Featured Post

"নবপ্রভাত" ৩০তম বর্ষপূর্তি স্মারক সম্মাননার জন্য প্রকাশিত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা আহ্বান

ছবি
  "নবপ্রভাত" সাহিত্যপত্রের ৩০তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে আমরা নির্বাচিত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক ও পত্রিকা সম্পাদককে স্মারক সম্মাননা জানাতে চাই। শ্রদ্ধেয় কবি-সাহিত্যিক-নাট্যকারদের (এমনকি প্রকাশকদের) প্রতি আবেদন, আপনাদের প্রকাশিত গ্রন্থ আমাদের পাঠান। সঙ্গে দিন লেখক পরিচিতি। একক গ্রন্থ, যৌথ গ্রন্থ, সম্পাদিত সংকলন সবই পাঠাতে পারেন। বইয়ের সঙ্গে দিন লেখকের/সম্পাদকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি।  ২০১৯ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত গ্রন্থ পাঠানো যাবে। মাননীয় সম্পাদকগণ তাঁদের প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠান। সঙ্গে জানান পত্রিকার লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস। ২০২৩-২০২৪-এর মধ্যে প্রকাশিত পত্রপত্রিকা পাঠানো যাবে। শুধুমাত্র প্রাপ্ত গ্রন্থগুলির মধ্য থেকে আমরা কয়েকজন কবি / ছড়াকার / কথাকার / প্রাবন্ধিক/ নাট্যকার এবং সম্পাদককে সম্মাননা জ্ঞাপন করে ধন্য হব কলকাতার কোনো একটি হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে (অক্টোবর/নভেম্বর ২০২৪)।  আমন্ত্রণ পাবেন সকলেই। প্রাপ্ত সমস্ত গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার পরিচিতি এবং বাছাই কিছু গ্রন্থ ও পত্রিকার আলোচনা ছাপা হবে নবপ্রভাতের স্মারক সংখ্যায়। আপনাদের সহযোগিতা একান্ত কাম্য। ঠিকানাঃ নিরাশাহরণ নস্কর, সম্পাদকঃ নব

গল্প ।। মায়ের অভীপ্সা ।। পরেশ চন্দ্র মাহাত

 

মায়ের অভীপ্সা

পরেশ চন্দ্র মাহাত

 নিবেদিতা মাহাত…..কিন্তু গ্রামের অধিকাংশ লোক তাকে পূর্ণিমা বা পুণি নামেই চেনে ও জানে .…শান্তার প্রথম সন্তান পুণির  আজ ৩০তম জন্মদিন। ঊনত্রিশ পেরিয়ে তিরিশে পা দিয়েছে। কিন্তু এ পর্যন্ত জীবন যাত্রায় ইজরি নদীর ধারে, জঙ্গলে ঘেরা কাওয়াহারা গ্রাম, সেখানকার লোক মুখনিঃসৃত অনেক কিছু কুকথা কর্ন কুহরে ঢুকাতে হয়েছে শান্তাকে, তবে কিনা সে শুধু কুকথা গুলো ঢুকিয়েই রাখেনি বরং দ্বিতীয় কর্ন ছিদ্র দিয়ে বের করতে সক্ষমও হয়েছে।

 আজ থেকে ঊনত্রিশ বছর আগে যখন পুণি ভূমিষ্ঠ হয়, তখন তার মা শান্তা —প্রথম মা হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে এবং পৃথিবীর প্রত্যেক নারীর প্রথম কাঙ্ক্ষিত ইচ্ছে “মা” নামক সমাজে নিজের প্রতিষ্ঠালাভ করে। তাই তার আনন্দের জোয়ার চোখে মুখে প্রতিভাত। কিন্তু পাড়ার লোকেদের কাছে  এই খবর সুসংবাদ বার্তাবাহক নয়, তাদের কাছে দুঃসংবাদ। পুণির গায়ের রং সম্পর্কে পাড়ার লোকেদের মনোপুত হয়নি।

-----  “হ্যাঁ লো শুনেছিস কাল শান্তার বিটি হয়েছে!”

 —-“বলিস কি, কই নাতো শুনিনি?”

—--“কাইল্ দেখতে গেছিলি বিকালে।”

—--“ত কেমন দেখলি লো?”

—--“আর বলিস না লো পুরা চড়কে চড়ক ফর্সা।”

—--“ই..মা লো ..ও..ও…”

 তারপর তাদের মধ্যে সেই অভিযোগ পুণির মায়ের দিকে। তার স্বভাব – চরিত্রের দিকে। তারা নাকি কোথায় পুণির কাকার সাথে মিল খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু তারা জানে না যে, অপত্যের গায়ের রং শুধু মায়েরই থাকবে—তা নয়, বাবারও থাকতে পারে। এ জন্যে একমাত্র জিনই দায়ী। সন্তান কার জিন নিয়ে ভূমিষ্ঠ হবে সেটার নির্ণায়ক কোনো যন্ত্র এখন বিজ্ঞানীদের শীতল মস্তিষ্কে  স্থান পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। ভবিষ্যতে স্থানলাভ করতে পারবে কিনা সেটা বিজ্ঞানীদের উপরেই ছেড়ে দিয়েই আমি মুক্তিলাভ করলাম।

 তাই লোকসমাজে লজ্জাবতী নামে পরিচিতা —পরচর্চা পরনিন্দা পরসমলোচনা, যারা কিনা মা নামক সমাজে অলরেডি এন্ট্রি করেছে, সেই সমস্ত মহিলারা, তারা প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে চোখা চোখি করে শেষে এক মুফোস্কা মহিলা মুখে হাত দিয়ে চাপা স্বরে বলেই ফেলল—----

“আর বলিস না লো,কয়েকমাস আগে আমি গেছিলি, তখন দেখছি পুণির কাকাকে খাবার খেতে দিয়ে, রান্না ঘরের ভিতরে চৌকাঠে পুণির মা  বসে দুজনেই পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকিয়ে গদ গদ কণ্ঠে কথা বলছে আর  হাসাহাসি করছে। তখনই আমি বুঝে গেছিলি।”

এইভাবেই তাদের মধ্যে নিজেদেরকে সতী -সাবিত্রী প্রমাণে সফল প্রমাণিত করে পরনিন্দা পরসমালোচনা সেদিনের মতো শেষ করল, কিন্তু তাদের মনোজগতে শেষ হয়নি, হওয়ার কথাও নয়।

এদিকে পুণির মায়ের হৃদয় আনন্দে উৎফুল্লিত। তাই সে নাত্তা না পেরোলও সমস্ত কাজ আনন্দে করছে। শরীরের যন্ত্রণাকে সে পাত্তাই দিতে চাই না। সমস্ত ব্যথা চলে যায় পুণির সেই চন্দ্রমুখী মুখমন্ডল দর্শনে। তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় আচার ব্যবহারে। একটু কাজের অবসর পেলেই সে পুণিকে কোলে করে নেই এবং —“উম্মা! উম্মা! উম্মা! …” আদর ও স্নেহ মিশ্রিত লিপ টু লিপ কিস করে ।

এদিকে নাত্তার দিন পড়েছে আগামীকাল। নাত্তার আয়োজন প্রায় শেষ। আত্মীয় কুটুম স্বজন বন্ধু গ্রামের কাছের লোক প্রত্যেককে নিমন্ত্রন বার্তা পাঠানো হয়েছে। তাই রাত্রে ঘুমানোর সময় বিছানায় শুয়ে পুণিকে সংবৃত স্তনের কালো বোঁটা মুখে ঢুকিয়ে ডান বুকের পাশে নিয়ে কল্পনা করছে, কালকে পুণির মামাবাড়ি থেকে দাদু দিদার সঙ্গে মামাও আসবে। পুণির যত না আনন্দ, তার থেকে তার মায়ের বেশি আনন্দ। কারণ এখন সে আর শান্তা নয়, শান্তা নামকেই ছাপিয়ে সে সম্পুর্ণ এক নতুন নাম অর্জন করেছে— “পুণির মা”। সে এখন নতুন সমাজে তথা মাতৃত্ব নামক সমাজের কলিগ। সে এখন গর্ব করে বুক ফুলিয়ে তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সন্তানের কথা বলতে পারবে – এই আকাশ কুসুম কল্পনা করে । কেনই বা করবে না, করাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। ক’জনের কপালে জোটে খুব তাড়াতাড়ি সন্তানের মুখ দেখতে। তাও আবার এই রকম কোমল মিষ্টি মধুর মুখ, চোখের পাতার নিম্নে বিধাতার পরিয়ে দেওয়া কাজল পরা চোখজোড়া।

পরের দিন ভোরেই ঘুম ভেঙে যায় পুণির মায়ের। পুণিকে বিছানার একপাশে সরিয়ে দিয়ে উঠে পড়ে, যতটুকু তার দ্বারা কাজ করা সম্ভব তা সে করতে চেষ্টা করে। হৃদয়ের আনন্দের ফলে সব কাজই করতে মন করে কিন্তু বাড়ির লোক একটু তার প্রতি দয়ালু, তাই তাকে একটু কম কাজ করতে দেয়। আনন্দে থাকলে ঘড়ির কাঁটা খুব দ্রুত ঘোরে। পাঁচ ঘণ্টা সময় তখন দুঘন্টা থেকে কম মনে হয়। এদিকে সকাল সকাল পুণির মামাবাড়ির লোক চলে এলো। পুণির দাদুর প্রথম মুখ দর্শনেই শান্তার মুখ হাসিতে ভোরে গেল। এই প্রথম মাতৃরুপিনী শান্তা হিসাবে বাবার সাথে দর্শন ও আলাপ। মনে মনে খুব খুশি। পুণির মায়ের মতো শান্তার বাবাও মনে মনে অত্যন্ত খুশি, একই সঙ্গে গর্ববোধও করেছে এই কারনে যে — বাবা হিসাবে যা যা করণীয় সবই কমপ্লিট, ইনকমপ্লিট বলে কিছু  নেই। মনে মনে সে ভাবে—

   “যাক এত দিন আমি সার্থক বাবা হলাম। মেয়ের বিয়ে দিলাম, মেয়ে সন্তান লাভ করলো, এটাই তো পৃথিবীর প্রত্যেক সন্তানের সুভাকাঙ্খি বাবা চাই।”

 শান্তা তার বাবাকে আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেনি। তার যত টুকু সাধ্য, সমস্তই সে চেষ্টা করেছে। অবশ্য পুণির দাদু ভন্দু মেয়ের প্রতি কোনো রাগ করে না। কারণ সে তো জানে মেয়ের অবস্থা। তারা কোনো মতনে সংসার চালায়। কিন্তু সংসার স্বাছন্দ্যের উপর তো সন্তানের আগমন নির্ভর করে না। সন্তানের জন্মগ্রহণ আর্থিক স্বাছন্দ্যের উপর নির্ভর করে না, সেটা নির্ভর করে শান্তা বা শান্তার মতো বিবাহিত নারীর গর্ভাশয়ের উপর। গর্ভাশয়ের গর্ভধারণের ক্ষমতার উপর।

এরপরে যথা সময়ে নাত্তানুষ্ঠান পর্ব শুরু হয়। অনেক আত্মীয় স্বজনের আবির্ভাব অনুষ্ঠানের মাহাত্ম্য বৃদ্ধি করেছে। শান্তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা অত্যন্ত সহানুভূতি ও আহ্লাদের সঙ্গে আহুত এমনকি অনাহুতদেরকেও যথাযোগ্য সম্মান  দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সম্মানের কোনো ঘাটতি না হয় তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। শ্বশুর বাড়ির লোকেরাও ভয়ে ভয়ে থাকে এই বলে যে তাদের মধ্যে যেন কোনো ত্রুটি হলো কিনা।

অনুষ্ঠানের পর দুপুরে ভোজন পর্ব। ভাত ডাল সবজি নিরামিষ আহারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কেউ যেন বাদ না যায়, তার সুব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথম ব্যাচে বসে পুরুষেরা।  মাদুর পেতে সারি সারি বসেছে। পরিবেশন চলছে। আহুত পুরুষেরা মনের আনন্দে খাচ্ছে। সেখানে পুণির দুই দাদুও আছে।

—“কই বেহায়……কেমন হয়েছে  তরকারি রান্না টা?”

—“খুব ভালো বেহায়।

—“বলো দেখি রাধুনী কে ছিল বেহায়?”

 —“বেহান ছাড়া কে আর থাকবে বেহায়। সেই প্রথম মুখে দিয়েই বুঝতে পেরেছি, এটা বেহান-এর হাতের রান্না ছাড়া  আর অন্য কারো হতেই পারেনা।”

এইভাবে দুই বেহায়ের সরস কথাবার্তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য যারা আহুত আত্মীয় স্বজন কুটুম বাটুম ছিল তারাও কিন্তু রান্না নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি, প্রত্যেকেই সন্তুষ্ট । প্রত্যেকেই তৃপ্তি ভরে খেয়েছে। এবং রান্নার কাজে জড়িত প্রত্যেককেই “ভালো” নামক পুরস্কার প্রদান করে বাধিত করেছে। তারপরে বাকিরা যারা ছিল তারা যথাক্রমে দ্বিতীয় ব্যাচ ও তৃতীয় ব্যাচ করে ভোজন পর্ব শেষ করেছে।

ভোজন পর্ব শেষ হবার পর এলো বিদায় পর্ব। এরপরে কিন্তু শান্তার চোখে মুখে একটু বিরহ বিষণ্ণতার ছাপ স্পষ্ট। তার মন খুব খারাপ । কিন্তু শেষে ভাবে —

“ওরা তো আর চিরকাল থাকবে না, আজ না হয় কাল তো যেতই…”।

সেটা সে জানে ও বুঝে, কিন্তু মন তো আর বুঝেও বুঝতে চাই না। এটা শুধু শান্তার মনে নয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা। তাই আহুত সবাই চলে গেলেও  পুণির উজ্জ্বল মুখ দেখে সমস্ত কিছু  ভুলে যায় শান্তা। তারপরে ধীরে ধীরে শান্তার শরীর আগের অবস্থায় ফিরে আসে। আর শরীরে কোনো ব্যথা যন্ত্রণা নেই, সব কিছুই বিদায় নিয়েছে। আগের মতোই সে শরীরে বল পাচ্ছে,কাজ করতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। ফলে এইভাবে দিন মাস বছর চলে যেতে থাকে অন্যদিকে পুণিও ক্রমে ক্রমে বড় হতে থাকে।

            *****      

 কয়েক মাস হয়েছে পুণির বিয়ে হয়েছে। কাওয়াহারা গ্রাম থেকে খুব বেশি দূর নয়, মোটামুটি প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে, গুয়ায় নদী থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, কাঁঠালট্যাঁড় গ্রামের ভক্তরঞ্জন মাহাত’র  জ্যৈষ্ঠ পুত্র শ্রীমান জলেশ্বর মাহাত’র সঙ্গে, গত বৈশাখের মাসের সংক্রান্তিতে চার হাত এক হয়েছে, উভয় উভয়কে মালা পরিয়েছে। জলেশ্বর যথেষ্ঠ উচ্চ শিক্ষিত কিন্তু বেকার, বাংলায় এম. এ., বি.এড, বয়স প্রায় ৩২ এর কাছাকাছি। এদিকে পুণিও তথা পুর্নিমাও কিন্তু কম নয়। সেও স্বামী জলেশ্বরের প্রায় সমগোত্র বাংলায় এম.এ.কিন্তু বি এড করা হয়নি, অর্থাভাব এর জন্যে দায়ী। বয়সে ৫ বছরের ছোটো স্বামী জলেশ্বরের থেকে। প্রথম দিকে অবশ্য পূর্ণিমার ভাবনা চিন্তা ভিন্ন ছিল। সে ভাবত তার স্বামী হবে মাস্টার অথবা কোনো সরকারি চাকরি করা। এরূপ ভাবনা করাটা পুণির স্বাভাবিক। কারণ তার বাবা কোনো মতে, দিন মজুরির কাজ করেও তার মেয়েকে পড়িয়েছে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত । পুণিই একমাত্র শিক্ষিত। বাবা মা এমনকি তার কাকু দের সন্তানরাও নিরক্ষর। তারা শিক্ষালাভ করতে পারেনি,  করার সুযোগ পায়নি। তাই প্রত্যেকেই আশাও করেছিলো যে পূর্ণিমা  হয়তো আমাদের বংশের মান রক্ষা করবে। বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে।

—“বুঝলি দাদা পুনুকে একটা ভালো ঘরে বিহা দিবো।”

—“হ রে, কিন্তু দেখ্ ভাই জনম মরণ বিহা বিধাতার লিখা। সেটা তো হামদের হাতে নাই। দেখি হামদের পুণির ভাগ্যে বিধাতা কি লিখ্যেছে!”

—“সে ঠিক দাদা, কিন্তু হামরা দেখে শুনেই একটু বিহা দিবো,  ই ! এত পড়হেছে  তো ভালো ঘরে না দিলে হবেক?”

এইভাবে দুই দাদা ভাইয়ের  কথোপকথন চলে । পুণির সাথে সাথে বাবা কাকাদেরও ইচ্ছে যেন ভালো চাকরিওয়ালা বর ও ভালো ঘরে বিবাহ হয়। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে ভাবনা চিন্তাও বদল করতে হয়েছে । কারণ সেই মতো চাকরিওয়ালা বর পাওয়া যায়নি, পাবে কোথা থেকে চাকরি গত দশ বছরে হয়নি !... একমাত্র প্রতিরক্ষা বিভাগ বাদ দিয়ে। তাই ভাবনা চিন্তার বদল করতে হয়েছে বাবা কাকাদের, এমনকি পুণিকেও। কারণ বয়স তো আর থেমে থাকে না । সময় থাকতে বিয়ে দিতে না পারলে আবার পাড়া পড়শিরা অনেক কথা বলবে। ফলে তারা বিয়ে দিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েছে। এবং পুণিও বিয়ে তে “নৈব নৈব চ” করে রাজি হয়েছে।

আজ বৈশাখ সংক্রান্তি, পূর্ণিমা ও জলেশ্বর দুজনের বিবাহের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। গত একবছর তাদের দাম্পত্য জীবন মোটামুটি খারাপ না বললেও,  খুব ভালোও বলা চলে না— মাঝামাঝি রকমের। সে রকম কোনো কিছু দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে যেটা ঘটেছে সেটা অবশ্য দুর্ঘটনা নয়, সুঘটনা, আনন্দের সংবাদ…. পুণি প্রেগন্যান্ট, হবু মা হতে চলেছে। ডাক্তার দিনক্ষণ দেখে বলে দিয়েছে ১০ই  আষাঢ় সোমবার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবে। তাই পুণিকে ঠিক মতো খাবার খেতে দেওয়া থেকে শুরু করে শরীর চর্চা সব কিছুর খবর নেয় তার শ্বাশুড়ি মেনকা। একটু অলসতার ভাব দেখতে পেলেই শ্বাশুড়ি তাকে বলে—

“এ গো বহু , শরীলকে বেশি আরাম দিস্  না। এখন আরাম দিলে তখন পস্-সবের সময় অসুবিধা হবে।”

পূর্ণিমাও কিন্তু শ্বাশুড়ি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করে। তবু কোনো সময়  ত্রুটি ঘটে যায়। সেও চাই প্রসবকালে যেন না কোনো অসুবিধা হয়।

তারপরে দেখতে দেখতে সেই কাঙ্ক্ষিত বহু প্রতীক্ষিত দিনের আগের দিন অর্থাৎ ৯ই আষাঢ় উপস্থিত।  পুণিও রাত্রে বেলায় শুয়ে শুয়ে ভাবে —“কাইলকের পর আর পূর্ণিমা বা পুণি নয়, আমার নামের সঙ্গে “মা”নামক পবিত্র শব্দ যোগ হবে।”

সকাল হতেই শ্বশুর বাড়ির সকলে আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। আজ তাদের সংসারে নতুন এক অতিথির আগমন ঘটবে, সংসারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করবে। এদিকে পুণিও ভাবছে, “এই ব্যথা শুরু হলো বলে” ।

অবশেষে পুণি ও শ্বশুর বাড়ির সকলের ভাবনা ও আশাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে গিয়ে ঠিক দুপুর ১২টায়, সূর্য যখন মধ্যাহ্ন গগনে প্রখর সূর্যালোকে পৃথিবীর প্রত্যেক প্রাণী ও বস্তুকে অশান্ত করে তুলেছে, সেই প্রখর সূর্যরশ্মি পুণির গর্ভে থাকা সন্তানকেও বাদ দেয়নি, সেই গর্ভে থাকা শিশুকেও অশান্ত করেছে। এবং আঁধ ঘন্টার মধ্যে পুণির সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েই “অয়াঁ…অয়াঁ…”চিৎকার করে নিজের আবির্ভাব সকলকে জানান দিয়েছে—পৃথিবী নামক গ্রহের বাসিন্দা হিসাবেই অভিষেক ঘটেছে তার।

এদিকে সন্তান প্রসব হওয়ার কয়েক মিনিট পরেই সমস্ত ব্যথা ভুলে গিয়ে পুণিরও মনে হলো সেও এক নতুন, যা প্রত্যেক বিবাহিত নারীর চির আকাঙ্ক্ষিত আশা “ মাতৃত্ব লাভ” তার প্রতিষ্ঠার শুভ সূচনা হলো। মাতৃত্ব নামক সমাজে সেই নিজের নাম নথিভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। সে তার কল্পনাকাশে দেখতে পাচ্ছে – আজ থেকে আমি যেমন মাতৃত্ব নামক সমাজে পবিত্র মা হিসাবে পরিচিত হলাম । ঠিক তেমনি আজ থেকে তিরিশ বছর আগেও আমার জন্ম দিয়ে আমার মাও নিজেকে “মা” হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাই পুণিও অত্যন্ত আশাবাদী —প্রত্যেক নারী জাতি ক্রমান্নয়ে মা হিসাবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করে পৃথিবীকে সুন্দর, প্রাণবন্ত ও গতিশীল করে তুলবে।

============================


পরেশ চন্দ্র মাহাত

গ্রাম – বড়কিটাঁড়

ডাকঘর – করমাটাঁড়

থানাজয়পুর

জেলা – পুরুলিয়া

পিন  — ৭২৩২১৩

 

 

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

নবপ্রভাত সম্মাননা ২০২৪

জনপ্রিয় লেখা

মুদ্রিত নবপ্রভাত বইমেলা 2024 সংখ্যার জন্য লেখা-আহ্বান-বিজ্ঞপ্তি

প্রবন্ধ ।। লুপ্ত ও লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ জীবিকা ।। শ্রীজিৎ জানা

সাহিত্যের মাটিতে এক বীজ : "ত্রয়ী কাব্য" -- সুনন্দ মন্ডল

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৭তম সংখ্যা ।। আশ্বিন ১৪৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩

কবিতা ।। বসন্তের কোকিল তুমি ।। বিচিত্র কুমার

কোচবিহারের রাস উৎসব ও রাসমেলা: এক ঐতিহ্যবাহী অধ্যায় ।। পার্থ সারথি চক্রবর্তী

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৭৪তম সংখ্যা ।। বৈশাখ ১৪৩১ এপ্রিল ২০২৪

অনুভবে, অনুধ্যানে অনালোকিত কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসী ।। সুপ্রিয় গঙ্গোপাধ্যায়

প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র ।। ৬৬তম সংখ্যা ।। ভাদ্র ১৪৩০ আগস্ট ২০২৩