বিষ্ণুপুরের গোড়ার কথা ও ভ্রমণবৃত্তান্ত
প্রাচীন মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী ছিল এই বিষ্ণুপুর।খ্রীঃ সপ্তম শতাব্দ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ পর্যন্ত মল্লরাজারা এই বিষ্ণুপুরে শাসন করে গিয়েছেন। 'মল্ল' কথার অর্থ কুস্তি,অর্থাৎ মল্লরাজারা ছিলন বাহু যুদ্ধে নিপুণ।আদিমল্ল বা রঘুনাথ ছিলেন প্রথম মল্লরাজ,যার রাজধানী ছিল প্রদুম্নপুর(জয়পুরের কাছে)। পরবর্তীকালে ১৯তম মল্লরাজ জগৎ মল্ল তার রাজধানী বিষ্ণুপুরে স্থানান্তরিত করেন।মল্লরাজারা ছিকেন প্রধানত শিবের উপাসক। পরবর্তীকালে ৪৯তম মল্লরাজ বীর হাম্বির কৃষ্ণভক্ত শ্রীনিবাস আাচার্যের গৃহলুঠ করেন,তবে কৃষ্ণসংক্রান্ত কিছু পুঁথি ছাড়া আর কিছুই পেলেন না যেগুলো পড়ে তিনি কৃষ্ণভক্ত হয়ে ওঠেন এবং শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।শুরু হয় বিষ্ণুপুরের এক নতুন ইতিহাস।মল্লরাজারা গড়ে তুলতে থাকেন একের পর এক বিষ্ণুমন্দির,রাসমন্ঞ্চের মত সৌধ। রাজ্যের খরা কাটানোর জন্য খনন করা হয় সাতটি বাঁধ ( লালবাঁধ উল্লেখযোগ্য)
দর্শনীয় স্থান-- [প্রথমেই রাসমন্ঞ্চের গেটে জনপ্রতি ২০ টাকা করে A.S.O.I -র কাউন্টার থেকে টিকিট সংগ্রহ করতে হবে,যা পরে সবকটি স্থাপত্যে ঢোকার জন্য দেখাতে হবে।অর্থাৎ টিকিট এই একবারই কাটতে হবে।]
রাসমন্ঞ্চ(বীর হাম্বির,১৬০০ খ্রীঃ) =১০৮ টি খিলান দিয়ে সুসজ্জিত এই স্থানে রাস উৎসবে সারা বিষ্ণুপুরের রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহগুলি সাজানো হত।১৬০০ খ্রী থেকে এই রাস উৎসব শুরু হয়,১৯৩২ খ্রী সর্বশেষ রাস উৎসব হয়।
মৃন্ময়ী মন্দির(জগৎ মল্ল,৩০৩ মল্লাব্দ,৪০৪ বঙ্গাব্দ,৯৯৭ খ্রীঃ) = শুরুতেই বলে রাখি এতগুলো সাল এর হিসেব দেওয়ার কারণ, ঠিক এভাবেই মন্দিরের গাঁয়ে খোদাই করা আছে।১০২২ বছরের প্রাচীন এই দুর্গা মন্দির জগৎমল্ল বিষ্ণুপুরে এসে স্বপনাদেশ পেয়ে প্রতিষ্ঠা করেন।বিশ্বের প্রথম দুর্গামন্দির এটি।গঙ্গামাটির তৈরী এই মূর্তি স্বপ্নাদেশ পেলে তবেই অঙ্গরাগ করা হয়। দুর্গাপুজোর সময় টানা ১৫ দিন ধরে এখানে পুজো হয়।অস্টমীর দিন তোপধ্বনী দেওয়ার প্রথা আছে।
শ্যামরায় /পাঁচচূড়া মন্দির(রঘুনাথ সিংহ,১৬৪৩)= দক্ষিনমুখী এই মন্দির পাঁচটি চূঁড়ার সমন্বয়ে সুসজ্জিত। ২ টি বাংলা,২টি ওড়িশা ও ১টি ইসলামী শিল্পের আদলে তৈরী চূঁড়াগুলি।
জোড়বাংলা /কৃষ্ণরায় মন্দির(রঘুনাথ সিংহ,১৬৫৫)= A.S.O.I দ্বারা অধিকৃত এই মন্দিরটিতে পোঁড়ামাটির কাজ দিয়ে রামায়ণ -মহাভারতের গল্পকথা খোঁদাই করা রয়েছে। দুচালা মন্দির হওয়ায় এর আরেক নাম জোড়বাংলো।
লালজী মন্দির(বীরসিংহ,১৬৫৮)= এই মন্দিরের সামনে বিরাট উদ্যানে রাজআমলে দরবার বসত।
মদনমোহন মন্দির(দুর্জন সিংহ,১৬৯৪)=এই মন্দিরের বিশেষত্ব হল সারা মন্দিরে দশবতার ভাস্কর্য্য খোঁদাই করা রয়েছে।
রাধাশ্যাম মন্দির(চৈতন্য সিংহ,১৭৫৮)=মল্লরাজাদের তৈরী সর্বশেষ মন্দির এটি।মাকড়া পাথরের (ল্যাটেরাইট)তৈরী এই মন্দিরের সামনে নহবতখানা লক্ষনীয়।মন্দিরের পূর্বদিকে ওড়িশার স্থাপত্যের ন্যায় তুলসীমন্ঞ্চ খুব সুন্দর।পঙ্খের কাজের জন্য মন্দিরটি বিখ্যাত( শাঁখের গুঁড়ো ও চুনমিশ্রিত)
দলমাদল কামান(১৭৪২)= রঘুনাথ সিংহের আমলে বর্গীরা বাংলা লুঠ করতে এলে মদনমোহন স্বয়ং এই কামান দেগেছিলেন, যার জন্য বর্গীসেনাপতি ভাস্কর রাও পালিয়ে যান।"মর্দন" শব্দের অর্থ দমন করা, পরে সেটিই অপভ্রংশ হয়ে মাদল হয়ে দলমাদল কামান নাম হয়।
বড় ও ছোট পাথর দরওয়াজা= সেনারক্ষীরা এই বৃহদাকার দরজার ধারে গুপ্তস্থানে লুকিয়ে থাকত।বাঁকানো ছিদ্রের ভেতর দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সদা প্রস্তুত থাকত তারা।
গুমঘর= এই স্থাপত্য নিয়ে অনেকরকম মতামত শোনা যায়। কারোর মতে প্রাচীন যুগের শস্যভান্ডার ছিল এটা,কেউ বলেন রাজ্যের জলাধার ছিল এটা।তবে সবথেকে বেশি যে কথা প্রচলিত রয়েছে তা হল শাস্তিস্বরূপ বন্দীদের এখানে গুম করে দেওয়া হত।তাই এর নাম গুমঘর।
লালবাঁধ= রঘুনাথ সিংহ তার রাজপ্রাসাদে নর্তকী লালবাঈ কে নিয়ে আসেন,ক্রমে ক্রমে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং এর ফলে তার রাণী বিরাগ পোষণ করেন এবং এই বাঁধের জলে ছল করে লালবাঈকে ফেলে হত্যা করেন।সেই থেকে এই বাঁধের নাম হয় লালবাঁধ।
অন্যান্য দ্রষ্টব্য = আচার্য্য যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতি ভবন (মিউসিয়াম,সোমবার বন্ধ), ছিন্নমস্তা মন্দির,কালাচাঁদ মন্দির, পাথরের রথ, সর্বমঙ্গলা মন্দির ইত্যাদি।
শিল্প-সংস্কৃতি= লন্ঠন,তসর,বালুচরী -স্বর্ণচুরী শাড়ি,টেরাকোটার কাজ,ডোকরার কাজ এখানে বিখ্যাত।
দিল্লীর সেনী ঘরানার বাহাদুর খাঁ বিষ্ণুপুর আসেন ২য়রঘুনাথ সিংহের আমলে। শুরু হয় বিষ্ণুপুরের নিজস্ব ঘরানা।অন্যান্য ওস্তাদের মধ্যে গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়,যদু ভট্ট প্রমূখ।বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনী তে বিষ্ণুপুরের কথা লেখা আছে।
থাকার হোটেল ও লজ্ = wbtdcl এর টুরিস্ট লজ্ (online booking www.wbtdcl.com)
উদয়ন লজ্ (০৩২৪৪২৫২২৪৩), মোনালিসা লজ্(০৩২৪৪২৫২৮৯৪), লক্ষী পার্ক হোটেল(০৩২৪৪২৫২৫৬৭),হেরিটেজ লজ্(০৩২৪৪২৫৪২৯৮), বাস স্ট্যান্ডের নিকট মল্লভূম লজ্(০৩২৪৪২৫২৭৬৫),3 star hotel annapurna (৯৯০৩১৮২৫১৫) । এছাড়াও জয়পুর জঙ্গলের কাছে আছে বনলতা রিসর্ট(৯৭৩২১১১৭০৭, তবে বলে রাখা ভালো এই রিসর্ট মূল টুরিস্ট স্পট থেকে বেশ কিছুটা দূরে,তবে খুব সুন্দর পরিবেশ)
বিষ্ণুপুর স্টেশনের সামনে থেকে অটো ঠিক করে নেবেন, হাইস্কুল মোড় এর কাছে চলে যাবেন কারণ সেখানে অনেক লজ বা হোটেল পাবেন, আগে থেকে বুকিং করা না থাকলে নিজেরা বেছে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।আমি সপরিবারে গিয়েছিলাম গত ৩০শে নভেম্বর। আমাদের একজন সারা বিষ্ণুপুর ঘুড়িয়ে দেখিয়েছেন এবং চমৎকার গাইডেরও কাজ করেছেন। তার নাম ও যোগাযোগের নম্বর দিলাম ( অসীম, ৯৬১৪৪৪৭৪৯১,অটো)।
==========================
- অনির্বাণ ঘোষ
সোদপুর, থানা - খড়দহ। জেলা - উত্তর ২৪ পরগণা।
ফোন নং - ৯১২৩৩৯২০৮৯, ৮০১৩২২০৬৯৫(whatsapp)