দেবদাস কুণ্ডু
'যতো নষ্টের গোড়া তুমি।' আমার গলায় রাগ।
বেলারানি অবাক। মেজো ছেলের মুখের দিকে তাকালেন, 'কি কস তুই?আমি আবার কি করলাম তোর?'
'কি করলে তুমি? আবার জিজ্ঞেস করছো?' আমার চোখ দুটো বড় হয়ে উঠলো। গলায় রাগ ঝরে পড়ল ।বড় ক্ষোভ নিয়ে বললাম, 'আটটা সন্তান তো জন্ম দিয়েছে। তাদের বার্থ সাটিকফিকেট যন্ত করে রাখোনি কেন?'
'কাগজ তোর ঠাকুরমা রাখতো। আমি লেখা পড়া জানি না। আমি কাগজের কি বুঝি? তোর বাবা উদ্বাস্তু হয়ে এ দ্যাশে এসে সারা জীবন লড়াই করে গেল। কাগছপএ নিয়ে কখন মাথা ঘামাবে বল?'
এই কথায় আমার রাগ এতটুকু কমলো না। বরং বেড়ে গেল। বললাম,' ঠাকুরমা কোথায় রাখলো তা জেনে রাখবে না? '
' ক্যান তুই আমারে দোষ দিচ্ছিস। ঘর ঝাড় দিচ্ছিলেন, এবার সোজা হযে দাঁড়াল, 'তোর বাবার এগুলো ঠিক করে রাখা উচিত ছিল। কিন্তু মানুষটা ভিটে মাটি হারিয়ে এদেশে এসে দুটো ভাতের জন্য রাতদিন খাটতো। '
' তুমি এখন ঠাকুরমা বাবার দোষ দিয়ে পার পেতে চাইছো। আমার এখন খাওয়া নেই ঘুম নেই টেনশন হচ্ছে। কিছু হয়ে গেলে কে দায় নেবে। আমাও তো বয়স ষাটের কাছাকাছি হয়ে এলো। 'ক্যান তোর আবার টেনশনে কি হলো। একটা মাএ ম্যাইয়া।তার বিয়ে হয়ে গেছে। নাতি হয়েছে। বউমা এখনও চাকরি করে।তুই এল আই সি করিস। তোর টেনশন ক্যান? টেনশন তো হবে আমার। ফ্ল্যাটে একা থাকি।কখন কি হয়ে যাবে কে বলতে পারে?' বেলারানি চেয়ারে বসলেন। হাঁফাসে। হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে।
' দেখ তুমি আশি পার করেছো। তোমার অসুখ বিসুখ থাকবে। তা নিয়ে টেনশন করে তুমি কিছু করতে পারবে না। আমার টেনশন কিসের জানো? '
টি ভি চলছিল। মা এই ফ্ল্যাটে একা থাকেন। তার স্বামী বলে গেছেন, এটা সরকারি ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাট ছেড়ে কোন ছেলের কাছে গিয়ে থাকবে না। তিনিও স্বামীর কথা মেনে চলেছেন। তাকে অনেক বার বলা হয়েছে তোমার পাঁচ ছেলে থাকতে তুমি এখানে একা পড়ে থাকবে কেন? লোকে কি বলে? তারা ভাবে আমরা মানুষ নই। তা তো নয়। তুমি পালা করে ছেলেদের কাছে থাকলে। ভালো না লাগলো আবার তোমার ফ্ল্যাটে চলে এলে। তিনি তা করবেন না। এখান থেকে নড়বেন না। স্বামী এখানে মারা গেছেন তিনিও এখানে মরবেন। তাই একা থাকেন। যখনই এসেছি দেখেছি মা রান্না ঘরে কাজ করছেন বড় ঘরে টিভি ফুল ভলুয়েমে চলছে। নি:সঙ্গতা কাটানোর জন্যই বুঝি এটা করেন। যেন ঘরে আরো কতো মানুষ আছে। তিনি একা নন।
টিভি বন্ধ করলাম। এতোখন মার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। এবার চৌকেতে বসলাম। বললাম 'এন আর সি হবে দেশে শুনেছো? '
'এন আর ছি? সেটা আবার কি? '
'এন আর ছি নয় এন আর সি। ''
'সে যাই হোক তাতে তর কি?
'আমার কি? আমি আর এ দেশে থাকতে পারবো না। `
বেলারানির হলদে চোখে বিস্ময় আর আতংক, 'কে কইছে তোরে এইসব কথা? `
'কেন তুমি খবর দেখ না? লোকের মুখে কিছু শোনো নি? `
'খবর শুনতো তোর বাবা। আমি দেখ রাসমনি চৈতনদেব`
লোকনাথ সিরিয়াল ।'
'তুমি তো সিরিয়াল দেখব। তোমার আর কি? জীবন তোমার শেষ হয়ে এসেছে। আমার কি অবস্থা ভাবো একবার। পঁচান্ন বছর ধরে জানলাম এটা আমার দেশ। এখন সরকার বলছে তুমি অনুপ্রবেশকারী।তুমি বাংলাদেশি। `
'কি কস তুই? তুই বাংলাদেশি? `বেলারানি রাগের সংগে বলেন। তারপর চুপ করে বসে থাকেন কিছু সময়।
'কি হলো এখন কথা বলছো না কেন? `
'কি কমু তোরে? তোর তো মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আমি তোরে জন্ম দিলাম মেডিকেল কলেজে আর তুই হয় গেলি বাংলাদেশি? `এ কি যাদুকর খেলা পাইছোস নাকি কৃষ্ণ? `
'হ্যাঁ ।যাদুরই খেলা। এটা খেলার বল। ভারত মারবো লাথি আমি যামু বাংলাদেশে। বাংলাদেশ মারবো লাথি আমি নো ম্যান ল্যান্ড এর মানুষ হয়ে যাবো। `
'সেটা আবার কি? এমন কথা তো কখনো শুনি নাই। '
'নো ম্যান ল্যান্ড মানে তুমি কোন দেশের নাগরিক নও।
'তা আবার হয় নাকি? কি সব কস তুই। সত্যি তোর মাথাটা খারাপ হইছে। শোন সেদিন ছিল ঝড়জলের রাত। আমার ব্যাথা উঠছে ।তোর ঠাকুরমা আমাকে রিস্কা করে নিয়া গেল হাসপাতাল। সারারাত ব্যাথায় ছটপট করছি। ভোরবেলা তুই হলি। ঝড়জলের রাতে হইছিস বলে তর নাম রাখলো তোর ঠাকুরমা কৃষ্ণ। `
'নাম তো রেখেছো খুব ভালো জন্মের কাগজ রাখো নাই। `
'বার বার একথা কস ক্যান? তা এখন ঐ কাগজ দিয়া কি হইবো তোর? বেলারানি হাঁফাচ্ছেন। রোগ তাকে ধরেছে। সুগার প্রসার অর্শ হার্ট মাথা ঘাড় যন্ত্রণা। এই সি আই টি ফ্ল্যাটে তিনি একা থাকেন। কাছেই বস্তিতে তার একটা বাড়ি আছে। সে বাড়িতে দু ছেলে থাকে। বাকি ঘর গুলোয় ভাড়াটে আছে। তিন ছেলে ফ্ল্যাট কিনে আলাদা আলাদা জায়গায় থাকে। যেমন আমি থাকি দাশ পাড়া। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেরা খাবার দেয়। চিকিৎসা করে। টাকা দেয়। খোঁজখবর রাখে। আমি একটা ছোট মোবাইল কিনে দিয়েছি। ফোন রিসিভ করা দেখিয়ে দিয়েছি। একটা ডাইরিতে পাঁচ ছেলের নাম লেখা আছে। পাশের ঘরের রতনকে দিয়ে ফোন করেন। একটা ঘন্টা কিনে দিয়েছে দাদা। বিপদ কিছু হলে জোরে জোরে বাজাবে। তখন আশপাশের লোকজন ছুটে আসবে। খবর দেবে। আমরা চলে আসবো। তবু ওনার একটা ভয় কখন রাতবিরাতে মরে পড়ে থাকবে। একটু জল পর্যন্ত পাবেন না।
'1971 সালের পর যারা এসেছে তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে।
'তাড়াবে না তো কি করবে? বেলারানি জোরের সংগে বলেন, 'গলা জড়িয়ে ধরবে? । বলবে এসো বসো। এটা কি খোলা বাজার নাকি? যে কেউ যখন তখন এলো আর বসবাস করতে শুরু করলো। তুই ক্যান ভয় পাস। তোর বাবা পঞ্চাশ সনে রায়টের সময় এসেছিল। আমি যখন ঐ দ্যাশ ছেড়ে এ দ্যাশে আসি তখন আমি ফ্রক পড়ি। আমার বয়স ছিল তের বছর। বাবা মা মারা গেছেন। পিসি নিয়ে এসেছিল। তের বছর বয়সে বিয়ে হয়ে গেল।
'তা দেশ ছেড়ে এলে কেন? কামড়ে থাকতে পারলে না? '
'শোন তোর এক পিসি ছিল। তার ইজ্জদ গেলে সে আত্ম হত্যা করেছিল। মেয়ে বউদের নিরাপত্তা নেই। কোন ভরসায় সেখানে থাকি?
ছাড়ো তোমার ইতিহাস আমার কি হইবো কো?
'`
`আমি বলছি তোর কিছু হবে না। যারা পরে এসেছে এখনও আসছে রোজ তাদের বের করে দিতে পারে। সেটা তো অন্যায় নয়।
'তুমি সব জেনে বসে আছো না? দেশ জুরে আন্দোলন হচ্ছে। '
'হোক আন্দোলন। তোর কোন ভয় নেই। তোর কিছু হবে না। আমি বলছি। মিলিয়ে নিস আমার কথা। ঐ দেশে আমাগো ওপর অনেক অত্যাচার হইছে। সে যে কি জ্বালা কি কমু তোরে!
বেলারানি একটা কৌটো বের করলেন। দুটো ট্যাবলেট খেলেন, 'আমগো তাডাই বো না। তুই চিন্তা করিস না।
তুমি বললেই তো আমার চিন্তা দূর হয়ে যাবে না।
তা আমারও জন্ম কাগজ নাই। আমারে কি তাডাই দেবো? ঐ দেশে তো সব ফ্যাইলা আইসি।
আরে বাবা তুমি আইসো 50 সালে। আমাগো কাগজ না থাকলে বের করে দিতে পারে।
অত সোজা নাই। তোর মতো কতো মানুষের কাগজ নাই। কতজনরে তাডাইবো হ্যাঁ ।
বাবার লকারে কোন কাগজপত নাই?
কি আছে না আছে আমি কি জানি। আরে বাবা তোর তো ভোটার কার্ড আধার কাড স্কুলের কাগজ সবই আছে।
এসব দিয়ে প্রমান হবে না তুমি এ দেশের নাগরিক? ।
তাহলে দেখ একবার লকার খুইল্যা কোন কাগজ পাস কিনা।
• অনেক কসরত করেও লকার খোলে না। শেষ পর্যন্ত শিলনোডা দিয়ে লকার খুলল।
• ভিতরে কত কাগজ। বাড়ির দলিল। ফ্ল্যাটের কাগজ। বাডি ভাড়ার রসিদ। আরো কতো কিছু। কিন্তু আসল কাগজ নাই।
• তুই যে এতো ভয় পাইতাছোস।কেন? তোরে কি জেলে দেবে নাকি? । কতো লেতা কতো লোকের টাকা খাইলো তাদের কিছু হইছে নাকি? । এসব লোকরে ভয় দেখানো।
• আচ্ছা বাবা যখন এদেশে আসে তখন সরকার থেকে কোন কাগজ দেও নাই?
• সে আমি কইতে পারুম না। তবে জাহাজে কাজ করবো বইল্যা খিদিরপুর গেছিল। তখন অনেক ছোটাছুটি করছে কি সব কাগজের জন্য। আমি ঠিক জানি না।
• তুমি কিছু জানো না মা হইছো ক্যান?
• এই দেখ তোর বাবা কি আমারে সব কইতো?
• এই দু:চিন্তা নিয়ে কতদিন কাটবে? আসামের কথা কাগজে পডি। বিশ্বাস হয় না। তবে এটাও তো ঠিক তুমি এদেশে জন্ম নিয়েছো তোমার কেন জন্ম কাগজ থাকবেনা? । হারিয়ে গেলে নকল বের করবে না কেন? শুধু বছর বছর বাচ্চা বিয়াইলে হইবো? আর কোন দায় নাই? ।কাকে সে এসব কথা বলবে? হতাশ হয়ে বের হয়ে আসছে বেলারানি বললেন, 'ঐ লকারের ভিতর কিন্তু আরো একটা খোপ আছে। সেটা দেখছোস?
• না তো। আমার তো চোখে পড়ল না। দাও দেখি চাবি আবার।
• লকারের ডান দিকে এ্যন্টি লকার। চাবি ঘোরাতে চাবি শূদ্ধ আটকে গেল। এতো হমা বিপদ। আবার শিলনোডা। হ্যাঁ এবার খুলেছে। একটা ভয় কাজ করছে বুকে। পাবো তো? যদি না পাই সেই দু:চিন্তা। এভাবে বাঁচা যায় না। আচ্ছা সে কি এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি ভাবছে?
• এখানে হিজিবিজি কাগজের জংগল। সে সব সরিয়ে চোখে পড়ে একটা মলিন প্লাস্টিকের প্যাকেট। সেটা নিয়ে বারান্দায় আসি। বেলারানি জিজ্ঞেস করেন, 'কি রে পাইলি কামের কাগজ?
• দাঁড়াও। আগে দেখতে দাও।
• ভালো কইরা দেখ।
• জীর্ন হলুদ ছেঁড়া ফাটা সেলুটেপ লাগানো। চোখের সামনে তুলতে চোখে পড়ে একটা লম্বা কাগজে মোটা হরফে
• ছাপা FROM OF CERTIFICATE
তার নিচে অনেক লেখা। শেষে লেখা-হরিদাস হরিদাস পাল IS AN INDIAN CITIZEN
আর একটি কাগজ হাতে তুলে নিলাম। সেটার জীর্ন দশা। তাতে মোটা হরফে লেখা-সার্টিফিকেট OF REFUGE ।নিচে ফাস্ট ক্লাস ম্যাজিস্ট্রেটের সই। তারিখ। সীল মোহর।
এতোদিন বাবা ওপর রাগ হতো। কিন্তু না। মানুষ টা বুঝেছিল শরণার্থী মানুষের যন্ত্রণা। তাই কাগজ দুটো এতো যত্ন করে রেখেছিলেন।
বেলারানি বললেন, 'পাইছোস?
পাইছি মা। হঠাৎ মাকে জরিয়ে ধরি, 'বাবা যদি এ দেশের নাগরিক হয় আমিও এ দেশের নাগরিক।
মার শরীর থেকে মাটির গন্ধ পাচ্ছিলাম আমি।
*****************************************
Debdas kundu
6D GORAPADA sarkar Lane kol 67
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন