বয়স্ক
প্রতীক মিত্র
বাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে তৈরি। মধ্যিখানে ঝিল। জনবসতি থেকে একটু দুরেই বাড়িগুলো। বাড়ির লোকগুলোই নাকি ইচ্ছে করে এটা করেছে। মিশতে যে তারা অন্যদের সাথে একদমই চায় না তা নয়, তবে হৈ-হুল্লোড় থেকে একটু দুরেই থাকতে চায়। বাড়ির বাসিন্দারা অধিকাংশই বয়স্ক। সন্ধ্যের দিকে জনবসতি থেকে ফচকে ছেলের দল যখন ঝিলের ধারে ঘুরতে আসে সুরেলা কন্ঠে গান শুনতে পায়।ওদের বিড়ি-মদ খাওয়া বাধাপ্রাপ্ত না হলে ওদের মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু না… ওরা না বিড়ি ফোঁকায় মন দিতে পারে না গাঁজায় না মদে। এক-একদিন সঙ্গে ওদের মেয়ে-মহিলাও থাকে। তাদের সাথেও শারীরিকতাতেও বাধাপ্রাপ্ত হয় ওই গানে। ওরা ভীষণ রেগে তারপর বেজার মনে বাড়ি ফিরে যায়। ভাবে দিনের বেলায় এসে সব শোধ নেবে। ওদের সাথে পাঙ্গা নেওয়া? ওরা বাড়িতে, ক্লাবে, পার্টি অফিসে এসব আলোচনা করে। সবাই অবাক হয়। রেগেও যায়। এমন কাজ করবেই বা কেন যার জন্য ওদের খোকারা বিরক্ত হবে। বুড়ো হয়েছিস বুড়ো হয়েই থাক না! সকালে ছেলেগুলো গিয়ে দ্যাখে ওই বয়স্কদের কেউ কেউ ঝিলে স্নান করছে, কেউ মাছ ধরছে। আর একজন ঝিলের পাড়ে যোগাসন করছে তো চতুর্থজন খাতা-কলম নিয়ে কিসব যেন লিখছে। একজন তো আবার অদ্ভুত কিসব মন্ত্র আওড়াচ্ছে যে মন্ত্র ছেলেগুলো বুঝতে না পারলেও মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে প্রতিটা মুহুর্তে। সেদিনও ছেলেগুলো ফিরে যায়। সব আলোচনা হয়, স্কুলে, ক্লাবে, বাড়িতে। প্রথমে বিষয়গুলো বাড়ির লোকেরা পাত্তা না দিতে চাইলেও পরে কৌতুহল থেকে একটু-আধটু শুনে বেশ সন্তুষ্ট হয়। স্মৃতিচারণও তাদের হয়ে যায় পুরোনো দিনের যখন তারা এসব করতো শৈশবে। ফলে বয়স্ক মানুষদের কাজগুলো তাদের বেশ ভালোই লাগে। আরো ভালো লাগে এই ভেবে যে তাদের ছেলেরা, মেয়েরাও কেমন যেন এইসবের দ্বারা বাঁদরামি -টাঁদরামি সব ভুলে যেতে বসেছে। এইসব বয়স্ক মানুষগুলোর কাজগুলোতে অদ্ভুত এক মাদকতা ছিল।জনবসতির অধিকাংশ বিশেষ করে অল্পবয়সীরা বেশ মুগ্ধ হয়ে এইসব মানুষদের কাজগুলো অনুকরণ এবং অনুসরণ করতে শুরু করে। জনবসতিতে অকারণে অসময়ে অহেতুক চিৎকার চেঁচামেচি বন্ধ হয়ে যায়। তার বদলে কখনও গানের গলা কখনও বাদ্যযন্ত্রের সুর ভেসে আসে। তারপর মাসখানেক,মাস তিনেক পর অল্পবয়সীগুলোদের কেউ কেউ ঝিলের ধারে আসে মাছ ধরাটা আর একটু রপ্ত করতে, কেউ আসে কবিতাটায় আর একটু হাত পাকাতে, কেউ বা ভাবে যোগাসনের জন্য আর একটু শরীরটাকে নমনীয় কি করে করা যায়। বাড়িগুলোতে তারা ওই বয়স্কদের কারোকেই পায় না। ওরা কেউ নেই। সবাই চলে গেছে। খালি বাড়িগুলো উত্তরহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে। বিস্ময় অল্পবয়সীদের চোখেমুখে। মন খারাপও। কিন্তু সবই সাময়িক। কেননা,সময় নষ্ট না করে সৃজনশীল কাজে নিজেদের ব্যস্ত রাখার তাগিদটা তারা জেনে গেছে।
=====================
প্রতীক মিত্র
কোন্নগর-712235, পশ্চিমবঙ্গ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন