Featured Post
নিবন্ধ ।। তারুণ্যের প্রতিস্পর্ধায় হোক বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ ।।সত্যম ভট্টাচার্য
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
তারুণ্যের প্রতিস্পর্ধায় হোক বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ
সত্যম ভট্টাচার্য
'If Winter comes, can Spring be far behind'-Shelly
জব্বর শীত পড়েছিল এবারে। পাহাড়ে ঘন ঘন তুষারপাতের পর ধেয়ে আসা উত্তুরে বাতাস যেন হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এসবের মধ্যেই সরস্বতী পুজোর আগ দিয়ে দেখলাম বিদ্যালয়গুলি খুললো। আর দলে দলে ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ের পোশাকে রাস্তায় দল বেঁধে যেতে দেখে হাপ ছেড়ে মন যেন বলতে চাইলো যে যাক অবশেষে হয়তো সব স্বাভাবিক হতে চলেছে।হ্যাঁ, যে কালো দিন শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে গোটা পৃথিবী যেন তাতে থমকে গিয়েছিল। আজ দু বছর পর বিভিন্ন পরিসংখ্যান দেখে আমরা হাজার কথা বললেও এটাই সত্যি যে প্রথম কয়েকমাস আমরা প্রায় সকলেই ঘর বন্ধ করে বসেছিলাম। হাজার হাজার শ্রমিক যারা এই বিশাল ভারতের গ্রামগঞ্জ থেকে বাইরে বড় শহরে কাজ করেন তারা ঘরে ফিরতে শুরু করেছিলেন এবং তাতে প্রচুর মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। কর্মহীন হয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। বাচ্চারা হারিয়ে ফেলেছিল তাদের দৈনন্দিনের কলকাকলির স্কুলজীবন। এক অন্ধকার দেওয়ালের সামনে গোটা মানবসভ্যতাকে যেন এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে এভাবেই হয়তো কেটে যাবে আমাদের বাকি জীবন।
কত মানুষ যে এই কোভিডকালে তাদের পেশা হারিয়েছেন তার ঠিক নেই। শুধু দিন আনা দিন খাওয়া নয়, এমনও দেখা গিয়েছে যার হয়তো জীবন ছিল স্বচ্ছল, সন্তানসন্ততি ভালো স্কুলে পড়াশুনা করতো, তিনি তার পেশা হারিয়েছেন। আমরা কি কখোনো ভেবে দেখেছি যে অগুন্তি স্কুল ভ্যান বা টোটো বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যেতো কেমন আছেন সেই সব ভ্যান বা টোটোর চালকরা। আমরা কি ভেবে দেখেছি স্কুল বাসের ড্রাইভার বা হেল্পারদের বেতন দিয়েছে কি স্কুল দু বছর। অথবা কেমন আছেন রাস্তায় চলা এমনি বাসের ড্রাইভার, কন্ডাক্টর বা ক্লিনাররা। আমরা কিন্তু ভাবিনি।
তবে এই যে আমরা ভয় পেয়েছিলাম তা যেমন সত্য, এটাও সত্য যে আমাদেরকে ভয় দেখানো হয়েছিল। কারণ জনমানসের একটা বিশাল অংশের মানসিকতা এখন নিয়ন্ত্রণ করে ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া। তাদের সারাদিন নৈর্বতিক মানসিকতার খবর প্রচারের কারণে আমরা অনেকেই সেই সময় ভেবে দেখেনি যে এর আড়ালে অনেক খেলা থাকলেও থাকতে পারে।
বছর পেরিয়ে আমাদের মাথায় যখন তা আসলো আমরা দেখলাম পার্লামেন্টে কৃষি বিল পাশ হয়ে গিয়েছে। আমরা দেখলাম যে একের পর এক নির্বাচন হয়ে চলেছে। সে সবকে আটকানো হচ্ছে না। অথচ মানুষের খাদ্য,বস্ত্র বা বাসস্থানের মতো প্রাথমিক চাহিদাতে বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। লকডাউনের প্রথম ধাক্কা সামলিয়ে সব একটু একটু করে খোলা হলেও হীরক রাজার দেশের মতো বিদ্যালয়গুলিকে কিছুতেই খোলা হচ্ছিল না। যেন স্কুল খুললেই যাবতীয় রসাতলে যাবে।
অথচ তথ্য হাতের সামনে নিয়ে বসলে দেখা যাবে যে এই গোটা কোভিডকালে সব থেকে নিশ্চিন্তে ছিল শিশু কিশোররাই। আর বিদ্যালয় তো কেবল পড়াশুনা করবার জায়গা নয়। তা শিশু কিশোরদের সামগ্রিক বিকাশের আতুঁড়ঘর। আর তাকেই যদি দিনের পর দিন আটকে রাখা হয় তাহলে মানবসভ্যতা কোথায় যেতে পারে এই ভেবেই মাথা খারাপ হবার যোগাড় হচ্ছিল।
হ্যাঁ, এটা সত্যি যে কোভিডে মৃত্যু হয়েছে প্রচুর। আমাদের দেশের থেকেও তা বেশী হয়েছে ইউরোপে। যতটুকু খবর পাওয়া গিয়েছে এশিয়া বা আফ্রিকা ওতটা বেহাল হয়নি যতটা ভাবা হয়েছিল প্রথমে। আর এসবের মাঝেই এল ভ্যাকসিন। তার কার্যকারীতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুললেও এটা মানতেই হবে যে ভ্যাকসিন আমাদের দুর্বল মনকে বেশ খানিকটা মানসিক জোর দিয়েছিল। আমরা ভাবতে শুরু করেছিলাম যে এবারে আমরা মনে হয় আটকে দিতে পারবো। তবু একের পর ঢেউ আসছিলোই। কিন্তু মানুষও তার সাথে যুঝে নিচ্ছিল। অফিস ব্যাংক আদালত খুলছিল আস্তে।
কিন্তু সব হলেও সব খুললেও কোথাও যেন একটা খামতি রয়েই যাচ্ছিল। আসলে বিদ্যালয় বা কলেজগুলো খুলছিল না। এ যাবত পৃথিবীতে যত যত বড় বিপ্লব হয়েছে যা সভ্যতায় এনেছে নতুন প্লাবন তা কিন্তু এসেছে তারুণ্যের হাত ধরেই। তা কয়েক বছর আগে আমাদের পাশের দেশ বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া শাহবাগের আন্দোলন ধরা যাক বা মধ্য প্রাচ্যের আরব বসন্ত। টিভিতে টকশোতে বসে হাজার লোক হাজার কথা বললেও দলমত নির্বিশেষে এটা মানতেই হবে যে রাস্তায় নেমে কিন্তু আন্দোলন করেছিল তরুণরাই। হয়তো কোন জায়গায় তাদের ভুল থাকতে পারে কিন্তু শেষ পর্যন্ত কান্ডটি তারাই যে ঘটিয়েছে এ নিয়ে কোন মতভেদ থাকার কথা নয়।
সব খারাপেরই একটা শেষ থাকে। সব অন্ধকারের পরে কিন্তু আলোর রেখা ফুটবেই ফুটবে। তাই কবি শেলীর কবিতার সেই বিখ্যাত লাইনের সূত্র ধরেই শীতশেষে আমরা দেখলাম ছাত্ররাই আন্দোলনে নেমে বললো যে স্কুলে আমাদের ক্লাস চাই। এর আগেও কয়েকবার স্কুলের কয়েকটি ওপরের দিকের ক্লাস খোলা হয়েছিল বটে কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তা বন্ধ করে দিতে হয়। আর বটেই তো এই অনলাইন ক্লাস তা তো বাস্তবে সম্ভব কেবল মাত্র শহরেই। সারা ভারতের কয় শতাংশ লোকের হাতে এন্ড্রয়েড ফোন আছে বা থাকলেও তাতে নেট সংযোগের বিপুল খরচ বহন করে তারা ক্লাস করতে পারবে বা সে গ্রামে আদৌ নেট কানেকশন আছে কি না তাও তো একটা ভেবে দেখার বিষয়। তা দিয়ে হয়তো সাময়িক একটা পড়াশুনা চালানো গিয়েছিল কিন্তু অনলাইন পড়াশুনা কি কখোনো স্কুলের পড়াশুনার পরিপূরক হতে পারে? উত্তর সকলেরই জানা।
তাই শেষ অব্দি হয়তো ঘুরে দাঁড়ানো গেল। যে মানবসভ্যতা থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল নতুন আলোর দিশা পেয়ে সেও ভাবছে অবশেষে সব হয়তো আবার শুরু হবে নতুন করে। আবার স্কুল বাস এসে দাঁড়াবে পাড়ার মোড়ে। আবার স্কুল ভ্যান বা টোটো হাঁক দিয়ে ডাকতে থাকবে ছোট ছোট কচিকাঁচাদের। তারা দৌড়ে আসবে গলিপথ ধরে। সাইকেল চালিয়ে বা হেঁটে গ্রামের পথ দিয়ে স্কুলে আসতে থাকবে ছেলেমেয়েরা। তাদের প্রার্থনার আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠবে চারিদিক। টিফিনের ঘন্টা বাজলে তারা ছুটে আসবে মিড ডে মিল খেতে। আর দিনশেষে ঘরে ফিরে যাবে বন্ধুর পিঠে হাত রেখে প্রাণের কথা বলতে বলতে। এ বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ এভাবেই উদযাপিত হোক তবে। আগুনরঙা পলাশ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে যাক যাবতীয় অন্তরের ভয় ভীতিকে।
==============
সত্যম ভট্টাচার্য
আস্থা এপার্টমেন্ট,রায়কতপাড়া, জলপাইগুড়ি
- লিঙ্ক পান
- X
- ইমেল
- অন্যান্য অ্যাপ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন