প্রিয় মানুষের পছন্দ
সৌমেন দেবনাথ
মানুষ কখনো একা বাঁচতে পারে না। ঘুরতে গেলেও সাথে একজন না থাকলে ঘোরাটা ঠিক ঘোরাঘুরি হয়ে উঠে না। চলতে-ফিরতে অন্তত একজন মানুষের সান্নিধ্য পেলেই সময় কাটানো মধুময় হয়ে উঠে। স্বপ্নে বিচরণ করতে হলেও একজন লাগে, নতুবা স্বপ্নের মধ্যেও বিচরণ নীরস হয়ে যায়।
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে হলে জীবনের বড়ো একটা অংশ একাই থাকতে হয়। দ্বৈত হওয়ার বাসনা, যৌথ হওয়ার চেষ্টা, একত্র হওয়ার আকাঙ্ক্ষা একাকিত্ব জীবনের প্রতিটি ক্ষণেই থাকে। কেউ পায় বন্ধু, কেউ পায় মনের বন্ধু, কেউ পায় বন্ধু-বান্ধবমহল। আর অধিকাংশই থেকে যায় একা। যারা নামে নামে বন্ধু পায় তারা বরং একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। যারা পায় মনের বন্ধু তারা আনন্দ, বিরহ, কলহ, তর্কাতর্কি, অম্ল-মধুর তিক্ততায় বেঁচে থাকে। বন্ধু-বান্ধব ভাগ্য যাদের সুপ্রসন্ন তারা বেশিই উপভোগ করে, হৈ-হল্লা, হৈ-হট্ট, হৈ-হুল্লোড়, আনন্দ-স্ফূর্তিতে জীবন কাটায়। কিন্তু আবার একান্ত ক্ষণে একজন একান্ত বন্ধুর শূন্যতায় কাতর হয়ে উঠে।
একাকিত্ব থাকলে কি আর ক্যাম্পাস লাইফ উপভোগ করা যায়? একলা শূন্যতার মাঝে বিশাল পূর্ণতা হয়ে কাজলের জীবনে কেউ আসেনি। নিজ জেলা শহরে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কারণে ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখে চমকিত হওয়ারও তার কিছু নেই। দেখতে দেখতে হয়ে গিয়েছে সে পাথর। একটি ছেলে একটি মেয়ের হাত ধরে হাঁটলে সে আর আবেগতাড়িত হয় না। নির্জনে বসে কোনো জুটির আলাপ করা দেখলে আগে যেমন সে হিংসায় জ্বলে উঠতো এখন দেখেও না দেখার ভান করে। পৃথিবীর সব সুখ প্রিয় মানুষের সাথে সময় কাটানোর মধ্যে, যা সে পাইনি; কিন্তু যারা পেয়েছে তাদেরকে সে সাধুবাদ দেয়।
কাজলের মন জুড়ে যে তৃষ্ণা ছিলো তাতে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো। আরেফিন নামে তার এক বন্ধু জুটে গেলো। কাজল আরেফিনকে বন্ধুত্বের জায়গাটা পুরোপুরি দেয়নি। মূল্যহীন সম্পর্ককে সে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু কিছুদিন যেতেই সে বুঝলো আরেফিন আসলেই ভালো মানুষ। ওদের মধ্যের বন্ধুত্বটা আগের চেয়ে গাঢ় হতে থাকলো। মনের বন্ধু পেতে হলে কথায় আর চেহারায় মুগ্ধ হতে হয়, কিন্তু শুধুই বন্ধু পেতে হলে কথা রাখলে আর কথায় মুগ্ধ হলেই চলে।
কাজল আর আরেফিনের বন্ধুত্বের মধ্যে অমি প্রবেশ করতে চায়। কিন্তু কাজল আর আরেফিনের সমর্থন পায় না। অবিশ্বাসীদের ভীড়ে বিশ্বাসী মানুষের উপরও বিশ্বাস রাখা যায় না। অমি যদি তাদের বন্ধুত্বে ঢুকে তাদের কথা অন্যত্র প্রকাশ করে তবে বন্ধুত্বটায় না ভেস্তে যায়! চাওয়াটা যদি পবিত্র হয় পাওয়াটা নিশ্চিত হয়। বন্ধুত্বটাকে পাওয়ার ইচ্ছা সবারই যদি প্রবল থাকে সত্যই সম্পর্কটা মজবুত হয়ে যায়। কাজল, আরেফিন আর অমির বন্ধুত্বটা এখন দৃশ্যমান। ক্যাম্পাসে তারা একত্রে ঘোরে, একত্রে বসে আড্ডা দেয়। তিনজনে যে বন্ধুত্ববলয় গড়েছে সেই তিনজনই আবার একা। যে বন্ধুদের সঙ্গ তারা পেয়েছে তাতে হৃদয়ের খা খা কমে না। অন্যের ভালোবাসা দেখলেই কাজল বলে, মানুষের ভালোবাসা দেখে গেলাম আজীবন। লোকের ভালোবাসা দেখলে এখন চোখ দুটো টাটায়। আমাকেও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসতো, তবে তাকে কখনোই কষ্ট কী জানতে দিতাম না!
অমি বললো, সাব্বির একেক দিন একেকটা মেয়ে নিয়ে ঘোরে; আসল পুরুষ তো এক নারীতেই সন্তুষ্ট থাকে। মেয়েগুলোও নকল আর লম্পট পুরুষই চেনে।
আরেফিন বললো, ভালোবাসাটা সত্যই সুন্দর যদি দৃষ্টি একজনের দিকেই সীমাবদ্ধ থাকে।
কাজল দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, ভালোবাসা ছাড়া জীবন বাঁচে না। জীবনে ভালোবাসার খুব প্রয়োজন। একজন প্রিয় মানুষ পেলে জীবনে আর কিছুই প্রয়োজন হবে না। সত্যই তারা ভাগ্যবান যারা ভালোবাসার মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে।
আরেফিনও দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, মাঝে মাঝে অজান্তে নিজেকে বলে ফেলি দিনশেষে একজন মানুষের খুব প্রয়োজন। হৃদয়ের খোরাক না পেলে হৃদয় বাঁচে না। পাশে একজন মনের মানুষ থাকলে আর কিছুই লাগতো না।
অমিও একটু বললো, জীবনে তো হাজার জনের প্রয়োজন হয় না, শুধু বিশ্বাসযোগ্য একজন হলেই হয়। যত্ন জানা যত্নশীলা একজন ধরা দিলে আগলে রেখে দিতাম।
কাজল আক্ষেপ করে বললো, হয়তো খুব বেশি করে চাওয়া জিনিসগুলোই অপূর্ণ থেকে যায়। খুব বেশি ভালোবাসতে চাই তো, তাই কেউ ধরা দেয় না।
হঠাৎই কাজলের সামনে দিয়ে একটি মেয়ে হেঁটে গেলো যাকে মনে হয় সে চেনে। কিন্তু কোথায় দেখেছে বুঝতে পারলো না। মেয়েটির পিছু নিলো সে। অর্থনীতি বিভাগের দিকে গিয়ে হারিয়ে গেলো। অনেকক্ষণ চেষ্টা করার পর মনে করতে পারলো, মেয়েটি তারই এলাকার এবং সে যে কলেজে পড়েছে সেই কলেজের ছাত্রী ছিলো সে।
অন্যদিনের অন্য এক সময়ের ঘটনা। অমির ফোন পেয়ে কাজল বন্ধুদের কাছে চলে এলো। আরেফিন চুপ মেরে বসে আছে। কাজল বললো, যত বেশি প্রত্যাশা ততই বেশি হতাশা। চাহিদা যত কম, জীবন তত সুন্দর আর সহজ।
আরেফিন বললো, মনের বেলাভূমিতে কি সূর্যকিরণ পড়বে না?
কাজল বুদ্ধিজীবীর মতো করে বললো, হৃদয়ে ব্যথা ডেকে এনে ঐশ্বর্যের মতো উপভোগ করিস কেনো?
আরেফিন বললো, পথের শাখা-প্রশাখার শেষ নেই, আমার না পাওয়ার শেষ নেই।
কাজল বললো, বর্তমান সময়ে সম্পর্ক হয় ক্যারিয়ার আর রূপ দেখে। সত্যিকারের ভালোবাসার কি মূল্য আছে?
আরেফিন দীর্ঘশ্বাস কেটে বললো, আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়ে এগিয়ে গেলে সব মেলে।
তারপর আর কেউ কথা বললো না, তিনজনই চুপ হয়ে বসে থাকলো। বেশক্ষণ নীরবতা পালন করা শেষে আরেফিন কাজলকে বললো, ক্যাম্পাসের কাউকে না হয় জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলাম না, কিন্তু ক্যাম্পাসের মায়া কাটাবো কীভাবে? তোর জেলাতেই শুভ কাজ সারবো, আর তুই তাতে আমায় সাহায্য করবি।
কাজলের উত্তরের আগে অমি বললো, আর আমাকে ক্যাম্পাস আর এই শহরের আলো-বাতাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিবি? আমিও তোর শহরে বিয়ে করবো। সময় পেলে আসবো, সুযোগ পেলে আসবো, উপলক্ষ পেলে আসবো, কারণ ছাড়াই আসবো।
কাজল ওদের কথা শুনে হাসে। নিজেই একা, আর দুইজনের দায়িত্ব সে নেবে কাঁধে কীভাবে?
পরের দিন কাজল ঐ মেয়েটিকে আবারও দেখলো। আজ লাল পোশাকে এসেছে। লালপরী লাগছে দেখতে। ভীষণ ভালো লাগার মতো চেহারা। অন্য কাউকেই তার সাথে তুলনা চলে না। নির্দিষ্ট একজনের মুগ্ধতায় আটকে গেলে আর কাউকেই দেখলে তেমন ভালো লাগবেও না। এত মেয়ে সামনে দিয়ে ঘোরে, কিন্তু ঐ মেয়েটির মতো আর কাউকে ভালো লাগে না। এলাকার হওয়ার কারণেই এত বেশি আপন লাগে। আপন করতে ইচ্ছা জাগে। কিন্তু বাড়িটা ঠিক কোন গ্রামে, বাবা-মায়ের নাম কি, তারই বা নাম কি কিছুই জানার উপায় পাচ্ছে না সে।
রুমে ফিরেও সারাক্ষণ ভাবে কাজল। খুব সুন্দর ও, ওকে না পাওয়াটা জীবনের বড়ো ব্যর্থতা হবে। প্রেমকলার পূর্ণদেবী বোধ হয় তাকে। হৃদয় সীমানা ঘেঁষে আগমন-প্রস্থান, হৃদয় দুয়ার উদোম করে দেখে সে সারাক্ষণ।
একদিন কাজল ক্যাম্পাস থেকে সন্ধ্যার আলো-আঁধারির মধ্য দিয়ে হেঁটে হেঁটে রুমে ফিরছিলো। হঠাৎ এক ছেলে তার গলায় ছোরা ধরে মোবাইল, মানিব্যাগ কেড়ে নিলো। দূরেই দুইজন দাঁড়িয়ে ছিলো, যেহেতু তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি, তাই সে বুঝলো ঐ দুইজনও ছিনতাইকারী দলেরই সদস্য। শক্তি প্রয়োগ করলে মোবাইল, মানিব্যাগ সে বাঁচাতে পারতো, কারণ ছোরা ধরেছে যে ছিনতাইকারী তার শরীর লিকলিকে, নেশায় টলছে, ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে। শুধু হাতের ছোরা আর অনতিদূরের দুই সঙ্গীর কারণে কাজল শক্তি দেখালো না।
মোবাইল খোয়া দিয়ে বিষণ্ন মনে রুমে ফিরলো কাজল। একটি কিম্ভূত চেহারার লাল চোখের ছিনতাইকারীর চেহারা কেবলই তার চোখে ভাসছে। মানুষের মতোই অবয়ব, কিন্তু কী বীভৎসই না কাজ করতে পারে!
পরের দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে আরেফিন আর অমিকে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার কাহিনি শোনালো। আরেফিন আর অমিও ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলো সেই কাহিনিও কাজলকে শুনলো। দুই বন্ধুর কাছ থেকে কিছু টাকা ধার পেলো কাজল, আর নিজের কাছের জমানো টাকা দিয়ে সে মোবাইল কিনলো।
কাজল অনেক দিন পর ক্যাম্পাস থেকে বাসায় গেলো। চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে শুনলো, পাশের ইউনিয়ন থেকে একটি মেয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঞ্চ পেয়েছে। একথা শুনতেই সে চমকে গেলো। মোটরসাইকেলে চড়ে পাশের ইউনিয়নে চলে গেলো। বাজারের বিশাল বড়ো বিলবোর্ডে কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। কে কোন বিশ্বিবদ্যালয়ে চাঞ্চ পেয়েছে তার ছবি সম্বলিত তালিকা। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঞ্চ পাওয়া অর্থনীতির মেয়েটির নাম যে রিতিমা তার আর বুঝতে বাকি থাকলো না।
কাজল বাসায় ফিরে এলো। আজ বড়ো বেশিই রিতিমার মুখটা চোখে ভাসছে। একবার বিলবোর্ডে দেখা ছবিটা চোখে ভাসছে, একবার ক্যাম্পাসে দেখা ছবিটা চোখে ভাসছে। মনের দেখা কেউ আটকাতে পারে না। কী দারুণ নাম, চেহারার চেয়েও সুন্দর নাম। মনে মনে ভাবে সে, সব ভাবনাতেই তোমাকে চাই। তোমার মতো প্রিয় মানুষ যদি পাশে থাকে তাহলে কত ভালোই না লাগবে! প্রতিটি মুহূর্তে তোমাকে সেভাবেই ভালোবাসবো যেভাবে তুমি চাইবে।
ক্যাম্পাসে ফিরে এলো কাজল। সব গোপন কথা বন্ধুদের বললেও রিতিমার কথা বন্ধুদের বললো না। অমি ক্যাম্পাসের মেয়েদের দেখে গবেষণাধর্মী একটি কথা বললো, সাদা জামা পরলে মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে।
কাজল ঘোর আপত্তি জানালো, না, লাল জামা পরলেই মেয়েদের বেশি সুন্দর লাগে।
আরেফিন বললো, তবে খয়েরী রঙের জামা পরলেও মেয়েদের সুন্দর লাগে।
আরেফিনের কথার সাথে সহমত পোষণ করলো কাজল। অমি বললো, মেয়েরা যে কাঁধ ব্যাগ বোগলদাবা করে হাঁটে দেখে আমার ভীষণ খারাপ লাগে।
কাজল আপত্তি জানালো এবারও, আর বললো, তোর খারাপ লাগা তোর কাছে। আমাদের ভালোই লাগে, নারে আরেফিন?
আরেফিন বললো, তবে তারা যে মাথার চুল ছেড়ে দিয়ে হাঁটে দেখে আমার খারাপই লাগে। বেণি করে হাঁটলে দেখতে বেশি ভালো লাগে।
কাজল এবার আরেফিনের কথার সাথে সহমত পোষণ করলো না, বললো, খোলা চুলেই মেয়েদের বেশি ভালো লাগে। এলোকেশীর এলোকেশে বাতাস দোলা দিলে কী দারুণই না লাগে!
এভাবেই রিতিমার পছন্দকে, সাজগোজকে আপন পছন্দ ভেবে বন্ধুদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে। পরের দিন রিতিমাকে ক্যাম্পাসে আবার দেখতে পেয়েছে সে। মনে মনে যাকে ভাবে সেই সামনে দেখা দেয়, এটা সত্যই বড়ো ভালো লাগার।
রিতিমা আজ চুলে বেণি করে এসেছে, আর সাদা জামা পরেছে। কাজল বন্ধুদের সাথে একত্র হওয়া মাত্রই অমিকে বললো, বন্ধু, সাদা জামা পরলে আসলেই মেয়েদের সুন্দর লাগে।
আর আরেফিনকে বললো, বেণি করলে মেয়েদের আসলেই দারুণ লাগে। এক বেণিতে লাগে পরি, দুই বেণিতে লাগে অপ্সরী।
আরেফিন মৃদু হেসে বললো, তোর চিন্তা-চেতনা মুহূর্তে পরিবর্তন হয়। যখন যেটাকে ভালো দেখিস তখনই সেটাকে ভালো ভালো বলে বর্ণনা করিস। অন্যের মতকেও প্রাধান্য দিতে হয়।
অমি বললো, কিন্তু সুন্দরী মেয়েগুলো তো সুন্দর চেহারার ছেলেদের সাথে মেশে না, ঘোরে না। খেয়াল করে দেখ প্রত্যেকটি সুন্দর চেহারার মেয়ের সাথে হয় ফটকা, হয় বাটপার, হয় উদ্ভট আচরণকারী, হয় গাঞ্জাখোরদের মতো কেউ না কেউ ঘুরছে।
কাজল দ্বিমত পোষণ করে বললো, তা হবে কেন? তুই মেয়েটিকে দেখছিস সুন্দর চোখে, আর ছেলেটিকে দেখছিস হিংসার চোখে। সুন্দর সুন্দরের সাথেই মেশে, সুন্দরটা কি শুধু বহির্মুখে?
আরেফিন বললো, একজন সুদর্শন মানুষ অপেক্ষা একজন দায়িত্বনিষ্ঠ মানুষ শতগুণে ভালো। ওসব মেয়েদের শেখাতে হবে না, ওরা ওসব বোঝে।
ওদিন যখন সে ডিপার্টমেন্টের দিকে যাবে তখনই রিতিমাকে দেখতে পেলো। কিন্তু রিতিমা আজ একা নয়। তার সাথে সুন্দর চেহারার একটি ছেলেও আছে। গল্প করছে, না প্রেম করছে কাজল বুঝতে পারলো না। কিন্তু এ দৃশ্য দেখে হৃদয়টা তার ভেঙে গেলো। ক্লাস না করে বিষণ্ণ মনে আরেফিন আর অমির কাছে এলো। কিছু একটা জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও অমি জিজ্ঞাসা করলো না। কিছু সময় আছে এ সময় মানুষকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করতে নেই।
পরের দিন কাজল রিতিমাকে অন্য আর একটি ছেলের সাথে দেখতে পেলো। এই ছেলেটিও সুন্দর। সুন্দর বাচনভঙ্গি, হাস্যোজ্জ্বল। দেখে কাজলের হিংসা হলো। কিন্তু নিজের মনকে বুঝ দিলো এই ভেবে হয়তো তার মতোই রিতিমাও বন্ধুহীন আবদ্ধ থেকে বন্ধুবলয়ে প্রবেশ করেছে।
রিতিমাকে কাজল বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে দেখেই, কিন্তু তার সাথে সে কথা বলতেই পারেনি সাহসের অভাবে, নম্রতার প্রাবল্যে। পবিত্র আত্মা প্রেমের পথে বড্ড বড়ো অন্তরায়।
কাজল, আরেফিন আর অমি তিন বন্ধুই কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন তিন বিভাগের। পাস করে বের হয়ে গেলো। তিন বন্ধুই সার্টিফিকেট পেলো, পেলো না হৃদয়ের রানি। ফাইল ভরা সার্টিফিকেট, হৃদয় ভরা শূন্যতা।
হল ছেড়ে দেওয়ার কারণে, চাকরি না পাওয়ার কারণে ক্যাম্পাসেই তারা কেউ যায় না। ক্যাম্পাস সংলগ্ন মেসে উঠেছে একত্রেই। সাপ্তাহিক চাকরির পত্রিকার বিজ্ঞাপন দেখে দেখে একত্রে আবেদন করে, একত্রে ঢাকা গিয়ে পরীক্ষা দেয়, একত্রে ফেরে, একজন আরেকজনের কাঁধে ভর দিয়ে ঘুমায়। বয়স বয়ে যায়, বন্ধুত্বের বন্ধন আরও গাঢ় হয়।
কাজল বাসায় গেলেই রিতিমাদের এলাকায় যায়। রিতিমার পরিবারের খোঁজ নিয়ে জানলো এলাকায় বেশ প্রভাবশালী, পাশাপাশি সম্পদশালীও। এসব বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হলে তার মতো মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলের প্রথম শ্রেণির একটা সরকারি চাকরি না হলে বড্ড বেখাপ্পা লাগবে।
মানুষ যা চায় তার সবটা না পেলেও কিয়দংশ পায়-ই। সৌভাগ্যবশত সে একটা চাকরি পেলো ব্যাংকে অফিসার পোস্টে। আরেফিনও ব্যাংকে চাকরি পেলো, তবে সিনিয়র পোস্টে। আর অমির ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন, সে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যোগ দিলো সরকারি কলেজে।
মন অনেক কিছু চায়, কিছু তার পায়, কাজলের চাওয়া জুড়ে রিতিমার অবস্থান। বাসায় ফিরে ঘটক মারফত রিতিমার বাসায় সে প্রস্তাব পাঠালো। না পাওয়া অন্য কথা, কিন্তু কেনো সে কম চাইবে?
রিতিমার বাসা থেকে ভালোই সাড়া পেলেন ঘটক। সবাই মিলে ওরা রিতিমাকে দেখতে গেলো। এলাকার ছেলে, শিক্ষিত, চাকরিজীবী সব বিবেচনায় রিতিমার বাবা-মা রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু নারাজি মত এলো রিতিমার থেকে। সুন্দরী আর শিক্ষিত মেয়েদের চাহিদা থাকে আকাশস্পর্শী। কাজলকে অপছন্দের কারণ রিতিমা না বললেও পরে ঘটক মারফত জানতে পেরেছে কাজলের শরীরের রং কিছুটা শ্যামলা। একারণে মেয়ের ছেলেকে পছন্দ হয়নি। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাজল নিজের চেহারা দেখতে থাকলো, একটু শ্যামলার কারণে তার ভেতরের আর কোনো গুণ রিতিমার চোখে পড়লো না!
কিছুদিন পরে আরেফিন ঘুরতে এলো কাজলের বাসায়। নিজ ক্যাম্পাসের একটি মেয়ে আছে তার এলাকায় আরেফিনকে বললো। কিন্তু নিজে যে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বললো না। ঘটককে ডেকে আনলো। আরেফিনকে সাথে দিয়ে ঘটককে পাঠিয়ে দিলো রিতিমাদের বাসায়। আরেফিন খুশি হলো বন্ধুর আজকের ভূমিকায়। কিন্তু কাজল সাথে গেলো না বলেও মন খারাপ করলো। দিন শেষে আরেফিন ফিরে এলো। রিতিমা তাকেও অপছন্দ করেছে। কারণ হিসেবে ঘটককে জানিয়েছে একটু খাটো। একটু খাটো বলে সে যে মেয়েদের চেয়েও চেহারায় সুন্দর, মেধাবী, চাকরিজীবী তার এই গুণগুলো ম্লান হয়ে গেলো।
অন্য এক ছুটিতে অমি এলো কাজলের বাসায়। ক্যাম্পাস দেখার আনন্দ, পাশাপাশি কাজলের সাক্ষাৎ পাওয়ার প্রবল আকাঙ্খায় অমি চলে আসে প্রায়ই। অমিকেও একই ভাবে ঘটকের সাথে প্রেরণ করলো রিতিমাদের বাসায় কাজল। রিতিমা অমিকেও প্রত্যাখ্যান করলো, কারণ হিসেবে দেখালো মোটা। মোটা হওয়ার কারণে অমির মতো উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী, বিসিএস ক্যাডার পাত্রকেও রিতিমা প্রত্যাখ্যান করলো! ছেলেগুলো সংসারে ঢুকবে কী করে?
রিতিমার আশা ছেড়ে দিলো কাজল। যার চাহিদার শেষ নেই, যার চাহিদা এত বেশি বৈচিত্র্যে ভরা তাকে পাওয়ার আশা দুরাশার নামান্তর। নিজ দুই বন্ধু মানুষ হিসেবে কতই না ভালো, তাছাড়া তার চেয়ে যোগ্যতায়ও অনেক এগিয়ে, তারাও কীভাবে তার চাহিদার কাছে হারে! তাই মিছে আশা ছেড়ে দিলো সে।
শীতকালীন অবকাশ চলছে অমির। আরেফিনও বৃহস্পতিবার ছুটি নিয়েছে। বুধবার বিকালেই কাজলের বাসার উদ্দেশ্যে রাজশাহী চলে এলো ঘুরতে। বন্ধুত্বের বন্ধন কত বেশি সুদৃঢ় হলে সম্পর্কটা এখনও এত প্রগাঢ় থাকে! ওদিনই কাজল ঘটক মারফত জানতে পারলো শুক্রবার রিতিমার বিয়ে।
আরেফিন হিংসান্বিত হয়ে বললো, কাকে সে বিয়ে করছে দেখবো! কত লম্বা ছেলে দেখবো তার বর!
অমিও কর্কশকণ্ঠে বললো, আমিও দেখবো কার সাথে তার বিয়ে হচ্ছে, কত সুন্দর চেহারা তার স্বামীর দেখবো!
কাজল অবশ্য হিংসা কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করলো না। শান্ত থাকলো। সত্য সত্য ওরা তিন বন্ধু শুক্রবার বিবাহের অনুষ্ঠানে হাজির হলো। বর সেজে বসে থাকা লোকটি তিন বন্ধুকে দেখে মাথা নত করে থাকলো। কাজল নিশ্চল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে গেলো। ডান দিক থেকে সরে এসে কাজলের কানে কানে আরেফিন বললো, আরে এ ছেলে তো ক্যাম্পাসের ঘুপচিতে বসে গাজা খেতো। অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে আমার ল্যাপটপটা তো এই ভদ্রলোকটিই ছিনতাই করেছিলো!
বাম দিক দিয়ে কাছে সরে এসে অমি বললো, এই ছেলেই তো ক্যাম্পাসের সন্ত্রাস বাহিনীর লিডার। গাজা খেয়ে টাল থাকতো সারাক্ষণ। আমার ট্যাবটা তো এই বদমাশই ছিনতাই করেছিলো।
কাজল নিশ্চল থেকে সচল হলো, কিন্তু নিশ্চুপই থাকলো। দুই বন্ধুকে টেনে নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো। কোনো প্রকার হট্টগোল করতে দিলো না। তার মোবাইলটাও যে এই ভদ্রজনই কেড়ে নিয়েছিলো তা কাউকেই বুঝতে দিলো না। কারণ তার ঘরেই যে থাকবে তার প্রিয় মানুষটি।
---------------------
নারায়ণগঞ্জ, বাংলাদেশ থেকে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন