ওয়ানডে মিড নাইট
আষাঢ় মাসের মাঝামাঝি সময়, রোদ্দুর তাপদাহন তখন উচ্চ মাত্রায়। প্রচন্ড গরম চলছে, বাইরে বেরোলে গা ফোস্কা পড়া আর জ্বালাময়ী ভাব। এমনিতে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বর্ষার ডাক এসে যায়। কিন্তু সেবার বৃষ্টির বালাই নেই।
বিকেল বেলা। আমরা তখন অরবিন্দ ক্লাবের মাঠে ফুটবল নিয়ে, আমাদের সঙ্গে ছিল কোচ ভুজঙ্গ গাঙ্গুলি। লম্বা, ফর্সা ! বয়স বিয়াল্লিশ তেতাল্লিশ হবে। অবসর আর্মি ম্যান। টানা ২১ বছর চাকরিতে ছিলেন! আর্মির বিভিন্ন ফুটবল দলে যেমন প্রতিনিধিত্ব করেছেন তেমনি জেলার হয়েও প্রতিনিধিত্ব সামলেছেন তরুণ বয়সে। এখন আমাদের ক্লাবের কোচের ভুমিকা পালন করেছে।
সে সময় সাইকেল নিয়ে মাঠে প্রবেশ করল অতনু, সাইকেল থেকে নেমেই যেন হাফাচ্ছে অতনু! হাফাতে হাফাতে বলল, জানিস সুভাস আমাদের পাড়ায় একটা লোক মারা গেছে! কিন্তু লোকটার মারা যাওয়ার কোনো কারণ নেই। বিছানায় শুয়ে ছিল ওভাবেই মারা গিয়েছে। আমরা সবাই হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছি। আমাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, মারা গিয়েছে অথচ কারণ থাকতে পারে না এটা কি করে সম্ভব? তুই তো বললি, লোকটার বয়সও হয়নি! অসুখ বিসুখও তো নেই। আমি বললাম, অতনু একটা রহস্য আছে বোধ হয়। অতনুও বলে উঠল, বিষয়টা আমারও খটকা লাগছে। কেন জানি মনে হচ্ছে কোনো একটা রহস্য তো আছেই।
সবাই গোল হয়ে বসে পড়লাম পাকুর গাছটার নীচে। আমাদের কোচ ভুজঙ্গদাও। প্রথমে ভুজঙ্গদা বলল, যা রোদ্দুর আর গরম পড়েছে একটু বেলা শেষে প্র্যাকটিস ধরছি কেমন? আমরা সবাই বলে উঠলাম, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে! ভুজঙ্গদা বলল, খেলা বড় না জীবন বড়! আগে জীবন বাচাই তারপর খেলা। আমাদের মধ্যে একজন খুব গরীব ছিল। তাপস সে মাধ্যমিক গতবছর মাধ্যমিক পাশ করে ইলেভেনে পড়ছে। ভুজঙ্গদা বলল, এই তাপস তুই এয়ারফোর্সএর চাকরিটায় এপ্লিকেশন করিস নিই, তাপস আমতো আমতো করে বলল, করিনি দাদা ! একটু রাগান্বিত ভঙ্গিতে ভুজঙ্গদা বলল, হা! করিসনি! কেন করিসনি?? বল।। পয়সা না থাকলে আমাকে বলতে পারতিস। তাপস মাথা নীচু করে রইলো আর কিছু বলল না।
তাপস ফূটবলে আমাদের ক্লাবের বটে, জেলা দলেরও সম্পদ। গতবছর জেলার হয়ে আন্ডার সেভনটিনের অধিনায়কত্ব করেছে। দুর্দান্ত সট আর পাস।। খেলায় ওর পায়ের দিকে সবার লক্ষ্য থাকে।
ভুজঙ্গদা বলল, শোন তাপস তোকে ভালো কথাই বলছি! চাকরি হলে আমাকে দিবি বল? তোদেরও সংসারটা বাজবে। তাপসের চোখে জল পড়ছে, ভিতরে ভিতরে কাঁদছে। ততক্ষনে আকাশে মেঘ জমার তাঁবেদার চলছে। সেদিনই আবার প্রথম আকাশের মেঘ রাশির সভা, মনে হচ্ছে আজ বৃষ্টি হবেই। এই সময় তাপসের মন ভালো করা দরকার এটা বুজতে বাকি রইলো না ভুজঙ্গর, তিনি মনে মনে ভাবছেন যে, বেচারা তাপস দুঃখ পেল, পরে ওকে বুঝিয়ে বলব! এখন ওকে ঠান্ডা করা প্রয়োজন, তবে একটা প্রসঙ্গ তো লাগবেই। ভুজঙ্গদা বলল, এই সুভাস অতনু কি জানি বলছিলে তখন। আমি বললাম, কিছু না দাদা! ভুজঙ্গদা বলল, কিছু না বললেই হল! আমি সব শুনেছি! অতনুদের পাড়ায় একজন চলে গেছে ওপার, তার কারন কিন্তু এখনও পাওয়া যায়নি। ভুজঙ্গদা বলল, তোমরা ভুতে বিশ্বাস করো কি? আমি বললাম, আমার ভয় লাগে দাদা। আচ্ছা আমি বলি আমার দেখা একটা অভিজ্ঞতা। যা আজও আমার মনে পরলে খুব ভয় লাগে। আমি বললাম, ভুজঙ্গদা তোমার জীবনের অভিজ্ঞতা?? বলো না একবার শুনি। ভুজঙ্গদা বলল, গল্প করছি না কিন্তু সত্যিই যা ঘটেছে তাই বলছি। এক কথা যদি বলি বলে তবে দাড়ায় "মাশকলাইবাড়ির রহস্য '",!
ভুজঙ্গ বলল, আমার চাকরি হয়নি তখন! এই তোমাদেরই এই ব্যাচটার একটু বড় হব! মানে কলেজে পড়ছি তখন। আমাদের একটা ফুটবল টিম ছিল। খেলে বেড়াতাম জেলা থেকে ক্লাব সব জায়গায়!
একদিন শনিবার, আষাঢ় মাস সন্ধ্যে নাগাদ বাড়ি থেকে অরবিন্দ ক্লাব মাঠের দিকে এলাম। অনেকদিন পর হঠাৎ সঙে ঝুটে গেল আমার প্রিয় বন্ধু অমিত। বেশ কদিন দেখা নেই! আমি বললাম, কি অমিত কি হয়েছে রে তোর? দেখাই হচ্ছে না যে? কিছু হয়েছে নাকি? ঝরবৃষ্টি শুরু হল তখন! অমিত বলল, দেখবি কি করে? আমি ওই কদিন বাড়িতে ছিলাম! আজ আমার ছুটি। আমি বললাম, ওই মোড়ের চা'য়ের দোকানে গিয়ে বসি চল! অমিত বলল, বসতে পারি তবে আগুন আমার আর ভালো লাগে নারে, বস চুপচাপ। আমি বললাম, সিগারেট ধরাব, খাবি তো? অমিত আবার রেগে গিয়ে বলছে যা আমার সহ্য হয় না, তুই তাই করছিস দেখছি। আমি চলে যাবো নাকি বল? আমি বললাম, এরকম কেন করছিস? তুই তো আমাকে সিগারেটের জন্য কম বকাবকি করিস না, আজকে নিজেই আমার মতো হয়ে গেলে। ঠিকই আছে বস এই সব ছাইপাস নেশা না করাই ভালো। অমিত বলল, আমিতো এখন একদম ভালো হয়ে গিয়েছি আর নেশা করি না।
তখন ন'টা সারে ন'টা হবে আমরা গল্পই করছি তখনও! এই বৃষ্টির মধ্যে একটা মরার চিতা নিয়ে চলছে প্রায় শ 'খানেক লোক। বল হরি, হরি বোল! বল হরি, হরি বোল! বল হরি, হরি বোল! বল হরি, হরি বোল।ধ্বনি দিচ্ছে লোকেরা আর ফুল ছিটিয়ে ছিটিয়ে চলে যাচ্ছে মাশকলাইবাড়ি শ্মশানে। অমিত আমাকে বলছে ব আমার সময় হয়ে এল বন্ধু! চল শ্মশানের দিকে ঘুরে আসি। আমার আগে আগে অমিত আমি পিছনে। ছাতা নিয়ে মাথা ঢাকা আমার আর ওকে দেখতে পাচ্ছি না কালো অন্ধকারের বৃষ্টি রাতে। শুধু শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ও আমাকে বলছে একটু জোরে হাট, আমি তোকে ঠিক দেখতে পাচ্ছি। শ্মশানের কাছে লোকেদের ভিরে দেখলাম বিশালাকার একজন, অমিতের মতো মুখ চিতার কাছে দাড়িয়েই বিলিন হয়ে গেল। আমি তখন চিৎকার করে ডাকছি অমিত, বন্ধু অমিত কই গেলি।
অমনি অমিতের বাবা ভাঙা গলায় কান্না শুরু করে বলল, আমার অমিত আর নাইরে ভুজঙ্গ, আমার অমিত নাই। হাত দিয়ে ইশারা আর মাটিয়ে লুটিয়ে মাথা থাপরাতে থাপরাতে বলল, ওই দেখ ভুজঙ্গ অমিত ঘুমাচ্ছে।ও আর কোনো দিন ঘুম থেকে উঠবে না। ওকে ডাকিস না! ও ঘুমাক।
আমার তো মাথা খারাপ হয়ে গেল, কিছু কাজ করছে না তখন। এক্ষুনি অমিতের সাথে কথা হল আর, ওর পিছন পিছন তো এলাম! তবে কি মনের সন্দেহ? না কি ভুল দেখলাম। ভাবছি, এটা কি করে সম্ভব??
গা আর চলছে না, এখুনি অমিতকে দেখলাম! আর অমিত কিনা মাশকলাইবাড়িতে আমাকে ডাকল।
মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। ঘড়ির দিকে তাকালাম আর বেশি দেরি করলাম না, যা দেখলাম! অদ্ভুত তো বটে ভয়ংকরও, যা আমি জীবনেও দেখিনি! আর না দেখলে হয়তো বিশ্বাসও করতাম না, ভুত বলে যে একটা কিছু আছে। বাড়ি ফিরলাম, খাওয়া দাওয়া আর হলো না। মা বলল, কি রে খেয়ে আসছিস নাকি! আমি বললাম, হুম! আমার জরোসরো শরীর দেখে মা বলল, ভয় পেয়েছিস না কিরে? তোকে তো ভয় ভয় দেখাচ্ছে। আমি বললাম, না না মা, যা ভাবছ তেমন কিছু নয়। জানো মা আজকে অমিত মারা গেছে! মা বলল, সে কি কবে? আমি বললাম, আজকে। মা বলল, খুব ভালো ছেলে ছিল রে অমিত! কি হয়েছে ওর? আমি বললাম, আমিও ঠিক জানি না মা।
বিছানায় শুয়ে পড়েছি। বৃষ্টি হচ্ছে ঝনঝন করে! এইসময় রাত তখন মধ্য হয়েছে, কিছুক্ষণ আগে বারোটার আসামগামী একটা ট্রেনটা হর্ন বাজিয়ে চলে গেল। চারদিকে চুপচাপ, শুধু বৃষ্টির শব্দ ঝনঝন করছে। এদিকে আমার তো ভয় লেগেছিল ওই অমিত বিষয়টা। ঘুম হচ্ছে না করে ঘুম এল, ঘুমিয়ে তখন পুরোপুরি পরিনি। চাদর মুড়ে বিছানায় শুয়ে আছি। এমন সময় গম্ভীর স্বরে, গলার আওয়াজ ঠিক অমিতের মতো বলছে, এই ভুজঙ্গ! ঘুমোচ্ছিস না কি? ঘুমোলে চলবে! আরে আমি অমিত, তোর বন্ধু রে। চল যাই, খেলতে যাবরে ওই অরবিন্দ ক্লাবের মাঠে। আমি তোকে ওখানে রেখে, একটু মাশকলাইবাড়ি যাব!ওখানেই তো এখন আমার সব। চল চল তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে! আরে দুপুর হয়েছে যে, ওদিকে জমিদার পাড়ার টিমটা এল!যেমনি মুখ ঢাকা চাদর মুখ অবধি খুলে দরজার দিতে দেখলাম ভয়ংকর ও বিশ্রী মুখে অমিত দাড়িয়ে আছে, পা নেই, পাগলের যেমন জামা প্যান্ট হয় ঠিক সেভাবেই পড়ে আছে, আর মাথায় চুল ঝাঁকড়া, চোখ বড় বড়, চোখ থেকে উল্কা পিন্ডের মতো আগুন ঝরছে।আর উড়ে উড়ে দাড়িয়ে আছে যেন! আমার তো এতোই ভয় লেগেছে যে প্যান্টে পেচ্ছাবের উপক্রম হয়েছে, অমনি হাতবাড়িয়ে দিয়াশলাই কাঠি জ্বালাতেই সব যেন উবে গেল। কুপি ধরালাম তখন দেখি কিছুই নেই। ভয়ে ভয়ে ঘড়ির দিকে দেখছি, তখন বাজে রাত আড়াইটে। আর ঘুম হল না সারারাত! বাড়ির সবাইকে খুলে বললাম সকালবেলা। বাবা বেশি দেরি না করে দশটার মধ্যে একজন ওঝাকে ডেকে আনলেন! আনবেই না কেন আমি ছিলাম একমাত্র ছেলে বাবার, আমাকে আদরও করত! আমার যদি কিছু হয়, সারারাত বাবার ঘুম হয় না। যাইহোক, তখন ওঝা এসে বলল, বাবা মরার পর বন্ধু বান্ধব কিংবা আত্মীয় স্বজন কেউ আপন হয়না ওরা হয় স্বর্গে যায় আর না হলে অতৃপ্ত বা অশরীরী আত্মায় পরিনত হয়! আর তোর বন্ধু সে অতৃপ্ত আত্মা হয়ে তোকে ওর দোষর করার জন্যে নিয়ে যেতে তোর পিছনে ঘুর ঘুর করছে। এই নে মন্ত্রপুত তাবিজ, এক্ষুনি লালসুতোয় বেধে দিলাম তোর হাতে ভুততুট তোর কেউ আর কোনো দিন ক্ষতি করতে পারবে না! আমার বাবাকে ওঝা বলল, এই সুখেন্দুবাবু এই সরিষাবাবু দিলাম তুমি সারা বাড়ি ছিটিয়ে দাও। ভয় নেই ছেলে ঠিক হয়ে যাবে।।আর হ্যাঁ বাছাধন তুমি কালরাতে দিয়াশলাই দিয়ে আগুন না জ্বালাতে, তোমার প্রান সংশয় ছিল। যাজ্ঞে ভগবান স্বহায় ছিলেন। রক্ষা পেয়েছো।এই বলে ওঝা চলে গেলেন।
এই সময় অমিতের পাড়ার একটি ছেলে বাড়িতে এসে আমাকে বলল, ভুজঙ্গদা অমিতদা কাল মারা গেছে তুমি শোনোনি! আমি বললাম, হুম, সব শুনেছি তুমি যাও আমি পরে আসছি! ওর জন্য তো এস হল আমার।। যাব যাব তুই যা।
আমি তখন বুজতে পারলাম অমিত কেন আমাকে বলছে আগুন আমার ভালো লাগে না আর বেশি করে আগুন আগুন করলে রেগে যায়! আর মাশকলাইবাড়িতে ওকে যেতে হবে বলছে, ওটাই নাকি ওর বাসা এবার বুজলাম ওখানে তো শ্মশান। হুম এবার। বুজতে বাকি রইলো না, মারা যাওয়ার সাথেই ভুত হয়েছে অমিত। এই থেকে আমার ভুতে ভয় রে ভাইরা। তোমাদের ভয় লাগে তো? সবাই এক সাথে বলে উঠল, ভুতের ভয় আর কার না লাগে বলো!!ভুজঙ্গদা আমাকে হাত নারার ভঙিমায় বলল , এই সুভাস এদিকে আয়তো! আমি বললাম, কি? ভুজঙ্গদা বলল, কালকে সকালবেলা তুই আর তাপস আমাদের বাড়ি আসিস তো, কিছু কথা আছে।। আমি বললাম, ঠিক আছে।