Featured Post
জাঁতাল পুজো ।। অরবিন্দ পুরকাইত
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
গোকর্নী পুরকাইত পাড়ার জাঁতাল পুজো
– অরবিন্দ পুরকাইত
আদিম জোছনা। আদিম জোনাকি। এ মহাগ্রামে। হ্যাঁ, সুদূর সমুদ্র কিংবা দুর্গম অরণ্য-পর্বত ছেড়ে দিলে, মাঝে মাঝে এক-একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো শহর-শহরতলির বাইরে বসবাসের এ পৃথিবীকে অখণ্ড এক মহাগ্রামই মনে হয় যেন (তারাও কি গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে সব গ্রাম-বৈশিষ্ট্য!)! শহর-শহরতলির ঝলমলে বিজলীর আলোয় এই জোছনা, জোনাকি আদি বড় ম্লান এই যা। কিন্তু অজ পাড়া-গাঁ কিংবা অরণ্য-অধ্যুষিত লোকালয়ে কিঞ্চিদধিক বিজলী বা সোলার আলো সত্ত্বেও আজও এদের উপস্থিতি রীতিমতো টের পাওয়া যায়। আর কৃত্রিম আলোর নিতান্তই সীমিত বলয়ের বাইরের বৃহত্তর জগতে তো তাদের রীতিমতো রাজত্ব! এই সেদিনও স্বনামধন্য কবি গেয়ে উঠেছেন, চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে..., জোনাকি কি সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ...। অরণ্যচর বা পশুপালক কিংবা কৃষিজীবী আমাদের তস্য পিতামহ-পিতামহীর সময়েও তারা ছিল, আজও রয়ে গেছে! বড়জোড় ভিন্ন বা বিবর্তিত রূপে। আদিম হয়েও অধুনাতন – আধুনিক। চিরকালের যোগসূত্র – চিরন্তন। আদি ও অকৃত্রিম যেন! মধ্যরাতে বসতের উপর দিয়ে 'প্রিল্যুড'-এর পরে 'চোখ গেল' 'চোখ গেল' (আমাদের ভেবে-নেওয়া ভাষায়) ডেকে যায় আজও যে পাখি, কে জানে তার মতোই কেউ – তারই কোনও পূর্ব-প্রজন্ম – গুহা, অরণ্য বা নদীতীরের বসতের উপর দিয়ে একইভাবে উড়ে যেত কি না আমাদের সেই তস্য পিতামহ-পিতামহীদেরকে চমকিত করে! বিষাক্ত সাপ-খোপ বা বন্য শ্বাপদ ইত্যাদিকে দূরে রাখতে সন্ধ্যায় আবাসের আশেপাশে যে আগুন জ্বালাত বা বিপদভঞ্জন ভেবে – ভয় হতে অভয় চাওয়া কিংবা শত্রুরূপে ভজনার মতো ভয়ঙ্কর জীবজন্তু বা প্রকৃতির রুদ্র রূপের হাত থেকে রক্ষা পেতে মাটি-পাথরের যে অবয়বকে আরাধনায় সন্তুষ্ট করতে চাইত আমাদের তস্যরা অথবা উপকার-পাওয়ার কৃতজ্ঞতাজনিত ভক্তি থেকে সন্তুষ্ট করত প্রকৃতির মঙ্গলময় উপাদানকে বা তার কোনও প্রতীককে, কে জানে হারিয়ে যেতে যেতেও তার কতটা কী এখনও রয়ে গেছে – বাঁচিয়ে রেখেছে অরণ্যপ্রধান অঞ্চল বা গাঁ-গঞ্জের মানুষ, বিশেষত অশিক্ষিত বা অল্পশিক্ষিত দেহাতি মানুষ! সন্ধ্যায় সেই আগুন জ্বালানোই কি প্রতীকী হয়ে রইল না সাঁঝের প্রদীপ জ্বালানোয়! সেই ভয়ঙ্কর খণ্ড বা অসম্পূর্ণ অবয়বই কি আরও বিস্তৃতি পেল না কিংবা সংস্কারকৃত হল না বিবিধ বরাঙ্গ বা দিব্যাঙ্গ দেবকল্পে – লৌকিক থেকে শাস্ত্রীয় বিবিধ দেববিগ্রহে, বিশেষত আর্য তথা ব্রাহ্মণ্য প্রভাব-পরবর্তী কালে!
