ওরা কখন আসছে?
মানে পুজোর কতদিন আগে আসবে সে সব কিছু বলেছে তোমাকে?
নিরবতাটা পরমাই প্রথম ভাঙলেন । সেই বিকেল পাঁচটা থেকে দুইজনে এই ছাদে এসে বসে আছেন । যদিও তারা এই প্রথম আসছেন না, তারা একরকম রোজই আসেন । লকডাউনের আগে রজত বাবু পার্কে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে একটু গল্পগুজব করতেন, পরমা অবশ্য এই ছাদেই আসতেন যার অন্যথা আজো হয় না কারণ তার কিছু শখের গাছ লাগানো আছে এই ছাদে, সঙ্গী হিসেবে সঙ্গে মায়াও থাকে গাছে জল দেওয়ার জন্য । আজো এসেছিল তবে এখন নীচে খাবার বানাচ্ছে কারণ আজ ও একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবে ওর ছোট ছেলের শরীরটা ভালো নেই , গত দুই দিন থেকে জ্বর আসছে ।
মাসির ছেলের জ্বর হয়েছে তবুও তাকে আসার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে এ কথা শুনে অনু এবং দেবু দুইজনেই খুব রাগ করছিল ।
কিন্তু মাসি মানে মায়াকে আসতে না দিলে পরমা যে বিপদে পড়ে যাবেন, কারণ তার যে আর সেই শক্তি নেই সবটা গুছিয়ে করার । তবুও তিনি মায়াকে বারণ করেছিলেন কিন্তু ও কিছুতেই রাজি হয়নি, তার অবশ্য কিছু কারণ আছে । প্রথমত ও জানে পরমা দেবী তার উপর কতখানি নির্ভরশীল কারণ এতো গুলো বছর ও ওনার পাশে আছে তাই সে মোটামুটি সবটাই জানে।এছাড়াও আরো একটা কারণ হলো ও ভয় পায় পাছে কাজটা যদি চলে যায় তবে ওর সংসার চলবে কি করে ? ওর স্বামী একজন ফুচকা ওয়ালা-মানে ফুচকা বিক্রি করে কিন্তু এই করোনার কারণে তেমন খোদ্দের খুব একটা আসে না তাই তার ব্যাবসা একেবারেই ভালো হচ্ছে না। বাড়িতে শাশুড়ি সহ তারা পাঁচটা প্রাণ সব যে না খেয়ে মরতে হবে। আর এই সময় নতুন কাজ পাওয়ার তেমন কোন সম্ভাবনাই নেই । কারণ বেশিরভাগ সবাই লোক রাখা বন্ধ করে দিচ্ছে ।
মায়ার এই কষ্টের কথা পরমা অবশ্য তার ছেলে-মেয়েকে জানিয়েছেন, কিন্তু উত্তরে তারা বলেছে -
তুমি মায়া মাসিকে বুঝিয়ে বলো তার টাকা প্রতি মাসে ঠিক সময় মতো সে পেয়ে যাবে, আর তুমি দরকার মনে করলে কিছু বেশি টাকাও ওকে দিয়ে দাও। আর মা তোমাকে সব কাজ কষ্ট করে করার দরকার তো নেই, আজকাল অনলাইন হোম ডেলিভারিতে সবই পাওয়া যায় সেখান থেকে বাঙালি খাবার অর্ডার করে নিলেই হলো।
গুগুল সার্চ করে তাদের দু-চারটের নাম ঠিকানা সব পাঠিয়ে দিয়েছে, বলেছে -
এদের মধ্যে কোন একটা বেছে নিয়ে আমাদের জানাও আমরা সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি, আর রোজ রোজ ঘরবাড়ি পরিস্কার করার কোন দরকার নেই থাকতো মাত্র দুটো মানুষ তাও আবার নরন-চরন তেমন নেই সুতরাং নোংরা তেমন নিশ্চয় হয়ই না, আর জামাকাপড় তো মেশিনেই কাচা হয় শুধু একটু কষ্ট করে মেলে নিলেই হয়ে গেল।
হ্যাঁ, ওরা হয়তো ঠিকই বলেছে শেষ পর্যন্ত হয়তো তাইই করতে হবে । কিন্তু এই নির্দিষ্ট কিছু বাঁধাধরা কাজের বাইরেও তো অনেক কাজ থাকে যেমন এই গাছে জল দেওয়া । ছেলে মেয়েদের অবশ্য এই ব্যাপারেও আপত্তি আছে। ওরা সারাক্ষণ বলতে থাকে-
নিজেদের শরীরের যত্ন নেওয়ার তেমন শক্তি নেই আর এইসব কেন যে রাখ ? কাউকে দিয়ে দাও ।
পরমা অবশ্য সেটাও মানতে পারেন না, কারণ তার এই বুড়ো নিঃসঙ্গ জীবনে তারা যে তার বড়ো সাথী। তার স্বামী অর্থাৎ রজত বাবু অবশ্য আছেন কিন্তু তারো বয়স হয়েছে, তিনিও তার মতো ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের অভাব সারাক্ষণই অনুভব করেন।
সেই সন্ধ্যা থেকে রজতবাবুও কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলেন পরমার কথায় রজত বাবু সেই ঘোরকাটিয়ে উঠলেন-
অ্যা! কি বললে, ওরা পুজোর কতদিন আগে আসবে? না আমাকেও তো তেমন কিছু বলেনি। শুধু বলেছে একটু আগেই আসবে যাতে আমাদের সঙ্গেও কিছুটা সময় কাটাতে পারে, আর যে সব আশ্রম গুলো ওদের মোটামুটি ভালো লেগেছে সেগুলোর একটু খোঁজ খবর নিয়ে স্বচক্ষে দেখতে চাই তারা যেমনটি বলছে তেমন সুখসুবিধা আদৌ ঠিকমতো দেয় কি না।
কথা গুলো এক নাগাড়ে বলে রজতবাবু কিছুক্ষণ নীচের দিকে মুখ নামিয়ে বসে রইলেন । পরমাও গাছ গুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে কথা গুলো শুনছিলেন, কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও তেমনটাই তাকিয়ে রইলেন ।
এবার রজত বাবুই মৌনতা ভাঙলেন-
আচ্ছা রমা-
পরমাকে তার বাড়িতে সবাই ছোট করে রমা বলে ডাকতো। তাই তাদের বিয়ের পর রজত বাবুও তাকে ঐ নামেই ডাকা শুরু করেন, যেমন অনুলেখা এবং দেবাশিসকে তারা অনু এবং দেবু বলে ডাকেন ।
আচ্ছা রমা তোমার মনে পড়ে অনু এবং দেবুর বোর্ডিং স্কুল খুঁজতে আমাদের কি অবস্থা হয়েছিল। তখন তো আর আজকের দিনের মতো গুগুলের যুগ ছিল না । এখান-ওখান থেকে খোঁজ করে বিভিন্ন স্কুলের নাম ঠিকানা জোগাড় করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা, অফিস থেকে ছুটি নিয়ে সেখানে গিয়ে তাদের ব্যবস্থাপনা দেখা সব ঠিক আছে কি না।
বলতে থাকা স্বামীর কথা শেষ হবার আগেই কথা লুফেনিয়ে পরমা দেবী বলে উঠলেন-
হ্যাঁ, মনে আবার থাকবে না, সে এক -দিন গেছে। আমার মা-বাবা, তোমার মা সকলেরই অবশ্য এ ব্যাপারে খুবই আপত্তি ছিল। কিন্তু তুমি কারোরই কোন কথা শোনোনি, কারণ তুমি মনে করতে এই ঠাম্মা, দাদু-দিদারা সঙ্গে থাকলে বাচ্চারা পড়াশোনা তো করেই না বরন্ঞ্চ আদরে বাঁদর হয়ে যায়। আর আমাদের দুজনের তখন যা অবস্থা ছিল তাতে কারো পক্ষেই সম্ভব ছিল না ওদেরকে প্রয়োজন মতো সময় দেওয়ার ।
রজত বাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
হ্যাঁ! আমাদের সময়ই ছিল না, তোমার ব্যাঙ্কের চাকরি আমার অফিস। মাসের বেশিরভাগ সময়টাই আমাকে অফিসের কাজে বাইরে বাইরে ঘুরতে হতো। তবে এখন সময়ই সময়।
কথা গুলো বলার সময় তার গলাটা ধরে অসলো, হয়তো চোখের কোনায় জলও ছলকাতে যাচ্ছিল কিন্তু সেটাকে ধরে রাখতে
কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইলেন তারপর পাশে রাখা বোতল থেকে একটু জল খেয়ে আবার বলতে শুরু করলেন-
আচ্ছা রমা তোমার মনে পড়ে অনু যখন প্রথম হাঁটা শুরু করেছিল-আমি তখন শহরের বাইরে, তুমিও অবশ্য অফিসে ছিলে। বাড়ি ফেরার পর মা যখন তোমাকে খবরটা দেন তুমি একদম অবাক হয়ে গেছিলে, তারপর তুমিও যখন দেখে আমাকে ফোন করে খবরটা জানাও তখন সেকি আনন্দ। তবে প্রথম পা-ফেলা দেখার আনন্দটা আমাদের দুজনের ভাগ্যেই জোটেনি। দেবুর ক্ষেত্রেও তাই। এমনই আরো কতো অনুভূতি আমরা হারিয়েছি।
ওদের অসুস্থতার দিন গুলোতেও আমাদেরকে আপণ আপণ কাজে যেতে হয়েছে , কোনো উপায় ছিল না। আসলে কাজে না গেলে কাজ হারানোর ভয় ছিল। ওদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য তখন আমাদের অনেক টাকার দরকার ছিল। ওদেরকে সমাজের অনেক উচ্চ স্থানে দেখার স্বপ্ন ছিল আমাদের দুইজনের চোখেই । আর তাইতো জীবনের ছোট ছোট অনুভূতি গুলোকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়েছিল ।
জানো রমা দেবু যখন আমাকে ফোন করে বলল-
দিদি আর আমি ঠিক করেছি তোমাদেরকে কোন একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবো, কারণ তোমরা দুইজনেই বেশিরভাগ সময়ই অসুস্থ থাকো তাই তোমাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করার মতো উপযুক্ত লোক থাকা খুবই দরকার। তোমরা আমাদের সঙ্গে থাকলে আমাদের সে ব্যাপারে কোনো চিন্তাই থাকত না , কিন্তু তোমরা তো আমাদের কাছে এসেও বেশিদিন থাকতে পার না , এখনকার জীবন তোমাদের মনে হয় বদ্ধ জীবন। হ্যাঁ, বাড়িতে হয়তো তোমাদের ভালোভাবে দেখাশোনা করার মতো লোক রেখে দিতে পারতাম কিন্তু আজকাল খবরে এই তোমাদের মতো বয়স্ক মানুষদের নিয়ে যা সব ঘটনা দেখছি তাতে একেবারেই সাহস আর হচ্ছে না। তার থেকে তোমরা বৃদ্ধাশ্রমেই ভালো থাকবে।
ওখানে তোমরা সেবা-যত্ন, সময় মতো ওষুধ-পত্র, সবই ঠিক মতো পাবে, এছাড়াও তোমাদের বয়সী আরো অনেক বন্ধু-বান্ধব পাবে, দেখবে তাদের সঙ্গে তোমাদের সময় গুলো ভালোই কাটবে। আর যখনই আমাদের সঙ্গে থাকতে ইচ্ছা করবে আমাদের জানাবে আমরা তোমাদের আমাদের কাছে নিয়ে আসবো তোমাদের যতদিন ইচ্ছা হবে আমাদের সঙ্গে থাকবে।
হ্যাঁ জানি এতে সমাজ হয়তো আমাদেরকে ছোটচোখে দেখবে সমাজে আমাদের অনেক দুর্নাম হবে যা এর আগেও হয়েছে এখন হয়তো আরো একটু বেশী হবে, কিন্তু তোমাদের ভালোর কথা ভেবেই আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে । কি করি বলো আমরা তো আর সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে আসতে পারিনা।
পরমা এতক্ষণ স্বামীর কথাগুলো চুপচাপ শুনছিলেন কোনো বাধা দেননি। তবে এবার তিনি ধীর গলায় বলেন-
হ্যাঁ, বোর্ডিং এ যেতে অনু খুব একটা আপত্তি করেনি কারণ ও একটু বড়ো ছিল ও মোটামুটি কারণটা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু দেবু একদম রাজী ছিল না। ও ওর ঠাম্মাকে ছেড়ে কিছুতেই যেতে চাইছিল না। তার পর ওকে কতো বোঝানো হলো-
ওখানে তোমরা কতো ভালো ভালো টিচার পাবে তারা তোমাদের কতো ভালো ভাবে পড়াশোনা করাবেন, কতো নতুন নতুন বন্ধু পাবে, আর ছুটিতে বাড়ি আসলে কতো মজার মজার জায়গায় ঘুরতে যাবো মজার মজার খাবার খাবো কতো মজা হবে।
এ সব শুনে অনিচ্ছায় হলেও রাজী হয়েছিল।
এতক্ষণ পরমা গাছ গুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে কথা গুলো বলছিলেন এবার স্বামীর দিকে চেয়ে বললেন-
আচ্ছা রজত তোমার মনে হচ্ছে না আমাদের সন্তানরা সেটিই করছে যেমনটি আমরা তাদের কাছে চেয়েছিলাম বা শিখিয়েছিলাম। আমরাই তো তাদের সমাজের উচ্চ স্থানে দেখতে চেয়েছিলাম আমাদের সে ইচ্ছা তারা পূরণ করেছে এবং আমরা যেমনটি পথ দেখিয়েছিলাম তেমনটি তারা যথার্থ ভাবে পালন করছে । এছাড়া এটাও তো একটা বাস্তব সত্য, আজ ওরা যে স্থানে আছে সে স্থানে পৌঁছাতে ওরাও তো কম কষ্ট করেনি। দিনের পর দিন পরিবার থেকে দূরে থাকতে হয়েছে, অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে, তবেই নিজেদের যোগ্যতাই এই স্থানে পৌঁছাতে পেরেছে।
এবার পরমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন -
তখন ওদের ভালোর কথা ভেবে আমারা ঐ কঠিন সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয়ে ছিলাম, আজ আমাদের ভালোর কথা ভেবে ওরা এই সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হচ্ছে । কর্তব্যের মায়াজালের এক অদৃশ্য সুতোয় আমরা সবাই বাঁধা পড়ে আছি। শুধু শৃঙ্খলাপরায়ণ সময় সে তার নিজের গতিতে এগিয়ে চলছে ।
*************************************
8H, CN ROY ROAD
PICNIC GARDEN
Kolkata 700039
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন