যুদ্ধ এবং তার ফলাফল
সোমা চক্রবর্তী
মাত্র এক বছর আগেই অর্থাৎ ২০২১ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম আফগানিস্তানে তালেবানের অভ্যুত্থান, সেই সঙ্গে কাবুলের কার্যকরী সরকারের পতন। কয়েকদিন ধরে সংবাদপত্রের পাতায় পাতায় প্রকাশিত হতে লাগলো একের পর এক শিহরণ জাগানো নানা ধরনের খবর, সাধারণ মানুষের আতঙ্ক আর অসহায়তার গল্প। হ্যাঁ, নিছকই গল্প। গল্প বললাম এই কারণে যে, সেই খবরগুলো আমাদের সাময়িক ভাবান্তর ঘটালেও, আমাদের মননে তার কোনো স্থায়ী প্রভাব পড়েনি। আমরা আবার সবকিছু ভুলে গেলাম। আবার হাসি, গানে মেতে উঠলাম। আফগানিস্তানে এখন কি হচ্ছে, যে সব মানুষ দেশ ছেড়ে অনিশ্চিতের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো, তাদের কি হলো, যারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পারলো না, তাদেরই বা কি হলো, আর জানতে চাইলাম না। অবশ্য জানবার সরাসরি কোনো উপায়ও নেই। কারণ, সংবাদ মাধ্যমগুলি এখন আবার অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত। বরাবরই দেখা যায়, সংবাদ মাধ্যমগুলি আমাদের যতদিন, যে বিষয় নিয়ে মাতিয়ে রাখে, আমরা ঠিক ততদিন সেই বিষয়টা নিয়ে ভাবনা চিন্তা করি। এই প্রসঙ্গে প্রচলিত একটা কথা উল্লেখ করা যায় যে, জনতার স্মৃতিশক্তি নাকি বড়ো দুর্বল। খুব বেশীদিন কোনো বিষয় জনগণ মনে রাখে না। তাই তো, সময়ের ব্যবধানে অপরাধী ব্যক্তি রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে বসে। দেশের প্রকৃত বীর আর বরেণ্য সন্তানদের ভুলে গিয়ে আমরা তারিখ মেনে মেনে উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠি। এটাই বোধহয় পৃথিবীব্যাপী জনগনের চরিত্র।
এখন আবার সংবাদ মাধ্যমগুলি সক্রিয় হয়ে উঠেছে ইউক্রেন আর রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে। কি নিয়ে যুদ্ধ? কেন যুদ্ধ? এই যুদ্ধের কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে? এই যুদ্ধ চললে শেষ পর্যন্ত কি হবে? আমরা ভাববো না? আমরা জানবো না? এই যে বিশ্বের বড়ো বড়ো দেশগুলো যুদ্ধের ঘুঁটি সাজিয়ে চলেছে ছোট অথবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশগুলোর বিরুদ্ধে, এসব কেন? আমরা বিজ্ঞানের সাহায্যে চাঁদে পা রেখেছি ১৯৬৯ সালে। আর একবিংশ শতাব্দীতে মঙ্গলে শুধু পা রাখা নয়, সেখানে বসতি স্থাপন করার স্বপ্ন দেখাচ্ছেন শিল্পপতি এলন মাস্ক। অজানা মহাবিশ্বের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মানব সভ্যতা সেই কবে থেকে! যে কোনো দিন হয়তো আবিষ্কার হয়ে যাবে এলিয়েনের অস্তিত্ব। তারা আমাদের মতো হবে, না আমাদের থেকেও উন্নত হবে অথবা বর্বর হবে, সেকথা আমাদের জানা নেই। তবে তাদের সঙ্গে যদি সম্পর্ক স্থাপন করা যায়, তবে তারা কি দেখবে? ছোট্ট একটা গ্রহের মধ্যে ঝুলন সাজানোর মতো করে ছড়িয়ে থাকা দেশগুলো নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে? গোলা বারুদ বন্দুক নিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে একে অপরের বিরুদ্ধে? হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, আর বাকি পৃথিবী তাকিয়ে সেসব দেখছে! তারা অবাক হবে না? আর আমরা লজ্জিত হবো না?
এলিয়েনরা আছে কি নেই, তারা আসবে কিনা পৃথিবীতে, সে কথা কেউ জানে না। কিন্তু তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই, হলিউডের ইংরেজী সিনেমাগুলোর মতো একদিন এলিয়েন আক্রমণের মুখে পড়বে আমাদের এই নীল গ্রহ, তখন কি সত্যি সত্যিই ভাববার মতো সময় থাকবে যে, কে কোন ভৌগলিক অঞ্চলে বাস করে, কে কোন ভাষায় কথা বলে, কার সংস্কৃতি কার থেকে আলাদা? হয়তো কিছু কিছু ক্ষমতাবান অথচ অন্ধ শাসক তখনও বেছে বেছে কিছু মানুষকেই কেবল বাঁচাতে চাইবে। হয়তো সেখানে হিসেব কষা হবে এই বলে যে, গরীব মানুষগুলোর বাঁচার প্রয়োজন নেই, কালো চামড়ার মানুষের আর কিসের দরকার? হয়তো সাধারণ মানুষের কথা বিন্দুমাত্র না ভেবে, শুধু অর্থবান আর প্রতিভাবানদের বেছে বেছে বাঁচানো হবে- এইরকম আরো নানানরকম বাছবিচার চলতে থাকবে। হয়তো তখনও, আমরা-ওরা, আমাদের-তোমাদের- এইসব চালাতে চেষ্টা করবে কেউ কেউ। কিন্তু এলিয়েনদের কাছে কিন্তু আমাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই! ওদের কাছে আমরা সবাই শুধুমাত্র অন্য গ্রহের প্রাণী, পৃথিবীবাসী। শত্রু হলে শত্রু, মিত্র হলে মিত্র!
এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যুদ্ধ শুরু হলে, দাবার চালের মতোই কূটনৈতিক চালের শিকার হতে হয় যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া দেশগুলোর সাধারণ মানুষকে। সম্প্রতি (২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে) ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ রাশিয়া যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ করার মতো সত্যিকারের তেমন কোনো কারণ আছে কি নেই, সেটাও বিশেষ তর্কসাপেক্ষ। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট সহ আরো বিভিন্ন দেশ বারবার শান্তিপূর্ণ আলোচনা করার আহ্বান জানানো সত্ত্বেও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অথচ রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে পড়লাম, ইউক্রেনের সীমান্তে রাশিয়ার সেনা আমদানী এবং সাজসজ্জা দেখে, যুদ্ধ শুরু হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই নাকি বার্লিনের বিখ্যাত ব্র্যানডেনবার্গ গেটটিকে ইউক্রেনের জাতীয় পতাকার রঙের সঙ্গে রঙ মিলিয়ে নীল আর হলুদ রঙের আলোয় আলোকিত করা হচ্ছে প্রতি রাতে, বিশ্বের কাছে মানবতার আর সংহতির বার্তা জানাতে। প্যারিসের সিটি হলকে একই ভাবে আলোকিত করে রাখা চলছে যুদ্ধবিরোধী বার্তা জানাতে। তর্কের খাতিরে মানা যেতে পারে যে, এসব না হয় সরকার বা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছেতে হচ্ছে। কারণ, জার্মানি বা ফ্রান্স কোনো দেশই ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আক্রমণকে সমর্থন করেনি। কিন্তু রাশিয়ার সাধারণ মানুষ? কি বলছেন তারা? "The Guardian" পত্রিকার সমীক্ষা অনুযায়ী মাত্র ৪৫% রাশিয়ান এই যুদ্ধকে সমর্থন করেন, বাকী ৫৫% করেন না। "The Indian Express" এর ২৫শে ফেব্রুয়ারীর একটি প্রতিবেদন বলছে,
Defying police warnings, people took to central squares and protest against the military campaign. Some risked arrest in order to voice their opposition to the invasion. Over 1000 were later detained.
এর অর্থ হচ্ছে, কোনো দেশের সাধারণ মানুষই যুদ্ধ চায় না। এমনকি, যে দেশ অন্য দেশকে আক্রমণ করছে, সেই দেশের সাধারণ মানুষও যুদ্ধ চায় না। রাশিয়াতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে সবচেয়ে বেশী। তাঁরা মিছিল করছেন, গ্রেপ্তার হচ্ছেন, রাশিয়ায় অবস্থিত ইউক্রেনের দূতাবাসের সামনে শিশুদের নিয়ে গিয়ে, তাদের হাত দিয়ে ইউক্রেনের মানুষের উদ্দেশ্যে ফুল রেখে আসছেন ওই দেশের সাধারণ মানুষ। সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধের খবর প্রচারে বাধা দেওয়ার কারণে একাধিক টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একই কারণে বন্ধ হয়ে গেছে মস্কো রেডিও। রাশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম তেলের কোম্পানি পর্যন্ত পুতিন সরকারের সঙ্গে সবরকমের সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে। আর যেই দেশটি যুদ্ধে আক্রান্ত? যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতি, আতঙ্কের পরিমাণ যে কতো, পৃথিবী তার কোনো হিসেব চায় না, ইতিহাস তার হিসেব নেয় না।
রাশিয়া যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে, তখন আমেরিকা বলছে তারা ইউক্রেনের পাশে আছে। আবার যখন আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তখন রাশিয়া বলে তারা ইরানের পাশে আছে। আর ছোট ছোট দেশগুলো নিজেদের স্বার্থের দিক বিবেচনা করে, শক্তিধর দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী দেশ চীন এই মুহূর্তে রাশিয়ার বিরোধিতা করছে না। কারণ, রাশিয়ার সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে বেশ ভালো। আর রাশিয়ার সীমান্তবর্তী আর্মেনিয়া, কাজাখস্তান, কর্গিস্তান, তাজিকিস্তান এবং বেলারুসের মতো ছোট ছোট দেশগুলি রাশিয়ার বিরোধিতা করতে পারবে না। কারণ, ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, এখনও এই দেশগুলি সর্বান্তকরণে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। তালেবানপন্থী আফগানিস্তান এই যুদ্ধে রাশিয়াকেই সমর্থন করছে। ওদিকে, ন্যাটো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলি এবং জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকা সহ বিশ্বের বেশীরভাগ দেশ- কেউই এই যুদ্ধে রাশিয়াকে সমর্থন করছে না। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও বারবার বলেছে যে, এই যুদ্ধ তারা সমর্থন করে না। কারণ, এই যুদ্ধের ফলাফল সরাসরি ভাবে তাদের সবার ওপরেই পড়বে। আমেরিকা, পোল্যান্ড আর ক্রোয়েশিয়ার মতো কিছু দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য পাঠিয়ে সহায়তা করেছে। জার্মানি ফ্রান্স দিয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ইতিমধ্যেই ইউরোপ, আমেরিকায় তেলের দাম বেড়ে আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারতই বিশ্বের একমাত্র দেশ, যে এখনো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে, দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধ চলতে থাকলে আমাদের দেশের ওপরও তার প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। এমনকি যুদ্ধের ফলাফল ভুগতে হবে রাশিয়াকেও। কারণ এর মধ্যেই পশ্চিমের দেশগুলির তরফ থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
হঠাৎ করে রাশিয়া কেন যুদ্ধ ঘোষণা করলো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে - এর উত্তর পেতে হলে আমাদের বেশ খানিকটা পিছিয়ে যেতে হবে। ২০১৪ সালে রাশিয়া প্রথমবার ইউক্রেনে প্রবেশ করে। ইউক্রেনের ভেতরে যে রুশ অধ্যুষিত অঞ্চল, সেখানে তখন সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। অনেক ভাবনা চিন্তা করেই তখন সেই বিদ্রোহকে সমর্থন করেছিলো রাশিয়া। পরে, এই বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিলে রুশ সৈন্যরা ইউক্রেনের অন্তর্গত ক্রিমিয়া অঞ্চলটি দখল করে এবং সেটি নিজেদের দেশের অংশ বলে ঘোষণা করে। এরপর থেকেই রুশ সেনারা ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে আসছে। সেই বছরই অর্থাৎ ২০১৪ সালে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য দুই দেশের মধ্যে "মিনস্ক চুক্তি" নামে একটি আন্তর্জাতিক শান্তি চুক্তি সাক্ষর করা হয়েছিল। কিন্তু লড়াই তাতে থামেনি। ক্রিমিয়া দখল করার পেছনে রাশিয়ার মূল উদ্দেশ্য অবশ্য ছিল কৃষ্ণ সাগরের বুকে অবস্থিত ক্রিমিয়ার সেভাস্তোপোল শহরের সেভাস্তোপোল বন্দরটির ওপর রুশ অধিকার বজায় রাখা। অতীতে দীর্ঘকাল এই অঞ্চলটি রাশিয়ার অংশ ছিল। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেনের কাছে হস্তান্তরিত করেন। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এটি স্বাধীন ইউক্রেনের অংশ হয়। ২০১৪ সালে রাশিয়া আবার এর দখল নেয়। ভৌগলিক অবস্থান এবং নাব্যতার দিক থেকে এই বন্দরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, একমাত্র এই বন্দরটিকেই সারা বছর উষ্ণ জলের জন্য সচল রাখা যায়। তাছাড়া, এখানে যে নৌ-ঘাঁটি রয়েছে, সেটিও রাশিয়ার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়ার বাল্টিক সাগরে প্রবেশ করার পথও হচ্ছে এই বন্দর। সাম্প্রতিক যুদ্ধে কৃষ্ণ সাগরের সঙ্গে নৌপথে যুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনীয় শহর খেরসন দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। এরপর মারিয়ুপোলে বন্দর শহরটির দখল নিতে পারলেই ক্রিমিয়া পর্যন্ত তাদের পথ একেবারে পরিষ্কার।
আরও একটি বিষয় রয়েছে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের মূলে। পরমাণু অস্ত্র ছাড়া, রাশিয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হচ্ছে তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল এবং গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশই আসে রাশিয়া থেকে। আর ইউরোপে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে ইউক্রেনই হচ্ছে রাশিয়ার প্রবেশ দ্বার। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপ লাইনগুলো গেছে ইউক্রেনের ভেতর দিয়েই। রাশিয়ার প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের সরবরাহ এই পাইপ লাইনের মাধ্যমেই হয়। তাই, ইউক্রেন ন্যাটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবার ফলে যদি আরো শক্তিশালী এবং নিরপেক্ষ হয়ে ওঠে, আর তার ফলে যদি সম্পূর্ণ ভাবে রাশিয়ার প্রভাবমুক্ত হয়ে যায়, সেটাই রাশিয়ার প্রধান আশঙ্কা। অবশ্য, ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে বাল্টিক সাগরের নীচ দিয়ে জার্মানি পর্যন্ত নতুন একটি গ্যাস পাইপ লাইন বসিয়েছে রাশিয়া। নতুন সেই লাইনের নাম নর্ড স্ট্রিম-২। যদিও, রাশিয়ার ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর এর নির্মাণকার্য স্থগিত হয়ে রয়েছে।
পূর্ব ইউরোপের কিছু কমিউনিস্ট দেশ এবং পূর্ব সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো, ইউক্রেনের মানুষের মধ্যেও বিপরীত দুটি রাজনৈতিক মত দেখতে পাওয়া যায়। ইউক্রেনের বেশীরভাগ মানুষ চায় পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলতে অর্থাৎ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য ন্যাটো সামরিক জোটের সদস্য হতে। ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এবং তার সরকার এই মতের পক্ষে। অন্যদিকে, ইউক্রেনের কিছু সংখ্যক মানুষ নিজেদের এখনো রাশিয়ার অংশ বলেই মনে করেন। কারণ তারা রুশ ভাষাভাষী এবং জাতিগত ভাবেও তারা রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক যোগাযোগ রয়েছে। এদের অনেকেরই রাশিয়ার পাসপোর্ট পর্যন্ত রয়েছে। পূর্ব ইউক্রেনের দুটি শহর দোনেৎস্ক আর লুহানস্ক (একত্রে ডনবাস) এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ইউক্রেনের সরকারী ভাষা ইউক্রেনীয় ভাষা। ইউক্রেনের মোট সাত কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ অর্থাৎ প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষই এই ভাষায় কথা বলেন। আবার সেখানকার কার্যকরী ভাষা হিসেবে রুশ ভাষারও প্রচলন রয়েছে। প্রায় এক কোটি মানুষ রুশ ভাষাভাষী। তবে, এ দেশের অনেক অধিবাসীই রুশ ও ইউক্রেনীয়- এই দুই ভাষাতেই কথা বলতে যথেষ্ট স্বচ্ছন্দ। সংখ্যার ভিত্তিতে প্রচুর ইহুদী মানুষ এখানে বসবাস করেন। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের ফলে, লক্ষ লক্ষ ইউক্রেনীয় সহ বহু ইহুদী মানুষও দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন সীমান্তবর্তী অন্যান্য দেশগুলিতে। প্রায় তিন বছর ধরে অতিমারীর ফলে বর্তমানে অর্থনৈতিক ভাবে জেরবার বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ। এরই মধ্যে যুদ্ধের কারণে বেড়ে যাওয়া এইসব শরণার্থীদের জন্য তৈরী করতে হয়েছে অস্থায়ী শিবির। এর ফলে ব্যাহত হতে চলেছে সেইসব দেশের অর্থনৈতিক সন্তুলন। প্রয়োজন হবে আন্তর্জাতিক সাহায্যের।
কিছু সংবাদ মাধ্যম এবং অনেক বিশেষজ্ঞরা রাশিয়া ও ইউক্রেনের এই যুদ্ধকে 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ' বা তার সমতুল্য বলে অভিহিত করছেন। কারণ, cold war এর পর প্রায় চল্লিশ বছর পর সক্রিয় ভূমিকা পালন না করলেও, এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই নীতিগত ভাবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে পৃথিবীর যাবতীয় দেশগুলি। যুদ্ধ চলাকালীন রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের কিছুটা (ডনবাস) অঞ্চলকে পূর্ব ইউক্রেন নামে 'স্বাধীন দেশ' বলে ঘোষণা করেছেন। যদিও অন্য কোনো দেশ এখনো পর্যন্ত এই বক্তব্যের সমর্থনে কিছু বলেনি। এরমধ্যে চারবার যুদ্ধ থামানোর লক্ষ্যে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ থামানোর কোনো পথ বের হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নে আর ন্যাটোতে ইউক্রেনের অংশগ্রহণ করা নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে রাশিয়া। এক পক্ষাধিক কাল হয়ে গেছে, ভয়াবহ সেই যুদ্ধ চলছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর এবং নিষিদ্ধ অস্ত্র প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে। উঠেছে স্কুল, হাসপাতাল আর জনবসতির ওপর বোমা বর্ষণের অভিযোগ।
আজ এই আলোচনা, কাল এর সঙ্গে ওর বৈঠক, এই চুক্তি, ওই জোট- এই সবের মধ্যে সবাই রূদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে একটা 'মিরাকেল' ঘটার। কিন্তু একথা সেকথায় দিন বয়ে যাচ্ছে। কাতারে কাতারে মানুষ মারা গেছে, মানুষ গৃহহারা হয়েছে, প্রিয়জনকে হারিয়েছে। সাধারণ মানুষের ঘর ভাঙছে, শহর গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর দীর্ঘকাল ধরে অজান্তেই তার জের বহন করে চলতে হবে সাধারণ মানুষকে। মাত্র সাত কোটি মানুষের দেশ ইউক্রেনের মাথাপিছু বার্ষিক আয় ছিল অনেক বেশী। সে দেশে উচ্চ শিক্ষিত মানুষের সংখ্যাও যথেষ্ট বেশী। প্রায় সব মানুষ ছিল সাক্ষর এবং প্রাথমিক শিক্ষাপ্রাপ্ত। উন্নত সংস্কৃতিবান দেশটি পর্যটনের জন্য বিশ্বের দরবারে উল্লেখযোগ্য ছিল। ছবির মতো সাজানো সুন্দর দেশটি এখন বিধ্বংসী যুদ্ধের লীলাক্ষেত্র। যুদ্ধ থেমে গেলেও, প্রায় সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত এই ইউক্রেনের পুনর্গঠনের জন্য কতদিন লাগবে কে জানে! আর শুধু ইউক্রেন নয়, পৃথিবীর প্রতিটা প্রান্ত আজ গৃহযুদ্ধের অশান্তিতে ক্ষতবিক্ষত। প্রায় সব জায়গাতেই প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক আর কূটনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত খারাপ। সম্প্রীতি আর সহিষ্ণুতা নেই কিছুমাত্র কোথাও। সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের আগুনে পুড়ছে গোটা পৃথিবী। বাড়ছে উদ্বাস্তুর সংখ্যা। এভাবে চলতে থাকলে কতদিন আর প্রেম, ফুল, সুখ আর সমৃদ্ধি নিয়ে বয়ে চলতে পারবে মানুষের সমাজ? ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে কি রেখে যাবো আমরা? কেমন পৃথিবী?
আজ নয়তো কালো, হয়তো যুদ্ধ থেমে যাবে। যদি আক্রান্ত দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বন্দী হয়, অথবা আক্রমণকারী দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে গুপ্তহত্যা করা হয়, সেই ঘটনা সাল তারিখ সহ ইতিহাসের পাতায় স্থান পাবে। কিন্তু যারা আমাদেরই মতো সাধারণ মানুষ? যারা ভয়ঙ্কর আতঙ্কপ্রহর যাপন করে চলেছে অকারণে, যারা হারালো তাদের প্রিয়জনকে অকারণে, যারা দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলো- সম্পূর্ণ অকারণে, তাদের নিয়ে কি বলবে আগামী দিনের ইতিহাস? তারা তো শুধু একটা সংখ্যা হয়ে রয়ে যাবে - "পাঁচ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে" কিম্বা "দশ লক্ষ মানুষ দেশ ছেড়ে চলে গেছে"। কিন্তু আমাদের সকলের মতো তাদেরও তো একটা জীবন ছিল! সুখ, দুঃখ, প্রেম, ভালোবাসা, বর্ষা, বসন্ত তো তাদেরও ছিল! সেই মানুষেরা একটা সংখ্যা থেকে একটা মুখ, একটা জীবন, একটা মানুষ কবে হয়ে উঠবে?
পরিসংখ্যান দিয়ে ভরাট করতে চাইলে এই প্রবন্ধটির পরিসর বেড়ে তিনগুণ হলেও তাতে কুলোবে না। পরিসংখ্যান তো ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। তাই পরিসংখ্যান দিয়ে এর পরিসর আর না ভরিয়ে আসুন, আমরা ভেবে দেখি, যুদ্ধ আমাদের কি দেয়! একসময় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হিটলারকে 'মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন' বলে দাবী করেছিলেন অনেক ঐতিহাসিক। আজকের দিনেও অনেক বিশেষজ্ঞ ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলাকে সেই একই পর্যায়ে ফেলতে চাইছেন। আশ্চর্য এই যে, সারা বিশ্বের বেশীরভাগ দেশ এই যুদ্ধ সমর্থন করছে না, তা সত্ত্বেও এই বর্বর আক্রমণ থামানোর জন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না তাবত কূটনীতিবিদরা। এদিকে বিধ্বংসী যুদ্ধ চলছে, চলছে নিরীহ মানুষের ওপর ভয়ঙ্কর অস্ত্রের প্রয়োগ। নির্বিচারে মানুষ মরছে, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ আর অসহায় মানুষেরাও রেহাই পাচ্ছে না। বিপন্ন মানবতার এই ছবি দেখতে দেখতে আর সংবাদ শুনতে শুনতে বোধহয় এখন ক্লান্ত পৃথিবীর প্রত্যেকটি ধূলিকণা। শক্তি আর ক্ষমতা যাদের কবলে, তারা গণিত বইয়ের লাভ-ক্ষতি অধ্যায়ের যাবতীয় অঙ্ক কষে ফেলার পরও নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবতার উত্তর মেলাতে পারেনি। তাই দিনের পর দিন মানুষ মরছে। শিশুরা কাঁদছে। তবু যুদ্ধ চলছে। আমরা সবাই নির্বাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি। বেদনায় অবশ হয়ে পড়লেও কিছু করার নেই।
বেশীরভাগ সময় মানুষ অমিত শক্তির অধিকারী হতে চায়,
শুধুমাত্র শক্তির অপপ্রয়োগ করবে বলে। দৈহিক শক্তি, অস্ত্রের শক্তি, রাজনৈতিক কিম্বা রাষ্ট্রিক শক্তির অধিকারী হতে পারলেই সে দুর্বলকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। মানুষ ভুলে গেছে, জোর করে কাউকে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয় না। একদিন না একদিন সে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসবেই- তা সে বাস্তবের কারাগার হোক, কিম্বা মনের কারাগার। সভ্যতার সঠিক সংজ্ঞা হলো ক্ষমতা প্রয়োগে সংযম দেখানো। প্রাপ্ত অথবা অর্জিত ক্ষমতাকে কল্যাণকর কাজে ব্যবহার করা। সমাজের সকলের সার্বিক মঙ্গল করা।
তা না হলে, শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত বা গবেষণালব্ধ উন্নতিকে
সভ্যতা বলা যায় না। যখন দেখি, মানুষের বিরুদ্ধে মানুষ আঘাত শানাতে চাইছে, তা সে ধর্মের জন্যই হোক, কিম্বা ক্ষমতা দখলের জন্য; যখনই দেখি মানুষের হাতে মানুষেরই বিরুদ্ধে অস্ত্র, তা সে লাঠিই হোক, কিম্বা বন্দুক- আমি তো মানবতার মৃত্যু দেখতে পাই!
-------------------------------------
তথ্যসূত্র:
Wikipedia.org
আনন্দবাজার পত্রিকা
The Guardian
এবং অন্যান্য
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন