জল চলে না উজানে
সৌমেন দেবনাথ
প্রবাদ আছে, গাঙে গাঙে দেখা হয় তো বোনে বোনে দেখা হয় না। চোখের দেখা না হলেও মনের দেখা হয় ছাড়া কি! বুলি আর দুলির দেখা হওয়া অসম্ভব কোনো ব্যাপার না, তবুও তারা একে অপরের সাথে দেখা করে না। দুই বোনের মধ্যে কিভাবে দূরত্ব সৃষ্টি হলো সেটা আগে বলি।
বুলির স্বামী কোটিপতি, ব্যবসায়ী কিন্তু রঙে একেবারে মরা। বুলি আর দশটা মেয়ের মত না হওয়ায় কালো স্বামীকে অনায়াসে গ্রহণ করতে বাঁধেনি। বিবাহের আগে দুলি বিবাহে বাঁধা দিয়েছিলো। বুলি বলেছিলো, সুন্দরের মধ্যে সুখ থাকে না। আর জীবনও সৌন্দর্যসর্বস্ব নয়।
বিবাহ হয়ে গেলো। দুই পরিবারের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক হলো। দেবব্রতর সাথে বুলির বোঝাপড়া ভালো। একদিন দেবব্রত বললো, দুলি বড় বেশী সৌন্দর্যপ্রেমী। সৌন্দর্যই সত্য।
বুলি বললো, সত্যই সুন্দর। সত্য চিরস্থায়ী। সৌন্দর্য চিরস্থায়ী নয়। শারীরিক সৌন্দর্যের একদিন শেষ আছে। সুন্দর ও সাদা চামড়াকে নয়, সুন্দর ও সাদা মনকে ভালোবাসতে হয়। দুলি কি মনে সুন্দর? ওর কত রূপের অহংকার!
বছর যেতেই দেবব্রত আর বুলির কোলজুড়ে কৃষ্ণকালো পুত্রধন এলো। দুলি নাক বাঁকালো। কালোকে দুলি বড় ঘৃণা করে। দ্বীপকে কোলে নিয়ে দুলি বললো, বাবার মত হয়েছো, বাবার মান রেখেছো, বাবা।
বুলি শুনে বললো, ছেলে ছেলেই। ছেলে যে রত্ন হয়েই জন্ম গ্রহণ করে! এটা মনে রাখিস, সোনার আংটি বাঁকাও ভালো।
দুলি বললো, বাঁকা সোনার আংটি যত দামীই হোক তুলে রাখতে হয়। ব্যবহার করা যায় না।
বুলি বললো, আমার দ্বীপ একদিন মানুষের মত মানুষ হবে। রং নয়, কর্মই আসল। ওকে আমি অনেক বড় করবো।
দুলি বললো, যত বড়ই হোক, যত ডিগ্রীই অর্জন করুক, এ সমাজ তোর ছেলেকে দেখলেই নাক সিটকাবে।
বুলি বললো, সেটা সমাজের দোষ।
দুলি রেগে গেলো, হ্যাঁ, তোর ছেলে রত্নই। এখন সিংহাসনে পা তুলে বসে থাক। আর পা নাচা। কোথায় কৃষ্ণ আর কোথায় দ্বীপ! পাহাড় হবে, আকাশ হবে, অবাক কাণ্ড!
বুলির চোখে জল চলে এলো। বললো, ছেলেটাকে নিয়ে এভাবে বলছিস কেন্? আমার ছেলে কি তোর ছেলে না? নিজের ছেলেকে কেউ আশীর্বাদ না করে অভিশাপ দেয়?
দুলি বললো, বলেছিলাম কালো ভূতের সাথে বিয়ে করিস না। তোর পরবর্তী প্রজন্ম সব কালোই হবে।
বুলি চোখ মুছে বললো, কালোকে কালী বলিস কেন্? কালোও একটি রং। সন্তানের চেয়ে যদি রং তোর কাছে গুরুত্ব পায়, তবে তুই কালী কিংবা কৃষ্ণের উপাসনা করিস কেন্? কৃষ্ণও কালো, কালীও কালো।
দুলি বললো, কৃষ্ণ, কালীর সাথে কারো তুলনা পাপ। আর কালো রং, কিন্তু সকল অশুভর রং। দিদি, সব ফেলে চলে আয়।
বুলি তখনই রেগে যায়, চলে যা তুই। খবরদার আর আমার বাড়ি আসবি না। যা।
দুলি চলে যায়। দুলির সাথে বুলি আর দেখা বা কথাও বলেনি। এমনকি দুলির বিবাহতেও সে যোগ দেয়নি।
ব্যবসায় ক্ষেত্র থেকে দেবব্রত বাড়ি এলো। প্রতিক্ষার প্রহর শেষ হলো বুলির। বুলির প্রশ্ন, গতকাল যে কাজটি ভুল করেছিলে ঠিকঠাক করেছো?
দেবব্রত বললো, মিষ্টি বৌটার কি চিন্তা দেখো! সঠিকতা থেকে যে শিক্ষাটা না হয়, ভুল থেকে তার বেশী শিক্ষা হয়। আত্ম-সচেতনতা বাড়ে। ক্ষুধা লেগেছে। খেতে দাও। ঘুম চেনে না শ্মশানঘাট, ক্ষুধা চেনে না মুচির পাত।
বুলি খেতে দিলো। দেবব্রত বলো, দুলির সাথে কথা না বলাটা অনুচিত। তুমি ওর বড় দিদি।
বুলি বললো, ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে জোড়া লাগানো যায়, কিন্তু দাগ থেকে যায়। ভাঙা কাঁচ কাস্টিং করে জোড়া লাগানো যায়, কিন্তু দাগ থেকে যায়। আর সে দাগ কখনো মুছে না।
দেবব্রত বললো, ভুল বললে, রক্তের বন্ধনে সাময়িক সময়ের জন্য দূরত্ব সৃষ্টি হলেও সম্পর্কে ফাঁটল ধরে না। দাগ তো পড়া দূরের কথা।
দুলি আর জয়ন্তর মধ্যে রেষারেষি লেগেই থাকে। একটু রেষারেষি ভালো, বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। জয়ন্ত বললো, পৃথিবীতে সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদটির নাম সুখ। যার ক্রেতা সবাই, বিক্রেতা কেউ নেই। আমি সুখ কিনতে চাই, আমার প্রচুর টাকা দরকার।
দুলির জবাব, সুখ যদি কেনা যেত তবে কোটিপতিরাই সুখী হতো। সুখী মানুষের তালিকায় রাস্তার মানুষ ছাড়া খুব কমই অন্য মানুষদের দেখা যায়। অলস! কর্মচোর! কাজ না করে আমার কাছে টাকা চাও! ব্যক্তিত্বপূর্ণ নির্লোভী মানুষগুলো নিরবে কাজ করে যায়। কাজ পাগল হও, টাকা এমনিতেই আসবে।
দেখতে দেখতে অনেক বছর পার হয়ে গেলো। দ্বীপ বেশ বড় হয়েছে। শরীরের রংটা ময়লা বলে সে কেমন হীনমন্যতায় ভোগে। আত্ম-বিশ্বাস পায় না। কিন্তু বন্ধুর অভাব নেই। বান্ধবীর অভাব নেই। মোটর সাইকেল চড়ে দাদু বাড়ি গেলো। দাদু দেখে বললেন, দাদু, বুকে আয়।
দুলি এসেছে। মাসীকে ভালো, মন্দ জিজ্ঞাসা করলো। বাড়ি এসে মাকে বললো, মা, মাসী কি দাদুদের বাড়িই থাকেন?
বুলি প্রশ্নের উত্তর না করে বললো, হাত মুখ ধুয়ে আয়। ভাত খাবি।
খেতে বসে দ্বীপ বললো, মা, টাকা আছে, বাইক আছে, তাই বন্ধু আছে। সময়, সুযোগ বা কথাচ্ছলে শ্বেত বন্ধুরা কিছু বলতে পিছপা হয় না। চারিদিকে সাদা চামড়ার বড় বেশী চাহিদা, মা৷ মা, কালো বলে কি অছ্যুৎ?
বুলি বললো, তোর বন্ধুরা তো সত্য বলে। সত্যকে গ্রহণ করতে তোকে শেখাইনি? সুন্দরকে সুন্দর বললে দোষ নেই। তোকে কালো বললে দোষ কিসের?
দ্বীপ খাওয়া বন্ধ করে বললো, সুন্দরকে সুন্দর বলা হয় প্রশংসার্থে, কিন্তু কালোকে কালো বলা হয় অবজ্ঞার্থে।
বুলি বললো, তোর মাসী কি তোকে কিছু বলেছেন?
দ্বীপ বললো, দাদু দেখেই বুকে টেনে নিলেন। আর মাসীকে প্রশ্ন করেও উত্তর পাই না। মা, সবাই সুন্দরের পূজারী।
বুলি বললো, তোর মাসীর সাথে কথা বলার দরকার নেই। পড়াশোনা করছিস কর্। মানুষ হ্ আগে। কৃষ্ণচূড়ার ফুল কিন্তু লাল। তোর সফলতা তোর সকল কষ্টকে দূর করবে।
দ্বীপ বললো, লেখাপড়ায় সফল হলেও ফল শূন্য। ভালো জবের পূর্বশর্ত আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী।
বুলি ছেলের হতাশায় বিমর্ষ। বললো, বাবা রূপে ভোলে চোখ আর গুণে ভোলে মন।
দ্বীপ বললো, মা, আমি পথ চলি, আমি জানি বাস্তবতা।
বুলি বললো, বাবা, তোর জানা ভুল হতে পারে। গুণের কদর সর্বদা। গুণের মর্ম জানা নেই যাদের তাদের সাথে তুই থাকিস। কদর্য আর কালো এক নয়। তুই নিজেকে মিছে মিছে কদর্য করে ফেলেছিস।
পরদিন দ্বীপ কলেজে গেলো। তিন বন্ধু তৎক্ষণাৎ জুটে গেলো। দেবু মিটিমিটি হেসে বললো, তোর কি জিম্বাবুয়ের নাগরিকত্ব আছে? না, মানে আমাদের প্রিন্সিপালের মেয়ের তো অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব আছে!
দাশু বললো, ওরে না, ওর দাদুর বাড়ি জিম্বাবুয়ে। বংশ পরম্পরায় ওরা কালত্বকে বহন করছে গর্বের সাথে।
দবির বললো, আমার কোকিলের স্বর ভালো লাগে। কাকেরও। দেখ্, কালো বলে কিন্তু বললাম না।
দ্বীপ প্রচণ্ড রেগে গেলো। কিন্তু কিছু বললো না। ও বাড়ি চলে এলো। ওরা তিন বন্ধু হাসাহাসি করতে লাগলো। দাশু বললো, বন্ধুটা আজ বেজেছে ভালো। প্রত্যেক দিন ওকে এভাবে পঁচাবো।
ব্যবসায় সংক্রান্ত কাজে দেবব্রত ব্যস্ত থাকে। আজ বাবাকে সামনে পেতেই দ্বীপ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো। দেবব্রত বললো, কিছু বলবি, বাবা?
দ্বীপ বেশ রাগতস্বরে বললো, বাবা, আমার দ্বীপ নাম রেখেছিলে কেনো? দুনিয়াতে কি আর নাম ছিলো না? কাজল, শ্যাম, শ্যামল রাখলে তো পারতে!
দ্বীপ নিজের ঘরে চলে গেলো। বুলি এলো। দেবব্রত বললো, ছেলেটার কি হলো? এমন আচরণ তো করে না!
বুলি বললো, ওর বন্ধুরা ওকে কালো বলে ক্ষেপায়, কটাক্ষ করে।
দেবব্রত বললো, কই আমাকে তো কেউ কালো বলে না আর! প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। হাতে ক্ষমতা থাকলে সবাই স্যার বলবে। কালো বলার সাহস পাবে না। ছেলে যেন পড়ালেখায় গাফিলতি না করে।
বুলি আড়চোখে চেয়ে বললো, তারমানে তোমাকে ভালোবাসি তোমার টাকা আছে, তুমি প্রতিষ্ঠিত তাই?
দেবব্রত বললো, তোমার চোখ আছে, তুমি মানুষ চেনো। ব্যক্তি হলেই হয় না, ব্যক্তিত্ব থাকা চায়। তুমি যে ব্যক্তিত্বকে ভালোবাসো। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষ ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না।
বুলি বললো, অর্থ কি সুখ দেয়? অঢেল সম্পত্তির মাঝে থেকেও কজন সুখ পায়? মিল থাকলেই আর কিছু লাগে না। বাঁচার রশদ ভালোবাসা। যা অর্থ বিত্তে থাকে না।
দেবব্রত বললো, কখনো কাউকে খুব বেশী বিশ্বাস করতে নেই। খুব বেশী ভালোবাসতে নেই। প্রিয়জনের কাছ থেকে খুব বেশী আশা করতে নেই। কারণ পৃথিবী স্বার্থপর নয়। পৃথিবীর মানুষগুলো বড় স্বার্থপর।
বুলি বললো, তোমার সান্নিধ্য আমার সাধনার ফল৷ তোমার দেয়া কষ্ট হবে আমার উপহার। আমি জানি, নিজ আত্মাকে কেউ কষ্ট দিতে পারে না৷ কষ্ট দেয়ার ভাবনাও জাগে না৷ আমি তোমাকে কারণ ছাড়াই ভালোবেসে যাবো। তোমাকে আকাশ থেকে চাঁদ এনে দিতে পারবো না, মিথ্যা কথার পাহাড় বানিয়ে স্বপ্ন দেখাতে পারবো না। পারবো না ছলনা করতে৷ শুধু ভালোবাসতে পারবো জন্ম-জন্মান্তরে।
দেবব্রত আশ্চর্য হয় আর বলে, এই যুগে তোমার মত সর্বগুণ ধন্যা, সর্বগুণ শ্রেষ্ঠা বৌ না জানি কোন কর্ম গুণে পেয়েছি!
অনেক দিন পর জয়ন্তকে দুলি ফোন দিলো। জয়ন্ত উচ্চস্বরে বললো, ফোন দিয়েছো কেনো?
দুলি বললো, তুমি আমার বর, আমার বন্ধু, আমার উপর প্রভুত্ব ফলাও কেনো?
জয়ন্ত বিরক্তি প্রকাশ করে বললো, তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই, রাখো।
দুলি বললো, জীবনকে সুখী করার সংলাপই শ্রেষ্ঠ সংলাপ। কথা না বললে থাকতে পারবো?
জয়ন্ত বললো, আমার সংকটে তোমার উদার হস্ত মেলেনি৷ তুমি রাখো।
দুলি বললো, দুঃখ, কষ্ট, সংকট সব চারাগাছ। এতে সার, জল দিলেই বাড়বে। তুমি তোমার সমস্যা উত্তরণে আমাকে পাশে না রেখে বরং আমার উপর বোঝা চাপিয়ে দিয়েছো।
জয়ন্ত বললো, তুমি টাকার বন্দোবস্ত না করে ফিরবে না।
দুলি বললো, টাকাতে সংকট কাটে না। বুদ্ধিতে সংকট কাটে। পরিশ্রমে সংকট কাটে। ত্যাগে সংকট কাটে। মহব্বতে সংকট কাটে। পরিকল্পনাপূর্ণ জীবনই স্বাচ্ছন্দ্যময় হয়, সাফল্যের দ্বারে সে জীবন নোঙর ফেলতে পারে।
জয়ন্ত বললো, এত মিষ্টি যুক্তিতে জীবন চলে না।
দুলি বললো, যাদের কল্পনাশক্তিই নেই, শ্রদ্ধাশক্তিই নেই, তারা পৃথিবীকে কিছু দিতে পারে না। তোমার নিজের আর কি হবে?
জয়ন্ত বললো, বিশে বিদ্যা, ত্রিশে ধন, চল্লিশে ঠনঠন। ত্রিশ চলছে, এখন ধনের পিছে দৌঁড়ানোর সময়। তুমি আমার ব্যবসায়ের টাকার ব্যবস্থাটা দ্রুত করে তারপর ফেরো।
দুলি বললো, সমাজ আলোকিত হয় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন, জ্ঞানবান মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। বিশে বিদ্যা, সে বিদ্যা অর্জন তোমার হয়নি। পাকা ফসল খাওয়াই তোমার শখ। আগে ফসল ফলাতে শেখো।
জয়ন্ত বললো, রূপ নিয়েই ঘরে এসেছো, তোমার রূপ দেখার সময় নেই আমার। সেজে সেজে ঘুরে বেড়াও, পরিবেশকে রঞ্জিত করো।
দুলি বললো, তোমার মত হীন মন-মানসিকতার মানুষের সাথে ঘৃণা হয় আমার কথা বলতে। টাকার বিনিময়ে যদি সম্পর্ক বাঁচাতে হয়, তবে সে সম্পর্ক আমি রাখবো না। মনে রেখো, আমি ঢোল না যে বাজালেই বাজবো। আমি গ্রামের সংসার বাঁচানো কোনো ভীত মেয়ে না যে, বলবে আর মুটোমুটো টাকা এনে দেবো। থাকো তুমি তোমাকে নিয়ে।
দুলির কথাগুলো দেবাশীষ বাবু শুনলেন। মেয়ের সংসার বাঁচানোর জন্য তিনি বড় মেয়ে বুলির বাড়ি গেলেন। বাবাকে দেখে বুলির চোখে জল চলে এলো। দেবাশীষ বাবু বললেন, মারে, দুলি চার মাস আমার এখানে এসে পড়ে আছে। এক লক্ষ টাকা না নিয়ে গেলে ওর স্বামী ওকে ঘরে উঠতে দেবে না।
বুলি নাকে হাসলো আর বললো, দুলির স্বামী তো কার্তিক ন্যায়। অসুর হলো কবে থেকে?
দেবাশীষ বাবু বললেন, কোনদিন তোকে জানতে দেয়নি। জয়ন্তর ঘরে মেয়েটা আমার একদিনও সুখ পায়নি।
বুলি বললো, ওকে না হয় আমাদের বাসায় আসতে বলো। কটা দিন থাকুক।
দ্বীপ কলেজে গেছে। দেবু বললো, কিরে শেভ করেছিস? মুখে দাড়ি উঠার সুযোগই পায় না। মন মজলো নাকি কোনো নারীর রূপে?
দেবুর কটাক্ষাচ্চারণে দ্বীপের মন ভেঙে গেলো। দাশু বললো, কইরে তুই কাছে আয়। দিনের বেলাতেও তোকে বাতি জ্বালিয়ে দেখতে হবে নাকি?
দবির বললো, ওহ, কাঠ পুড়ে কয়লা, কয়লা পুড়ে ছাই। তারপর থাকবে না অবশিষ্ট।
দাশু বললো, হাড়ির তলার থেকেও তোর মুখটা গাঢ় কালো।
দেবু আবার একটু কটাক্ষ মিশিয়ে সান্ত্বনা বাক্য শোনালো, ওরে এভাবে বলিস না। সবার উপর মানুষ সত্য তাহার উপর নাই।
দ্বীপ বাড়ি চলে এলো। মাকে বললো, মা, আমার বাঁচতে ইচ্ছে হয় না।
ছেলেকে বুকে জড়িয়ে নিলো বুলি। বললো, কি সব অলুক্ষণে কথা!
দেবব্রত বললো, বন্ধুদের কথা গায়ে মাখিস কেন্? যে যা বলবে এক কান দিয়ে শুনবি তো অন্য কান দিয়ে বের করে দিবি। ফ্রি হ্ বাবা। বন্ধুদের কথায় মন খারাপ করবি না।
দ্বীপ বললো, বাবা, মা, বাইরটা ওদের। জগৎটা ওদের৷ আমাদের প্রতি পদে কটাক্ষ ভোজন করতে হয়।
দ্বীপ ঘরে চলে গেলো। দেবব্রত বললো, তোমার ছেলের মত আজীবন আমিও মনোক্ষুণ্নে ভূগেছি। আমাদের সহসা কেউ গ্রহণ করতে চায় না। বিবাহের আগে আট থেকে দশটা মেয়ে দেখেছিলাম। আমি দুই হাতে রোজগার করি সে কথা কেউ বিবেচনায় নেয়নি। ভগবান কেনো আমাকে এত কালো করে সৃষ্টি করলো তাই নিয়েই ছিলো কানাঘুষা।
বিকালে দুলি এলো। দিদিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। দুলি বললো, দিদি আমার চোখ আছে, চোখে দৃষ্টি নেই। ঝলমলে সব মাধ্যমেই সৌন্দর্য যেন অক্সিজেনের মত। আমি তাই সৌন্দর্যকে সুন্দর ভেবে খুব গুরুত্ব দিতাম। জন্ম পরিচয় আর রূপের গর্বের উর্ধ্বে আপন কর্ম পরিচয়। আর এই কর্ম পরিচয়ই আসল পরিচয়। আর এটাই মানুষের জীবতব্রত হওয়া উচিত।
বুলি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, হৃদয়ের রূপে বিকশিত যে জন তার শারীরিক সৌন্দর্যের কি প্রয়োজন!
দেবব্রত এসে শ্যালিকার ভালো, মন্দ খোঁজ নিলো আর বললো, তুমি যদি সত্যাশ্রয়ী সুন্দর আত্মার হও, তবে তুমি স্বর্গের সুখ পাবে।
দুলি জল চোখে বললো, দাদাবাবু, আপনাকে নিয়ে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে অনেক মন্তব্য করেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। খুন করেও তো খুনী ক্ষমা চায়, আর আমার ঐ ভুলের কি কোনো ক্ষমা নেই?
দেবব্রত বললো, আমার চোখে তো তুমি অন্যায়ই করোনি, আমি আমার পরিবেশের অজস্র চাপ খুব সাধারণ ভাবে নিই। এই যে তোমার চিন্তার পরিবর্তন হলো, এটা অনেক কিছু। এটাই আমাদের প্রাপ্তি। একটি বিশুদ্ধ চিন্তার বিবেক সভ্যতার পতন ঠেকাতে পারে। মনে রেখো, তোমার কিছুই নেই যদি উন্নত হৃদয়ের না হও, হৃদয়ে যে উচ্চ সে সদা সম্মানিত।
দুলি বললো, ভ্রষ্ট পথিক ছিলাম, ভ্রষ্ট পথিকের আর্ত-চিৎকার হারিয়ে গেছে বিশাল মরুভূমিতে। আমি আমার জীবন দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করছি।
দেবব্রত বললো, কাজের প্রতি আত্ম-নিবেদন হলো সৌন্দর্য। জয়ের জন্য জেদী হলো সৌন্দর্য। অন্যের হিতার্থে হাত প্রসারিত হলো সৌন্দর্য। অর্থে আভিজাত্য নয়। আমি পারবো এটাই আভিজাত্য। আমি সংসারকে ছায়াতলে রাখবো এ ব্রতই হলো সৌন্দর্য। আমি সবার নিরাপত্তায় বিসর্জিত এটাই আভিজাত্য। আমি সুন্দর দেখতে এটা বলা সৌন্দর্য না, এটা আভিজাত্যও না।
বুলি বললো, মানুষের বদ্ধমূল চিন্তাতে শক্ত করে আঘাত করতে হবে নতুন ধ্যান-ধারণা সৃষ্টির জন্য। সমাজের মগজে, শিরা-উপশিরাতে মোজাইক করা যে গদ-বাঁধা চিন্তা তার অনায়াসে পরিবর্তন হবে না। দুলি বোনটা যে আমার বুকে ফিরেছে, এ যে কত বড় প্রাপ্তি! চল্, দূর থেকে এসেছিস, হাত মুখ ধুয়ে নে। বাবা আছেন, মিলেমিশে খাবো।
ওরা ঘরে গেলো। দুলি খেতে খেতে জীবন ইতিহাস খুলে বললো। শারীরিক, মানসিক নানা আঘাতের স্বীকার করলো। বুলি সান্ত্বনা দিলো। খাওয়া দাওয়া শেষে টাকা দিতে গেলে দুলি বললো, কিসের টাকা? বাবা বলেছে? রাখ্। টাকা দিয়ে সংসার টিকানোর মানুষ আমি না। বিশ্বাস আর ভালোবাসা সভ্যতার ভিত্তি। এ দুটোর কোনটাই আমাদের মাঝে নেই।
দুলি দ্বীপের রুমে গেলো। দ্বীপ মাসীকে দেখে হতবাক হলো। দুলি দ্বীপের পড়াশোনার খোঁজ নিলো। দ্বীপ বললো, মাসী আপনাকে পর পর মনে হয়। আপনি কি পর?
দুলি দ্বীপের পাশে বসে বললো, বাবা, তোকে আদর করি না বলে ভাবিস না, তোকে ভালোবাসি না। কোলে পিঠে মানুষ করিনি বলে ভাবিস না, তোর ভালো চাই না। মা মাসীতে কোনো তফাৎ নেই। তুই অনেক বড় হবি।
বুলিও পিছন পিছন এসে বললো, দ্বীপ, আমার কালো মানিক।
দ্বীপ শুনে বললো, মা, এই পৃথিবীতে একমাত্র তুমিই আমাকে কালো বলোনি, তাও আজ বললে?
বুলি বললো, কোনো সন্তানই তার মায়ের কাছে সাদা কালো বিবেচ্য থাকে না, থাকেওনি।
দুলি বললো, কালো মানুষ অনেক উদার হয়। অনেক দায়িত্বশীল হয়। পিঠকে দেয়াল করে সকল ঝড় রুখে দেয়। আমার আশীর্বাদ জুড়ে তুই থাকবি।
বুলি বললো, শেষ পর্যন্ত তোর আশীর্বাদ আমার ছেলে পেলো?
দুলি বললো, কালো মানুষের মন তো আর কালো হয় না। তোরা যে ভালোবাসার মধ্যে বাস করিস, আমি তো তার দেখা আজো পেলাম না।
কিছুদিন থেকে দেবাশীষ বাবু আর দুলি বাড়ি চলে গেলো। মাকে দ্বীপ বললো, কালো মানুষ অনেক সুন্দর কিছু চাইতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়, না?
বুলি বললো, না। সুন্দর কিছু কি? দেখি এনে দিতে পারি কিনা!
দ্বীপ বলতে গিয়েও বললো না। নিজের ঘরে গিয়ে উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে একটি সুন্দর মুখের স্বপ্ন দেখতে লাগলো।
দ্বীপ ঘুমিয়ে গেলো। স্বপ্ন জগতে ভাসতে লাগলো ও। দ্বীপের সামনে একটি অপকাণ্ড দাঁড়িয়ে দ্বীপকে বলছে, এই যুবক, সুন্দর মুখের স্বপ্ন দেখো কেনো? তুমিও তো তবে সৌন্দর্যের পূজারী! তবে অন্যরা তোমাকে কালো বললে রাগো কেনো?
দ্বীপের ঘুম ভেঙে গেলো, প্রচণ্ড শব্দ করে কেঁকিয়ে উঠলো। বুলি আর দেবব্রত দরজায় এসে টোকর দিলো৷ দ্বীপ দরজা খুললো, বুলি বললো, কি হয়েছে বাবা?
দ্বীপ বললো, মা, আমি আর মনোক্ষুণ্ন হবো না। আমি আত্ম-বিশ্বাসী হবো। কেউ কালো বললে কষ্ট পাবো না।
দেবব্রত বললো, আজে-বাজে চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুমা। তোকে কালো যে বলে সে কালো। তোর কালোত্ব নিয়ে যারা মাথা ঘামায় তাদের মাথায় রোগ। কালো কোনো বাঁধা না, কালো কোনো রোগ নয়, মনে মনে দ্বিধান্বিত থাকবি তো মনোরোগে ভূগবি। কালো সফল হওয়ার পথের অন্তরায়ও না।
বুলি বললো, বাবা, নিশ্চিন্তে ঘুমা। তোর ভবিষ্যৎ নির্মাণে আমাদের দুইজনের ভাবনা আছে। তুই ভুলে থাকবি, দেখবি ভুলে গিয়েছিস। তুই যে কালো তা মনে রাখার দরকার কি! তুই কালো বলে সামনে পাছে যারা কটাক্ষ করে তারা তুই যেদিন বড় হবি সেদিন তোর সামনে দাঁড়াতেও পারবে না।
দেবব্রত আর বুলি নিজ ঘরে চলে গেলো। দেবব্রত শঙ্কা প্রকাশ করে বললো, মানসিক ভাবে ছেলেটা হেরে যাচ্ছে। সব সময় ওকে শক্তি জোগাবে।
বুলি বললো, ওর বন্ধু বলয়টাতেই যত গণ্ডগোল। ওদেরকে বোঝাতে হবে। ওদের অত্যাচারে নিয়মিত কলেজে যাচ্ছে না।
দেবব্রত আর বুলি মিলে দ্বীপের বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করলো। সবাই এলো, খেলো। আর কথা দিলো দ্বীপকে পঁচাবে না। এরপর কটা দিন ভালো গেলো। একদিন দাশু বললো, কালো মানুষের রোগ কম হয়, সুঠাম দেহের হয়, শৌর্য-বীর্যও বেশী। কালোই হতাম!
বলেই সবাই হাসাহাসি করলো।
দেবু বললো, কালো তাই কি দেখতে কি খুব খারাপ! চুল তো আমাদের মতই, নাইজেরিয়ানদের মত তো না, ঠোঁট তো আমাদের মতই, কাঁচকলা তো আর না। তুই আমাদের বন্ধু মাঝে আলাদা যাকে বলে স্বাতন্ত্র্য, নিজ গুণে ব্যতিক্রম। নজর আটকে না পড়লেও নজর তোর দিকেই আগে যায়।
একথা শুনেই আবার সবাই হাসিতে ফেঁটে পড়লো।
দবির বললো, চুল কালো দোষ নেই, চামড়া কালো হলেই দোষ, না? কেউ দ্বীপকে পঁচাবি না।
আবার সবাই একচোট হাসলো। দ্বীপ পড়লো বিপদে, যেতে পারলে বাঁচে।
দাশু আবারও বললো, দেখেছিস দ্বীপের বাবা কি সৌভাগ্যবান, নিজে আফ্রিকান, বৌ পেয়েছেন ইউরোপিয়ান!
দ্বীপের জন্য কথাটি সুখকর ছিলো না। দৌঁড়ে যেয়ে দাশুকে মেরে দিলো দুই ঘুষি। তারপর রাগে ফুঁসে বললো, আমাকে নিয়ে অনেক বলেছিস, তাই বলে এবার আমার বাবা মাকে নিয়ে বলবি?
দাশু বললো, আজ বুঝলাম সিনেমার ভিলেনরা কেনো কালো হয়। তুই বাস্তবের ভিলেন।
দেবু দাশুর পক্ষ নিয়ে বললো, সিনেমার ভিলেন পর্যন্ত যাচ্ছিস কেন্, এলাকার চোর ডাকাতের দিকে তাকা, কেউ পরিষ্কার না, সব কালো।
দবির বললো, তোর বাবার টাকা আছে, যার তার গায়ে হাত তুলবি এটাই স্বাভাবিক।
দ্বীপ বললো, তোরা কথা দিয়ে কথা রাখিসনি। তোরা ভালো হবি না। কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না।
দাশু বললো, ঠিক বলেছিস, কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। তুই যতই শেভ করে থাকিস আর বিদেশি স্নো পাউডার মাখিস কোনো লাভ নেই।
পাশ থেকে দবির বললো, ওরে দাশু ওভাবে বলিস না, জাতের মেয়ে যেমন জাতের ছেলেও কালো ভালো।
কত কালো ব্যক্তিই তো জগৎ বিখ্যাত। নাম বলবো দ্বীপ?
দ্বীপ জলচোখে ওখান থেকে চলে গেলো। বন্ধুরা যদি ওকে গ্রহণ না করে তবে জগৎটায় তো পর।
বুলি আর দেবব্রত ছেলেকে খুঁজে পাচ্ছে না। যত আত্মীয়, স্বজন সবার কাছে খোঁজ নেয়া হলো। ওর বন্ধুরাও হতাশ। দ্বীপ কোথায় গেলো? বন্ধুরাও খুঁজতে লেগে গেলো। বুলি কাঁদছে, দেখে দাশু দবিরকে বললো, এত মশকরা করা ঠিক হয়নি।
দবির বললো, ওর বাবা মা তো বারণ করেছিলেন। আমরা কি কথা রেখেছি?
বুলি সবার উদ্দেশ্যে বললো, দ্বীপকে খুঁজে না পেলে তোমাদের পুলিশে দেবো।
ভয়ে সবাই দ্বীপকে খুঁজতে বের হয়ে গেলো। দিন শেষে তাকে হাসপাতালে খুঁজে পাওয়া গেলো। ধারালো অস্ত্র দিয়ে সে তার মুখ ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত করেছে। দেখে দাশু দেবুরা অঝোরে কাঁদতে লাগলো।
বুলির চোখ থেকে জল শুকায় না। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে থাকলো। পৃথিবীতে নিষ্পাপ হয়ে আসি সবাই, কেনো এত অহেতুক ভেদাভেদ সৃষ্টি করে অন্যের স্বাভাবিক জীবন চলনে বাঁধা সৃষ্টি করি? আতিশয্যে যেমন, তেমন অন্যকে হেয় করার মধ্য দিয়ে কখনো মহত্ত্ব প্রকাশ পায় না। মানুষকে প্রাপ্য মর্যাদা দিলে পৃথিবীটা হয়ে উঠবে স্বর্গের চেয়ে সুন্দর। সবার উদ্দেশ্যে কাঁদতে কাঁদতে বুলি দ্বীপের মুখের একটা কথা বারবার বলতে লাগলো, তুই ঠিকই বলেছিলি বাবা, বাইরটা ওদের, জগৎটা ওদের।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন