দিন পরে তো এখানে আর থাকতে দেবে না শুনতে পাচ্ছে। রেলগাড়ি চলছে না বলে স্টেশনটাও বন্ধ। নাহলে স্টেশনে আলো পাখা আছে, ওখানে দিব্যি নিশ্চিন্তে থাকা যায়। অনেক লোক আগে থাকত তো! রঘু নিজের চোখে দেখেছে। একবার রঘু বাবার সঙ্গে রেলগাড়ি চড়ে কলকাতায় বড়বাজারে গিয়েছিল। বিক্রির জন্য প্লাস্টিকের খেলনা আর নরম নরম তুলোর পুতুল আনতে। তখন দেখেছিল। তারপর একদিন রঘু স্টেশনের ওপারে জগদ্ধাত্রী ঠাকুর দেখতে গিয়েছিল শামসেরের সঙ্গে। শামসের রহিম চাচার ছেলে। রঘুর সঙ্গে এক ইস্কুলে একই ক্লাসে পড়ে। তখনও ওরা দু'জনে স্টেশনে ঢুকেছিল। দু'নম্বর প্ল্যাটফর্মের দোকানটা থেকে ডিম-ঘুগনি নিয়েছিল পনেরো টাকার। একটা বাড়তি কাঠের চামচ চেয়ে ভাগাভাগি করে খেয়েছিল। সেদিনও দেখেছিল সব কটা প্ল্যাটফর্মের টিনের ছাউনির তলায়, আর টিকিট কাউন্টারের সামনের জায়গাটায় কত লোক পুরো সংসার পেতে আছে। স্টেশনটা খোলা থাকলে রঘুরাও ওখানেই থাকতে পারত। তবে খাবার জোটানোর ব্যাপারটা একটা চিন্তার বিষয় বটে! এখন অবশ্য অনেক এনজিও না কী একটা বলে, তারা দুবেলাই রঘুদের মতো চালচুলোহীন লোকেদের খাবার দিচ্ছে। একটু খোঁজখবর রাখতে হয়। এরিয়া ভাগ আছে বলছিল শামসের। তবে শামসেরদের নিজেদের ঘর আছে। গঙ্গার পাড়ের ইটখোলার ওধারের বস্তিতে। রহিম চাচা বাবার পাশেই বসে ফুটপাতে দোকানদারি করত। খাতির ছিল দু'জনের খুব। রহিম চাচার পুঁজি বেশি। সাইকেলভ্যান ভর্তি করে পুরনো জামাকাপড় কিনে এনে বিক্রি করে। ভালো সেল আছে। অন্ততঃ রঘুদের খেলনার থেকে ঢের বেশি বিক্রি। রঘুর বাবাটা অমন দুম করে মরে যাওয়ায় এখন রঘুর কাঁধেই সংসারের দায়িত্ব।

এই রোগটা ভারি বিচ্ছিরি পাজি। সব একেবারে নয়ছয় করে দিয়েছে। ইস্কুল বন্ধ সেই কতদিন ধরে। নইলে দুপুরে খাওয়ার চিন্তাটা দুই ভাইবোনের থাকে না। ইস্কুলে মিড-ডে মিল দেয় তো। এই হতচ্ছাড়া রোগটার জন্য রঘুদের মতো গরীব-দুঃখীদের দুঃখ খুব বেড়ে গেছে। রঘু মনেমনে হিসেব করল যে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাদেই স্বাধীনতা দিবস। এই ইলিশের দিনেই ঐ উৎসবটা হয়। থানার পাশের মাঠে আর কর্পোরেশনের মাঠে সকাল বিকেল জোরদার মহড়া চলে প্যারেডের। রঘুরা মাঠের ধারের ঘাসের ওপর বাবু হয়ে বসে দেখে। কী সুন্দর ব্যান্ড বাজে! রঘুরা তালে-তালে হাততালি দেয়। পুলিশ বাবুরা কখনোসখনো সিগারেট কি পানমশলা এনে দিতে বলে লঞ্চঘাটের গুমটি দোকানটা থেকে। একছুটে এনে দেয় রঘু আর শামসের। বদলে স্বাধীনতা দিবসের দিনে ফুটপাতের বাচ্চাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকটা বাড়তি লজেন্স বিস্কুট পায় রঘুরা। এমনকি সেদিনে থানায় খাওয়াদাওয়াও হয় অনেক। রঘুরা জানে। তাই আশেপাশে ঘুরঘুর করে। পুলিশ বাবুরা হাত নেড়ে ডেকে বাড়তি খাবারও দিয়ে দেয় ওদের। কিন্তু এবারে যে কী হল! কিচ্ছু হচ্ছে না এখনও মহড়া-টহড়া। একদিন রঘু সাহস করে একজন মুখচেনা পুলিশ বাবুকে জিজ্ঞেস করেছিল, "সার, এবারে স্বাধীনতা দিবস হবে না?" পুলিশ বাবু রঘুর কথায় হেসে বলেছিলেন, "স্বাধীনতা দিবস তো পালন হবেই, তবে ফাংশনটা আর হবে না অন্যবারের মতো। এইতো সবে আনলক শুরু হল।" রঘু অবাক চোখে জানতে চেয়েছিল, "আনলক কী সার? সবকিছু এতদিন ধরে বন্ধ কেন?"

পুলিশ বাবু বলেছিলেন অনেক কথা। সব রঘু বোঝেনি। তবে বুঝেছিল ওদের মতো গরীবদের ভোগান্তি এখনও চলবে। রঘু সকাল বিকেল দোকান বিছিয়ে বসে ঠিকই, তবে বিক্রিবাটা কিছু নেই। রহিম চাচাও আজকাল দোকান লাগাচ্ছে না। কর্পোরেশনের লোক আর পার্টি অফিসের লোকেদের সঙ্গে ভ্যানে করে মাইক আর মেশিন টানছে। মাইকে করে লোকগুলো সবাইকে বলছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে... মানুষ কী করবে আর কী করবে না। শামসের এসেছিল আগেরদিন। রঘুকে যেতে বলেছে। ওদের ওদিকটায় গঙ্গা থেকে নাকি মাছ ধরছে ওরা।

বৃষ্টিটা সামান্য ধরতেই রঘু ওর এগারো বছরের ছোট্ট কাঁধে প্লাস্টিকে বাঁধা দোকান নিয়ে চলেছিল গঙ্গার ধারের ফুটপাতের উদ্দেশ্যে। কিন্তু শামসেরের কথা মনে পড়তেই মায়ের টিনের বাক্সে সব ভরে রেখে ছুটল শামসেরদের বাড়ির দিকে। ইস্, মনেই ছিল না। এত বেলা অব্দি মাছ ধরা পড়ে? অবশ্য রোদ ওঠেনি। আসলে বৃষ্টির জন্যই সকালটা আজ বরবাদ।

দৌড়তে দৌড়তে রঘু শামসেরদের বস্তি লাগোয়া ঘাটটায় পৌঁছয়। শামসের শুকনোমুখে একাই বসেছিল। মাছ ধরা পড়েনি একটাও। বস্তির বাকি ছেলেপুলেরা মাছ পায়নি বলে উঠে গেছে। শামসের রঘুর জন্য অপেক্ষা করছিল। দু'জনে বন্ধু তো। অনেকরকম গল্প করছিল দু'জনে। সবই ওদের দুঃখ-কষ্টের কথা। শামসের পকেট থেকে একমুঠো ছোলাভাজা দিল রঘুকে। খুঁটে-খুঁটে দু'জনে খাচ্ছিল। হঠাৎ দেখে খানিকদূরে ইটখোলার ওধারে গঙ্গার পাড় ঘেঁষে কাদার ওপরে ঝপাং করে বস্তা জড়ানো কী একটা ভারি জিনিস পড়ল। তারপর পরপর আরো দুটো। ওরা দেখল যে তারপরই দুটো লোক কাদার ওপর দিয়ে পাশ হয়ে-হয়ে গঙ্গার পাড়ের ঝুলে থাকা আগাছা লতাপাতা খামচে ধরে ধরে গঙ্গার ভাঙাঘাটের দিকে এগোচ্ছে।

কৌতূহলী রঘু আর শামসের উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল উত্তেজিত হয়ে। ক্লাস ফোরের দুই কিশোরের মাথায় এল, "গঙ্গার ধারে দিব্যি পাকা রাস্তা থাকতেও লোকদুটো ওখান দিয়ে যাচ্ছে কেন?" তারপরই ওরা দেখল লোকদুটো ঐ বস্তা জড়ানো জিনিস দুটো ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। একটা জিনিস পড়েই রইল। কী ওগুলো? মড়া মানুষ নাকি? কিন্তু ওভাবেই বা নিচ্ছে কেন? তারপর লোকদুটো যেন ভোজবাজির মতো কোথায় মিলিয়ে গেল। আরে? একী ব্যাপার? রঘু আর শামসের গঙ্গার ঘাটের শেষ ধাপ অব্দি নেমেও লোকদুটোকে কোথাও দেখতে পেল না। তাহলে কি লোকদুটো কাদা থেকে পাড়ের রাস্তায় উঠে গেল? কিন্তু তাহলেও তো ওরা দেখতে পেত। কারণ এখান থেকে সবটাই দেখা যাচ্ছে।

শামসের আর রঘুর চোখাচোখি হল। বুঝে নিল দু'জন দু'জনের চোখের ভাষা। এগারো বছরের দুঃস্থ কিশোর দুটি ঘাটের পাশ দিয়ে নেমে পড়ল গঙ্গার জলের ধারের একহাঁটু কাদায়। তারপর ঠিক ঐ লোকদুটোর কায়দায় পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে পাড় থেকে ঝুলে থাকা ঝোপ-জঙ্গল খামচে খামচেই সেই বস্তা জড়ানো জিনিসটার কাছে পৌঁছল। দু'জনে আবার চোখাচোখি। তারপর অসীম সাহসে ভর করে লম্বা জিনিসটায় হাত ছোঁয়াল দু'জনে। "এতো শক্ত লোহার জিনিস রে!" ফিসফিস করে দু'জনে। রঘু বুদ্ধি করে বস্তার পাটের সুতো ফাঁক করে ফেলে আঙুলে খুঁটে। আবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ওরা, "এতো কালো রঙের লোহার মোটকা পাইপ রে। চোরাই মাল লুকিয়েছে এখানে। চল থানায় খবর দিই।"

দু'জনে আবার একইভাবে পাশাপাশি এগোতে থাকল ভাঙাঘাটের দিকে। এদিকটাই কাছে হবে। লোকদুটো তো এদিকে যেতে যেতেই অদৃশ্য হয়েছিল। ঘাটের ভাঙা সিঁড়িতে উঠতে যাবার আগে রঘু "আঁক" করে উঠে শামসেরের হাতটা খামচে চেপে ধরল। ভাঙাঘাটের আর পাড়ের কোণটাতে একটা পুরনো লজঝড়ে দরজা। বন্ধ করা। তারমানে লোকদুটো এই দরজাটা দিয়ে ঢুকে গেছে। তাই ওরা দেখতে পায়নি। দু'জনের বুক ধড়াস-ধড়াস করছে। যদি লোকদুটো এক্ষুণি বেরিয়ে আসে? তারপর যাহয় হবে করে দু'জনে পা টিপেটিপে এগোয় দরজাটার দিকে। ভেতরে মনে হচ্ছে লোকজনের ফিসফিসানি চলছে। রঘু সামনে। দরজার ফুটোয় চোখ রাখে। বড় একটা ঘরের মতো মনে হচ্ছে ভেতরে লাইটও জ্বলছে। কয়েকজন লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে ছোট ছোট শিশিতে কাগজ সাঁটাচ্ছে মনেহয়। আর দাঁড়াল না ওরা। ঝুঁকি হয়ে যাবে। কোনো একটা গোপন চোরাই কারবার চলছে এখানে সেটা বুঝল। যেকোনো মুহূর্তে লোকগুলো বেরিয়ে আসতে পারে। একটুও সময় নষ্ট না করে রঘু আর শামসের হাঁচোড়পাঁচোড় করে কাদা আর ঝোপ-জঙ্গল ভেঙে ভাঙাঘাটে উঠল। শামসের পা ধুতে চেয়েছিল। হাঁটু অব্দি কাদায় ভর্তি। রঘু ওর হাত ধরে টেনে ছুট লাগিয়েছিল, "যদি লোকগুলো দেখতে পেয়ে যায়! চল থানায়।"

ছুটতে ছুটতে ওরা থানায় পৌঁছে ওদের মুখচেনা পুলিশ বাবুটিকে সব খুলে বলল। সব শুনে তিনি ওদেরকে খানিকক্ষণ থানায় বসিয়ে রাখলেন। বড়বাবু ভেতরে ডেকে ওদের কাছে পুরো ঘটনাটা শুনলেন আরেকবার। তারপর বিরাট পুলিশবাহিনী নিয়ে চললেন ভাঙাঘাটের উদ্দেশ্যে। পুলিশ বাবুরা দূর থেকে জায়গাটা দেখিয়ে ওদের চলে যেতে বললেন। ওরা কৌতূহল আর উত্তেজনায় ফুটছিল। অনেক বেলাও হয়েছে। এবারে ফিরতে হবে। ক্ষিদে পেয়েছে।

******

সেদিন বিকেলে বৃষ্টি হয়নি। রঘু দোকান বিছিয়ে বসেছে। যদি কিছু বিক্রিবাটা হয়। অনেকে বিকেলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে আসে মাঝেমাঝে। কিন্তু কপাল বেজায় মন্দা। করোনার ভয়ে লোকে যত বাইরে বেরোচ্ছে না তার থেকে বেশি পুলিশের ভয়ে বেরোচ্ছে না। মাত্র সাতটা বাজল, তাতেই গঙ্গার ধারের স্ট্র্যান্ডটা পুরো শুনশান ফাঁকা। রঘু ওর দোকানের জিনিসপত্র বেঁধে-ছেঁদে কাঁধে ফেলে ওদের রাতের আস্তানার পথে রওনা হল।

কর্পোরেশনের শিবিরে থাকার মেয়াদ শেষ হতেই মা অনেক বলেকয়ে একটা ফ্ল্যাটবাড়ির সিঁড়ির তলায় রাতে শোবার জায়গা জোগাড় করেছে। দুবেলা ফ্ল্যাটে ওঠানামার সিঁড়ি, ফ্ল্যাটের নিচের গাড়ি রাখার জায়গা আর বাঁধানো চাতালটা পরিষ্কারের কড়ারে। তবে শর্ত হল ওখানে রেঁধেবেড়ে খাওয়া যাবে না, এমনকি সকাল আটটা থেকে রাত আটটা অব্দিও থাকা যাবে না। তবে খুব দরকারে কিছুক্ষণের জন্য ঢুকতে বেরোতে পারবে। সিঁড়ির তলায় নিজেদের ভাঙাচোরা গেরস্থালি গুটিয়ে প্লাস্টিক চাপা দিয়ে রেখে সারাদিন মা বোনকে নিয়ে স্ট্র্যান্ডের ধারে, সুলভ শৌচালয়ের চাতালে, এখানে ওখানে ঘুরে বসে কাটিয়ে দেয়। চার্চের পাশে ফাদাররা একটা খাবার জায়গা খুলেছে। দুবেলা লাইন দিয়ে খাবার নিতে হয়। রঘুরা তিনজনেই থালা-বাটি নিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। খাবার নিয়ে গঙ্গার ধারের বেঞ্চিতে বসে খায়। সকাল-বিকেল মা একটা ওষুধের দোকানে ঝাঁট-পাট দেয়, বোতলে বালতিতে জল ভরে। তারা নগদ পয়সা দেয়। কামাই বা দোকান বন্ধ হলে পয়সা নেই। মা গুছিয়ে তাই থেকেই দুবেলার চা-পাঁউরুটি কেনে। গঙ্গার ধারে বসে তিনজনে খায়। মা থেকেথেকে চোখের জল মোছে। রঘুর খুব কষ্ট হয়। ভাবে ওরা কি তবে একেবারে ভিখিরি হয়ে গেল?

পেছন থেকে শামসেরের ডাক, "ওই রঘু, তাড়াতাড়ি আয় এখেনে।" রঘু তাকিয়ে দেখে শামসের একটা পুলিশ বাবুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে। রঘু ধীরপায়ে এগোয়, "কী হয়েছে?"

শামসের কিছু বলতে যাচ্ছিল। ওকে থামিয়ে পুলিশ বাবুটা বলেন, "স্বাধীনতা দিবসের দিনে পরিষ্কার জামাপ্যান্ট পরে একদম সকালে থানায় চলে আসবি। বাপ-মাকে নিয়ে।"

রঘু ভাঙাগলায় বলে, "বাবা নেই। মা একা এলে হবে?"

পুলিশ বাবু হেসে রঘুর পিঠ চাপড়ে দিলেন।

স্বাধীনতা দিবসের দিনে সকালেই রঘু মা আর বোনকে নিয়ে থানায় পৌঁছে গেছে। শামসেরও এসেছে রহিম চাচা আর চাচিকে নিয়ে। কতদিন পরে আজ রঘু আর শামসের কাচা-পরিষ্কার স্কুল-ড্রেসটা পরেছে। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে। পুলিশ দিদিমণিরা গাইলেন, "আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে...।"

পুলিশ বাবু দুহাতে রঘু আর শামসেরের হাত ধরে সুন্দর সাজানো স্টেজের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। রঘুর চোখে জল টলমল করছে। ঝাপসা চোখদুটো। স্টেজে দাঁড়িয়ে শুনল মাইকে থানার বড়বাবু অনেক কথা বলছেন। রঘুর কানে এল, "সাহসিকতার জন্য আর্থিক পুরষ্কার পাচ্ছে আমাদের ছোট্ট দুই সমাজবন্ধু রঘুদাস সিং আর শামসের মিঞা।"

রঘুর পা-দুটো থরথর করে কাঁপছে। পুলিশ বাবু রঘু আর শামসেরের গলায় মালা পরিয়ে দিলেন। তারপর বড়বাবু চাকতির মতো মেডেল ঝুলিয়ে দিলেন গলায়। আর এসডিও সাহেব রঘু আর শামসেরকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে দিয়ে কপালে চুমো খেলেন। তারপর একটা মোটা খামে ভরে টাকা আর প্যাকেটভর্তি জামাপ্যান্ট, মায়ের জন্য শাড়ি, ব্যাগভর্তি খাবারদাবার দিলেন। রঘু চারিদিকে তাকায়, কিন্তু কিচ্ছু দেখতে পায় না, সব ঝাপসা।

এই স্বাধীনতা দিবসটা রঘু সারাজীবন মনে রেখে দেবে। কে জানত যে কৌতূহলের বশে রঘু আর শামসের যা করেছে তা আসলে দেশের কাজ হয়ে গেছে? রঘুদের উপস্থিত বুদ্ধি আর সাহসের ফলেই ধরা পড়েছে গঙ্গার ধারের ওষুধ আর অক্সিজেন সিলিন্ডারের গোপন চোরাকারবারিদের ডেরা। পুলিশ এতদিন এদের টিকিটিও ধরতে পারেননি। শেষপর্যন্ত রঘু আর শামসের ঐ গোপন ডেরার জায়গাটা পুলিশকে নিয়ে গিয়ে দেখাতে পুরো দলটাই ধরা পড়েছে। গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই নাকি ঐ চোরাকারবারিদের দলটা অক্সিজেন কালোবাজারি, জাল ওষুধ আর ভুয়ো করোনা প্যাথোলজি রিপোর্টের ব্যবসা করছিল এতদিন। অবশেষে রঘু আর শামসেরের জন্যই ধরা পড়েছে। তাই সরকারের তরফ থেকে রঘুরা পুরষ্কৃত। এই করোনা-কালে রঘুদের মতো দুঃস্থ মানুষের লাখো কষ্টের মধ্যেও গর্ব করার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে রঘুরা।

রঘুর কানে ব্যান্ডের আওয়াজ ঢুকল। আজ রঘু আর শামসের এসডিও সাহেবের দুধারে দাঁড়িয়ে "গার্ড অফ অনার" নিল। ব্যান্ডে বাজছে "সারে জাঁহাসে আচ্ছা...।" মেঘমুক্ত নীল আকাশের নীচে থানা প্রাঙ্গনের উঁচু খুঁটিতে ভারতের জাতীয় তেরঙ্গা পতাকা ঢেউয়ের মতো উড়ছে। এইপ্রথম রঘু বুঝল যে গরীব হলেও সৎ হতে হয়, প্রাণে আগুনের পরশমণি ছোঁয়াতে হয়। তবেই দেশের-দশের স্বাধীনতার পতাকা এমন সুন্দর করে উড়বে।

-------------------------------------


©সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী

P.O. & P.S. - Chandannagar

Dist. - Hooghly

Pin code. - 712136


---------------------------------------------------------------------

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক