বঙ্গ জীবনে রাম
নূপুর দাস
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভগবান রামের পূজা অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে। পশ্চিমবঙ্গের কাটোয়া মহকুমায় প্রায় কুড়িটির মতন রামের মূর্তি আছে। এছাড়া বাঁকুড়া জেলাতেও রাম মন্দির পাওয়া যায়। বাংলায় রঘুনাথ শিলা রূপে পূজা করা হতো রামচন্দ্রের। রাঢ় বাংলায় রামকে নিয়ে অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রানী রাসমণি, মুরারি গুপ্ত, চৈতন্য জীবনী লেখক দয়ানন্দ সহ অনেকেই রামের পূজা করতেন বাংলায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মতের জনপ্রিয় হওয়ার আগে অনেকেই রাম মন্ত্রে দীক্ষা নিতেন, রানী রাসমণি রঘুবীরের রথযাত্রা করতেন। এছাড়াও বাংলার প্রতিটি জনপদে প্রতিটি অঞ্চলে রাম ও লক্ষ্মণ নামের ভাতৃদ্বয় আজও বিদ্যমান।
বাল্মিকী রচিত সংস্কৃত রামায়ণের সহজবোধ্য বাংলা পদ্যানুবাদ করেছিলেন কৃত্তিবাস ওঝা। বাঙালির আবেগ, অনুভূতি ও রুচির দিক লক্ষ্য রেখে সর্বজনবোধ্য পদ্যে মূল সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদ করায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা বেড়ে ছিল বাংলায়, যা আজও অক্ষুন্ন।
চৈতন্য মহাপ্রভুর সমযকালে ভগবান রামচন্দ্রের পূজার নজির পাওয়া যায় তৎকালীন বাংলায়, কালনার গৌরীদাস পন্ডিতের শ্রীপাটে, শান্তিপুরের বড় গোস্বামী ও মধ্যম গোস্বামীর সূত্রাগড় অঞ্চলের বাড়িতে, হাওড়ার রামরাজাতলায়, পাঁশকুড়ার রাজবাড়িতে ও শ্রীরামপুরে। মহাপ্রভু নিজেও রামভক্তি পরায়ণ থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর সমস্ত লীলাকাল জুড়ে। যেমন দক্ষিণা পথে চলার সময় মহাপ্রভুর দ্বারা যে সংকীর্তন শোনা গিয়েছিল তা হলো-
“কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহিমাং
রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষমাং”
আজও বাঙালির ভ্রম সংশোধনের ক্ষেত্রে ‘এ-রাম’ শব্দটি সর্বজনবিদিত। আপামর বাঙালির অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয়ার্ত মুহূর্তে ‘রাম’ নামেই আস্থা আজও। এছাড়াও বাংলার শহর থেকে গ্রামে বহু অঞ্চলের নামের সাথে জড়িয়ে আছে রাম নাম। যেমন- রামপুর, গঙ্গারামপুর, রামপুরহাট, শ্রীরামপুর ইত্যাদি। ধর্মপ্রাণ বাঙালির নিত্য উপাসনায় হরিনাম সংকীর্তনে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ এর মাধ্যমে বঙ্গ সমাজ জীবনের অঙ্গে অঙ্গে পুরুষোত্তম শ্রীরাম দেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত।
ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে রামায়ণ এবং রাম কথার প্রভাব যে বাঙালির আত্মার সঙ্গে জড়িত তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। একান্ত ভয়ের মুহূর্তেও তাই বাঙালি রামকে স্মরণ করে বিপদত্তারণ রূপে। আমাদের ছোটবেলার এই ছড়াটির কথা ভুলে গেলে চলবে না।
“ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি
রাম-লক্ষণ সঙ্গে আছে, ভয়টা আমার কী”
অযোধ্যা পাহাড়ে রামচন্দ্র-সীতা-লক্ষণ এসেছিলেন এমন কাহিনি স্থানীয় সাঁওতাল সমাজ তাদের মৌখিক ঐতিহ্যে ধরে রেখেছে আজও। অযোধ্যা পাহাড়ে যে সীতাকুন্ড আছে, সাঁওতালরা বিশ্বাস করেন রামের তিরের আঘাতে এই অনিঃশেষ জলধারার সৃষ্টি।
বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজায় তো ধরে রেখেছে রামচন্দ্রের অকাল বোধনের ঐতিহ্য। রামকে বাঙালির স্বীকৃতির এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে। রাম ও রামায়ণ বাঙালির রক্তে হিমোগ্লোবিনের মতো মিশে রয়েছে, বিচ্ছিন্ন করতে গেলে তার প্রাণ পাখিটিই উড়ে যাবে।
বাংলার হৃদয়ে রাম এমনভাবে মিশে রয়েছেন যে খোদ কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
মন জপ নাম শ্রীরঘুপতি রাম
নব দূর্বাদলশ্যাম নয়নাভিরাম!
সুরাসুর-কিন্নর-যোগী-মুনি-ঋষি-নর
চরাচর যে নাম জপে অবিরাম।।
============
Nupur Das
Gangarampur
Dakshin Dinajpur
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন