Featured Post

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

ছবি
   মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি মুদ্রিত  নবপ্রভাত  বইমেলা ২০২৫ সংখ্যার জন্য  প্রবন্ধ-নিবন্ধ, মুক্তগদ্য, রম্যরচনা, ছোটগল্প, অণুগল্প, কবিতা ও ছড়া পাঠান।  যে-কোন বিষয়েই লেখা যাবে।  শব্দ বা লাইন সংখ্যার কোন বাঁধন  নেই। তবে ছোট লেখা পাঠানো ভালো (যেমন, কবিতা ১২-১৪ লাইনের মধ্যে, অণুগল্প কমবেশি ৩০০/৩৫০শব্দে)। তাতে অনেককেই সুযোগ দেওয়া যায়। সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত লেখা পাঠাতে হবে। মনোনয়নের সুবিধার্থে একাধিক লেখা পাঠানো ভালো। তবে একই মেলেই দেবেন। একজন ব্যক্তি একান্ত প্রয়োজন ছাড়া একাধিক মেল করবেন না।  লেখা  মেলবডিতে টাইপ বা পেস্ট করে পাঠাবেন। word ফাইলে পাঠানো যেতে পারে। লেখার সঙ্গে দেবেন  নিজের নাম, ঠিকানা এবং ফোন ও whatsapp নম্বর। (ছবি দেওয়ার দরকার নেই।) ১) মেলের সাবজেক্ট লাইনে লিখবেন 'মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা সংখ্যা ২০২৫-এর জন্য'।  ২) বানানের দিকে বিশেষ নজর দেবেন। ৩) যতিচিহ্নের আগে স্পেস না দিয়ে পরে দেবেন। ৪) বিশেষ কোন চিহ্ন (যেমন @ # *) ব্যবহার করবেন না। ৫) লেখার নীচে একটি ঘোষণা দিন:  'লেখাটি স্বরচিত ও অপ্রকাশিত'। মেল আইডি :  printednabapravat@gm

গল্প ।। ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে ।। চন্দন ব্যানার্জী


“হোয়াট ডিড ইউ সে স্যার, ঘুনটে?”
-“ইট ইস কলড ঘুঁটে,নট ঘুনটে৷”
-“ঘুউউনটে?হোয়াট ইস দ্যাট?”
-“ঘুঁটে ইস…ঘুঁটে ইস,সামথিং প্রিপেয়ার্ড ফ্রম কাউডাং৷”
-“কাউডাং? আ নিউ বুলশিট ইউ আর ইন্ট্রোডিউশিং!”
-“ইয়া৷বুলশিট!ইউ হ্যাভ অলমোস্ট হিট দ্য বুলস আই৷কাউডাং ইস কাউশিট,মোর অর লেস,সেম অ্যাজ় বুলশিট, ইন ফিজিক্যাল ফর্ম৷”
ওপরের কথোপকথনগুলো হচ্ছিল ক্লাস সিক্সের ছাত্রী মিলির সঙ্গে ওর বাংলার গৃহশিক্ষক বটকৃষ্ণ বটব্যালের৷বছর পাঁচেক আগে বটকৃষ্ণবাবু রিটায়ার করেছেন৷তিনি কাজ করতেন একটি সরকরি বিমা কোম্পানীতে৷প্রায় পঁয়তিরিশ বছর চুটিয়ে চাকরি করেছেন৷ শেষের পাঁচটা বছর তিনি পেনশন ডিপার্টমেন্টে কাজ করতেন৷ওটা একটা ভুঁইফোড় ডিপার্টমেন্ট৷১৯৯৫ সালের আগে পেনশন ব্যাপারটাই ছিল না৷তাই পেনশন ডিপার্টমেন্টও ছিল না৷এখন হয়েছে৷ডিপার্টমেন্টটা তাঁর পছন্দসই ছিল না৷যত বুড়ো হাবড়াদের নিয়ে কারবার৷কিছু শুনতে চায়না,বুঝতে চায়না,একই কথা তিনবার করে বলতে হয়৷বিরক্তিকর৷
এই পেনশন ব্যাপারটা যখন চালু হল,অর্থাৎ সেই ১৯৯৫ সালে,তখন পুরো ব্যাপারটা কেমন যেন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন ছিল৷কর্মচারিরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল৷কোম্পানীর তরফ থেকে সকলের অপশন চাওয়া হয়েছিল যে তারা পেনশন স্কিমে যোগ দেবে কিনা৷সমস্যাটা ছিল,পেনশন নিলে পিএফে কোম্পানী কন্ট্রিবিউশনের টাকা পাওয়া যাবে না৷এতকাল মাসিক বেতন থেকে যত টাকা পিএফ কাটা হচ্ছিল,তত টাকাই কোম্পানীও পিএফ অ্যাকাউন্টে দিচ্ছিল৷এইভাবে ‘বেসিক’মাইনের ১০%করে প্রতি মাসে কোম্পানী পিএফ খাতে দিচ্ছিল৷ তার ওপর সুদও দিচ্ছিল৷এই খাতে রিটায়ারমেন্টের সময় বেশ একটা মোটা অঙ্কের থোক টাকা পাওয়া যেত৷এখন পেনশন নিলে তা আর পাওয়া যাবে না৷ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো যে একটা থোক টাকার দাবি ছেড়ে দিলে তার বিনিময়ে আজীবন পেনশন পাওয়া যাবে৷কর্মচারিরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল৷একদল বলল পেনশন নিলে সারাজীবন ডালভাত তো জুটবে৷ঐ ব্যাপারে অন্ততঃ কোনও চিন্তা থাকবে না৷’বেসিক’ মাইনের অর্ধেক পেনশন হিসেবে পাওয়া যাবে৷এখন এক মাস কাজ করে যা পাওয়া যাচ্ছে রিটায়ারমেন্টের পর কাজ না করেও তার অর্ধেক আমৃত্যু পাওয়া যাবে৷মন্দ কি?অন্যপক্ষ বলল পিএফে কোম্পানী কন্ট্রিবিউশনের থোক টাকাটা ফিক্স্ড ডিপোজিট করে রেখে  দিলে তার সুদও তো আজীবন পাওয়া যাব৷উপরন্তু মৃত্যু হলেও প্রিন্সিপাল টাকাটাও থেকে যাবে যেটা উত্তরাধিকারী ভোগ করতে পারবে৷সেই টাকাটা ফিক্স্ড রেখে দিতে পারলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই সুদ ভোগ করে যাবে৷কিন্তু পেনশনের ক্ষেত্রে “চিতাতেই সব শেষ!”ফ্যামিলি পেনশন বলে পেনশনের একটা ছোট ভগ্নাংশ স্ত্রী/স্বামী পাবে বটে,তবে তার মৃত্যু হলে সেটাও বন্ধ৷অনেক ক্ষেত্রেই রিটায়ারমেন্টের পর মাত্র কয়েকমাসের পেনশন পাওয়ার পরই কর্মচারিটি মারা যাবে এবং তার কয়েকমাস পর তার স্ত্রী/স্বামী মারা যাবে৷তাই আখেরে কর্মচারির ক্ষতি আর কোম্পানীর লাভ৷ 
ব্যাঙ্কের বার্ষিক সুদ ১৯৯৫ সালে মোটামুটি ১২পার্সন্ট ছিল,অর্থাৎ মাসিক সুদ ১%৷তাই যত লাখ জমা,তত হাজার মাসিক সুদ বাবদ আয়৷দেখা গেল ঐ আয় আর পেনশনের অঙ্ক মোটামুটি সমান৷তাই পেনশন না নেওয়াটাই যুক্তিপূর্ণ বলে অনেকেই মনে করল৷বটকৃষ্ণবাবুও সেরকমটাই মনে করলেন৷এসব ছাড়াও তিনি ভাবলেন কোম্পানী যদি, আজ না হোক কাল, লালবাতি জ্বেলে উঠে যায়,তাহলে পেনশনটা দেবে কে?তার চেয়ে রিটায়ারমেন্টের সঙ্গে সঙ্গেই সব পাওনাগণ্ডা বুঝে নিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷কেউ কেউ অবশ্য বুঝিয়েছিল থোক টাকা থাকলে সহজে খরচ হয়ে যাবে আর সেক্ষে্রে মাসিক সুদের অঙ্কটাও কমে যাবে৷উনি কিন্তু কথাটায় আমল দেননি৷ভেবেছিলেন সেটা তো তাঁর নিজের হাতে৷ও তিনি ঠিক ম্যানেজ করে নেবেন৷সবদিক বিচার করে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি পেনশন অপ্ট করবেন না৷বদলে পিএফে কোম্পানী কন্ট্রিবিউশনের টাকাটাই নেবেন৷ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে, ‘হাতের একটা পাখি ঝোপের দুটো পাখির থেকে দামি’৷পরে পেনশন আদৌ নিয়মিত পাব কিনা তার নিশ্চয়তা কোথায়?তার চেয়ে যা পাওয়া যাচ্ছে সব কুড়িয়ে বাড়িয়ে নিয়ে নেওয়াই ভাল৷
তারপর প্রায় পঁচিশ বছর কেটে গেছে৷বছর পাঁচেক আগে তিনি রিটায়ার করেছেন৷এখন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন,তিনি কী মারাত্মক ভুল করেছিলেন৷তাঁর হিসেবে অনেক গলদ ছিল৷ব্যাঙ্কজমার ওপর সুদ যে এত কমে যেতে পারে সেটা তাঁর ধারণাতেই ছিল না৷বারো পার্শেন্ট থেকে কমে এখন প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে৷তাই তাঁর মাসিক আয় অনেক কমে গেছে৷আর একটা মারাত্মক ভুল তিনি করেছিলেন৷প্রতি পাঁচ বছর অন্তর তাঁদের ‘ওয়েজ় রিভিশন’ হয় এবং মহার্ঘ ভাতা ‘বেসিক’ মাইনের সঙ্গে ‘মার্জ’ হওয়ার ফলে ‘বেসিক’ মাইনে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়৷এর ফলে ১৯৯৫ সালে তাঁর ‘বেসিক’ পাঁচ হাজার টাকা থাকলেও রিটায়ারমেন্টের সময় তাঁর ‘বেসিক’ চারটে ‘ওয়েজ় রিভিশন’-য়ের ফলে আশি হাজার টাকা হয়েছিল৷পাঁচ থেকে দশ,দশ থেকে কুড়ি,কুড়ি থেকে চল্লিশ আর চল্লিশ থেকে আশি হাজার!তাই পেনশন নিলে তিনি অর্ধেক ‘বেসিক’ অর্থাৎ চল্লিশ হাজার টাকা পেনশন পেতেন৷অথচ তিনি ১৯৯৫ সালের বেসিকের হিসেবে ধরেছিলেন যে তিনি মাত্র আড়াই হাজার টাকা পেনশন পাবেন!আর পিএফ খাতে প্রাপ্য কোম্পানী কন্ট্রিবিউশনের থোক টাকাটা ব্যাঙ্কে ফিকস্ড রাখলে বার্ষিক ১২% দরে সুদ ধরলে মোটামুটি মাসিক আয়ও সেই রকমই হবে৷ কিন্তুএখন ব্যাঙ্কে পিএফে কোম্পানী কন্ট্রিবিউশনের টাকাটা ফিকস্ড রেখে পেনশনের তুলনায় অনেক কম সুদ পাচ্ছেন৷চল্লিশ হাজার তো দূর,দশ হাজারও হচ্ছে না1
তিনি অকৃতদার৷কোনও ‘লায়েবিলিটি’ নেই,তাই রক্ষে!তাও তিনি খরচা চালিয়ে উঠতে পারছেন না৷বাধ্য হয়ে টিউশানি ধরেছেন৷তিনি তো কোনও স্কুল কলেজের সঙ্গে যুক্ত নন৷তাই টিউশানির কাজও জুটছিল না৷অনেককে বলার পরে এক সহকর্মীর চেনাজানা এক পরিবারে ক্লাস সিক্সের এক ছাত্রীকে বাংলা পড়াবার কাজটা পেয়েছেন৷ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্রী৷ওর ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’৷ভাগ্যিস!তাই এই টিউশানিটা পাওয়া গেছে৷
তিনি ভাবছিলেন নিজের ছাত্রজীবনের কথা৷বাংলা মিডিয়াম স্কুলে তিনি খুব ভাল ইংরেজি শিখেছিলেন৷শিক্ষকরা বাংলাতেই ইংরেজি বোঝাতেন৷ঐভাবেই বুঝে তিনি ইংরেজিতে পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন৷এখন তঁর ছা্ত্রীকে ইংরেজিতে বাংলা পড়িয়ে বাংলায় পারদর্শী করতে হবে৷তাঁর সারা জীবনের শিক্ষা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে তাঁকে এই কাজটা করতে হবে৷এটাই জীবনযুদ্ধে তাঁর অন্তিম পরীক্ষা৷এর ওপরই নির্ভর করছে জীবনের বাকি কটা দিন তিনি আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল থাকতে পারবেন কিনা৷
আজ তিনি ছাত্রীটিকে বাংলা আপ্তবাক্য বা প্রবাদ বাক্য অর্থাৎ চলতি কথা শেখাচ্ছিলেন৷ছাত্রীটি কিছুতেই আপ্তবাক্য কথাটার মানে বুঝতে পারছিল না৷ইংরেজি proverb কথাটা বলাতে সে বলে উঠল, “ওঃ,ডু ইউ মিন টু সে,কহাবৎ?”
বটকৃষ্ণবাবু হতবাক৷ছাত্রীটি হিন্দি শব্দ ‘কহাবৎ’ জানে,অথচ বাংলা শব্দটা কোনওদিন শোনেইনি৷ সত্যিই ওর ‘বাংলাটা ঠিক আসে না’৷ উদাহরণ সহযোগে বোঝাতে গিয়ে তাঁর মনে পড়ে গেল এক রিটায়ার্ড ভদ্রলোকের উক্তি৷
চাকরি জীবনের শেষ দিককার কথা৷পেনশন ডিপারটমেন্টের কাজ তাঁর অপছন্দ হলেও সেটা এই টিউশানির চাকরি থেকে লাখোগুণ আরামের ছিল৷বুড়ো হাবড়া অবুঝ রিটায়রিদের ডিল করা তুলনায় অনেক সহজ কাজ ছিল৷ওঁরা সব তাঁর সিনিয়ার কলিগ হলেও তাঁর টেবিলেই লাইন দিতেন৷তিনিই তাঁদের গাইড করতেন৷সময় সময় জ্ঞানও দিতেন৷যেমন একবার ভুল করে একজনের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নম্বর ভুল এন্ট্রি করেছিলেন৷ভদ্রলোকের পেনশন পেতে বেশ সমস্যা হয়েছিল৷উনি বেশ চেঁচামেচি করেছিলেন৷বটকৃষ্ণবাবু বলেছিলেন, “কাজ করতে গেলে ভুল হবেই৷৯৯% কাজ ঠিক হলে ১% ভুল হতেই পারে৷৯৯% ঠিক কাজ করলেও কেউ শুকনো ধন্যবাদও দেয় না৷একদম থ্যঙ্কলেস জব৷আর ১% ভুল হলেই যত চেঁচামেচি৷বলি অত চেঁচামেচি করার কী আছে?আপনার ভাগ্য খারাপ,তাই ঐ ১%এর মধ্যে আপনি পড়ে গেছেন৷আপনি না হলে অন্য কেউ পড়তই৷এটা পুরো স্বাভাবিক ব্যাপার৷”
ভদ্রলোক বলেছিলেন, “স্বাভাবিক ব্যাপার?ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে৷আপনিও রিটায়ার করবেন৷তখন বুঝবেন৷”
বটকৃষ্ণবাবু বলেছিলেন, “সে গুড়ে বালি৷আমি পেনশন অপ্ট-ই করিনি৷রিটায়ার করার সময়ই সব পাওনা গণ্ডা বুঝে নেব৷”
কথাটা মনে পড়তেই উনি “ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে”বাক্যটা দিয়ে আলোচনা শুরু করলেন৷তখনই উপরোক্ত কথোপকথন৷ছাত্রীটি “ঘুঁটে”.”গোবর”কিছুই বোঝেনা৷বটকৃষ্ণবাবু কথাটার মানে বোঝাবেন কি,আগে তো “ঘুঁটে” আর “গোবর” বোঝাতে হবে৷বোঝাতে বোঝাতেই আজকের বরাদ্দ দেড় ঘণ্টা কেটে গেল৷এবার তো উঠতে হবে৷অতিরিক্ত সময় দেওয়ার কোনও প্রশ্ন্ই ওঠে না,কারণ অন্য বিষয়ের শিক্ষক সময় মত এসে পড়েছেন৷বটকৃষ্ণবাবু উঠে পড়লেন৷
বটকৃষ্ণবাবু বুঝতে পারছিলেন এভাবে বেশিদিন চলবে না৷এ চাকরি টিকিয়ে রাখা কঠিন৷ছাত্রীটির প্রগ্রেস কিছুই হচ্ছে না, অথচ তিনি নিয়মিত মাইনে পেয়ে যাবেন, এটা চলতে পারে না৷
রাতে ঘুম আসছিল না৷কেন জানিনা সেই রিটায়ার্ড ভদ্রলোকের সঙ্গে তাঁর সেদিনের কথোপকথনটাই মনে পড়ছিল৷অনেকক্ষণ ধরে বুকের বাঁ দিকটায় একটা ব্যাথা চিনচিন করছিল৷হঠাৎ ব্যাথাটা বেশ বেড়ে গেল৷একি,একি!চোখে অন্ধকার দেখছেন কেন?তিনি কি জ্ঞান হারাচ্ছেন?
*
আস্তে আস্তে অন্ধকার সরে গেল৷শরীরটা বেশ হাল্কা লাগছে৷চারদিক আলোয় ঝলমল করছে৷তিনি দেখলেন যে তিনি একটা ঘরে এক সৌম্যদর্শন পুরুষের মুখোমুখি বসে আছেন৷পাশে একজন গাঁট্টাগোট্টা লোক কাঁচুমাচু মুখ করে মিনমিন করে কী বলছে৷বটকৃষ্ণবাবু শুনতে পেলেন লোকটা বলছে,”ভুল হয়ে গেছে চিত্রগু্প্ত মহারাজ৷এনাকে অন্যলোক মনে করে নিয়ে এসেছি৷এক্ষনি ফিরিয়ে দিয়ে আসছি৷”
চিত্রগুপ্ত বললেন, “এরকম ভুল আমাদের শোভা পায় না৷আমরা বিধাতার নিয়ম ভাঙ্গতে পারি না৷এক্ষণি এঁকে ফিরিয়ে দিয়ে এস৷”
বটকৃষ্ণবাবু বুঝলেন তাঁর মৃত্যুর পরে তিনি চিত্রগুপ্তের দরবারে হাজির হয়েছেন৷যমদূতের ভুলেই তাঁর অসময়ে মৃত্যু হয়েছে৷তিনি ছিলেন কর্মী ইউনিয়নের একজন দাপুটে নেতা৷তিনি বলে উঠলেন, “চালাকি নাকি৷ফিরিয়ে দিলেই সব মিটে যাবে?আমার আত্মীয়স্বজনরা আমি মরে গেছি ভেবে কত হ্যারাসড হল,দুঃখ পেল,কান্নাকাটি করল,তার কী হবে৷আমি ক্ষতিপূরণ চাই৷”
চিত্রগুপ্ত বললেন, “এখানে ক্ষতিপূরণের কোনও নিয়ম নেই৷”
-“আর জ্যান্ত মানুষকে মেরে ফেলার নিয়ম আছে?ক্ষতিপূরণ দিতে হবে,দিতে হবে৷”তিনি শ্লোগান দিতে শুরু করলেন৷
চিত্রগুপ্ত বললেন, “করছেন কী৷এখানে চেঁচামেচি করছেন কেন৷আমি তো বলছি যে আপনাকে মর্তলোকে ফিরিয়ে দিয়ে আসা হবে৷”
-“সে তো দিতেই হবে৷কিন্তু ক্ষতিপূরণ না পেলে আমি ধর্ণায় বসব৷সব কিছু অচল করে দেব৷চাক্কা জাম৷”
চিত্রগুপ্ত ফাঁপড়ে পড়লেন৷এরকম ঝামেলায় তিনি কখনও পড়েননি৷আমতা আমতা করে তিনি বললেন, “কী ক্ষতিপূরণ চান?”
বটকৃষ্ণবাবু ভাবলেন এই সুযোগে একটা মোটা টাকা আদায় করে নিতে হবে৷তাহলেই পেনসন অপশন না দেওয়ার ক্ষতিপূরণ হয়ে যাবে৷তিনি বলে উঠলেন, “অন্ততঃ এক কোটি টাকা৷”
চিত্রগুপ্ত বললেন, “এখানে টাকা বলে কোনও বস্তু নেই৷ওসব মর্তলোকে চলে৷আমাদের পক্ষে টাকা দেওয়া সম্ভব নয়৷আর্থিকভাবে নয়, অন্যভাবে আপনাকে আমরা সাহায্য করতে পারি৷আপনি ভেবে বলুন কীরকম সাহায্য পেলে আপনার সুবিধে হবে৷বেশি দেরি করা যাবে না৷ওদিকে মর্তে আপনার শরীরের দাহকার্য করার আয়োজন চলছে৷দাহর আগেই আপনাকে ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে তুলতে হবে৷দাহ হয়ে গেলে আমারও আর কিছু করার থাকবে না৷তাড়াতাড়ি বলুন৷”
বটকৃষ্ণবাবু ভাবতে লাগলেন,মানুষের সব সমস্যার মূল হল মূত্যুর সময়টা অজানা থাকা৷মানুষ জানে, “জন্মিলে মরিতে হবে,অমর কে কোথা কবে?”কিন্তু কবে কখন মৃত্যু আসবে সেটা কেউ জানে না৷জানা থাকলে সব সমস্যারই সঠিক প্ল্যানিং করে সমাধান করা যেত!যেমন তাঁর কোনও উত্তরাধিকারী নেই বলে তাঁর যা টাকা আছে মৃত্যুর মুহুর্ত পর্যন্ত তার পুরোটাই খরচ করা যাবে৷তিনিও মরবেন আর তাঁর টাকাও শেষ হবে৷এখন তিনি ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেবলমাত্র সুদের টাকাই খরচ করেন. প্রিন্সিপ্যালে হাত দেন না৷বা,বলা ভাল,তিনি হাত দিতে পারেন না৷কারণ,ঐ টাকার ওপর পাওয়া সুদটাই তাঁর একমাত্র উপার্জন৷প্রিন্সিপ্যাল টাকাটা তাই কোনওভাবেই খরচ করা যাবে না৷কিন্তু তিনি কতদিন বাঁচবেন জানা থাকলে আর ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে হবে না৷এবার তিনি প্রিন্সিপ্যাল আর সুদ দুটোই খরচ করবেন৷তাহলে সুদের হার যতই কমুক না কেন,তিনি প্রিন্সিপ্যাল ভেঙ্গে তাঁর খরচ চালিয়ে যাবেন৷ঐ তারিখ পর্যন্ত তিনি যাতে প্রিন্সিপ্যাল আর সুদ মিলিয়ে তাঁর খরচ চালাতে পারেন সেইভাবেই পরিকল্পনা আর অঙ্ক কষে খরচ করলেই আর কোনও সমস্যা হবে না৷
কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে বটকৃষ্ণবাবু বললেন, “তাহলে আমাকে জানিয়ে দিন কবে কখন আমার সত্যিকারের মৃত্যু হবে৷এই জানাটাই আমার ক্ষতিপূরণ৷” 
চিত্রগুপ্ত বললেন, “ঠিক আছে৷এখানকার নিয়ম ভেঙ্গে আপনাকে সেটা জানিয়ে দিচ্ছি৷যে যমদূত আপনাকে নিয়ে এসেছে সে-ই আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসবে৷ওকেই আমি তারিখটা আমার জাবদা খাতা দেখে জানিয়ে দেব৷ওর কাছ থেকেই আপনি তারিখটা জেনে নেবেন৷”
*
চিত্রগুপ্ত তাঁর কথা রেখেছিলেন৷যারা বডিটাকে দাহ করার জন্য শববাহক গাড়িতে তুলছিল তাদের চোখগুলো বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে গেল৷মড়া চোখ পিটপিট করে চাইছে৷বন্ধুবান্ধব,পাড়াপ্রতিবেশী সকলকে চমকে দিয়ে উঠে বসলেন বটকৃষ্ণবাবু৷তাঁর মৃত্যু হয়নি৷জ্ঞান হারিয়েছিলেন মাত্র৷ তিনি দস্তুরমত বেঁচে আছেন৷
জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই বটকৃষ্ণবাবুর সব মনে পড়ে গেল৷যমদূত তাঁকে সাত বছর পরের একটা তারিখ জানিয়ে দিয়েছে৷ওটাই তাঁর জীবনের শেষ দিন৷এবার শুধুই অঙ্ক কষে চলতে হবে৷তাঁর মাসিক খরচা যদি কুড়ি হাজার টাকা হয় তাহলে প্রতি মাসেই ব্যাঙ্ক থেকে তিনি কুড়ি হাজার টাকাই তুলবেন পুরো সুদ আর প্রয়োজনে কিছুটা প্রিন্সিপ্যাল ভাঙ্গিয়ে৷এতে প্রিন্সিপ্যাল কমে যাওয়ায় পরের মাসে সুদও কমবে,ফলে প্রিন্সিপ্যাল থেকে বেশি ভাঙ্গিয়ে নিতে হবে৷এইভাবে প্রিন্সিপ্যাল আর সুদ দুটোই কমতে থাকবে৷কুছ পরোয়া নেই৷এই সাতটা বছর প্রিন্সিপ্যাল আর সুদ মিলিয়ে মাসে কুড়ি হাজার টাকা পেলেই তো কেল্লা ফতে৷তারপর অ্যাকাউন্টে কিছু থাকুক বা না থাকুক কিছু যায় আসে না৷তিনি হিসেব কষে দেখলেন,এইভাবে খরচ করলে তাঁর মৃত্যুর সময় অ্যাকাউন্টে হাজার পঁচিশেক টাকা পড়ে থাকবে৷সে না হয় মৃত্যুর আগের দিন ঐ টাকাটা তুলে নিয়ে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ় করে দেবেন৷মাঝে যদি সুদের রেট আরও কমে যায় আর মূদ্রাস্ফীতির জন্য মাসিক খরচা কুড়ি হাজারের বেশি হয়ে যায়,তাহলে ঐ পঁচিশ হাজার টাকাটাই কাজে লাগবে আর ওটারও একটা সদগতি হবে৷অঙ্কটা কষতে পেরে বটকৃষ্ণবাবু নিশ্চিন্ত হলেন৷তিনি টিউশানিটা ছেড়ে দিলেন৷ওটার আর কোনও প্রয়োজন নেই৷
*
আজ সাত বছর পরের সেই দিন৷উনত্রিশে ফেব্রুয়ারি,২০২৮৷লিপ ইয়ারে ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন৷বটকৃষ্ণবাবুর জীবনেরও শেষ দিন৷
তিনি আজ চিন্তামুক্ত৷নিজেকেই বললেন,হুঁ হুঁ বাবা,আমি বটকৃষ্ণ বটব্যাল৷ছোটবেলা থেকেই অঙ্কে পাকা মাথা৷তাই সঠিক অঙ্ক কষে আজকের দিন পর্যন্ত নিজের খরচ চালিয়ে নিয়েছি৷কাল আমিও থাকব না আর থাকবেনা আমার টাকাও৷যা কামিয়েছি,পুরোটাই ভোগ করে নিলাম৷এ কম্মো সকলের দ্বারা হত না৷
কিন্তু, বেলা যত গড়াতে লাগল একটা খটকা লাগতে শুরু হল৷ তাঁর শরীর তো আজ ঠিকই আছে৷মনেই হচ্ছেনা যে আজই তিনি মারা যাবেন৷বরং আজ একটু বেশিই চনমনে লাগছে৷এবার একটু আশঙ্কা হতে লাগল,যদি আজ মারা না যাই?তাহলে কাল থেকে খাব কী?হাতে তো কানাকড়ি নেই!
মনে পড়ল,প্রয়োজনে তাকে ডাকার জন্য যমদূত একটা মন্ত্র বলে গিয়েছিল যেটা জপ করলেই যমদূত তাঁর কাছে চলে আসবে৷রাত প্রায় এগারোটার সময় মরিয়া হয়ে তিনি ঐ মন্ত্রটা জপ করলেন৷সঙ্গে সঙ্গে যমদূতের আবির্ভাব৷
একটু রুক্ষভাবেই বটকৃষ্ণবাবু বললেন,”আজকের দিন তো শেষ হতে চলল৷কখন আমাকে নিয়ে যাবে?”
যমদূত বলল, “একটা ছোট ভুল হয়ে গেছে৷আজ নয়,আপনার সময় আর ঠিক দশ বছর পর৷আসলে সতেরোর বদলে ভুল করে সাত বছর বলে ফেলেছিলাম৷”
-“এটা কি ইয়ার্কি হচ্ছে?মানুষের মৃত্যু নিয়ে ছেলেখেলা?”
-“কাজ করতে গেলে ভুল হবেই৷এক কোটির মধ্যে একটা ভুল হতেই পারে৷৯৯,৯৯.৯৯৯ টা ঠিক কাজ করলেও কেউ শুকনো ধন্যবাদও দেয় না৷আপনাদের ভাষায় একদম থ্যঙ্কলেস জব৷আর, একটা ভুল হলেই যত চেঁচামেচি৷বলি অত চেঁচামেচি করার কী আছে?আপনার ভাগ্য খারাপ,তাই ঐ একটা ভুল আপনার ক্ষেত্রেই হয়েছে৷আপনি না হলে অন্য কারোর ক্ষেত্রে ভুলটা হতই৷এটা পুরো স্বাভাবিক ব্যাপার৷”
ঠিক যেন সেই রিটায়ার্ড ভদ্রলোককে বলা তাঁর কথাগুলোই শুনতে পেলেন বটকৃষ্ণবাবু৷সেই ভদ্রলোকের বলা কথাগুলোও মনে পড়ে গেল৷
উনি বলেছিলেন, “স্বাভাবিক ব্যাপার?ঘুঁটে পোড়ে, গোবর হাসে৷আপনিও রিটায়ার করবেন৷তখন বুঝবেন৷”
আজ তিনি গোবর থেকে ঘুঁটে হয়েছেন!

################
 
চন্দন ব্যানার্জী,
        Flat no. B/1/105,
        PRANTIK,
        Sonarpur Station Road,
        Teghoria.SONARPUR,
        Dt. South 24 Parganas
        PIN : 700150
Mobile :93310 37721
WhatsApp. 90079 96000
mail id -  chandan.nadnahc@yahoo.co.in

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৯তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৮০তম সংখ্যা ।। কার্তিক ১৪৩১ অক্টোবর ২০২৪

লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি : মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা ২০২৫

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

উৎসবের সৌন্দর্য: সেকালে ও একালে।। সৌরভ পুরকাইত

মুদ্রিত নবপ্রভাত উৎসব ২০২৩ সংখ্যার ডাউনলোড লিঙ্ক