হ্যাঁ, রয়ে গেছে – অশাস্ত্রীয় লৌকিক এমন একাধিক ঠাকুরদেবতা , পণ্ডিতরা যাঁঁদের বলেন লৌকিক দেবতা – বেঁচে রয়েছেন আদিবাসী বা দেহাতি এমনকি কালে-নাগরিক মানুষের বিশ্বাসে, বন্দনায়। সেসব ঠাকুরদেবতার কোনও কোনওটি শস্যোৎপাদন, শিকারপর্ব, গোষ্ঠীকে নিরাপদে রাখা ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত। অনেকেরই পুজো তাই ঋতু, শস্য ইত্যাদি পর্যায়ের হাত ধরে সাধারণত বাৎসরিক, তেমন জরুরি প্রয়োজনে বাড়তি বোধন; গোষ্ঠীপতির পরিচালনায় পুরো গোষ্ঠীর অংশগ্রহণে জমজমাট। সমবেত নৃত্যগীত কোনও কোনওটির অন্যতম লক্ষণ। অনেক ঠাকুরদেবতার পূর্ণাবয়ব মূর্তি হয় না বা হলেও খুব মনোহরদর্শন নয়। কোনও কোনও পুজোর সঙ্গে পশুপক্ষীর বলি ছিল ওতপ্রোত। এইসব পুজোয় পু্রোহিতের কোনো ভূমিকা থাকত না। কিন্তু স্থানীয় জনসমাজে তাঁদের কদর দেখতে দেখতে পরবর্তীকালে পুরোহিতরা কোনও কোনও দেবতাকে মেনে নিয়েছে বা গোষ্ঠীর মানুষরা পুরোহিতদের শরণাপন্ন হয়েছে।
এক্কেবারে ছোট্টবেলা থেকে আমরা দেখে আসছি আমাদের পাড়ার (দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মগরাহাট থানার গোকর্ণী গ্রামে) অদূরে মাঠের মধ্যে কাঠাখানেক পরিমাণ ঢিবিমতো জায়গা বা চত্বরে মাঘমাসে জাঁতালপুজো। এক সন্ধ্যার পুজো, কিন্তু তা নিয়ে আমাদের উন্মাদনা কম ছিল না। আর হবেই না বা কেন, পুজো উপলক্ষ্যে মজাটা তো নেহাত কম নয়! শীতের সন্ধ্যায় সেদিন চাষি-পরিবারের ছোট ছোট আমাদের পক্ষে জ্বালানোর জন্যে যতটা সম্ভব খড় নিয়ে যাওয়ার মতো স্বাধীনতা আর কবে সেইভাবে! যাওয়ার পথে অন্যের গাদা বা টাল থেকেও না বলে চেয়ে নেওয়াতেও কি আর বাধা ছিল তেমন! তার উপর নিজেদের বা অন্যের গাছের খেজুররস, নারকেল, খেতের কড়াইশুঁটি, ডাঙাবাড়ির ওলকপি ইত্যাদির আকর্ষণ তো আছেই।
প্রশ্ন হল, পাড়ার মধ্যে না হয়ে পাড়ার অদূরে মাঠের ঢিবিতে কেন? কারণ ব্যক্তিগত না হয়ে এই পুজোগুলো ছিল গোষ্ঠীগত বা পরবর্তীকালে পাড়াগত এবং তা অনুষ্ঠিত হত পাড়ার বাইরে সকলের মিলিত হওয়ার মতো কোনও স্থানে। তার প্রমাণ আমাদের এখানকার এই পূজাটিও। আদতে এটি ছিল আমাদের পুরকাইত পাড়ার, অংশগ্রহণ ছিল প্রতিবেশী মোড়ল পাড়ারও (প্রসঙ্গত, গত শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এ পাড়ায় মোড়লও ছিল। যেমন, প্রয়াত শ্যামাচরণ পুরকাইত। ইনিই সম্ভবত শেষ মোড়ল)। পূজাটি বহুদিন হয়ে আসছে আমাদের জ্ঞাতি ঠাকুরদা সুরেন্দ্রনাথ পুরকাইত থেকে তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র মৃত্যুঞ্জয় (অজিত) পুরকাইতের তত্ত্বাবধানে। অজিতকাকা এখন সত্তরোর্ধ, তিনি এ পুজো দেখে আসছেন আবাল্য। তিনি জানালেন মূলত সুন্দরবন অঞ্চলের এই ঠাকুরটি আমাদের এখানে আদতে 'জঙ্গলপত্তুনে ঠাকুর'। সেই হিসাবে এই পুজো হয়তো ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় পাদে মগরাহাট থানারই বনসুন্দরিয়া গ্রাম থেকে আগত কতিপয় জঙ্গলপত্তনী প্রজারই – জঙ্গল কেটে যারা বসতি গড়েছিল এখানে – সূচনাকৃত সম্ভবত। পাড়ার অনেকে আজও ডালা দেয় এবং পুজোয় অংশগ্রহণ করে। এই পুজো তো মূলত সুন্দরবন অঞ্চলের। জঙ্গলে কাঠ, মধু, মাছ ইত্যাদি সংগ্রহ করতে যাওয়ার লোকেরা এঁর পুজো দিয়ে থাকে। এমনকি জঙ্গলের মধ্যে মাটিতে মূর্তি থাকলে জোয়ারের জলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে পুজোর পরে গাছের উঁচু ডালে বেঁধে দিয়ে নিশান ঝুলিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
সংকীর্ণ-হতে-থাকা গণ্ডির বাইরে যে বৃহত্তর সুন্দরবন ছিল এবং একদা আমরাও যে তার অন্তর্গত ছিলাম তার অন্যতম প্রমাণ এতদঞ্চলে আজও প্রচলিত এই পুজো। পরবর্তীকালে কোনও কোনও পরিবারও আলাদা করে নিজেরা এই পুজো চালু করেছে। এই পাড়ারই প্রয়াত গৌর প্রামাণিকের পরিবারেও এইভাবে চলে আসছে এ পুজো। চলে আসছে পাশের পাড়ার প্রয়াত সাধন প্রামাণিকের পরিবারেও। কিন্তু লক্ষ্যণীয় হল এই পারিবারিক পুজোতেও এর চরিত্র আজও খানিক বহির্বাটীয় – বাড়িতে অবস্থিত ঠাকুরঘরে অবস্থান নয় এ ঠাকুরের। সাধারণত বাড়ির পিছনের দিকে (বা পাশে) বাস্তুর প্রান্তে ঈশান কোণে পুজো করা হয় এই ঠাকুরের। অন্যদিকেও দেখা যায়। যেমন গৌর প্রামাণিকের পরিবারে ঈশান কোণে, আবার সাধন প্রামাণিকের পরিবারে বায়ু কোণে। পুজো হয় মাঘ মাসেই, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পয়লা মাঘ অর্থাৎ মকর সংক্রান্তির সন্ধ্যায়। এই ঠাকুরকে বাস্তুঠাকুর বা বাস্তুদেবতাও বলা হয়, বাস্তু তথা পরিবারে কোনো অশুভ স্পর্শ করতে দেবেন না এই বিশ্বাসে। আর জাঁতাল বলতেই বোঝায় বাৎসরিক পুজো। প্রায় সব ঠাকুরের পুজোতেই বারা অর্থাৎ ঘট লাগলেও, বারা পুজো বলতে মূলত বোঝায় জাঁতাল পুজোকেই। চারিদিকে ঘেরা একটু উঁচু বেদিকেও বারা বলা হয় বলে উল্লেখ করে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু লিখেছেন যে বারা পুজোর সময় 'তাঁর ছোট বেদীটা খেজুর গাছের ডাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়।' (বাংলার লৌকিক দেবতা, দে'জ পাবলিশিং। প্রথম প্রকাশ – নভেম্বর ১৯৬৬, পরিবর্ধিত প্রথম দে'জ সংস্করণ – এপ্রিল ১৯৭৮, চতুর্থ সংস্করণ – জানুয়ারি ২০০৮) আমাদের এখানে অবশ্য এমন ঘেরা হয় না। বাস্তুপুজোর তাৎপর্য সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে, ড. দেবব্রত নস্করের একটি মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ। 'লোকবিশ্বাস বাস্তুঠাকুরের পূজা করলে দিনে বা রাতে বাস্তুর অমঙ্গলের কোন ঘটনা ঘটে না' বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনি লিখছেন, 'কারণ বাস্তুর উপর দিনে সূর্যদেবতা এবং রাতে চন্দ্র তারা তীক্ষ্ণ নজর রাখেন। এঁরাই প্রকৃত অর্থে বাস্তুদেবতা। সেই কারণেই চন্দ্র সূর্যের প্রতীকরূপেই যুগ্মবারা পূজিত হয়।' আর একটি বিষয় আমাদের এই লেখায় খুবই প্রণিধানযোগ্য। প্রত্নতাত্ত্বিক দেবীশংকর মিদ্যা সাক্ষাৎকারে শ্রী নস্করকে জানিয়েছেন যে বীরভূমের খেরোয়ালী আদিবাসী সম্প্রদায় আমাদের এই জেলায় পূজিত বারামূর্তির অনুরূপ মূর্তিকে 'সিমবোংগা' বলেন এবং পুরুষানুক্রমে তাঁরা সূর্যকেই সিমবোংগারূপে পূজা করেন। কেবল তাই নয়, আদিবাসী জীবনে সিমবোংগার গুরুত্ব বোঝাতে পঞ্চায়েত প্রধান সিমবোংগার নামে শপথ নিয়ে কার্যভার গ্রহণ করেন। (সুন্দরবন সভ্যতা ও লোকসংস্কৃতি অন্বেষণ, দে'জ পাবলিশিং, ডিসেম্বর ২০১৭)
আগে গৃহস্থের এই বাস্তুঠাকুরের বাৎসরিক পুজোর পরে সারা বছর পড়েই থাকত মূর্তি খোলা আকাশের নিচে। এখন কেউ কেউ মাথার উপর করে দেন চালাও এবং আরও বড় কথা হল বাড়ির ঠাকুরদের সঙ্গে সঙ্গে এঁদেরও কোথাও কোথাও মেলে নিত্যভোগ বা সন্ধ্যাপ্রদীপ। এতদঞ্চলের পৌণ্ড্রক্ষত্রিয় সমাজে বেশির ভাগেরই আলাদা করে ঠাকুরঘরও যেমন ছিল না, নিত্যভোগ প্রায় অদৃশ্য ছিল। এসবের খানিক শুরু হল গত শতকের আটের দশকে এবং এখন তো ঘর-ঘরই চল এর। তার আগে ঠাকুরের আবাস বলতে গেলে ঘরের কুলুঙ্গি, ধানের গোলার নিচের খোপে বা উঠোনের এক প্রান্তে মাটির বা দু-চারটে ইটের দু-এক ফুটের অতি সাধারণ এক আস্তানা।
খোলা আকাশের নিচে মাঠের মধ্যে দ্বীপের মতো কাঠাখানেকের এক ঢিবি। একটা মনসা গাছ ও একটা বাজবরণ (দুটোর কোনোটাই এখন আর নেই। খুব জোরালো আঠা না হলেও, ওড়ানোর সময় হঠাৎ ঘুড়ি ছিঁড়ে গেলে বাজবরণের ডাল ভেঙে বা খুঁচিয়ে তার আঠায় সারতাম আমরা)। মনসা গাছের নিচে দু-ধাপের ছোট্ট একটা বেদি মাঝ বরাবর। মনসা-বাজবরণের নিচে এবং আশেপাশে অর্থাৎ বেদির পিছনের দিকটা অল্প অল্প বুঁজগাছ, উলু, বেনা। বেদির সামনের দিকটায় দক্ষিণে বসানো একটা নারকেল গাছ, পরে বেদির আরও কাছাকাছি আপনিই জন্মানো এক তাল গাছ। বেদির সামনের দিকের ঢিবির অংশটা পরিষ্কার – মূলত ঘেসো অর্থাৎ ছোট ছোট ঘাসে ভরা আর বেদি ও তার একেবারে সামনের খানিকটা জায়গা লেপা-পোঁছা।
বেদির উপরে পাশাপাশি, বলতে গেলে পত্রমুকুটধারণকারী দুটি ঘট, ঘটের উপর দিক শুধু নয়, নিচের দিকও খোলা। ঘটাকৃতি নিম্নের অংশটিতে নাক-চোখ-ঠোঁট আঁকা মুখের আদল। একটির নাকের নিচে আঁকা গোঁফ, সেটি বসানো অন্যটির বামপার্শ্বে। কেউ কেউ অনুমান করেন গোঁফওলা হল ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায় আর তাঁঁর ডানদিকে তাঁঁর মা নারায়ণী। দক্ষিণরায়ের বোন বলেও ভেবে থাকেন কেউ কেউ নারীমূর্তিটিকে। 'যুগ্ম বারাকেও মৃত্যুদেবতারূপ আদিম মূর্তিতে ভাবা হয় এবং সহোদর সহোদরা ভাবনায় পুরুষমূর্তি দক্ষিণদরের ডানদিকে স্ত্রীমূর্তি নারায়ণীকে বসানো হয়। বলা হয় নারায়ণী দক্ষিণদরের বোন।' (ড. দেবব্রত নস্কর, প্রাগুক্ত গ্রন্থ) বলা বাহুল্য, দক্ষিণদর, দক্ষিণদ্বার, দক্ষিণেশ্বর দক্ষিণরায়েরই নাম। কোনও কোনও স্থানে উভয় মূর্তিই গোঁফযুক্ত। সেক্ষেত্রে বলা হয় দ্বিতীয় মূর্তি দক্ষিণরায়ের ভাই কালুরায়ের। আবার উভয় মূর্তিই গোঁফযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তা দক্ষিণরায়েরই বলতে চান কেউ কেউ, কেন-না কোনও একক দেবতার যুগ্ম বারাও প্রচলিত। ছোট্ট ছোট্ট পোঁতা-কঞ্চির উপর বসানো মূর্তি, উপুড়-করে কঞ্চিতে গলিয়ে নিচে রাখা চ্যাটালো খুরির উপর (সামনের দিক থেকে চোখে পড়বে না সে কঞ্চি, থাকবে পত্রমুকুটের আড়ালে)। খানিকটা পানপাতার-আকারের মুকুটাকৃতি অংশে লতাপাতা বা অন্যান্য কিছু আঁকা। কেউ কেউ অনুমান করেন যে এই লতাপাতার চিত্রণ নির্দেশ করে যে এ দেবতা আদিমকালের আরণ্যক সভ্যতা থেকেই জনমানসে বিরাজমান।
অল্প দু-চারজন বয়স্ক মানুষের সঙ্গে মূলত অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েদেরই বেশি অংশগ্রহণ এ পুজোয়। সন্ধ্যার পর কেউ পুজোর ডালা-হাতে, কেউ খড়ের তড়পা বা গল্লা বগলদাবায় বা মাথায় – কেউ বা উভয়ই নিয়ে চলে জাঁতাল পুজোর স্থলে। পুজো হয় অন্যান্য পুজোর মতোই সচরাচর প্রচলিত উপচারেই, পুজো করেন পুরোহিতই। খুবই ছোটখাটো সহজ সরল পুজো – জাঁকজমক নেই, বলির চল তো নেই-ই। তা বলে উৎসাহ-উদ্দীপনা-আনন্দ কোনো অংশে কম নয়। আর তাই এদিকে যখন কয়েকজনের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণে পুজো চলতে থাকে, ঠাকুরের সম্মুখস্থ ঢিবির দক্ষিণ প্রান্ত থেকে মাঠের বিভিন্ন জায়গায় দু-চারজনের ছোট ছোট দলে চলতে থাকে খড়পোড়ানো। সে খড়ের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে তোলা নাড়া যেমন মিশত তেমনি এসে মিশত না কি কারও তুলে-টাল-করে-রাখা নাড়া থেকে কারও ডাঙাবাড়ির ভাঙা বেড়া বা মাঠে শুকোতে-দেওয়া ঘাঁটাঘুঁটে! কেউ কেউ হানা দেয় কারও কারও জিরেনকাটের রসের দিকে (আগে থেকেই খবর থাকে কার কার গাছের সেদিন জিরেন কাট। অন্যথায় দোকাট-তেকাটের রসই সই!) তো কেউ কেউ হানা দেয় কারও কারও খেতের তেউড়ো কড়াই (খেঁসারি) বা মটর কড়াইয়ের শুঁটি কিংবা কারও ডাঙাবাড়ির ওলকপি-গাজর (মাঠে কপিচাষ তখন শুরু হয়নি, তা শুরু হল সুতিখাল আসার পর) বা কারও নারকেল গাছে। পাড়ার লোকেরা এইসব ব্যাপারকে খানিক প্রশ্রয়ের চোখে দেখলেও, সাবধানি কেউ কেউ আগেভাগেই কিছু কিছু সামলে নেন – শিউলি 'বেলাবেলি' বা 'সন্দের সোমায়' 'গাচ নেইমে' আনেন, তোলা-নাড়া বা ঘুঁটেঘাঁটা বাড়ি নিয়ে চলে আসেন। কেউ বা খানিক পাহারার ভঙ্গিতে পার করিয়ে নেন ওই দু-এক ঘণ্টা সময়। এসবের পরেও পরের দিন টুকটাক গালাগালি বা অভিসম্পাত কর্ণগোচর হয় না তা হলপ করে বলা যাবে না।
এই ঠাকুরটি আজও মনোযোগ আকর্ষণ করে এই কারণে যে আজকের এই চাকচিক্যের দিনেও গা থেকে এর আদি খোলসটি পুরোপুরি খসে পড়েনি। এক সুদূরকাল আজও প্রতিভাত যেন এই পুজোয়! নিজেকে দেখতে পাই কোন সুদূরের শিকড়ে! ওই জাঁতাল অর্থাৎ বছরে এক দিনেরই পুজো খোলা আকাশের নিচে, তারপর আবার পরের বছর। এর মধ্যে তাঁঁর আর কোনো ভোগারতি নেই, সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাবে না কেউ, বিপদ-আপদে পড়ে কেউ এখানে ধরনা দেবে না বা এঁঁর কাছে মানত করবে না। "সুন্দরবনের বসতি অঞ্চলে – যে স্থানে এখনও উন্নত ভাবাদর্শ পৌঁছায়নি – সেখানে দক্ষিণরায়ের বিশেষ বা 'জাঁতাল' পূজায় যে লোকায়ত বিধান বা আচার অনুসৃত হয় তা লক্ষ্য করলে, এঁর আদি পূজাচারের বহু লুপ্তাবশেষ ও নিদর্শন দেখা যায়। আর লক্ষ্য করা যায় 'বারা' পূজায়।...তার বন্য লতাপাতা আঁকা মুকুটের মধ্যেও দক্ষিণরায়ের আদিমযুগের বা অরণ্যবৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বিশদভাবে বলছি – উক্ত দিনে দক্ষিণরায়ের যে 'বারা' বা চিত্রিত ঘট প্রতীক পূজিত হয় তার মুকুটে আজও ঋকথবাহী মৃৎশিল্পীরা বন্য লতাপাতা অঙ্কিত করে। উন্নত বা বর্ণহিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চলে – যেস্থানে বারা পূজায় ব্রাহ্মণ পৌরহিত্য করে সেখানেও এই বিশেষ অঙ্কন প্রথায় ব্যতিক্রম দেখা যায় না। এই অঙ্কিত লতাপাতা বা ফুল থেকে দক্ষিণরায়ের বা লোক-বৈশিষ্ট্য Woodland Characteristics ধরা যায় আর ধরা যায় এঁর মিশ্রিত পূজাচার থেকে।" – কত বছর আগে এ কথা লিখেছেন গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু তাঁর সুবিখ্যাত পূর্বোক্ত গ্রন্থে। বিভিন্ন লৌকিক দেবতার আলোচনাকালে প্রসঙ্গক্রমে জাঁতাল পুজো নিয়ে অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন তিনি বইটিতে। তত বিস্তৃতির প্রয়োজন দেখি না স্মৃতিবাহী এই পুজোর কথায়, তবে প্রাসঙ্গিক আরও দু-একটি উদ্ধৃতি আবশ্যক এখানে। 'বারা দক্ষিণরায়ের আকৃতি-ভেদ হতে পারে না' অনুমান করে তিনি লিখেছেন, 'দক্ষিণরায়ের মূর্তির এর সঙ্গে মিল নেই, পূজাচারও বিভিন্ন রকম। দক্ষিণরায় ব্যাঘ্রদেবতা হলেও তাঁর আকৃতি সুশ্রী। বারা দেবতা মুখে আদিমত্বের চিহ্ন বেশ স্পষ্ট – অতি উগ্র দর্শন, মুকুটে বন্য লতাপাতা ফুল আঁকা থাকে, কোন মন্দির বা থানে নিয়মিতভাবে পূজিত হন না, আর তাঁর সহদেবতা নারায়ণীর মূর্তি থেকে ধরা যায় ইনি আদিম কোন কৌম পুরুষ দেবতা। আদিম যুগে বহু লোক গোঁফ কাটত কিন্তু দাড়ি বা গালপাট্টা রাখত। সেই যুগে কল্পিত কোন দেবতা দক্ষিণরায়ের পাশে বসেছেন বা দুজন ছিলেন, দক্ষিণরায়ের মধ্যে একজন মিলিয়ে গেছেন, অপর দেবতাটি তাঁর গালপাট্টা সহ স্বরূপ বজায় রেখেছেন, সে কারণ নারী বলে অভিহিত হয়েও তাঁর মুখে গালপাট্টা। আর ওই নারায়ণী ত তান্ত্রিক দেবী! তিনি কি কারণে দক্ষিণরায়ের পাশে বসলেন বা তাঁঁর মা হলেন? এ-বিষয়ে বলা যায় বা অনুমান করা যায়, এককালে ওই অঞ্চলে তান্ত্রিকবাদের খুব প্রাধান্য ছিল, পরে দক্ষিণরায়েরও সেখানে প্রাধান্য হয়, এই সময় সম্ভবত দক্ষিণরায় উপাসনা (কাল্ট) ও লোকায়ত তান্ত্রিকধর্মের একটা মিশ্রণ ঘটে, তার ফলে এই বারা পূজায় দক্ষিণরায়-নারায়ণী একত্র দেখা যায়।'
বইটির 'প্রাক্-কথন'-এ এই সত্য তুলে ধরেছেন দিনের পর দিন সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে লৌকিক দেবতা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহকারী শ্রী বসু, 'সত্যই আমরা সাধারণতঃ যে ইতিহাস পড়ি, তা ত পূর্ণাঙ্গ নয়; সেগুলি দেশের জনসংখ্যার তুলনায় মুষ্টিমেয় রাজন্যবর্গের আচার-আচরণ, ধর্ম-কর্ম, যুদ্ধ-বিগ্রহ, বিলাস-বৈভব ইত্যাদির বিবরণ মাত্র। অতীতকালে সাধারণলোকও ছিলেন, তাঁদের সমাজ, আনন্দ-উৎসব, শিক্ষা-দীক্ষা, ধর্ম-কর্ম ইত্যাদি, – সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় সবই ছিল, তাঁদের বা প্রাকৃত জনসমাজের কথা ইতিহাসে দেখা যায় না, অথচ তাঁরাই ছিলেন সংখ্যায় অধিক। কোন দেশের সংখ্যাগুরুদের কথা বাদ দিয়ে পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস হতে পারে না।' আজ যখন সনাতন ভারতবর্ষের নামে সবকিছু ঘুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে দেশের বিবিধ বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তখন বড় বেশি করে মনে পড়ে বহুদর্শী প্রাজ্ঞজনেদের এইরূপ প্রকৃত মূল্যায়ন।
দক্ষিণরায় প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে অর্ধশতকেরও আগে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বলেছিলেন যে এ পূজা প্রায় লোপ পেয়েছে। শুধু তাই নয়, তাঁর মনে হয়েছে যে দু-একটি শাস্ত্রীয় দেবতা বলে পূজিত দেবতা ব্যতীত লৌকিক দেবতাদের মূর্তি কিছুদিন পরে লোপ পাবে, কেন-না তিনি লক্ষ করেছেন 'পল্লীর লোকদের রুচি পরিবর্তনের কারণে' এঁদের 'মর্যাদা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।' দশ বছরের ব্যবধানে একই অঞ্চলে গিয়ে তিনি অর্ধেকও মূর্তি দেখতে পাননি।
এইভাবে লোপ পাওয়ার মধ্যেও এমন যেসব মূর্তি আজও পূজা পাচ্ছেন এঁদের প্রতি তাই এক স্বাভাবিক কৌতূহল এবং আকর্ষণ বোধ করি, কেন-না সুদূর অতীতের সঙ্গে সঙ্গে অগণিত পূর্বপুরুষের সঙ্গেও অদৃশ্য একটা সেতু রচিত হয়ে যায় যে এঁদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে!
* * * * *
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন