Featured Post
গল্প ।। লোভ ।। অঞ্জন রায় চৌধুরী
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
লোভ
অঞ্জন
মোহিত বাবুদের বাড়িটা ছিলো শহর থেকে মিনিট চল্লিশ দূরে একটা বর্ধিষ্ণু গ্রাম্য এলাকায়। পাকা দোতলা বাড়ি, বছর কুড়ি পুরোনো। ইদানিং ওই বাড়িটাতে মোহিত বাবুর বাবা মা ছাড়া আর কেউ থাকেন না। মোহিত বাবু, বাবা মা এর একমাত্র সন্তান। লেখা পড়ায় ভালো হওয়ায় মাস্টার্স পাস করে বেকার বসে থাকতে তাঁর মোটেই ভালো লাগছিলো না। যদিও মোহিত বাবুর বাবা ছেলেকে একটা দোকান করে দিতে পারতেন তাঁদের বসত বাড়ির নীচে, কিন্তু মোহিত বাবু বললেন,"একটা শিক্ষিত ছেলে হয়ে চাকরি না করে দোকান করবো?" এই সব কথা শুনে ছেলেকে আর দোকান করতে না বলে চাকরির চেষ্টা করতে বললেন। মোহিত বাবু ও বছর দুয়েকের মধ্যে একটা আধা সরকারি চাকরি জুটিয়ে ফেললেন, তবে বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরের এক জেলায়। রান্না বান্না করার অভ্যাস না থাকায়, মেসে থাকলেও দুপুর আর রাতের খাবার জুটতো স্থানীয় হোটেলে। কিন্তু একদিনের জন্য ছুটি পেলেও বাড়ি চলে আসতেন তিনি। বাড়ি টাকে বড্ড বেশী ভালোবাসতেন মোহিত বাবু। যেহেতু মাইনে খুব একটা বেশী ছিল না তাঁর, যা মাইনে পেতেন তার প্রায় সবটাই খরচ হয়ে যেত হোটেলে খাওয়া আর প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যাতায়াতের জন্য। তবু একবেলা একসন্ধ্যে বাড়ি যেতে পারবেন, তাই বেশী মাইনের বাইরের রাজ্যের চাকরী ছেড়ে ওই চাকরিতেই থেকে গেলেন তিনি।
এইভাবে বছর তিনেক চলার পর হোটেলের তেল মশলা দেওয়া খাবার দীর্ঘ দিন খাওয়াতে পেটে আলসার জাতীয় কিছু হলো মোহিত বাবুর। পরিস্থিতির কারণে যথেষ্ট আয় না থাকা সত্ত্বেও মোহিত বাবুকে বিয়ে করে নিতে হলো বাড়ির চাপে । বিয়ে করে প্রথমে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে স্ত্রী কে নিয়ে থাকলেও "যে পয়সা উনি ভাড়া গুনছিলেন সেই পয়সা দিয়ে তাঁর নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট হয়ে যেতো", এই চিন্তা কেউ বা কারা তাঁর মাথায় ঢোকানোয় শেষ মেষ দু কামরার একটা ফ্ল্যাট কেনার পরিকল্পনা করলেন তিনি। যেহেতু তিনি কোনোদিন ভাড়া বাড়িতে থাকেন নি, তাই মনে মনে তিনি ভাবতেন বাবার মতো তাঁর ও নিজের একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই হোক, যাতে তিনি তাঁর ছেলে পুলেদেরকেও নিজের একটা বাড়ি দিয়ে যেতে পারেন।
একে আয় পর্যাপ্ত নয়, তার উপর ফ্ল্যাট কেনার ঠিক আগের বছরই বাবা হয়েছিলেন মোহিত বাবু। তবুও একটা ফ্ল্যাট কেনার লোভ তিনি সামলাতে পারলেন না, বছর দুয়েকের মধ্যে কিনে ফেললেন তিনি।
কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফ্ল্যাটের ই.এম.আই তার উপর সংসারের খরচ চালাতে ওই রোজগারে প্রায় হিমশিম খাওয়ার মত অবস্থা মোহিত বাবুর। শেষে অবস্থা এমন হলো যে অফিসের সহকর্মীদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা ধার করতে আরম্ভ করলেন মোহিত বাবু। কিন্তু সবাই তো আর লোকের ভালো চায় না। সহকর্মী দের একটা অংশ ,সেই সব সহকর্মী, যাঁরা মোহিত বাবুকে টাকা ধার দিচ্ছিলেন, তাঁদের কে বোঝাতে লাগলেন মোহিত বাবুর আর্থিক অবস্থা তো ভালো নয়, উনি যে টাকা ধার করছেন ফেরত দিতে পারবেন তো? কিছু সহকর্মী আবার মোহিত বাবু সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করলেন যে মোহিত বাবু এর ওর থেকে টাকা ধার করে বেড়াচ্ছেন এবং তাঁর জ্বালায় অফিসে আসা দায় হয়ে যাচ্ছে।
সেই সুহৃদ সহকর্মীর দল যাঁদের উপর দুর্দিনে ভরসা করছিলেন মোহিত বাবু, তাঁরা যখনই এই সব সন্দেহ জনক কথা বার্তা শুনলেন অন্য সহকর্মীদের কাছ থেকে, তখনই কাল বিলম্ব না করে মোহিত বাবুর কাছ থেকে টাকা ফেরত চাইলেন।
একে নিজের সঞ্চয় বলে কিছুই নেই, তার উপর যা কিছু ছিল সবই খরচ করে ফেলেছিলেন তিনি। থাকার মধ্যে ছিল বাবার বাড়ি টুকু। উনি সব কথা বাবা মা কে জানাতে ওনারা কিন্তু কিন্তু করেও ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে অবশেষে রাজি হলেন নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে ছেলের ফ্ল্যাটে গিয়ে থাকতে। প্রথমে যে দাম রাখা হয়েছিলো, সেই দামে কেনার খদ্দের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলনা। ওদিকে মোহিত বাবুকে তাঁর সহকর্মীরা একরকম হুমকি দিতে লাগলেন টাকা ফেরত করার জন্য। এর মধ্যে একবার অফিসের মধ্যে তাঁর কলার চেপে ধরে অপমান করা হলো এবং সময় বেঁধে দেওয়া হলো যে তার মধ্যে ফেরত না দিলে এবার থানা পুলিশ হবে। বাধ্য হয়ে দাম কমিয়ে খদ্দের খুঁজতে আরম্ভ করলেন মোহিত বাবুরা।
খুঁজতে খুঁজতে পরিচয় হলো রমেন বাবুর সঙ্গে। রমেন বাবু, মোহিত বাবুদের দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নতুন চাকরি পেয়েছেন। ওনার বাড়ি মোহিত বাবুর দেশ বাড়ির পাশের জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। উনি অবিবাহিত এবং বাবা মা ছাড়া ওনার আর কেউ নেই। নতুন চাকরি হওয়ার সুবাদে ওনার বেতন ও খুব একটা বেশি ছিল না, কিন্তু বাবা মা কে ওই গ্রামে রেখে উনি একা থাকতে পারছিলেন না। তাই উনি একটা কম দামের মধ্যে বাড়ি খুঁজছিলেন। মোহিত বাবুর বাড়ির তুলনায় বাড়ির দাম বেশ খানিকটা কম হওয়ায় রমেন বাবু বাড়িটা কিনতে আগ্রহী হলেন। কিন্তু পাকা কথা বলার আগে উনি একবার বাবা মা এর মতামত নিতে চাইলেন। রমেন বাবুর বাবা মা পুরনো পন্থী গ্রামের লোক। ওনারা এই ব্যাপার টা শুনে ওনাদের গুরুদেবের সাথে আলোচনার কথা বললেন। ওনাদের গুরুদেবের বাড়ি ওই গ্রামেই। সত্তরের উপর বয়েস, রোগা পাতলা, বেঁটে খাটো মানুষ। রমেন বাবুর বাবা মা এর মুখে সব কথা শুনে উনি রমেন বাবুর জন্ম বৃত্তান্ত জানতে চাইলেন। তারপর রমেন বাবুর কোষ্ঠী বিচার করে উনি বললেন," এই কোষ্ঠী যা বলছে, তাতে এই মুহূর্তে কোনো শুভ কাজ না করায় ভালো। হিতে বিপরীতও হতে পারে।" রমেন বাবু বাবা মা এর মুখে এই কথা শুনে একরকম হেসেই উড়িয়ে দিলেন। বললেন," আজ কালকের দিনে কেউ এসব মানে না। আর তাছাড়া এসব কোষ্ঠী বিচার করে কিছু হয় না, যা ঘটার তা এমনিই ঘটবে।" তাছাড়া এই মূল্যে অমন দোতলা বাড়ি কেনার লোভ সামলাতে পারলেন না রমেন বাবু। বাবা মার গুরুদেবের কথা একরকম অগ্রাহ্য করেই ব্যাংকের সাথে কথা বলে লোনের ব্যবস্থা করলেন রমেন বাবু। দেশের বাড়িটা বিক্রি করতে বাবা মা কে একরকম বাধ্য করে ব্যাংক লোন আর বাড়ি বিক্রির টাকা দিয়ে কিনে ফেললেন মোহিত বাবুর দেশ বাড়ি।
এরপর একদিন শুভ দিনক্ষণ দেখে রেজিস্ট্রি করে, পুজো দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন রমেন বাবুরা।
বুকে একরাশ স্মৃতি আর চোখে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে চোখের জলে ঘর ছাড়লেন মোহিত বাবুর বাবা মা।
বাড়ি বিক্রির টাকায় সহকর্মীদের কাছ থেকে ধার করা টাকা শোধ করলেও যেহেতু ফ্ল্যাটের ই.এম.আই দেওয়ার পর মোহিত বাবুর মাসিক আয়ের সামান্য অংশই পড়ে থাকতো সংসারে দেওয়ার জন্য, তারপর বেতন বৃদ্ধি ও বন্ধ হয়ে ছিলো অনির্দিষ্ট কালের জন্য। ফলে লোক সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য আবার নতুন করে সমস্যায় পড়লেন তিনি। বাড়ি বিক্রির টাকা প্রায় পুরোটাই ব্যয় হয়ে গেছিলো ঋণ পরিশোধ করতে, আর মোহিত বাবুর বাবার সামান্য পেনশন ছাড়া মোহিত বাবুর আর কোনো আয়ের সংস্থান ছিলো না, ফলে সংসারে লোকসংখ্যার অনুপাতে টাকা পয়সার পরিমাণ অপর্যাপ্ত হওয়ায় সংসারে দেখা দিল তীব্র অভাব। অভাবের সঙ্গে সঙ্গে সংসারে অশান্তি ও বাড়তে থাকলো, ন্যুনতম প্রয়োজন মেটানোর সংস্থান না থাকলে যা হয় আর কী।
মোহিত বাবুর বাবা নিজের দেশেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন যাতে মাঝে মাঝে তাঁদের মন খারাপ হলে বুড়ো, বুড়ি নিজেদের দেশে যেতে পারেন। যখন এই অর্থাভাব আর অশান্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছালো, তখন মোহিত বাবু একদিন রাগের মাথায় তাঁর বাবা মা কে বললেন," এই ভাবে চলতে থাকলে তো আর একসাথে থাকায় যায় না। তোমাদের অসুবিধা হলে তোমরা আসতে পারো।" মোহিত বাবুর বাবা মা এর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। যে সন্তানের জন্য তাঁরা সর্বশ্রান্ত হলেন, শেষে সেই সন্তানের মুখে এহেন কথা শুনে মোহিত বাবুর বাবা হতবম্ব হয়ে গেলেন। সেই রাতেই তাঁরা ঠিক করলেন যে আর ছেলের ফ্ল্যাটে থাকবেন না। পরের দিন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই মোহিত বাবুর বাবা মা বেরিয়ে গেলেন তাঁর ফ্ল্যাট ছেড়ে। তারপর শেষে পৌঁছলেন সেই ভাড়া বাড়িতে। সেখানে কয়েকদিন যাহোক করে কাটলো তাঁদের। একে নিজের বাড়ি বিক্রির ক্ষত, তারউপর ছেলের দুর্ব্যবহারে মাথার শেষ ছাদ টুকুও চলে যাওয়া, এই দুইয়ের ধাক্কা সামলাতে পারলেন না তাঁরা। একদিন ঠিক করলেন তাঁরা আত্মহত্যা করবেন।
সেদিন সকাল থেকে খুব বৃষ্টি হচ্ছিলো। যে ঘরে ভাড়া থাকতেন তাঁরা সেটা দোতলায়, ওনাদের বসতবাড়ি থেকে খানিকটা দূরে বাজারের মধ্যে। সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ায় বাজার চত্বর টা ছিল সেদিন ফাঁকা ফাঁকা। দুপুরে শেষ বারের মত খাওয়া দাওয়া করে, পাশের দোকান থেকে কিনে আনা কীট নাশক খেয়ে নিলেন দুজনে। তারপর থেকে রাত অবধি বিষের জ্বালায় ছটফট করতে করতে শেষে দুজনেই একসময় ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে, কেউ জানতেও পারলো না। তিন চারদিন পর তীব্র পচা গন্ধে চারদিক ভরে যাওয়ায় ওই এলাকার স্থানীয় লোক জন আর ব্যবসাদারেরা ঘরের দরজা ভেঙ্গে বের করলো মোহিত বাবুর বাবা মা এর পচা গলা মৃতদেহ। মোহিত বাবুকে খবর পাঠানো হলেও উনি এলেন না, কারণ ওই মুখ নিয়ে বাবা মার মৃতদেহের সামনে দাঁড়ানোর মতো নির্লজ্জ সম্ভবত তিনি হতে পারেন নি। যাই হোক, তাঁদের দেহ উদ্ধার করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হলো। পোস্টমর্টেম করে শেষ কৃত্য সম্পূর্ন হলো ছেলের অনুপস্থিতিতেই।
মোহিত বাবুর দেশ বাড়ির সামনের দিকে বেশ কিছুটা ফাঁকা জায়গা ছিল, তারপর পাঁচিল দেওয়া। রমেন বাবুর বাবা গ্রাম্য মানুষ। বাড়ির সামনে ফাঁকা জায়গা পেয়ে উনি গোটা বিশেক মুরগী নিয়ে একটা মুরগীর খামার বানালেন।নিজেই পরিচর্যা করতেন খামার টা।
মোহিত বাবুর বাবা মা গত হওয়ার সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। একদিন রাত্রি বেলায় মুরগি গুলো হঠাৎ করে চিৎকার করতে শুরু করলো সঙ্গে ডানা ঝাপটানোর শব্দ। রমেন বাবুর বাবা ভাবলেন হয়তো খটাশ বা শিয়াল ঢুকেছে খামারে। একটা লাঠি হাতে নিয়ে তিনি দরজা খুলে বাইরে বেরোলেন। বাইরে বেরিয়ে যা দেখলেন তাতে তাঁর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। বাইরের চাঁদের আলোয় তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন দুটো লম্বা লম্বা মূর্তি, একটা পুরুষ আর একটা মহিলা। উনি মুরগীর খামারের দিকে এগিয়ে যেতেই দেখতে পেলেন দুটো মুরগী ঘাড় মটকে পরে রয়েছে খামারের সামনে, আর পুরো চত্বর টা তাদের রক্তে ভেসে যাচ্ছে। ওনাকে দেখেই সেই ছায়া মূর্তি দুটো হুস করে কোথায় উড়ে গেলো। এই রক্তারক্তি দৃশ্য দেখে আচমকা শরীর খারাপ করতে লাগলো রমেন বাবুর বাবার। একটা আর্তনাদ করে দুম করে পড়ে গেলেন বুকে হাত দিয়ে। তাঁর চিৎকার শুনে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন রমেন বাবু ও তাঁর মা। তাঁরা কিন্তু কাউকে দেখতে পেলেন না। রমেন বাবুর বাবা মুখ দিয়ে তখন ঘর ঘর শব্দ করছেন। তাঁকে যাহোক করে ঘরে নিয়ে গেলেন রমেন বাবুরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। কিছুক্ষণ পরই মারা গেলেন রমেন বাবুর বাবা। ওনার মৃত্যুর পর ওনার মা ও কেমন যেনো হয়ে গেলেন। রমেন বাবু চাকরী সূত্রে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকতেন। ফলে ওই অত বড় বাড়িতে ওনার মা সম্পূর্ন একা থাকতেন। দুপুর বেলায় প্রায় তিনি শুনতে পেতেন পুরুষ ও মহিলার কণ্ঠ স্বর, হাঁসাহাসি করার শব্দ, কখনও খিল খিল করে হাসছে আবার কখনো গুমরে গুমরে কাঁদছে। রাতে একাই শুতেন রমেন বাবুর মা। রাতে স্পষ্ট দেখতেন এক জোড়া ছায়া মূর্তি সারা ঘর জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। রমেন বাবু কে তিনি প্রায় বলতেন, " চল বাবু, এখান থেকে চলে যাই",কিন্তু রমেন বাবু ভাবতেন, বাবা চলে যাওয়ায় মা মানসিক রোগী হয়ে গেছেন, তাই পাত্তা দিতেন না ওনার কথায়।
মাস খানেক পরের এক দুপুর বেলার ঘটনা। স্নান সেরে উঠে ছাদে কাপড় জামা মেলতে উঠেছিলেন রমেন বাবুর মা। কাপড় মেলতে মেলতে ছাদের আলসের কাছে চলে এসেছিলেন তিনি। হঠাৎ শুনতে পড়লেন পেছনে কেউ যেনো খিল খিল করে হাসছে। পেছন ফিরে দেখতে যাবেন এমন সময় কেউ যেনো দৌড়ে এসে দিলো তাকে এক ধাক্কা। দোতলার ছাদ থেকে নীচে পড়ে গেলেন তিনি। আর উঠলেন না। রমেন বাবু যখন খবর পেলেন, ততক্ষনে সব শেষ।
মা এর মৃত্যুর পর কেমন যেন মুহ্যমান হয়ে পড়লেন রমেন বাবু। দুই রকমের চিন্তা তাঁকে একরকম ব্যতিব্যস্ত করে তুললো। একদিকে তিনি ভাবতে লাগলেন যে তিনি বিজ্ঞানের ছাত্র, তার উপর স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কর্মী। রোগী আর মৃতদেহ দুটোই তাঁকে রোজই ঘাঁটতে হয়। ভূত বা আত্মা বলে যে কিছু থাকতে পারে তা তিনি কোনোদিনই বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু অন্যদিকে বাড়িটা কেনার পর তাঁর বাবা মায়ের অপমৃত্যু তাঁকে ভাবতে বাধ্য করাচ্ছে যে এই বাড়িতে নিশ্চয় এমন কিছু ঘটছে যা স্বাভাবিক নয়, অতিপ্রাকৃতিক। কিন্তু এই রকম বাড়ি এই টাকায় তো রোজ রোজ পাওয়া যাবে না, তাছাড়া একবার যে শুনবে এই বাড়িতে কী কী ঘটেছে, সে কি আর বাড়িটা কিনতে চাইবে?
এইসব সাত পাঁচ চিন্তা রোজ করতে করতে মানসিক ভাবে তিনিও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন, বুঝে উঠতে পারছিলেন না এখন তাঁর কী করণীয়। এমন সময় একদিন হঠাৎ তাঁর মনে হলো বাবা মায়ের গুরুদেবের কথা। সেই সপ্তাহের রোববারই তিনি চললেন তাঁর নিজের গ্রামে,গুরুদেবের সাথে দেখা করতে।
সব শুনে গুরুদেব বললেন," এবার বুঝলে তো, কেন আমি বারণ করে ছিলাম তোমার মা বাবা কে?" রমেন বাবু অপরাধীর মতো মাথা নিচু করে বসে রইলেন। গুরুদেব বলে চললেন," দেখো, ওই বাড়িটা যাদের, তাঁরা তাঁদের অধিকার ছাড়তে চাইছেন না। এখন উপায় দুটো। প্রথম উপায় হলো, ওই বাড়ি বিক্রি করে দেওয়া, কিন্তু তোমার কোষ্ঠী অনুযায়ী এখন বিক্রী করলে তুমি ডাহা লোকসান করবে। আর দ্বিতীয় উপায় হলো," গুরুদেব থামলেন। রমেন বাবু তাঁর মুখের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন, যেমন মুমূর্ষ রোগী ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে থাকে। গুরুদেব বললেন," দ্বিতীয় উপায় হলো, ওই ভিটেতে যে দোষ আছে সেটা যজ্ঞ করে কাটাতে হবে।" রমেন বাবু এইসব বিশ্বাস না করলেও এখন আর বিশ্বাস না করে উপায় ছিল না। তিনি গুরুদেব কে জিজ্ঞাসা করলেন," তা হলে আমাকে এখন কি করতে হবে?" গুরুদেব বললেন," দেখো, আমি এইসব কাজ করি না, তবে এইসব কাজ যিনি করেন তাঁর ঠিকানা তোমাকে দিতে পারি। তুমি তাঁর সাথে যোগাযোগ করে নিও। ভদ্রলোকের নাম শম্ভু তান্ত্রিক। বাড়ি পাশের গ্রামে। তুমি সেখানে যাও, গিয়ে আমার নাম করবে। দেখো উনি কতদূর কী করতে পারেন।" অগত্যা রমেন বাবু গিয়ে পৌঁছলেন শম্ভু তান্ত্রিকের বাড়িতে। শম্ভু তান্ত্রিক তখন পুজোয় বসেছিলেন। বয়েস বছর পঞ্চাশেক। বেঁটে খাটো, ভুঁড়িদার, গোলগাল লোক। মুখে ঘনো গোঁফ দাড়ি। রমেন বাবু কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর বাইরে এলো শম্ভু তান্ত্রিক। রমেন বাবু ওনাকে সব কথা খুলে বলতে উনি বললেন," আসলে ওই বাড়ির আসল মালিক বাড়ির অধিকার ছাড়তে চাইছেন না। তোমার কোনো দোষ নেই, কিন্তু তোমার বাবা মা কে হারাবার জন্য ওনারাই দায়ী। যাই হোক, তুমি কি ভাবছো? বাড়িটা বিক্রী করে দেবে?" রমেন বাবু বললেন," আসলে এই মুহূর্তে আমার সেই ক্ষমতা নেই যে আর একটা বাড়ি কিনতে পারবো। তাছাড়া আমার ব্যাংক লোনও এখনও শোধ হয় নি। লোন শোধ না করে বাড়ি বিক্রি তো করতে পারবো না, সুতরাং ওই বাড়িতেই আমাকে থাকতে হবে।" শম্ভু তান্ত্রিক বললেন," হুঁ, তাহলে ওই বাড়ির দোষ কাটাতে একটা যজ্ঞ করতে হবে। তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি তোমাকে একটা ফর্দ করে দিচ্ছি, সেই অনুযায়ী জিনিস পত্র গুলো এনে রেখো। আর একটা কথা আজ কৃষ্ণ পক্ষের সপ্তমী, আগামী অমাবস্যায় যজ্ঞ করবো আমি। ততদিন ওই বাড়িতে রাতে থেকো না। কয়েকদিনের জন্য একটা অন্য বাসার ব্যবস্থা করো। আমি আগেরদিন পৌঁছে যাবো তোমার কাছে।"
সেই কথা অনুযায়ী রমেন বাবু সপ্তাহ খানেকের জন্য একটা অন্য বাসা ভাড়া করলেন যেটা বাঁশ বাগানের ভেতর একটা ছোট্ট টিনের চালার ঘর। নির্দিষ্ট দিনে শম্ভু তান্ত্রিক দুই শিষ্য কে নিয়ে পৌঁছে গেলেন রমেন বাবুর বাসায়। যখন তাঁরা পৌঁছলেন তখন বিকেল তিনটে। রমেন বাবু একবার অফিস থেকে এসে ওনাদের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন," আপনারা একটু গুছিয়ে বসুন, আমি বাকি ডিউটি টা সেরে আসছি।"
শম্ভু তান্ত্রিক বললেন," সেই ভালো, আমরা একটু বিশ্রাম করে নি। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ একবার ওই বাড়িতে যাবো, কিছু প্রাথমিক ক্রিয়া করতে হবে।"
সন্ধ্যা বেলায় দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজে শম্ভু তান্ত্রিক ভাবলেন হয়ত রমেন বাবু ফিরে এসেছেন। দরজা খুলে দেখলেন, হাত খানেক দূরে বাঁশ ঝারের গা ঘেঁষে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে তার মুখ ঠিক করে বোঝা যাচ্ছে না। শম্ভু তান্ত্রিক জিজ্ঞাসা করলেন," কে আপনি?" সে কথার জবাব না দিয়ে লোকটা বললো," আপনি শম্ভু তান্ত্রিক তো? রমেন বাবুর বাড়িতে কাজ করার জন্য এসেছেন। তবে আজ রাতে আর ওই দিকে না যাওয়ায় ভালো।" শম্ভু তান্ত্রিক খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বললেন," কোন টা ভালো, আর কোনটা মন্দ সেটা আমি বুঝবো। তাছাড়া আপনি কে আমাকে বারণ করার?" লোকটা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে বললো," আমি আর কে আপনাকে বারণ করার। বেশ, আপনার যেটা ইচ্ছে আপনি করুন। আমি শুধু সাবধান করতে এসেছিলাম। এখন চলি।" বলে লোকটা আস্তে আস্তে বাঁশ বাগানের ভেতর কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো। একটু পরেই রমেন বাবু এসে পৌঁছলেন। শম্ভু তান্ত্রিক তাঁকে এই ঘটনার কথা কিছুই বললেন না। চা খেয়ে শম্ভু তান্ত্রিক আর তাঁর দুই শিষ্য রমেন বাবুকে সঙ্গে করে নিয়ে চললেন তাঁর নতুন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাসা থেকে বেরিয়ে মেন রোড টপকে আম বাগানের ভেতর রমেন বাবুর নতুন বাড়ি। আম বাগানের মধ্যে যেই না তাঁরা প্রবেশ করেছেন, হঠাৎ এক শিষ্য প্রায় চিৎকার করে উঠলো," গুরুদেব সাবধান। সামনে কারা যেনো রয়েছে।" রমেন বাবু সে দিকে টর্চের আলো ফেলতেই দেখলেন দুটো কালো কুচ কুচে বেড়াল। তাদের দুই জোড়া চোখ যেনো ভাঁটার মত জ্বলছে। লোক জন দেখেই দৌড়ে তারা পালিয়ে গেলো আম বাগানের ভেতরে। বাড়ির সামনে পৌঁছে গেট খুলতেই শম্ভু তান্ত্রিকের নাকে এলো একটা পচা গন্ধ। কাউকে কিছু না বলে শম্ভু তান্ত্রিক বাড়ির চৌহদ্দিতে ঘুরতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর শিষ্যদের এবং রমেন বাবুর চ্যাচামিচির আওয়াজ শুনে শম্ভু তান্ত্রিক সেদিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন অন্ধকারে তাঁদের উপর ইট বৃষ্টি হচ্ছে। এই বড় বড় ইট, একটা মাথায় লাগলে আর বেঁচে থাকতে হবে না। গেট বন্ধ করে যাহোক করে তালা লাগিয়ে তাঁরা সকলে ছুটে মেন রোডে চলে এলেন। রমেন বাবু শম্ভু তান্ত্রিক কে জিজ্ঞাসা করলেন," কিছু বুঝলেন মশাই?" শম্ভু তান্ত্রিক কিছু বললেন না, চুপ করে হন হন করে হাঁটতে লাগলেন।
সারা রাত ঘুম হলো না শম্ভু তান্ত্রিকের, চিন্তা করতে লাগলেন সন্ধ্যেবেলায় ঘটা ঘটনাটির কথা। পরের দিন দুপুর থেকেই ওনারা চলে গেলেন রমেন বাবুর বাড়িতে। সেখানে পুজোর স্থান নির্বাচন করে, পুজোর সামগ্রী গুছিয়ে যখন পুজোয় বসলেন শম্ভু তান্ত্রিক, তখন রাত সাত টা। চত্বরে কেউ কোথাও নেই, শুধু চার জন ছাড়া। আসন শুদ্ধি করে পুজোয় বসে নিজের, দুই শিষ্যের এবং রমেন বাবুর গাত্র বন্ধন করে দিলেন তিনি। তারপর রমেন বাবু কে বললেন," কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটতে পারে, আপনি যেনো কোনো মতেই আসন ছেড়ে উঠবেন না।" এইবলে তিনি পুজো শুরু করলেন। প্রাথমিক পর্যায়ের পুজো শেষ করে উনি ঝোলা থেকে বের করলেন একটা নর কপাল। তারপর সেটা সামনে রেখে তার মধ্যে কারণ বারি ঢেলে কাল ভৈরব মন্ত্র উচ্চারণ সবে শুরু করেছেন তিনি, অমনি পাশের বাগান থেকে এক পাল শেয়াল বিকট শব্দে চিৎকার করতে লাগলো। আসে পাশের পরিবেশের নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে গেলো তাদের সেই ডাকে। রমেন বাবু ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শম্ভু তান্ত্রিকের দিকে কিন্তু তিনি নির্বিকার, কারণ উনি জানতেন যে এমন ঘটনা ঘটা টা অস্বাভাবিক নয়। এরপর আরো কিছুক্ষন পুজো এগোলো ঘণ্টা খানেক ধরে। এবার পুজো শেষ করে যজ্ঞ শুরু করার পালা। শম্ভু তান্ত্রিক তাঁর এক শিষ্য কে বললেন ধুনুচি তে ছোবরা দিয়ে ধুনো জ্বালাতে। শিষ্য টি ধুনো জ্বালাতেই একরকম চিৎকার করে উঠলো সে ," গুরুদেব।" সবাই অবাক হয়ে দেখলো ধুনোর সেই পবিত্র গন্ধের বদলে একটা তীব্র মরা পোড়ার গন্ধে সারা ঘর ভরে গেলো। শম্ভু তান্ত্রিক একটা ফুল কে মন্ত্রপূত করে ছুঁড়ে দিলেন ধুনুচির মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে সেই মরা পোড়ার গন্ধ উবে গিয়ে ধুনোর সেই পরিচিত পবিত্র গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। যজ্ঞের আগুন জ্বালিয়ে আহুতি দেওয়া শুরু করতেই হঠাৎ কোথা থেকে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করলো। হাওয়ার বেগে যজ্ঞের আগুন প্রায় নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো। অনেক চেষ্টা করেও আর কিছুতেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না সেই আগুন। ঘরের দরজা জানলা গুলো ধড়াম ধড়াম শব্দে খুলতে, বন্ধ হতে লাগলো, আর সেই হাওয়ার ভেতরে যেনো কাদের জান্তব অট্টহাসি আর গোঙানির শব্দ শোনা গেলো," এ বাড়ি আমাদের। এখানে আমরাই থাকবো, আর কেউ না।" শম্ভু তান্ত্রিক আর তাঁর দুই শিষ্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগলেন যজ্ঞের ওই নিভে আসা আগুন কে আবার জ্বালিয়ে যজ্ঞ সম্পূর্ন করতে কিন্তু আচমকাই যজ্ঞের স্থানে শুরু হলো গত সন্ধ্যার মত ইট বৃষ্টি। শুধু ইট নয়, তার সাথে যুক্ত হলো মরার হাড় আর মাথার খুলি। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় শম্ভু তান্ত্রিক আর তাঁর দুই শিষ্য কোনো রকমে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দৌড়ে গেলেন মেন রোডের দিকে। রমেন বাবু ও ছুটলেন তাঁদের পেছন পেছন। তাঁরা শুনতে পেলেন এক প্রবল অট্টহাসির শব্দ তাঁদের পেছনে যেনো তাড়া করে আসছে। মেন রোডে উঠে তাঁরা সকলে হাঁপাতে লাগলেন। তারপর শম্ভু তান্ত্রিক হন হন করে হেঁটে চললেন রমেন বাবুর বাসার দিকে। সেখানে পৌঁছে সেই রাতে সারাক্ষন গুম মেরে রইলেন শম্ভু তান্ত্রিক। হয়তো এই ব্যর্থতা মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি।
পরের দিন সকালবেলা শম্ভু তান্ত্রিক যাওয়ার সময় রমেন বাবুকে বলে গেলেন," রমেন বাবু, ওই বাড়িতে কেউই বাস করতে পারবে না। আপনি অন্য কোনো বাসস্থান ঠিক করে ওখান থেকে চলে যান, নয়তো আপনারও প্রাণ হানি হতে পারে।" রমেন বাবু তাঁকে তাঁর প্রাপ্য দিতে গেলে তিনি বললেন," আমি এটা নিতে পারবো না। সফল হলে অবশ্যই নিতাম, কিন্তু গত রাতে আমি ব্যার্থ হয়েছি আমার কাজে। কাজেই পারিশ্রমিকের প্রশ্নই ওঠে না।" এই বলে দুই শিষ্য কে নিয়ে চলে গেলেন শম্ভু তান্ত্রিক।
এর পরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। ওই বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে রইলো। রমেন বাবু ওই গ্রামেই অন্য একটা বাড়ী ভাড়া নিয়ে থাকতেন বটে, কিন্তু বাবা মা এর মৃত্যু এবং বাড়ী হারানোর যন্ত্রণায় তিনি মানসিক অবসাদ গ্রস্থ হয়ে পড়লেন। এক সকালে তাঁর প্রতিবেশীরা উদ্ধার করলো তাঁর মৃতদেহ। পুলিশ এসে ঘর থেকে উদ্ধার করলো একটা সুইসাইড নোট, তাতে লেখা রয়েছে," লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু।"
---------------------------------------
অঞ্জন রায় চৌধুরী, বহরমপুর , মুর্শিদাবাদ
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন