মার্গারেট স্যাঙ্গার এবং
জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে কিছু কথা
অনিন্দ্য পাল
ঠিক যখন এই লেখাটা শুরু হচ্ছে, তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা প্রায় ৭৯৭ কোটির কাছাকাছি! গত এক বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৫ কোটি ১১ লক্ষ ৯৫ হাজার! পৃথিবীর এই বিপুল জনসংখ্যার ৩৬% অবদান চিন আর ভারতের। বর্তমানে চিনের জনসংখ্যা ১৪৪ কোটি এবং ভারতের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। গবেষকদের ধারণা, ২০৩০ সালের মধ্যে জনসংখ্যার নিরিখে ভারতবর্ষ চিনকেও ছাপিয়ে যাবে। এখন জনসংখ্যার এই বহর যে কোন দেশের ক্ষেত্রে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এত বিপুল জনসংখ্যার দেশে অর্থনৈতিক কাঠামো ঠিক রেখে দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করে যাওয়া যথেষ্ট কঠিন হলেও পৃথিবীর মোট ১৯৫টা দেশের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর বাকি দেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার তেমন কোন দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না।
পৃথিবীর ইতিহাসে সুপরিকল্পিতভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা বা আন্দোলন যাঁর হাত ধরে শুরু হয়েছিল, তিনি মার্গারেট স্যাঙ্গার। আমেরিকান এই মহিলা আজ থেকে একশো বছরেরও বেশি সময় আগে খোদ মার্কিন মুলুকে জন্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আন্দোলন করেন। ১৮৭৯ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর জন্ম হয় মার্গারেটের। বাবা মাইকেল হিগিন্স আর মা অ্যানি ছিলেন জন্মসূত্রে আইরিশ। মাইকেল পাথরের ব্যবসায়ী ছিলেন, তবে রাজনীতির চক্করে ব্যবসায় তেমন মন দিতে পারেননি, ফলে সংসারে ছিল নিত্য অভাব। অন্যদিকে মার্গারেটের মা অ্যানি আঠারোবার গর্ভধারণ করে এগারোটি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। আর এই ভাবে ক্রমাগত গর্ভবতী হয়ে পড়ার জন্য শারিরীক সমস্যায় জেরবার অ্যানি মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মায়ের এই মৃত্যু মার্গারেট কখনই মেনে নিতে পারেন নি। পরবর্তী সময়েও তিনি মায়ের মৃত্যুর কারণ হিসেবে বারবার গর্ভপাতকেই দায়ী করেছেন।
ভারত, চিন প্রভৃতি দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, একথা যেমন ঠিক তার সঙ্গে এটাও বলতে হয় যে কয়েকটা আইন আরোপ করলেই যে জন্মনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, ব্যাপারটা ততটা সহজ কখনোই ছিল না। ভারতের তামাম জনসাধারণের মানসিকতায় তো "যৌনতা" শব্দটা খুবই অপ্রিতিকর এবং অচ্ছুত। এটা একটা খুবই স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনীয় শারীরবৃত্তীয় চাহিদা হলেও এই সম্পর্কে আলোচনা করাটা যেন একধরনের গর্হিত কাজ বলেই মানুষ ভাবে। তবে শুধু এই দেশে নয়, খোদ মার্কিন মুলুকেও ১৯০০ সালের আগে পরিস্থিতিটা খানিকটা এরকমই ছিল। জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনও সচেতন প্রয়াস সেখানে ছিল না। এই প্রয়াস যিনি শুরু করেছিলেন, তিনি মার্গারেট স্যাঙ্গার।
১৯১২-১৩ সালে মার্গারেট কয়েকটা শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেন। এই সময় নিউইয়র্ক সোশ্যালিস্ট পার্টির মেয়েদের সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনার আদান প্রদান ঘটে। এই রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে মার্গারেট আমেরিকার বাইরের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মহিলাদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। ইতিপূর্বে মার্গারেট কিছু বছর নার্সিং ট্রেনিং নিয়েছিলেন। আবার তাঁর মনের মধ্যে নিজের মায়ের মৃত্যুর অভিঘাত তখনো ছিল। এই সব মিলিয়ে মার্গারেট এবার জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অনেকটাই এগিয়ে গেলেন। ওই অ-মার্কিন মহিলাদের থেকে যা কিছু জানলেন, তাতে তাঁর মনে হল এরা ঠিকঠাক জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে অবহিত নয়। এমনকি অনেকে আবার অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই চেষ্টা করতে গিয়ে ডেকে এনেছেন বড় বিপদ। এই সব ব্যপারগুলো লক্ষ করে মার্গারেটের মধ্যে একটা অদম্য ইচ্ছা তৈরি হল। তিনি সেই সময় থেকেই তাগিদ অনুভব করলেন, কি ভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে মেয়েদের কাছে সঠিক বোধ আর ধারণাটা পৌঁছে দেওয়া যায়। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। "নিউইয়র্ক কল" পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল তাঁর লেখা দুটি প্রবন্ধ। এদের একটি ছিল, "হোয়াট এভরি মাদার স্যুড নো(১৯১১-১২)", এবং "হোয়াট এভরি গার্লস স্যুড নো(১৯১২-১৩)"। এই দুটিতে ব্যাপক সাড়া ফেলার পর এই প্রবন্ধগুলি বই আকারে প্রকাশ পেল ১৯১৬ সালে। কিন্তু সেই সময়কার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের খোলনলচে এখনকার মত ছিল না। যৌনতা বিষয়ক আলোচনা তাও আবার এরকম খুল্লমখুল্লা একেবারে বই আকারে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার স্পর্ধা দেখানোতে মার্গারেটের উপর প্রচন্ড রেগে গেলেন রক্ষণশীল মার্কিন গোষ্ঠী। তাঁরা মার্গারেটের এই প্রবন্ধদুটিকে 'অশ্লীল' বলে দেগে দিলেন। তবে হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান নয়, তেমন সব পাঠকও সমান ছিল না। মার্গারেটের পক্ষে কিছু সমর্থক ও জুটে গেল। ১৯১৪ সালে তিনি "The Women Rebel" নামে একটা কাগজ প্রকাশ করতে শুরু করেন। কাগজটির মূল উদ্দেশ্য ছিল জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা চিত্রসহ এই কাগজে প্রচার করা হত। এই সময়েই মার্গারেট প্রথম "বার্থ কন্ট্রোল" শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন। সমস্যা হল, ১৮৭৩ সালে মার্কিন সরকার একটা আইন প্রণয়ন করেছিল, যার মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল জন্ম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সমস্ত ধরনের প্রচার বন্ধ করা। মার্গারেটের কাগজ প্রকাশ এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কাজকর্ম মার্কিন সরকারের কাছে বেশ চিন্তার বিষয় হয়ে গেল। মার্গারেটের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হল দেশের আইন ভাঙার। এই পরিস্থিতিতে মার্গারেটের হাতে একটাই উপায় ছিল, কিছুদিন অন্তরীণ হয়ে থাকা। এই কারণে ১৯১৪ সালের আগস্ট মাসে তিনি আমেরিকা ছাড়েন।
আমেরিকা থেকে তিনি এলেন ইংল্যান্ড, বলা যায় এখানে তিনি নিলেন স্বেচ্ছা নির্বাসন। তখন সেখানে জনপ্রিয় ছিল 'থমাস রবার্ট মালথাস'-এর তত্ত্ব। আসলে ব্রিটেনেও তখন অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধের সম্পর্ক নিয়ে অনেকেই চিন্তায় ছিলেন। এই সব পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবও পড়েছিল মার্গারেটের উপর। তিনি আরো বেশি করে বুঝতে পারলেন কেন জন্ম নিয়ন্ত্রণ আরো বেশি করে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। তাঁর পরিচয় হল নেদারল্যান্ড-এর একটি জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সঙ্গে। সেখান থেকে তিনি শিখলেন নতুন নতুন যন্ত্রের ব্যবহার।
আবার ফিরে এলেন আমেরিকায়। আইনের তোয়াক্কা করলে যে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হবে না তা ভালমত বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। তাই আর আইনের তোয়াক্কা করলেন না। ১৯১৬ সালের ১৬ ই অক্টোবর তিনি নিউইয়র্ক শহরের বুকেই খুলে ফেললেন আমেরিকার প্রথম পরিবার পরিকল্পনা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। খুলে তো ফেললেন, কিন্তু আমেরিকা তখনও এই ধাক্কার জন্য প্রস্তুত হয় নি, ফলে যা হওয়ার তাই হল। মার্গারেটকে আইনি চোখ রাঙানি সহ্য করতে হল বেশ ভাল রকমের। এই সংস্থা খোলার ঠিক ন'দিন পর পুলিশ এর হাতে গ্রেফতার হলেন মার্গারেট। অবশ্য এর আগেও জন্ম নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত প্রচারের জন্য অশ্লীলতার দায়ে তাঁকে ৩০ দিন জেল খাটতে হয়েছিল। তবে এবার ৫০০ ডলারের জামিনে মুক্ত করা হল মার্গারেটকে।
তবে একটা কথা আছে না, ভবি ভোলবার নয়! মার্গারেট বাড়ি ফিরে আবার একই কাজ করতে শুরু করলেন। আবার এল পুলিশ! তবে এবার আর শুধু মার্গারেট গ্রেফতার হলেন না, সঙ্গে তাঁর বোন এথেলকেও গ্রেফতার করল পুলিশ। ১৯১৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিচার হল দুজনের। বিচারে এথেলের ৩০ দিনের সশ্রম কারাদন্ড হল। তিনি এই শাস্তি মাথা পেতে না নিয়ে এর বিরুদ্ধে অনশনে নামলেন। এথেলের এই স্পর্ধা শাসকের পছন্দ হবার কথা নয়, পছন্দ হলও না। জোর করে এথেলকে খাওয়ানো হলো। বোনের এই রকম পরিণতি দেখে মার্গারেট ঘাবড়ে গেলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন আর কোনো দিন আইন অমান্য করবেন না। দশদিন পর তাঁর বোন এথেল মুক্তি পেলেন কিন্তু মার্গারেট দোষী সাব্যস্ত হলেন। জজসাহেব তাঁর রায়ে বললেন মাতৃত্বের সম্ভাবনা নেই এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হওয়ার অধিকার কোন মেয়ের নেই। অর্থাৎ সন্তান ধারণের সম্ভাবনা রোধ করার কোনও অধিকার মেয়েদের নেই। মার্গারেটকে বলা হয়েছিল, যদি তিনি এমন প্রতিশ্রুতি দেন যে ভবিষ্যতে এই ব্যাপারে সমস্ত আইন তিনি মেনে চলবেন তবে তাঁকে লঘু দন্ড দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু মার্গারেটের ধনুক ভাঙা পণ! তিনি রাজি হলেন না। ফলে তাঁকে ৩০ দিনের জন্য সশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়।
লড়াই থামলো না। ১৯১৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ক্রমাগত আন্দোলন চালিয়ে গেলেন মার্গারেট। ১৯৩২ সালে জাপান থেকে এক জন্মনিরোধক আনিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন সরকারের দিকে। সরকার ওই জন্মনিরোধক দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তা সম্পূর্ণ ভাবে বেআইনি ঘোষণা করে এবং বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু ক্রমাগত আন্দোলন ততদিনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের একটা বৃহৎ গোষ্ঠীর মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল, বেড়েছিল সচেতনতা। যার ফলস্বরূপ ১৯৩৬ সালের এক ঐতিহাসিক রায়ে চিকিৎসকরা জন্মনিরোধক হাতে পাওয়ার অধিকার লাভ করেন। ১৯৩৭ সালে অ্যামেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কর্তাব্যক্তিরা জন্মনিয়ন্ত্রণকে স্বাভাবিক চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হল। মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ও এই জন্মনিয়ন্ত্রণ পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হল। অর্থাৎ সর্বাত্মকভাবেই মার্গারেটের আন্দোলন জয়যুক্ত হল। ১৯৬৬ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি এই কাজের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন।
======
অনিন্দ্য পাল
গ্রাম -- জাফরপুর
পোঃ-- চম্পাহাটিি
পিন - ৭৪৩৩৩০
থানা -- সোনারপুর
জেলা -- দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন