ঘঙা
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
ধিলু- লম্বু -ভলা -শিবা -দেবা - কুনু - গাড্ডু- বিট্টা- টেপি -খেপি -অনি -হাবা -ডিস্কো -পিয়া- থিলু - নন্দিনীর মত গেঁড়ি- হাউড়ি- লিলু -হানু - গঁড়া- ঘনা - ঘঙা- পাম্পিরাও হাপু গান গেয়ে পথে- ঘাটে -ট্রেনে -গৃহস্ত বাড়িতে বাড়িতে ভিক্ষা করে।
গেঁড়ি- হাউড়ি- লিলুর ঝুল নিকষ কালো রঙ। তালিতাপ্পা দেওয়া ছিন্ন ময়লা জামা প্যান্ট । হানু - গঁড়া - ঘনা- ঘঙার ময়লা ছিন্ন জামার হাতা দুটো দিয়ে কোমরে বাঁধা । সকলের মাথার চুলে লালচে ভাব । উষ্কোখুষ্কো । প্রত্যেকের মাথায় উকুনের অভয়ারণ্য । জীবনে কেউ টুথপেস্টের ধার ধারে না। বাদামি দাঁত ধেড়ে ইঁদুরের মতো। ময়লা মুখ দুর্গন্ধ। তেলের সাথে সম্পর্ক নেই। গোড়ালি ফাটা পায়ের চেটোয় ধুলোর আস্তরণ । হাতে একটা করে শক্ত দেড় ফুটের বাঁশের বাখারি। খালি গায়ে চটাক্ চটাক্ শব্দে পিঠে উপর্যুপরি বারংবার বেত্রাঘাত । চোখে মুখে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি । মাঝে মাঝে বাম হাতটা ঠোঁটের কষের সংলগ্ন করে অদ্ভুত অভিনব কায়দায় "প্যাঁ" "প্যাঁ" শব্দ করে । মুখে কাতর আবেদন পেটের জ্বালা মিটানোর জন্য ; ও দিদিরা -- ও বাবুরা --- ও কাকারা -- হাপু খিলা দিখাব -- দু'টা পইসার লেগে । দু'টো পইসা দিবে গো বাবু -- নাইলে খাব কি বাবু?
ওরা থাকতো খড়গপুর স্টেশনে । ট্রেন ধরে চলে এলো সংখ্যাধিক্যের কারণে । এত জনের সাথে থাকলে নিত্যযাত্রীরা কাকে দেবে কাকে না দেবে ভিক্ষা । গা সওয়া হয়ে গেছে। সত্যিই সভ্য সমাজে ওদের দেখে ঘৃণা তৈরি হয়। দয়া মায়া জাগে না। মাঝে মাঝে আক্রোশবশতঃ গায়ের দুর্গন্ধের কারণে দূরে সরে যেতে বলেই বলে । নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে এরা যেন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে । শৈশব নেই- খেলনাপাতি নেই- শিক্ষা নেই-স্থায়ী ঘর নেই- ভবিষ্যৎ নেই -অবসর নেই -মা বাবার কোলে বসার অধিকার নেই -ভোটাধিকার নেই- সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেবার অথবা পড়াশোনা করার রেওয়াজ নেই। আদর ভালবাসা পেতে জন্মায়নি। আমাদের মতো মসৃণ নয় । সুখের কিংবা আনন্দময়ও নয়। এদের এই দোলাচলতা কারো কারো মনে শিহরণ তোলে।
গেঁড়ি- হাউড়ি- নীলুর সাথে হানু -গঁড়া -ঘনা জুটি বেঁধেছে। ঘঙার বয়স বারো প্লাস । সে একা লাঠি নিয়ে পাড়ায় এসেছে হাপু খেলা দেখাতে। চাল- কুচা পয়সা যা জুটবে ওদের সাথে স্টেশনে এসে যাহোক কিছু ফুটিয়ে খাবে। প্রত্যেকের কাঁধে তালিতাপ্পা দেওয়া ময়লা জীর্ণ ব্যাগ । প্রত্যেকে যে যার জুটি নিয়ে ভিন্ন পথে পাড়ি দিয়েছে।
ঘঙা একা ন্যাকড়ার মধ্যে ডেনড্রাইট নিয়ে হাত ঠেকিয়ে নাকে ঘ্রাণ নিতে লাগল। তারপর ন্যাকড়া ফেলে দিয়ে ব্যাগ থেকে গুটখা বিমল মিশিয়ে অর্দ্ধেকটা মুড়ে রাখল ব্যাগে আর বাকিটা মুখে ঢেলে একটা থুতুর অংশ ফেলতে "থু" "থু" শব্দ তুলে দাঁড়িয়ে। পাড়ার অসীম - নির্মল দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে । সজনে আর শিরীষ গাছের নীচে ও দাঁড়িয়ে । হঠাৎ করে "প্যাঁ" "প্যাঁ" শব্দ তুলে , ---হাঁপু খিলা দিখাবো --- দেখবি ও ভাই ?
অসীম - নির্মল অবাক হয়ে গেল। সেটা কি রকম খেলা ওরা জানে না । কাছে গেল আর মনে মনে ভাবল ; "এইটুকু ছেলে এ আবার কি খেলা দেখাবে?"
পিছনে পিছনে পাম্পি যে এসেছে ঘঙা সাপুড়িয়া জানে না ।
----- কিরে তুই আসসু ? ভাল হইছে । আয় আয় বাবু গো ঘরে যাইয়ে খেলা দিখাব ।
পাম্পিকে স্টেশনে বসিয়ে রেখেছিল। গোধূলি বেলায় ওরা ফিরলে মোলাকাৎ হবে । কিন্তু সে চলে এলো । এ নিয়ে ঘঙা নিশ্চিন্ত হল ।
দু'জনে হকারের মতো হাঁকিয়ে বলল , বাবুরা হাপু খিলা দিখাব না কি গো ? বলে--- , হু-র-র -র হাঁপু খেলা , খেলা দেখাব নাকি ?
বসন্তের আগমন তো অনেক দেরি। তাই রিপন মন্ডলের উঠানে গাঁদা ফুলের অভাব নেই। গাছে গাছে আমের মুকুল দেখা দিয়েছে । কোকিল ডাকছে । কুহু ডাক শুনে পাম্পি সুর নকল করে ডাকতে লাগল। ওদেরই উঠানে গেল প্রথম খেলা দেখাতে । পিছনেও পাড়ার ছোটো -বড় হাজির হয়েছে অনেকে । বেশি লোকে মজা করে খেলা দেখাবে ঘঙা স্থির করল। এই শীতের কাঁপনে বালতি চেয়ে নিয়ে জল তুলে উঠানে ঢেলে দু'জনে গড়তে লাগল। কাদায় সারা শরীর আখছার। খেলা শুরু । সবাই সবিষ্ময়ে নিষ্পলক চোখে দাঁড়িয়ে। পাম্পি হাতে তালি দিচ্ছে । বগলে তার লাঠি । যে বয়সটা ওদের লেখাপড়ার সেই বয়সে পেট নামক রাক্ষসটার জন্য খেলা দেখাচ্ছে । ঘঙা চেঁচিয়ে বলছে , --- ও বাবু খিলা দিখে যাও গো বাবু খিলা ---
---- আমের পাতা চিকন চাকন বেলের পাতা শুরু
---- বউ থাকতে বিয়ে করে সেই শালা গরু ।
বলে মুখে "প্যাঁ" "প্যাঁ" শব্দ তুলে --- "হায়রে হাপু-- হায়রে হাপু"। সঙ্গে সঙ্গে পাম্পি বলল ; "উরুর বেঙা" - " উরুর বেঙা"। পিঠে চটাস্ চটাস্ শব্দে বাখারি দিয়ে মেরে আদুল গায়ের কড়া পিঠ ফেটে রক্তমুখী করল । আর ঘঙা এক পংক্তি বললে পাম্পি পরের পংক্তি আধো আধো বললে সমান তালে ঘঙা সম্পূর্ণ উচ্চস্বরে শুনিয়ে দেয় ।
---- পুঁটির মা লো পুঁটির মা পুঁটি কেন কাঁদে।
----- ভেটকি মাছের পঁটা খেয়ে চুড়ুক চুড়ুক পাদে। সমস্বরে পাম্পি বলতে উপস্থিত দর্শক শ্রোতারা হো হো করে হেসে উঠল।
--- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম আদা। --- তোর বউ আদা খেয়ে হাগে গাদা গাদা ।
--- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম নাড়ু।
--- সেই নাড়ু খেয়ে তোর বউয়ের পেটটি হল গাড়ু।
--- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম নুন। --- তোর বউ নুন খেয়ে মুতে ছুন ছুন ।
--- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম ওল।
--- সেই ওল খেয়ে তোর বউ লাগায় গন্ডগোল ।
--- পান খেতে চুন লাগে পান্তো ভাতে নুন লাগে
--- প্রেম পিরিতি করতে গেলে মনের সাথে মানুষ লাগে ।
আবারও চটাস্ চটাস্ শব্দে পিঠে লাঠির আঘাত । আর পাম্পি বগল বাজিয়ে ছড়ার তাল ঠিক রাখছে।
--- হেঁয় হাঁপু হেঁয় হাঁপু মোদের বাড়ি যাবি।
--- মেজ বউকে দেখতে পালে বেগুন পোড়া খাবি। --- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম ঘুমসি।
--- হারার মাকে নিয়ে গেল মহিষাদলের মন্ত্রী ।
--- আশুত পাতা ঝিকিমিকি বেল পাতা সরু।
--- মাগ থাকতে রাঁঢ় রাখে সে শালা গরু।
--- গিমা শাক বলে রে ভাই আমি বড় তিতো।
--- আমাকে যে লাগেরে তোর পচা মাছের গুঁতো। --- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম সিঁদুর।
--- হারার মাকে নিয়ে গেল ল্যাজ কাটা ইঁদুর ।
--- হাটে গেলাম বাটে গেলাম কিনে আনলাম দক্তা।
--- সেই দক্তা খেয়ে হারার মা মাথায় মারে তক্তা।
--- কাঁচা লঙ্কা কনক চাঁপা কল্কে ফুলের মালা ।
--- নিতুর সাথে দেখা হবে জল খাবার বেলা ।
--- আম খেয়ো জাম খেয়ো তেঁতুল খেয়ো না। ---তেঁতুল খেলে পেট গুলাবে ছেলে হবে না ।
--- ছেলে যাবে লিখতে ।
---- দারোগা যাবে দেখতে ।
--- তাল গাছে তাল পাতা বকুলতলায় আলো ।
---- ও দিদি তোর কালো ভাতার বাঁশি বাজায় ভাল।
--- চালতা গাছে চাল ধুয়ালি বকুল গাছে আলোরে।
--- ও দিদি তোর কালো ভাতার বাঁশি বাজায় ভাল রে ।
--- বুড়ি আর বুড়োতে লড়াই লেগেছে
--- বুড়ির কপালে বুড়ো পেদে দিয়েছে ।
--- নানি লো নানি তালপুকুরের পানি ।
--- নানীর স্বামী ডুবে গেল হুড়কো দিয়ে টানি।
--- জামাই শালা পোঁদে কাদা বাগবাজারের দই
--- সব শালা খেয়ে গেল এক শালা কই ।
--- রে -রে - রে - রে খিলা দেখে বাবু সব পইসা ফ্যাল্ , ফ্যাল্ পইসা ফ্যাল্ পইসা খাবু কি পেট যে জ্বলে গো ও বাবুরা -- দাদারা-- দিদিরা -- ভুখা পেট যে দাউ দাউ করে জ্বলে। আগুনখাকি পেট যে আর তর সয় না । দে -দে -দিয়ে দে দিদি চাউল টাকা পইসা ফেলা।
এই হৃদয়স্পর্শী কাতর আবেদন সমবেত দর্শকের কানে গেলে বিশ - পঁচিশ- পঞ্চাশ - কয়েন দুই টাকা পড়ে পড়ে মাটিতে শোভা পাচ্ছে । চোখে জল পিঠে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
এই শারীরিক যন্ত্রণার ক্লেদাক্ত , দৈহিক কষ্টকে পণ্য করে জীবিকার পথ ঘঙারা বাতলেছে। হায়রে হাপু বলে দৈহিক নিপীড়নের মাধ্যমে যা করে তা যে সহানুভূতি আদায়ের ফন্দি মাত্র। চপাট চপাট শব্দে আর ওদের পুরুষানুক্রমে মুখের ছড়ার মাধ্যমে "হেঁই হাপু" "হেঁই হাপু" করে । ছড়াগুলো শুনতে অশ্লীল কিন্তু শ্রুতিমধুর । খিস্তি খেউড় শুনিয়ে ঘঙা পাম্পিরা ভিক্ষাবৃত্তি করে । ওদের মসৃণ সংসার পারিবারিক জীবন যাপন না থাকলেও গ্রাম -গঞ্জে- শহরের পারিবারিক জীবনের কলহ -চুলোচুলি- অলস- অবহেলা -নিয়ে রসাল হাপু খেলা দেখায়।
এভাবে ঘঙা আর পাম্পি খেলা দেখিয়ে পয়সা উপার্জনের মাধ্যমে পথ পরিক্রমা করে চলেছে ।
আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম , তোর নাম কি?
--- ঘঙ্গা সাপুড়িয়া । সপাটে সে উত্তর দিল ।
--- মেয়েটি কে ? তোর সাথে গান গাইছে ?
--- ও আমার হবু বউ গো বাবু ।
--- এখন থেকে !!!
---- হ গো বাবু । হয় নাই সামনের বছর সিঁদুর তুলে দুব । কিরে পাম্পু তুই বলবি তো ?
পাম্পি বাদামি দাঁত বের করে ঘঙার হাত ধরে গ্রামের তালপুকুর শিবের মন্দির ছাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে।
আমি শুধু তাকিয়ে চলে যাওয়া দেখিনি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজেকে হতভাগা মনে হল।
----------------------------
সুদামকৃষ্ণ মন্ডল
গ্রাম: পুরন্দর পুর (অক্ষয় নগর)
পোস্ট : অক্ষয় নগর
থানা : কাকদ্বীপ
জেলা : দঃ চব্বিশ পরগণা
পিন কোড :743347
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন