বিয়ের ফুল
মিঠুন মুখার্জী
"পুরুত মশাই বিয়ে বন্ধ করুন।" পুলিশ অফিসারকে সামনে দেখে ভয়ে পালিয়ে যান পুরোহিত। পনের বছরের সৌমির বুক কেঁপে ওঠে। আঠারো বছরের শোভন টেনশনে শীতের বিকেলে ঘেমে যায় । আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কালি মন্দিরে বিয়ে করছিল তারা। বিয়ের ফুল ফোটার আগেই তারা আবেগের বিয়ে করতে ব্যস্ত। শোভনের যে সমস্ত বন্ধুরা সৌমিকে তুলে আনতে সহযোগিতা করেছিল তারাও মুহূর্তের মধ্যে ভ্যানিশ হয়ে যায়। বিপদে কারকে সঙ্গে পাওয়া যায় না। শোভন ও সৌমির কোন যুক্তি পুলিশ অফিসারের সামনে খাটে না। বাল্যবিবাহ যে আইনত অপরাধ, আইনের লোক হয়ে তাকে তো প্রশ্রয় দিতে পারেন না।
সৌমির যখন বারো বছর বয়স তখন অকালে বাবা চলে যায়। মা ছাড়া তার কেউ নেই। তখন থেকেই অনেক কষ্টে সৌমিকে মানুষ করেছেন ওর মা বন্দনা। মেশিন চালিয়ে, বাবার রেখে যাওয়া গাড়ি ভাড়া দিয়ে সংসার চালায় সে। সৌমীর কোন অভাব বন্দনা রাখেন নি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর বান্ধবীদের পাল্লায় পড়ে প্রেম করে সৌমি। প্রেমে পড়ে পড়াশোনায় ফাঁকি শুরু হয়। পড়তে গেলে পড়া করে যেত না, স্কুলে যাওয়ার নাম করে দুজনে ঘুরতে যেতো। কয়েকবার তো পাড়ার এক দাদা ও কাকু ছেলেটির হাত ধরে ঘুরতে দেখেছে। তবুও এতটুকুও লজ্জা পাইনি সৌমি। আসলে বাবার শাসন মাথার উপর না থাকলে যা হয়। মা সংসার সামলাবেন না মেয়ের দিকে নজর দেবেন। মা বারবার সৌমিকে বলেছেন--- "এই বয়সে খুব বুঝে শুনে চলবি। মেয়েদের সম্মান একবার নষ্ট হয়ে গেলে আমৃত্যু তার জন্য কথা শুনতে হয়। আমাদের মতো মানুষদের খুব ভেবে চিন্তে পা ফেলতে হয়। আমাদের পায়ে পায়ে দোষ।" মার কোনো কথাই সে শোনে নি। গুরুজনেরা আজকাল সন্তানদের কাছে লঘু হয়ে গেছে।
অল্প বয়সে সৌমীর চিন্তাভাবনায় এমন ম্যাচিউরিটি আনার পেছনে মোবাইল কিছুটা দায়ী। সোশ্যাল মিডিয়া আজ কিনা করছে! বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। একটু একটু ছেলে-মেয়েদের মোবাইলের বায়না। না দিলে বাবা মাকে ব্ল্যাকমেইল করছে, এমনকি আত্মহত্যাও করছে। সৌমি ওর মাকে অনেক ব্লাকমেইল করে ফোনটা পেয়েছে। ও মায়ের কষ্ট একদম বোঝেনা।
শোভন বাবা-মার একমাত্র সন্তান। সৌমিকে খুব একটা ভাললাগত না ওর। শোভন দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ে। খুবই মেধাবী। তবে সব ধরনের ছেলেদের সঙ্গে মেশে। শোভনের প্রতি সৌমির টানটাই বেশি। তাকেও নানান ব্ল্যাকমেল করে সৌমি। শোভনের বাড়ি থেকে কখনোই সৌমিকে মেনে নেবে না, তা শোভন জানে। তাই খুব গভীরভাবে সৌমির সঙ্গে মেলামেশা করে না সে। মাধ্যমিক পাশের পর স্কলারশিপের টাকা দিয়ে শোভনকে একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিল সৌমি। মার কাছ থেকে টাকা ম্যানেজ করে রিচার্জও করে দিত প্রতি মাসে। শোভনের বাবা-মা তাকে বলেছিলেন---- "বিএ পাস না করলে মোবাইলে হাত দিবি না।" মানে মোবাইল কিনে দেবেন না। সে বাবা-মার এতটাই বাধ্য যে, মার কথা মেনে নিয়েছিল। শোভন নিজেও বুঝতে পারছিল সৌমির জন্য তার পড়াশোনার প্রভাব পড়ছে। তবুও যেন সৌমির একগুঁয়েমি জেদি মানসিকতার কাছে বারবার ধরা পড়ে যাচ্ছিল সে।
একাদশ শ্রেণির পরীক্ষা দেবার আগে থেকেই সৌমির মধ্যে একটা পরিবর্তন শোভন লক্ষ করেছিল। শুধু ভালোবাসা নয়, এই বয়সে বিয়ে করার প্রচন্ড আবেগ কাজ করেছিল তার মধ্যে। মার সাথে সামান্য সামান্য কথা নিয়ে ঝামেলা বাঁধছিল। একদিন তো সৌমীর মা সৌমিকে দুটো চড় মারায় মাকে ঠেলা মেরে ও ফেলে দেয়। তারপর দুরসম্পর্কের পিসতুতো দিদির বাড়ি চলে যায়।
দুইদিন পর দিদির বাড়ি থেকে বিকেল বেলা পালিয়ে যায় সৌমি। আগে থেকেই শোভন ও তার তিন বন্ধু একটা শুমো গাড়ি নিয়ে সেখানে গিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে সৌমিকে তুলে এনে জলেশ্বর-এর কাছে এক কালী মন্দিরে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল। পুরুত মশাই প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না কিন্তু পয়সার লোভ দেখিয়ে বিয়েতে রাজী করায় তারা। এদিকে সৌমিকে না পেয়ে সৌমির দিদি টেনশনে একেবারে স্নান করে যায়। সৌমির মাকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা জানায় সৌমি। যখন শোভনের সঙ্গে যাচ্ছিল, তখন সৌমির দিদির বাড়ির পাশের একজন লোক দেখেছিলো। সে-ই সৌমি দিদি রত্নাকে ঘটনাটা বলেছিল। এরপর সৌমির মা তারা কোথায় যেতে পারে অনুমান করে পুলিশ থানায় অভিযোগ জানায়।পুলিশ দেরি না করে তৎক্ষণাৎ সেখানে যান। সৌমি ও শোভনের বিয়ে পড়ানো চলছিল। ঠিক মালাবদল ও সিঁদুর দানের আগে পুলিশ অফিসার দুজন কনস্টেবল নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন।
সৌমি ও শোভনের বিয়ে অসমাপ্ত থেকে যায়। তাদের দুজনকে গাড়িতে তুলে থানায় আনা হয়। সৌমির চোখে জল। থানাতে সৌমীর মা বসেছিল। তাদের দুজনকে নিয়ে পুলিশ অফিসার ও দু'জন কনস্টেবল থানায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে শোভনের মা তার ভাইকে নিয়ে থানায় আসেন। অফিসারকে শোভনকে ছেড়ে দিতে বলেন। সৌমির উপর দোষারোপ করে তীক্ষ্ণ গলায় বলেন--- "আমার শোভনের কোন দোষ নেই। ওই মেয়েটিই ওকে একপ্রকার ব্ল্যাকমেইল করে জোর করে বিয়ে করছিল। আমার এমন সুন্দর স্বভাবের মেধাবী ছেলেটির কি দশা করেছে!!" শোভনের মার কথা শুনে লজ্জায় সৌমির মায়ের মাথা হেঁট হয়ে যায়।এরপর পুলিশ অফিসার তাদের দুজনকে বোঝান--- "দেখো তোমরা দুজনে নাবালক- নাবালিকা। বিয়ের বয়স এখনো হয়নি। তোমরা জোর করে বিয়ে করলে দু'জনকেই হোমে যেতে হবে। ভবিষ্যৎটা একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। তোমরা এ কাজ করো না। তোমাদের মায়ের কথা শুনে বাড়ি চলে যাও। বাড়ির সবাই যা চাইছে তাই করো। জীবনটা ছেলেখেলা নয়। এটা আবেগ, ভালোবাসা নয়।" পুলিশ অফিসারের কথা শুনে মন না চাইলেও তারা বাড়ি যেতে রাজি হয়। কিন্তু মন মানে না। দুজনেরই চোখে জল। শোভন ও সৌমির মা যখন তাদের হাত ধরে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য থানা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন অঝোরে জল পরছে সৌমি দুচোখ থেকে। শোভনেরও চোখে জল। কষ্টে দুজনের হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছিল। এই সমাজ ও তাদের আপনজনেরা মনের মধ্যে থাকা গভীর ভালোবাসাকে উপলব্ধি করতে পারেনি। বিয়ের ফুল না ফুটলে যত চেষ্টাই করা হোক বিয়ে হয়না। সময় এই বিষয়ে শেষ কথা বলে। আমরা যা চাই তা পাই না, আর যা পাই তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। শোভন ও সৌমির জীবন যে কোন পথে এগোবে, তার জবাব দেবে সময়।
================
মিঠুন মুখার্জী
গ্ৰাম : নবজীবন পল্লী
পোস্ট+থানা -- গোবরডাঙা
জেলা -- উত্তর ২৪ পরগণা
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন