রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ চেতনা
ভারতবর্ষ যখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে ইংরেজদের অকথ্য অত্যাচারে জর্জরিত তখন এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল ভারতবাসী। ঠাকুর পরিবার এই জাতীয় আন্দোলনে সামিল হয়েছিল এবং এর বিস্তার ঘটিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের জীবন স্মৃতিতে দেখা যায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে 'স্বাদেশিকতার সভা' নামে একটি সভা হত ঠনঠনিয়া অঞ্চলে। খুব ছেলেবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই স্বাদেশিকতার সভার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দে ১১ই এপ্রিল ঠাকুর বাড়ির উদ্যোগে 'হিন্দু মেলা' নামে একটি জাতীয় সম্মেলন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে স্বাদেশিকতা বোধে উদ্বুদ্ধ করা এবং নবগোপাল মিত্র ছিলেন এই 'হিন্দু মেলা'র সর্বময় কর্তা। তাই রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিক ভাবেই স্বদেশ ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন সেই ছোট্টবেলা থেকেই। 'হিন্দু মেলা' প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, 'ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া ভক্তির সহিত উপলব্ধির চেষ্টা সেই প্রথম। হিন্দু মেলায় দেশের স্তবগান গীত, দেশানুরাগের কবিতা পঠিত, দেশীয় শিল্প ও ব্যায়াম প্রদর্শিত এবং গুনীজন সমাদৃত হইতেন।' রবি কবি প্রতি বছর ঐ মেলায় কবিতা পাঠ করতেন, গান গাইতেন। ১৮৭৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারী কলকাতায় পার্শীবাগানে 'হিন্দু মেলা'র অধিবেশনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'হিন্দু মেলার উপহার' কবিতাটি পাঠ করেছিলেন যার মধ্যে ছিল পরাধীন ভারতবর্ষের লাঞ্ছনার কথা। এই কবিতাটি পরে প্রকাশিত হয়েছিল অমৃতবাজার পত্রিকায় (১৮৭৫ খ্রীস্টাব্দের ২৬শে ফেব্রুয়ারী)।
ভারতবর্ষের যুবশক্তিকে স্বদেশমন্ত্রে দীক্ষিত করার মহৎ উদ্দেশ্যে রাজনারায়ণ বসু 'সঞ্জীবনী সভা' নামে একটি গোপন রাজনৈতিক সমিতি গড়েছিলেন। কিশোর রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদাদের সাথে সেই সভাতেও যেতেন। তাঁর কণ্ঠরোধ নামক প্রবন্ধে তিনি ইংরেজ সরকার কর্তৃক রাজদ্রোহ নিরোধক আইন বলবতের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন। তিনি এখানে লিখেছিলেন, ''আজ সহসা জাগ্রত হইয়া দেখিতেছি, দুর্বলের কোন অধিকার নাই।'' তিনি এই সময়ে কিছু স্বদেশ সংগীত রচনা করেন, যেমন 'তোমারি তরে, মা, সঁপিনু এ দেহ, অয়ি বিষাদিনী বীণা', 'ভারত রে, তোর কলঙ্কিত পরমানুরাশি' প্রভৃতি। ১৮৮৫ থেকে ১৮৯৩ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশাত্মবোধক বহু গান রচনা করলেন, যেমন 'আগে চল্ আগে চল ভাই', 'আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে', 'হে ভারত', 'জননীর দ্বারে আজি ওই', 'অয়ি ভূবন মনোমোহিনী' ইত্যাদি।
১৬ই অক্টোবর ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের আদেশে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হল। ঐ দিনই বিকেলে আপার সার্কুলার রোডে ফেডারেশন হলের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করলেন পণ্ডিত ও নেতা আনন্দমোহন বসু। অনুষ্ঠানের শেষে যে বিশাল জনসমুদ্র এগিয়ে চলেছিল, তার অগ্রভাগে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির লেখা গান সেইদিন সেই জনসমুদ্রের প্রতিজনের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলঃ
''বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান/তুমি কি এমনি শক্তিমান?
আমাদের ভাঙা গড়া তোমার হাতে,এমন অভিমান/তোমাদের এমনি অভিমান?''
''ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে,ততই বাঁধন টুটবে/মোদের ততই বাঁধন টুটবে-
ওদের যতই আঁখি রক্ত হবে,মোদের আঁখি ফুটবে/ততই মোদের আঁখি ফুটবে।''
এর কিছুদিন পরে রাখীবন্ধন উৎসবকে কেন্দ্র করে সারা দেশে দেশপ্রেম ও মানবতা প্রেমের যে বন্যা বয়েছিল তা সত্যই সে যুগের সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একতাবদ্ধ হওয়ার এক উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন এই উদ্দেশ্যে রাখী সংগীত। সমবেত কণ্ঠে গানটি গাওয়া হয়েছিল ঐ অনুষ্ঠানে।
''বাংলার মাটি,বাংলার জল,/বাংলার বায়ু,বাংলার ফল,
পুণ্য হউক-পুণ্য হউক,পুণ্য হউক হে ভগবান।''
১৯১২ সালের ২৬শে ডিসেম্বর থেকে কলকাতার জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে। ঠিক তার আগেই ১২ই ডিসেম্বর পঞ্চম জর্জ বঙ্গভঙ্গ রহিত করলেন। বিশ্বকবিকে বলা হয়েছিল ব্রিটিশ সম্রাটের জয়গান করে গান লিখতে; কিন্তু তিনি রাজি না হয়ে পরম মঙ্গলময় ঈশ্বরের একটি স্তবগান লিখলেন। অধিবেশনের প্রথম দিন গানটি গাওয়া না হলেও দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিন এই গানটি গাওয়া হয়েছিল এবং স্বাধীনতার পর এটি জাতীয় সংগীতের মর্য্যাদা লাভ করেঃ
জনগনমন অধিনায়ক জয় হে- /ভারত ভাগ্য বিধাতা...
১৯১৯ খ্রীষ্টাব্দের ১৩ই এপ্রিল, জালিয়ানওয়ালাবাগে ভারতীয়দের ওপর ইংরেজ সরকার যে অমানুষিক হত্যালীলা চালিয়েছিল তার বিরুদ্ধে কবি জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। পাঞ্জাবের খবরাখবর ওখানকার পত্র-পত্রিকায় বের করতে দেওয়া হচ্ছিল না বলে বেশ ক'দিন পর ২৭শে মে ঐ হত্যাকাণ্ডের কথাটা কবি জানতে পারেন। আর তারপর থেকে নিদ্রাহীন কবি শুধু বেদনায় ছটফট্ করতে লাগলেন। ৩০শে মে সারারাত বিনিদ্র কবি বড়লাট লর্ড চেমসফোর্ডকে একটি চিঠি লিখলেন। ঐ চিঠিতে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন যে জালিয়ানওয়ালাবাগের অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তিনি নাইটহুড বা স্যার উপাধি পরিত্যাগ করলেন। চিঠিটার বাংলা অনুবাদ বসুমতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
১৯০২ সালে 'ভারতী' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ''ইংরেজদের কাছে ভিক্ষা পাইয়া আমরা আর সব পাইতে পারি, কিন্তু আত্মনির্ভরতা পাইতে পারি না। ভিক্ষার ফল অস্থায়ী, আত্মনির্ভরতার ফল স্থায়ী।'' এই উক্তি থেকেই আমরা কবির রাজনৈতিক ভাবনা আর দেশাত্মবোধের মূল সুরটি অনুভব করতে পারি।
রবীন্দ্রনাথ সাধারণ মানুষের দুঃখ ও গ্লানিতে ভীষণভাবে ব্যথিত হতেন। তাঁর মূল মন্ত্র ছিল ''আমাদিগের সকল দাবীই আমাদিগকে জয় করিয়া লইতে হইবে-হীনতার দ্বারা নহে, মহত্বের দ্বারা, মনুষ্যত্বের দ্বারা।'' 'গোরা' উপন্যাসে তিনি সাম্যের জয়গান গেয়েছেন, তাই গোরার মুখে শুনতে পাই, ''আমি এখন ভারতবর্ষীয়, পতিত হবার,ব্রাত্য হবার ভয় নাই।'' ''প্রায়শ্চিত্ত'', ''মুক্তধারা'' নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগী মুক্তির কথাই বারবার বলে। 'অচলায়তন', 'তাসের দেশ', 'কালের যাত্রা', 'রথের রশি' প্রভৃতি নাটকও সমাজের নানা ক্লীবতা, হীনতা ও কুসংস্কারকে উল্লেখ করেই তাঁর রচনা।
দেশাত্মবোধ জাগ্রত করার জন্য বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ যে সকল সংগীত, উপন্যাস, কাব্য, প্রবন্ধ, নাটক লিখে গেছেন তার আবেদন সুদূরপ্রসারী, সর্বজনীন ও সর্বকালীন। তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পরেও সেগুলি সমান প্রাসঙ্গিক। তাঁর মহতী আদর্শের পথে দেশবাসী যদি চালিত হয়, দেশের মঙ্গল নিশ্চয়ই হবে। আজকের এই চরম সঙ্কটের মুহূর্তে তিনিই আঁধারের আলো, কারণ তাঁর কাব্যের গুরুত্ব শুধু কোন সংগ্রামের জন্যে নয়, এর প্রয়োজনীয়তা আমাদের প্রতিটি চেতনাকে, প্রতিটি মুহূর্তে জাগ্রত করার জন্য।
=====================================================