Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী : রাজপুত যাপননির্ভর গ্রন্থ নির্মানে প্র‍য়াসী প্রথম বাঙালি নারী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়


গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী : রাজপুত যাপননির্ভর গ্রন্থ নির্মানে প্র‍য়াসী প্রথম বাঙালি নারী


সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়


হাঁটু থেকে পা টিপতে টিপতে গোড়ালিতে এসে বন্ধ করা! কিংবা পা ধরে কিছু সময় নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা, কিছুক্ষণ পর সেই পা ছেড়ে দেওয়া! কখনও শোনা গেছে গ্রামের বিবাহিত মহিলাদের প্রণাম করবার এই রীতি? আবার, জল দিয়ে বাসন মাজা হলে সেই বাসন 'উচ্ছিষ্ট' হিসাবে গণ্য হয়ে ওতে খাওয়া যায় না! বিকল্পে শুষ্ক বালি দিয়ে বাসন মেজে রুমালে মুছে লোকজনকে খেতে দিতে হয়, এমনটাও কি শোনা গেছে? শোনা গেছে কি যাদের সন্তান হতে বাধা আসে তারা সন্তান পাওয়ার লোভে অন্য লোকের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় এই বিশ্বাসে যে আগুন লাগালে তাদের সন্তান হবে! যদি বৈচিত্রময় ভারতবর্ষের ভৌগোলিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি লৌকিক সংস্কার-সংস্কৃতিকে ছুঁয়ে দেখতে সচেষ্ট হওয়া যায় তাহলে ভারত-আত্মার আনাচে কানাচে এমন রীতি-নীতি সহজেই প্রত্যক্ষ করা যাবে। আর উনিশ শতকে এক বাঙালি নারী তা শুধু প্রত্যক্ষই করছেন না, লিখে গ্রন্থ আকারে প্রকাশ করছেন। তিনি গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী। ১৩০৩ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত 'ধোলপুর' গ্রন্থের পাতায় পাতায় আঞ্চলিক অভিজাত-অনভিজাত সমাজের বিচিত্র আচার-অনুষ্ঠানের আড়ালে লৌকিক- সমাজতাত্ত্বিক- সাংস্কৃতিক দিককে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা। যা উনিশ শতকের বাঙালি নারীর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির স্মারক হয়ে ওঠে। পূর্ব রাজস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ছোট দেশীয় রাজ্য 'ধোলপুর।' ফলত, সেই অঞ্চলের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি গ্রন্থের আকর হলেও পিতৃতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় নারীর অবস্থান যে সর্বত্রই এক সুতোয় বাঁধা তা এই গ্রন্থ থেকে সহজেই জানা যায়। 


লেখিকা গ্রন্থে তুলে ধরেছেন রাজপুত জনজাতির বিভিন্ন দিকগুলিকে। রাজস্থানের ধোলপুরে বাড়ির গৃহিনীরা দিনের বেলা 'চর্ক্কা' (চরকা) কাটা সুতো দিয়ে ঘাগরা বানিয়ে পরিধান করে। সাজে প্রায় সকলেই ওস্তাদ, যা তাদের নিজস্বতার মূলধন। সেখানে বিধবা-সধবা চেনার উপায় কম। সকলেই রূপোর কান-গহনা, মুক্তা বা অন্য ধাতুর নাকছাবী, ঝুমকো প্রভৃতিতে মুড়ে রাখেন নিজেকে। বাঙালি বিধবাদের মতো সাদা থানে সর্বত্যাগী হয়ে ওঠার উপক্রম সেখানে নেই। তবে রঙীন পোশাক পড়লেও পুঁতি, লম্বা টিকুলী বা আড় বিধবারা পড়েন না। তেমনই আবার এখানে স্ত্রীলোক তামাক খেতে অভ্যস্থ, যা থেকে বাঙালি নারী (বেশ কিছু দরিদ্র, নিম্নবিত্ত নারী তামাক ব্যবহার করে) অনেকটাই বিমুখ। রাজস্থানের বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়েই 'গীত'কে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। যে কোনো অনুষ্ঠান থেকে সাধারণ খেতে বসা সব কাজেই 'গান' একটা স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে। আর একটি বিষয়, রাজপুতরা রাখীপূর্ণিমার দিন ভীষণ ধুমধাম করে, বাঙালির দুর্গাপুজোর মতোই। ভাইদ্বিতীয়া হয় ফাল্গুন মাসের দ্বিতীয়ার দিন। আর ছেলেদের অন্নপ্রাশন হয় (যে যখনই জন্মগ্রহণ করুক) ফাল্গুনের প্রতিপদে। আবার কালী পূজা বা দেওয়ালির রাত্রে হয় লক্ষীর পূজা। বাঙালির ১লা বৈশাখের নতুন খাতার মতো উৎসব সেখানে পালন হয়। ভালো লাগার বিষয় গর্ভবতী নারীদের গর্ভসঞ্চার হলে দশ মাস অবধি নিজের হাতে বেড়াল, কুকুরদের খেতে দেওয়া রীতি। তবে এই আলোর আড়ালে বহু আধাঁরময় দিক লুকিয়ে রয়েছে, যার দেখা খুব সহজেই মেলে।


ধোলপুরের নারীরা নাকি সপ্তাহে একদিন স্নান করবার সুযোগ পান, এমনটাই জানাচ্ছেন গিরীন্দ্রনন্দিনী। জলকষ্টই এর প্রধান কারণ। মাটি দিয়ে মাথা ঘসে, পাথর দিয়ে গা রগড়ে সেই স্নান। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই নিয়মটি বিপরীতও হতে পারে। কারণ, লেখিকা শুধুমাত্র স্ত্রীলোকের কথা উল্লেখ করেছেন। এই বৈষম্য, এই পৃথককরণ অবিশ্বাস্য কিছু নয়। কেননা, সেখানের অনেক পূজাতে মেয়েদের প্রবেশাধিকার নেই। যেমন- বিজয়া দশমীর দিনে হওয়া 'ছেকুর' পূজাতে। আবার কিছু পূজা আছে যাতে পূজারী হন মেথররা। মনে হতে পারে এটা তাদের সম্মান বৃদ্ধি কিংবা সাম্যের অনয়ন। কিন্তু তা বিন্দুমাত্র নয়। 'ইরাপীরা' নামক দেবতার পূজা করে অঞ্চলিক এই মেথরেরা। এই 'ইরাপীরা' হল রোগ-বালাই এর দেবতা। দেবতা যেখানে 'রোগ', পূজারী সেখানে 'মেথর' জাতি। ভয়ানক সুন্দর মিল এই রীতির! ব্রাহ্মণ্যবাদ যে কীভাবে নিজের আগা থেকে গোড়াকে ক্ষমতায়নের দাঁত-নখে মুড়ে রেখেছে তা ভারতআত্মাকে কিছুটা উপলব্ধি করলেই অনুমেয় হয়। সদ্য 'অল ইন্ডিয়া সাইকেল আরোহী' মাধাই পাল, পরিমল কাঞ্জির কথাতে উঠে আসে সারা ভারতকে জানা বা বোঝার সারকথা। সত্যিই এই উপলব্ধি বড্ড জরুরী। আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়ে কেউ যদি 'পক্স' বা ঐজাতীয় রোগে আক্রান্ত হয় তাহলে তা রোগ নয় বরং শীতলার অনুগ্রহ বলে ধরে নেওয়া হয়। বাঙলিরা অনেকেই এটিকে 'মায়ের দয়া' বলতে অভ্যস্থ। যেখানে রোগীর শরীরে প্রোটিন দরকার সেখানে তেল-মশলাবিহীন নিরামিষ লো-প্রোটিন খাবারদাবার খাওয়ানোর ধুম লেগে যায়। শুধু তাই নয়, সারাবাড়ি জুড়ে চলে এই নিয়ম পালনের ধুম। প্রসঙ্গত লেখিকা রাজস্থানে এই রোগ হওয়ার পরবর্তীকাল প্রসঙ্গে জানাচ্ছেন— 'বাটীর স্ত্রীলোক সকলে জড় হয়ে শীতলার গীত গায়। তিন অবস্থায় তিন রকম গীত। শীতলা দেখিলে বলে 'মাতা এলেন।' শীতলায় যখন গা ঢাকিয়া যায়, তখন বলে 'মাতা সিংহাসন পর অয়েঁ হঁয়,' আর কমিবার সময়কে বলে 'বাগ লে গাঁই' রোগীকে 'মাতা মইয়া' বলে ডাকে। সে যা খেতে চায়, তাই দেওয়া হয়।' এইসব আজও আছে। আর তা সর্বত্রই। শোনা যায়, দু'দিন পরে বাসী ভাত দিয়ে ব্রাহ্মণের অবিবাহিত পুত্র কন্যাকে সকালবেলা খাওয়াতে হয়। আর রাত্রে পান্ডা ধরে শীতলার ভজন গাওয়াতে হয়, সত্যপীরের গান হয় সেখানে। শীতলাতে মরলে লোকে তাদের পোড়ায় না, জলে ভাসিয়ে দেয়। ধোলপুরে নাকি এর সাথে 'কুশ পুত্তলিকা'ও দাহ করা হয়, যাকে 'নারায়ন বলি' বলে। 


সালটা ২০০৪। ঠাকুরদা শ্রী বৈদ্যনাথ গঙ্গোপাধ্যায় গত হলে বাবা-কাকার মাথার ওপর ছাদ সরে যাওয়ার উপক্রম হয়। শ্রাদ্ধাদি কাজ উপলক্ষ্যে ভোজনের জন্য অঞ্চলেরই অর্থনৈতিক প্রভাবশালী 'মেদ্দা' কিংবা 'সাধুখাঁ' পরিবারে করজোড়ে নিমন্ত্রন জানালেও তাঁদের বৃহৎ পরিবারের সকলেই অনুপস্থিতির খাতায় নাম লেখান। কারন হিসাবে জানতে পারা যায় বাবার করে ফেলা একটি চরম ভুলের কথা। ঠাকুরদা জানলেও বাবা জানতেন না নিমন্ত্রন করতে গেলে 'হাঁড়িবন্ধ', 'উনুনবন্ধ' এই সব শব্দগুলি উল্লেখ করে নিমন্ত্রন জানাতে হয়। নাহলে তাঁরা নিমন্ত্রন গ্রহণের ভঙ্গিতে আশ্বাস রেখেও আসেন না। 'ধোলপুর' গ্রন্থের লেখিকা গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী জানাচ্ছেন, 'আমি প্রথমে আসিয়া এখানকার রীতিনীতি দেখিয়া শুনিয়া বড়ই আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলাম। এখানে আসিলে পর মহারাজার কোন জ্ঞাতির পরিবার আমাকে নিমন্ত্রণ করেন। এখানকার পদ্ধতি এই যে, নাপিতিনী নিমন্ত্রণ করিতে আইসে এবং এই বলে যে 'চুলানুতো হঁয়' অর্থাৎ উনুনকে নিমন্ত্রণ করেছেন, তাহাতে বুঝা যায় সপরিবারে নিমন্ত্রণ, উনুন জ্বালাইতে হইবে না।' উভয় জায়গাতেই যদি বলা হয় সপরিবারে আপনাদের খাওয়ার নিমন্ত্রণ তাহলে তা গ্রহণীয় হবে না। বদলে 'হাঁড়ি বন্ধ' কিংবা 'উনুন বন্ধ' বলিলে আর কিছু বলবার উপক্রম লাগবে না। নিমন্ত্রণ আপনাতেই পাশ মার্কস গ্রহণ করে নেবে। রাজপুত হোক বা বাঙালি; লৌকিক সংস্কার হোক বা অন্তঃপুরচারিনীদের কথা বাহ্যিক দিক থেকে কিছুটা মিলহীন বলে মনে হলেও অন্তরে অন্তরে তা এক দড়িতেই বাঁধা। 


রাজস্থানের ধোলপুরে তথাকথিত বড়লোক- ছোটলোকের চিরচেনা নোংরা বিভাজন বর্তমান। সো-কলড ছোটলোক'দের মধ্যে কোনো নারী বিধবা হলে স্বামীর ভাই থাকলে তাকে বিয়ে করতে হয়। আবার স্ত্রীলোকের নিজস্ব নামের অস্তিত্বও সেই এলাকায় কম। স্ত্রীদের নাকি ডাকা হয় স্বামীর নামে নাম মিলিয়ে। যেমন, হরভজন সিংহ'এর স্ত্রীর নাম হবে হরভজন সিংহী। যে অঞ্চলের মেয়ে সেই অঞ্চলের নাম মিলিয়ে নারীদের ডাকা হবে। যেমন, কেউ জয়পুরে থাকলে তাকে ডাকা হবে 'জয়পুরওয়ালী' বলে। আবার বাপের বাড়ি গেলে ব্যপারটা বাঁদিকে বাঁক নেবে। তখন ডাকা হবে গোত্র মিলিয়ে। আর সেখানে গরীবের ছেলেদের 'মোড়া' বলে ডাকা হয়। সেই অনুযায়ী গরীবের মেয়ে হলে ডাকা হবে 'মোড়ী' বলে। কন্যা সন্তান জন্ম নিলে তাকে মেরে ফেলার দৃষ্টান্তও কম নেই। সদ্যোজাতর মুখে তামাক, দোক্তা পুড়ে মেরে ফেলার উদাহরণ প্রায় লক্ষাধিক। এর সবচেয়ে বড় কারণ রাজপুত জনজাতির কন্যা সন্তানের বিবাহে বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করবার রীতি প্রচলনের জন্যই। বিয়ে হলেও আবার ভয়ংকর এই যে, উপলক্ষ্য ছাড়া খুব অল্প সময়ের জন্যই বাবার বাড়ি আসতে পারে মেয়েরা। এই সব পিতৃতান্ত্রিক প্রথার কথা গিরীন্দ্রনন্দিনী তাঁর বই-এ দেখাচ্ছেন, যা বিরলও বটে। তবে এসব শুধু রাজপুত জনজাতিতে নয়। গোটা ভারতবর্ষ জুড়েই প্রচলিত ছিল ভিন্ন রং-এ। ভিন্ন তাল-বাহানায় বৈষম্যের চিত্র, নারীশোষনের চিত্র আজও বিলুপ্ত হয়নি। শুধু ভারতেই নয়, গুটিকয়েক জায়গা বাদ দিলে প্রায় সর্বত্রই এর বিস্তার। যতই আমরা নারীজাগরনের কথা বলি না কেন সাম্য আনতে গেলে পথ চলতে হবে আরও অনেক অনেক বেশি। তা না হলে একুশ শতকে দাঁড়িয়ে যে কোন দেশে যে কোন সময়ই নতুন নতুন তালিবান শাসিত আফগানিস্থানের জন্ম হবে।


পরাধীন ভারতবর্ষে ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠেছিল অতীতের জাতীয়তবাদী ইতিহাসচর্চায় ভিত্তিতেই। রাজপুত, পেশোয়া বাজিরাও, মারাঠা প্রভৃতি জনজাতির ঐতিহ্যবাহী বীর-বীরাঙ্গনা রূপ সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎস যে ছিল একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু সেই চর্চার আড়ালে ঐ সমস্ত জনজাতির ঐতিহ্যশালী মননশীল মানবজমিন, সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, কু-সংস্কার, অন্তঃপুরের আদবকায়দা, নারীগনের বীরত্বের আড়ালে লুকিয়ে রাখা বেদনাধীন পরাধীনতা'র চর্চা ব্রাত্য থেকে যায়। প্রসঙ্গত, বেশিরভাগ বীর জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি ছিল ইংরেজ শাসন বহির্ভূত এবং তা দেশীয় রাজ্য হিসাবে গতিশীল ছিল। তাই সেখানে পাশ্চাত্যের পসরার থেকে বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছিল তাঁদের নিজস্ব দেশজ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, যা আবার তাদের জোরের জায়গাও বটে। তবে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই দেশীয় রাজাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনজাতির আন্দোলন, কিছু জায়গায় ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ গোটা ভারতের স্বদেশি চেতনাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে। দেশীয় রাজ্যের সংস্কৃতি, অন্তঃপুরের কথা বাহ্যিক দিক থেকে কিছুটা বাঙালি জনজীবনের সাথে মিলহীন মনে হলেও কার্যত ভেতরে ভেতরে তা এক সুতোতেই বাঁধা। তবে, বিশ শতকের পূর্বে (সর্বভারতীয় সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন শুরুর আগে) পরাধীন ভারতে দাঁড়িয়ে তা কীভাবে পর্যালোচিত তা নিয়ে চর্চা বর্তমান ছিল, আছেও। গুরুত্বপূর্ণ এই যে সেই সময় বাঙালি নারী-দৃষ্টিতেও বাঙালি ভিন্ন অন্য জনজাতির সমাজতাত্ত্বিক সংস্কৃতিচর্চা ব্রাত্য থাকেনি। সেদিক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেজদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা শোভনাসুন্দরী দেবীর নাম স্মরণীয় হয়ে ওঠে। তাঁর স্বামী নগেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ছিলেন রাজস্থানের জয়পুর কলেজের অধ্যাপক। ফলত, রাজপুত জনজাতির সংস্কৃতি ও অন্তঃপুরকে তিনি যেমন সামনে থেকে দেখেছেন, তেমনই সংগ্রহে রাখতে আগ্রহী হয়েছেন সেখানকার প্রবাদ-প্রবচন গল্পকথা; যা লিখিত আকারে প্রকাশিতও হয়। স্মরণে যেমন আসে কৃষ্ণভাবিনী দাস, 'আর্যাবর্ত' লেখিকা প্রসন্নময়ী দেবীর নাম; তেমনই স্মরণে আসে জ্যোতির্ময়ী দেবীর নামও। যাঁর কলমে রাজস্থানের জয়পুর অঞ্চলের রাজান্তঃপুরের কথা এবং সমাজচিত্র ফুটে ওঠে। তবে এই ধারায় আর একজনের নাম স্ব-মহিমায় উচ্চারিত হওয়ার দাবি রাখে। তিনি এই গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী। জ্যোতির্ময়ীর কিছু আগে যিনি লিখতে আসেন। তাঁর 'ধোলপুর' গ্রন্থটি রাজস্থানের ধোলপুর জনজাতির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, সমাজতাত্ত্বিক দিক, অভিজাত সমাজ ও অন্তঃপুরকথার বৈচিত্রময় চিত্রণ হয়ে ওঠে। বাঙালি নারী লিখিত এই ধরণের গ্রন্থ যথেষ্ট গুরুত্ববহ হয়ে ওঠে, তাও আবার এই গ্রন্থ যেখানে লেখা হয় বিশ শতকের পূর্বে। নারীকণ্ঠের আধুনিকতার রাস্তা যে তারা নিজেরাই প্রস্তুত করে ফেলছিল তার প্রমাণ এই গ্রন্থ। নিভৃতে, নীরবে লিখে চলা বাঙলি নারী-প্রণিত এই গ্রন্থ ঐতিহাসিক ভাবে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ।


'ধোলপুর' গ্রন্থটি লেখার পিছনে একটা ছোট ইতিহাস আছে। লেখিকার স্বামী উমাচরণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন ধোলপুরের রানা নিহাল সিংহের শিক্ষক। ফলত, রাজবাড়ির রীতিনীতি, অন্তঃপুরকে সহজাত ভাবে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছিলেন লেখিকা। কিন্তু এমন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেলেও তা সদ্ব্যবহার করে গ্রন্থ করে তুলতে পেরেছেন ক'জন? আজও পারেন এমন ক'জন বা আছে? যেখানে মেয়েদের লেখাপড়া করাতেই সমূহ বাধা, সেখানে স্বামীর সঙ্গে ভিনদেশী তারা হয়ে আকাশে উজ্বলিত হয়ে ওঠা নিশ্চিতভাবেই কৃতিত্বের স্মারক হয়ে ওঠে। আসলে মেয়েদের এই ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার মধ্যেই এক মুক্ততার বীজ তৈরি হয়েছিল, যা নিজের চোখ দিয়ে দেখে এবং ভিন্ন কিছু পরখ করে তার নির্যাস-রূপ ইতিবৃত্ত রচনার মধ্যে দিয়ে মহীরুহ বৃক্ষে পরিণত হয়। তাই এই ধরণের গ্রন্থ (ধোলপুর) নারীকণ্ঠের বাঁকবদলের ক্ষেত্রে, বিশেষত বিশ শতকের পাঁচের দশক থেকে বাংলা কবিতার যে স্বতন্ত্র ধারার জন্মলাভের ক্ষেত্রে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। 

---------------

গ্রন্থঋণ: গিরীন্দ্রনন্দিনী দেবী : ধোলপুর (রাজপুত জাতির সমাজ চিত্র)— অনুরাধা রায়।


                        ————০০০————


সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

গবেষক, সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য।


মন্তব্যসমূহ

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